মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারালি – সঙ্গীতা ইমাম

মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারালি – সঙ্গীতা ইমাম

শেয়ার করুন

আজকাল ‘রাজনীতি’ কথাটি বললে চট করেই আমাদের মাথায় ‘সংস্কৃতি’র ধারণা তৈরি হয় না। নানামুখী চিন্তা-চেতনায় রাজনীতি বলতে এমন একটি ছবি ফুটে উঠে, যা দেখলে বা ভাবলে আমরা নিজেরাই আঁৎকে উঠি। ফলে সমাজের এক শ্রেণির কাছে রাজনীতি এখন প্রায় অচ্ছুৎ একটি ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের ভাবনার নানা বাঁক উপবাঁক আমাদের সামনে ধরা পড়ে। এই ক বছর আগেও, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা একটি নতুন শ্রেণির জন্ম হতে দেখেছি (যাদের প্রায় সবাই তরুণ), যারা নিজেদের রাজনৈতিক দর্শনের স্থলে বেশ গর্ব করেই লেখেন- আই হেইট পলিটিক্স। ক বছর আগে বলছি কারণ, বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ আলোচনার কারণে বর্তমানে প্রকাশ্যে এই ঘোষণা দেবার প্রবণতা কমেছে; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, পরিস্থিতি বদলেছে। কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই নয়, ‘রাজনীতি’র একটি নেতিবাচক অর্থ আমাদের সকলের মনে প্রায় স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। ব্যাপারটি এমন যে, রাজনীতি সচেতন মানুষও কিন্তু বিভিন্ন আলোচনাতে অত্যন্ত খারাপ কিছু বোঝাতে (কথার কথা হিশেবেও) বলে থাকেন- আমার সাথে রাজনীতি চলবে না। একটা সময় ছিলো চলচ্চিত্রে বা সাহিত্যে রাজনৈতিক কর্মীরা থাকতেন নায়ক; আর এখন একটি সময় এসেছে, যখন খলনায়ক বলতেই সবার আগে একজন রাজনৈতিক নেতাকে চিন্তা করা হয়। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, তোলাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি যতো রকমের নেতিবাচকতা আছে- প্রায় সবকটার সঙ্গেই আমরা একজন রাজনৈতিক নেতাকে বা রাজনীতিকে রিলেট করতে পারি। এই রিলেশনটা কিন্তু ভুল নয়, কারণ বর্তমানের রাজনৈতিক নেতাদের ভেতরে এই কলঙ্কগুলো একেবারে লেপ্টে আছে। লেখার এই পর্যন্ত এসে, যদি নিজেকে নির্মোহ একজন হিশেবে দাবি করি, তবে বলতেই হবে- অপরাধ কমবেশি সকলেই করেন। ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানাবিধ অপরাধের সঙ্গে আমলা-শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীসহ নানা পেশার লোকজনের খবর আমরা পাই। অর্থ্যাৎ গোটা সমাজেই একটা খ্যাঙড়ামোপনা চলছে, এবং আমরা প্রত্যেকেই যার যার মতো এর পক্ষে একটি যুক্তি খাড়া করছি। কিন্তু সমস্যার গভীরে আমরা যেতে চাইছি না। এর দুটো কারণ হতে পারে বলে আমি মনে করি; এক, সমস্যার গভীরে যাবার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা আমাদের নেই; দুই, সেই সৎ সাহস আমাদের নেই। এই চিন্তার নিরিখেই লেখাটির সূত্রপাত।
দুই
প্রথমেই আমরা একটি আলোকচিত্রের কথা ভাবতে পারি। ০৪ নভেম্বর, ১৯৩৬ সালে বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জওহরলাল নেহেরুর একটি আলোকচিত্র। এবার আমরা যতোটা ভুলে যেতে পারি নেহেরুকে, ততোটাই মনে রাখতে পারি রবীন্দ্রনাথকে। কারণ সেটাই আমাদের গণ-মানুষের ক্ষেত্রে সত্য। এবং এখান থেকেই শুরু করতে পারি আমাদের আলোচনা, কেননা সবকিছুর পর আসলে মানুষ, কেবল মানুষই সত্য। এই মানুষকে নিয়ে, মানুষের জন্যেই রচিত হয়েছে দর্শন-সাহিত্য-শিল্প এবং অতি অবশ্যই রাজনীতি। অতএব, এই আলোকচিত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নেহেরুর সংলাপকে আমরা ধরে নিতেই পারি মানুষের সঙ্গে রাজনীতির সংলাপ। রবীন্দ্রনাথ এই ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করছেন মানুষের। যে মানুষ সমস্ত বন্ধু রতার পরও উঠে দাঁড়ায়, হাতড়ে বেড়ায় আরেকটি মানুষেরই হাত, স্পর্শ করে, শক্ত করে ধরে, হাতে হাত রেখে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ থেকে ক্রমেই বহু বহুগুণ হয়, চোখ রাখে পূর্বপুরুষের ইতিহাসের দিকে এবং যুগপৎ নির্মাণ করে ইতিহাস অনাগত প্রজন্মের জন্যে। এই অনন্য কর্মযজ্ঞে কী রাজনীতি, কী সংস্কৃতি, কী সমাজ-অর্থনীতি সকলই আবর্তিত হয় আসলে মানুষকে প্রেক্ষণে রেখেই। সুতরাং রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এ দুটো সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় তৈরি করার আগে আমাদের বুঝতে হবে, দুটোই আসলে মানবজমিনে আবাদ করা ফসল। বর্তমান যে কথাই বলুক, গবেষক যতো যুক্তিই দিন এ কথা অনস্বীকার্য যে, ‘রাজনীতি’, ‘সংস্কৃতি’, ‘অর্থনীতি’, ‘সমাজনীতি’ বা ইত্যাদি আরও কিছু প্রত্যয়কে কেবল উদ্ধৃত চিহ্ন দিয়ে কমার পর কমা বসিয়েই একমাত্র পৃথক করা সম্ভব; অন্যভাবে নয়। কারণ এদের উৎস এক, বিকাশের জমিন এক; এমনকি এসব অপ্রয়োজনীয় বা বাতিল করে দেবার জন্যে যে আঘাত করতে হয়, তার উৎসটাও এক। জীবনের দাবি তাই মানুষের হাতেই পূর্ণ অথবা শূন্য নয়। রাজনীতির বিষয়ে লেখার শুরুতেই যে মানসিকতার কথা তুলে ধরলাম, সেটির কারণ হিশেবে আমি যতোই সাংস্কৃতিক বিচ্যুতির কথা বলি না কেনো বা আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই যে বারবার সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের আঘাতের স্বীকার হচ্ছে, এবং এসব বারবার ঘটার পরও মানুষ জাগছে না তার মূল কারণ, আমরা মানুষের সঙ্গে নেই। আমাদের রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কার্যালয় আসলে লোকালয় থেকে জনশূন্যে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। আমাদের বসবার চেয়ারটা অনেক উঁচু এবং সেখানে বসেই আমরা আশায় বুক বাঁধছি গণ-মানুষ আমাদের কাছে আসবেন। আর এই যে আমি লেখাটি লিখবার সময় বারবার বলছি ‘আমরা’, এটাও আমার ভেতরে প্রোথিত প্রাগৈতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা, যা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। হয় আমি ভাবছি না, গণ-মানুষ আমাদের অংশ; না হয় ভাবছি, আমরা গণ-মানুষের বাইরে। কেবল রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কেনো কোনো আন্দোলনেই নিজেদের পি সি সরকার ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা স্টেজে যাবো, হাত সাফাইয়ের মন্ত্রমুগ্ধতা প্রদর্শন করবো, আর জনগণ হাঁ করে সেটা দেখবেন। দুঃখের বিষয় হলো, এটাই আমরা করি। ফলে যা হবার তা-ই হয়। জনগণও আমাদের সমস্ত আয়োজনটাকে সার্কাস ভেবে হাততালি দিয়ে চলে যায়। এই যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন অবস্থায় আমাদের প্রতিটি প্রয়াস ক্রমশ সিসিফাসের শক্তিক্ষয়ের পরিণতি পাচ্ছে। আমাদের নবীন কমরেডরা হতাশ হচ্ছেন। কেউ কেউ হাল আমলের সস্তা জনপ্রিয়তার বাতাসে গা ভাসাচ্ছেন। সেটুকুও যারা পারছেন না, তারা মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ছেন। আর আমাদের চোখের সামনে গণ-মানুষ, যাদের গর্ভে জন্ম হয়েছে সভ্যতার, তারা বুঝতে পারছে এই সময় ইয়ং-এর মাদার কমপ্লেক্সের নয় ইউনিলিভারের বিউটি কনসেপ্টের। সুতরাং সভ্যতার বদলে নিদারুণ অসভ্যতার জন্ম দিচ্ছে মানুষই। বাবা-মা সন্তানকে শিখিয়ে দিচ্ছেন কী করে লোভ-মিথ্যে-ঠকবাজী আর আপোসকামীতা দিয়ে ক্যারিয়ারের একটি ভালো ব্যঞ্জন রাঁধা যায়। উনবিংশ শতাব্দীতে এই মানুষই জ্ঞান-সত্য আর
মানবিকতার আদর্শে নির্মাণ করেছে সভ্যতা; আর আজ মানুষ এসব ছেঁটে পাঠ নিচ্ছে লোভ আর মস্তিষ্ক বর্গা দেবার ব্যাকরণের। এখন প্রশ্ন হলো কে বদলেছে? সময়? মানুষ? না কি ‘আমরা’ যারা নিজেদের পরিচয় দেই রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কর্মী হিশেবে?
তিন
আগের অনুচ্ছেদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো এই অনুচ্ছেদে; উত্তরটি খুঁজে আনবো ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে। নিকটবর্তী ইতিহাসে রাজনৈতিক দাবার ছকে সংস্কৃতিকে মুখ থুবড়ে পড়তে আমরা প্রথম দেখি ১৯৪৭ সালে। সংস্কৃতি বিচ্যুত রাজনীতি ধর্মকে প্রধান অবলম্বন হিশেবে গ্রহণ করে চলে যায় ইতরদের হাতে। ফলশ্রুতিতে, মানুষ নির্ধারিত হয় ‘হিন্দু’ আর ‘মুসলমান’ পরিচয়ে। যে যার মতো ধর্মকে ব্যবহার করতে থাকে নিজেদের ফায়দা লাভের জন্যে। ধর্মের গুড় চেটেপুটে খেয়ে দেশ ভাগ করে রাজনৈতিক পিঁপড়ে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে মুখ ফিরিয়ে এই ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ যখন দাড়ি-টুপি বা টিকি-পৈতাকে ধারণ করলো নিজেদের পরিচয় হিশেবে, তখনই একটি প্রচ্ছন্ন পরাজয় নির্ধারিত হয়ে গেছে। বিভিন্ন আলোচনায় আমার অনেক বিদগ্ধ বন্ধুদের কাছে শুনেছি, দেশভাগ বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব -পাকিস্তান) মুসলিমদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, কেননা, এ অঞ্চলে তারা ছিলো ব্রাত্য। দেশ ভাগের ফলে এ অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে রেনেসাঁর আবির্ভাব ঘটে এ মতামতও অনেকেই দিয়ে থাকেন। বস্তুত বিষয়টি ছিলো একেবারেই অর্থনৈতিক। ধর্ম বা ধর্মীয় দাঙ্গা যেগুলো দেশভাগকে তরান্বিত করেছিলো, তার সবগুলোর অপারেশন জোন ছিলো কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের রাজনীতি। সেখানে কোথাও মানুষ ছিলো না। নিহত হয়েছে মানুষ, রক্ত ঝরেছে মানুষের, পুড়েছে মানুষ, ধ্বংস হয়েছে মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতা কিন্তু ক্রিয়াশীল ছিলো নেহেরু-জিন্নাহর গণ-বিরোধি রাজনীতি। ফলে এই যে পূর্ব -বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) তরতর করে পাকিস্তানের ভূত-দর্শনের গাছে চড়ে বসলো কেবল মুসলিম রেনেসাঁ র প্রত্যাশায়, তার মোহ ভাঙলো অচিরেই। ধর্মীয় নব-জাগরণ বলে যে আদতে কিছু নেই, গোটা বিষয়টাই যে ফাঁপা বাংলার মানুষ সেটি বুঝলো পাকিস্তান নামক প্রতারণার পাল্লায় পড়ে। কিন্তু ততোদিনে গঙ্গা-বুড়িগঙ্গার জল বহুদূর গড়িয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাহীন দেশভাগের রক্তাক্ত জমিনে ততোদিনে টাটা-বিড়লা আর আদমজী-ইস্পাহানিদের স্বার্থান্বেষী লকলকে জিভ টেক্কা খেলে ফেলেছে। সম্পর্ক, আবেগ পরাজিত হয়েছে কাঁটাতারের কাছে। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার বিজয় মিছিল করছে, আর তারই সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে কোটি কোটি শরণার্থী উদ্বাস্তু। বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী এখনও এটি বলার চেষ্টা করেন যে, দেশভাগের মূল কারণ ছিলো মুসলিম প্রজাদের ওপর হিন্দু জমিদার -জোতদারদের অত্যাচার। মানুষের যেমন কোনো ধর্ম থাকতে নেই, তেমনি অত্যাচারিদেরও কোনো ধর্ম থাকে না। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হলো এই বুদ্ধিজীবী মিথ্যাচারটি খন্ডন করা। আগেই বলেছি, দেশভাগের কারণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। এই রক্তক্ষরণে দুই বাংলার মানুষ কেবল ব্যবহৃতই হয়েছে। সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততাই দেশভাগের সঙ্গে ছিলো না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে যারা ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ নামে ইতিহাসে চালান করতে চান, তাদের লেলিনের সেই কথাটি মনে করিয়ে দেয়া দরকার, যেখানে তিনি বলেছিলেন জনগণ আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ও তাকে উচ্চ মর্যাদা দেয়, এবং আন্দোলনের জন্য বীরত্ব, আত্মত্যাগ, অধ্যাবসায় ও নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে, যদি সেই আন্দোলন খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনে সচেষ্ট হয়। ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে বাংলার মেহনতি মানুষ কোনো আন্দোলন করেনি। কৃষি-ভিত্তিক গ্রাম-প্রধান বাংলাদেশের জনতার গরিষ্ঠ অংশই কৃষক। তাই বাংলাদেশের যে কোনো আন্দোলনের সফলতার জন্যে কৃষক-জনতার ব্যাপক সংখ্যার অংশগ্র হণ একটি অপরিহার্য শর্ত, যা ঘটেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। কৃষক মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে লেনিন বলেন কৃষক জমি চায় এবং তার বৈপ্লবিক অনুভূতি ও গণতন্ত্র সম্পর্কে তার সহজাত আদিম বোধ জমিদারের জমির ওপর হাত ন
া বাড়িয়ে অন্য কোনো প্রকারেই অভিব্যক্ত হতে পারে না। তথাকথিত ‘পাকিস্তান আন্দোলন’- এর অব্যবহিত পরেই আবুল মনসুর আহমদের ‘জীবন ক্ষুধা’ উপন্যাসটি রচিত। মনে রাখতে হবে, তিনি কেবল একজন সাহিত্যিকই নন, পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় রাজনীতিক। দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিষয়ে তার মতামত যা-ই হোক, উপন্যাসটিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে কৃষকের যে সংলাপ তিনি নির্মাণ করেছেন, তাতে স্পষ্ট যে, কৃষকের কাছে জমিটাই মূল। হিন্দুদের জমি মুসলমানদের মধ্যে ভাগ হবে এই আশ্বাসের পরও কৃষক রহমত জানতে চায়, কে কতোটুকু জমি পাবে? মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই এই জাতীয় বালখিল্য প্রস্তাবে সে রাজি নয়, সে স্পষ্টভাবে জানতে চায়, তার হিস্যা কতোটুকু। কারণ, ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলায় কতোগুলো সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনা-পরম্পরার ফলশ্রুতিতে জমিদারগোষ্ঠীর বৃহদাংশই আসে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে। কৃষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের। ফলে জমিদার-কৃষকের বিভাজনটি আদতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে রূপ নেয়। আর তাকেই কাজে লাগায় কংগ্রেস মুসলিম লীগ। কারণ তারা জানতো, ধনী কৃষকদের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক মনোভঙ্গি প্রবল; সুতরাং ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক চেতনা তাকে সহজেই আচ্ছন্ন করবে। প্রসঙ্গত আমরা মনে করতে পারি সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের ফেলু মিয়া নামক মুসলমান জোতদারের একটি মন্তব্য, যা অখন্ড পাকিস্তানের জন্যে এবং অখন্ড পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির স্ফটিক-স্বচ্ছ প্রকাশ। সে বলছে “এই বাংলাদেশটা, তামাম হিন্দুস্তানটা কাদের ছিল জান?.. সেই আকবর বাদশা তামাম হিন্দুস্তানের বাদশা ছিলেন।..  কিন্তু ওই শুয়োরখোর ইংরেজ? কেড়ে নিল আমাদের বাদশাহী তখত। বাদশাহর জাত আমরা এখন ভিখারির জাত। পোয়াবারো ওই মালাউনদের, জমিজিরাত সবই লুটেপুটে খাচ্ছে ঐ ব্যাটারা”। একই স্বার্থ -চেতনা থেকে হিন্দু জমিদারও রচনা করে তাদের নিজস্ব আদর্শ। সুরেন মিত্র আবুল মনসুরের ‘জীবনক্ষুধা’-কে প্রতিক্রিয়াশীল উল্লেখ করে বলেন “পাকিস্তান চায় মুসলমানরা কোন্ অধিকারে? এ দেশ কার? আর্যরার। মুসলমানরা তো বিদেশী। তারাও তো ইংরেজের মতোই জোর কইরা আমরার মাতৃভূমির দখল লইছিলো। দ্যাশ স্বাধীনের লাইগ্যা আন্দোলন করলাম, জেল খাটলাম আমরা হিন্দুরা আর মুসলমানরা আইছে দ্যাশের ভাগ লইতে? আরে আমার শরীক রে!”। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, পাকিস্তান সৃষ্টি প্রসঙ্গে নিঃস্ব কৃষকের দৃষ্টি ছিলো এক আর ধনী কৃষক বা জোতদারের দৃষ্টি ছিলো আরেক। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মীরা কোথায়? বলাই বাহুল্য, সে সময়ে রাজনীতির কদাকার রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা। কারণ রাজনীতি চলে গিয়েছিলো জনগণ-বিচ্যুত ব্যক্তিদের হাতে। তখন সাংস্কৃতিক কর্মীরাই জানতেন মৃত্তিকা-সংলগ্ন জনসাধারণের কথা। সাতচল্লিশের পর স্পষ্টত একটি বিভাজন রেখা আমরা দেখতে পাই সাংস্কৃতিক কর্মী আর মুসলিম মধ্যবিত্ত থেকে আগত তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। মুসলিম মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি একটি টিপিক্যাল মনোভঙ্গি নিয়ে পাকিস্তানের ভাবাদর্শের জয়গান গাইতে থাকে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক কর্মীরা মানুষের মনোজগতের অনুগামী চেতনায় দীক্ষিত হতে থাকে। প্রথম অংশের অবলম্বন হয় ধর্ম , দ্বিতীয় অংশের অবলম্বন সংস্কৃতি। স্বীকার্য সংস্কৃতি আর সমাজ-মনস্তত্ব সমার্থক নয়। কিন্তু সমাজ-মনস্তত্ত্ব সঙস্কৃতির সঙ্গে অনপনেয় সূত্রে গ্রথিত; তাই সংস্কৃতির ওপর আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের মনোলোকে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই প্রতিক্রিয়ার বার্তা-বাহকই একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। তাই রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে বাঙালি সোচ্চার হয়ে উঠে। একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, ভাষা আন্দোলন তার শুরুর দিকে ছিলো শিক্ষিত সমাজের আন্দোলন। কারণ, যে মধ্যবিত্ত মুসলিম বুদ্ধিজীবী
রা পাকিস্তানের জন্যে জান কোরবান করার শপথ নিয়েছিলেন, তারাই বুঝতে পারলেন, উর্দূ রাষ্ট্রভাষা হলে তারা চাকুরি হারাবেন। প্রাথমিক অবস্থায় এই আন্দোলনের তেমন কোনো প্রভাব গ্রাম-বাংলার মানুষের ওপর পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু কৃষক শ্রেণি থেকে আগত ছাত্র সমাজ এবং কৃষক-শ্রমিকদের সাথে মিশে কাজ করা সাংস্কৃতিক কর্মীরা (যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে) শিক্ষিত সমাজের এই আন্দোলনকে গণচরিত্র প্রদান করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রান্তিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সবখানেই যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে সাংস্কৃতিক কর্মী হিশেবেই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রতি শিক্ষিত বাঙালির মোহভঙ্গ ঘটে, একই সঙ্গে গণ-মানুষের স্বতঃস্ফূ র্ত সম্পৃক্ততাই যে আন্দোলনে সফলতা আনতে পারে, তা স্পষ্ট হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের গণ-পরিষদে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে বাংলা স্বীকৃতি পায়, কিন্তু তা ওই কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। উপরন্তু পাকিস্তানের বর্বর শাসক-শ্রেণি নানাভাবে বাঙলার মানুষের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালাতে থাকে। ১৯৬১ সালে পশ্চিম এবং পূর্ব বাংলায় একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটে যা থেকে আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিষ্ঠা ও কর্মের একটি প্রত্যক্ষ নমুনা পাই। পূর্ব বাংলা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে পাকিস্তানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশত বর্ষ উদ্‌যাপনের, শিলচরে তখন বাংলা ভাষাকে ধুইয়ে দিচ্ছে তাজা রক্তের স্রোত। একুশের চেতনা এই যে নদীর স্রোতের মতো কাঁটাতার পেরিয়ে চলে গেলো উনিশের কাছে এ তো বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মীদেরই আন্দোলনের ফসল। ১৯৬১ সালেই তো মুছে গেছে ‘এপার বাংলা’ ‘ওপার বাংলা’, সৃষ্টি হয়েছে ‘অপার বাংলা’ যার ভিত বাংলা সংস্কৃতি। একষট্টির পর বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলন মূলত চালিত হয়েছে সংস্কৃতির হাতে হাত রেখে। অশুভ দমনের তীব্র মোহনা সৃষ্টি হয়েছে একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাই যতোটা রাজনৈতিক, ততোটাই সাংস্কৃতিক। বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র রাষ্ট্র যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুগপৎ রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ফসল হিশেবে।
চার
আরও একবার লেলিনের কাছে যাই। তিনি বলেছেন “জনগণের প্রকৃত শিক্ষাকে কখনও তাদের বৈপ্লবিক সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না”। স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে ‘জনগণ’ কথাটির একটি আলাদা গুরুত্ব আছে। দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসলো। বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃতে প্রণিত হলো বাহাত্তরের সংবিধান। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্যত্র। রাষ্ট্র স্বাধীন হলো, পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের নিকষ অত্যাচার থেকে মুক্তি পেলো, কিন্তু বাঙালির মানসকাঠামো স্বাধীন হলো না। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্ম-সমর্পন করলো বটে, কিন্তু বাঙালির মগজের ভেতরে চব্বিশ বছর ধরে বড়ো হতে থাকা ঘুন পোকাগুলো আত্ম-সমর্পন করলো না। একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে অধিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা অফিসাররা, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণের দোলাচলে হয়ে পড়লেন বহুধা বিভক্ত। একই ঘটনা ঘটলো সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যেও। যে রাজনীতি সংস্কৃতিকে তার পাশে রেখেছিলো দেশ স্বাধীনের আগে, সেই রাজনীতি তখন পার্লামেন্টের বদ্ধ ঘরে আটকে গেলো। সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ তখনও মানুষের সঙ্গেই রইলেন, কেউ কেউ রাজনীতির পেছন পেছন পার্লামেন্টে গেলেন। মোট কথা, সকলেই তখন ক্ষমতাকে চিনলেন, কিন্তু যে গণ-মানুষকে ঘিরে এই ক্ষমতা, তাদের ত্যাগ করলেন অধিকাংশই। ফলে সমাজে নতুন শ্রেণিকরণ ঘটলো। কৃষিজীবী, শ্রমজীবীর মতো ক্সতরি হলো রাজনীতিজীবী, সংস্কৃতিজীবী, বুদ্ধিজীবী। সেনাবাহিনী থেকে আমলাতন্ত্র সবখানেই কর্মী নয়, সকলে জীবী হতে চাইলেন। এই মেরুকরণের প্রভাব পড়লো আওয়ামী লীগের ওপরও। সাড়ে সাত কোটি বিপন্ন কোকিলের কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধুও এই মেরুকরণের ভেতরেই একলা হাঁটতে লাগলেন প্রাচীন বুড়ো সন্তের মতো। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরেই হোঁচট খেলো বাংলাদেশ পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করলো ভয়াল মেঘমালার নিচে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট ছিলো আমাদের জাতিগত ব্যর্থতা। যে জাতি মাত্র চার বছর আগে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই জাতি ভগ্নাংশে যেতে যেতে পিতার রক্তে হাত লাল করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তখনও রাষ্ট্রে একটি বিরাজমান শ্রেণি কেবলই ‘জনগণ’। অর্থ্যাৎ, তারা কেবলই স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণ। তারা কোনো জীবী নয়, তারা জনগণ। তাদেরই ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে গিয়ে কেউ কেউ রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসছে, কেউ কেউ মেরুদন্ড বেচে খাচ্ছে, কেউ কেউ সংস্কৃতিকে আগ্রাসনে রূপ দিচ্ছে। কিন্তু তখনও সমাজ-মনস্তত্ত্ব নির্ণীত হচ্ছে এই ‘জনগণ’ দ্বারাই। অতএব, বাংলাদেশ তখন নানা শ্রেণিতে বিভক্ত বহু স্বার্থে বিভক্ত। সংস্কৃতি কর্মীরা তখন আর জনগণের অংশ নেই। জনগণের মনস্তত্ত্ব তখন আর তাদের বোধগম্য নয়। এ কারণেই স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও একটি সুসংহত, কার্যকরী সাংস্কৃতিক বিপ্লব আমরা রচনা করতে পারিনি। রাজনৈতিক বিপ্লব তো অনেক পরের কথা। বর্তমানে সারা পৃথিবীর যে সঙ্কট, তা বাংলাদেশেও বিরাজমান। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের নানা আলোচনা পৃথিবী জুড়েই হচ্ছে। অনেকই আলোচনায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলছেন। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবটি কীভাবে হবে, তা নিয়ে আলোচনার কোনো সুফল আমরা পাচ্ছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একটি বিরাট বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আমরা বাস করছি। আমাদের রাজনীতি যেমন বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত, আমাদের সংস্কৃতিও। এবং আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা ভয়ানকভাবেই বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত। আমাদের যে রাজনৈতিক চেতনা আছে, তা আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে প্রকাশিত হচ্ছে না। আমরা মাটির ভাষাটি বুঝতে পারছি না। নগরকেন্দ্রিকতায় ভীষণভাবে আক্রান্ত
আমরা। ফলে নন্দনে বা শিল্পকলায়, রবীন্দ্র সদনে বা ছায়ানটে কিংবা ঢাকা কোলকাতার রাজপথে, শিলচর সিলেটের পাহাড়ি পথে আমরা যা কিছু বলতে চাইছি, তা জনগণের হৃদয় ভাষ্য নয়। কারণ, আমরা জনগণের সাথে নেই। জনগণ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিছু বিচ্ছিন্ন অংশের সঙ্গে আমরা নিজেদের একীভূত করে ভাবছি, আমরা জনগণের সাথেই আছি। এ আমাদের এক ভ্রান্তি বিলাস। বাংলার সঙ্কট বাংলার মানুষই মোকাবেলা করতে পারবে। কোনো খবরদারি রুই-কাতলার দরকার আমাদের কোনো কালেই ছিলো না, এখনও নেই। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিশেবে আমি মনে করি, আমার বিপ্লব যতোটা না থাকে দাস ক্যাপিটালে, তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে লালনের সুরে। ওখানেই আমার ইশতেহার। ওটুকুই আমার স্লোগান।


ছবি – মনিষ দেব

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২