ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী সার্ধশতবর্ষে স্মরণ – ডাঃ দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত
তখন মাত্র কয়েকমাস হল জন্ম নিয়েছেন পুত্র সত্যজিৎ। হঠাৎই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে সুকুমার রায়ের। জানা যায়, কালাজ্বরে আক্রান্ত তিনি। মৃত্যু অনিবার্য। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর। তিনি কি ভেঙে পড়বেন? সুকুমার বুঝি তেমন মানুষ?
ততদিনে কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছেন স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। এই কলকাতার বুকেই। কিন্তু ১৯২১ সালের সেই আবিষ্কার তখনও সাড়া ফেলেনি চারদিকে। পরীক্ষিতও হয়নি। মানুষের কাছে কালাজ্বর তখনও এক প্রাণঘাতী রোগ। একবার হলে, মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার নেই আর। নিস্তার পাননি সুকুমার রায়ও।
মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, বাঙালির হাস্যকৌতুকের রাজা সুকুমার রায়ের। কারণ তখনও পর্যন্ত কালাজ্বরের টিকা আবিষ্কার পরীক্ষামূলকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। আসলে একটা আবিষ্কারের নেপথ্যে থাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া, বহু মানুষের সাধনা, একইসঙ্গে বঞ্চনার ইতিহাসও।
কে এই উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী?
একটি প্রচলিত ধারণা — যাঁরা ব্রহ্মচারীর মতো জীবন যাপন করেন তাঁদের উপাধি হয় ব্রহ্মচারী। একটি কম সমর্থিত মত হল যে কেশবচন্দ্র ভারতী শ্রীচৈতন্যদেবকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দেন তাঁর বড়দাদা গোপালচন্দ্র ভারতী। দীক্ষার পরে নিজেদের মুখোপাধ্যায় উপাধি ত্যাগ করে ব্রহ্মচারী উপাধি গ্রহণ করেন। এদের নবম বা দশম বংশধর হচ্ছেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী।
এক অনন্যসাধারণ মেধার অধিকারী এই মানুষটি বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে জন্ম নিয়েছিলেন ১৮৭৩ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর। তাঁর বাবা নীলমণি ব্রহ্মচারী ছিলেন ভারতীয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের একজন চিকিৎসক (জেনারেল ফিজিসিয়ান)। আর মায়ের নাম ছিল সৌরভ সুন্দরী দেবী।
ইস্টার্ন রেলওয়ে বয়েজ হাইস্কুল থেকে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন। এরপর ১৮৯৩ সালে হুগলীর মহসিন কলেজ থেকে গণিত ও রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর উচ্চতর রসায়ন ও মেডিসিনের উপর ১৮৯৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। এই সময় প্রেসিডেন্সিতে পড়াতেন স্যার আলেকজান্ডার পেডলার এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো কিংবদন্তীরা।
তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী সময়
১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের সাথে যুদ্ধ জয় করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। কিন্তু ১৮২৫ সালেই বিশ্ববাজারের অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড। এ বিষয়ে দ্য ইকনোমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত আলোচনা “The Slumps That Hat Shaped Modern Finance” পড়লে জানা যায় এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা ব্যবসার ক্ষেত্রে যে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে এসেছিল তা গভীর প্রশ্নের মুখে পড়েছিল।
ইংরেজরা কার্যত একটি ঘোরতর “চা-খোর” জাতি। এজন্য কমদামে ভালো চা পাওয়া ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রনীতির অংশ হয়ে গিয়েছিল।
এরকম সময়েই শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ (১৮২৪-২৬)। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৫০,০০০ সৈনিক গারো পাহাড়, আসাম এবং মণিপুরের বিপজ্জনক দুর্ভেদ্য অঞ্চলে লড়াই করে মারা যায়। সেসময়ের হিসেবে ৫-১৩ মিলিয়ন পাউন্ড (বর্তমান হিসেবে ৪০০ মিলিয়ন থেকে ১.৪ বিলিয়ন পাউন্ড) ক্ষতি হয় যুদ্ধের ফলে। কিন্তু এ যুদ্ধের পরে দুটি ঘটনা ঘটে –
(১) ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চিনের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার নাকচ করে
এবং
(২) চার্লস আলেকজান্ডার ব্রুস, যিনি ইংল্যান্ডের পক্ষে সফল এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে চা চাষ করা সম্ভব সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হন। এরপরে আর বিশেষ সময় লাগেনি–আসাম ও সংলগ্ন অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে চা চাষ শুরু হল। এর সঙ্গে সঙ্গেই বদলে গেল এসব অঞ্চলের টোপোগ্রাফি, ডেমোগ্রাফি এবং খাদ্যাভ্যাস। এই ব্রুস সাহেবকে “ভারতে চায়ের জনক”ও বলা হয়।
একইসঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের যশোর থেকে নদীয়া ও হুগলি হয়ে বর্ধমানে পৌঁছয় বেলেমাছি বা স্যান্ড ফ্লাই-বাহিত মারাত্মক রোগ কালাজ্বর (যদিও এ রোগটি যে বেলেমাছি বাহিত সে আবিষ্কার হয়েছে অনেক পরে)। তারপর আরও অগ্রসর হয়ে অল্পদিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং গারো পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছে যায় এই রোগ—পথে কোনো জনপদ, গ্রাম বা লোকালয় এর হাত থেকে নিস্তার পায়নি।
ইতিহাসে কুখ্যাত “বর্ধমান ফিভার” বস্তুত দুটি রোগের যুগপৎ আক্রমণে হয়েছিল। ম্যালেরিয়া এবং কালাজ্বর।
১৯২৮ সালে প্রকাশিত তাঁর A Treatise on Kala-azar গ্রন্থে ব্রহ্মচারী জানাচ্ছেন – “কালা-আজার নামটি যদিও বহুল ব্যবহৃত হয়, কিন্তু যথোপযুক্ত নয়। এ নাম দিয়ে বোঝানো হয় যে এক বিশেষ ধরনের জ্বরে ত্বকের রং কালো হয়ে যায়। এজন্য অনেকেই মনে করেন একে “কালা-জ্বর” বলা উচিত। অঞ্চলভেদে কতভাবে এর নামের ভিন্নতা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা করেন তিনি। ১৮২৪-২৫ এ যশোরে যখন এ রোগের প্রকোপ দেখা যায় তখন একে “জ্বর-বিকার” বলা হত। এরই অন্যান্য নামগুলো হল–“দমদম জ্বর”, “সাহেবদের রোগ”, “সরকারি অসুখ”, “কালা-দুঃখ”, “কালা-হাজার” “আসাম ফিভার”, “ponos” (Greece), “semieh” (Sudan), “malattia de menssa” (Sicily) ইত্যাদি। এসব থেকে কালাজ্বরের পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। জলপাইগুড়িতে একে বলা হত “পুষ্করা” আর আসামের মানুষ একে বলত “সাহেবদের রোগ”।
যাহোক, আসামের সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগান তৈরি হল, “সাহেবদের রোগ” ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল স্থানীয় অধিবাসী এবং চা বাগানের কুলি তথা শ্রমিকদের মাঝে। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতে লাগল এই ব্ল্যাক ডেথ বা কৃষ্ণ মৃত্যুর থাবায়। তখন আড়কাঠিদের দিয়ে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে দরিদ্র, ভুখা মানুষদের নিয়ে আসা হল চা বাগানের কুলি হিসেবে। চা বাগান তৈরির মধ্য দিয়ে আগেই আসাম এবং গারো পার্বত্য অঞ্চলের টোপোগ্রাফি পরিবর্তিত হয়েছিল। এবার নতুন করে ডেমোগ্রাফির পরিবর্তন শুরু হল। আরেকটা পরিবর্তন হল—আসামের মানুষের মাঝে চা পানের অভ্যেস তৈরি করে দেওয়া হল। পরিবর্তন হল পানাভ্যাসেরও।
৩,৫০,০০০-এর বেশি মানুষ এ রোগে মারা গিয়েছিল। আবার কোনও কোনও হিসেবে এ সংখ্যা ২৫ লক্ষও হতে পারে। এ রোগে সেসময়ে মৃত্যুহার ছিল ৯০%।
ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি এক গভীর সংকটের মুখে পড়ল—মানুষ তথা চা বাগানের কুলিদের মৃত্যু আটকানো না গেলে চা উৎপাদন হবে না, মুনাফায় ঘাটতি পড়বে। আবার বিজ্ঞানীদের কাছে দুটি প্রশ্ন এল–(১) এ রোগ কীভাবে হয়? বাহক কে? এবং (২) মৃত্যুকে প্রতিরোধ করা যাবে কীভাবে?
ইংরেজ বণিকরা পড়ল বিপদে। শ্রমিকদের অভাবে চা বাগানের কাজ তো আর বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তখন খোঁজ পড়ল আড়কাঠিদের, যারা ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে দরিদ্র, ভুখা মানুষদের নিয়ে এল অসমের চা বাগানের কুলি হিসেবে। কিন্তু কালাজ্বর ততদিনে মহামারীর চেহারা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলে। কালাজ্বরে মৃত্যুর হার হয়ে গিয়েছে নব্বই শতাংশ। ইংরেজ বণিকরা দেখলেন, বাগানের কুলিদের মৃত্যু আটকানো না গেলে চা উৎপাদন হবে না, মুনাফাও হবে না। ব্রিটিশরা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কারক নোবেলজয়ী রোনাল্ড রসকে কালাজ্বর কমিশনের অধিকর্তা নিযুক্ত করল। কিন্তু তিনিও এই রোগের প্রতিকার করতে পারলেন না। শুধুমাত্র এইটুকু বললেন, এই রোগ ম্যালেরিয়ার থেকে আলাদা।
১৯০৩ সাল নাগাদ উইলিয়াম লিশম্যান এবং চার্লস ডোনোভানি নামে দুই ব্রিটিশ কলকাতা ও মাদ্রাজের দুই সৈনিকের অটোপ্সি করে কালাজ্বরের প্যাথোজেন আবিষ্কার করে ফেললেন। তাঁদের দুজনের নাম মিলিয়ে রোনাল্ড রস কালাজ্বরের নামকরণ করলেন লিশম্যানিয়া ডোনোভানি। জানা গেল লিশম্যানিয়া গণভুক্ত একপ্রকার প্রোটোজোয়া পরজীবী এই রোগটি ঘটায়। কাদামাটির ফাটলে বা ভিজে অঞ্চলে বাস করা বেলেমাছি বা স্যান্ড ফ্লাই বাহকের মাধ্যমে এই কালাজ্বরের সংক্রমণ ঘটে। এই পরজীবীর সংক্রমণের প্রভাবে যকৃৎ এবং প্লীহার আকার বেড়ে যায়, অস্থিমজ্জা, হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চামড়ার রং কালো হয়ে যায়।
১৯০২ সালের মধ্যেই ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে থাবা বসিয়েছে এই জ্বর। বিশেষ করে বাংলাদেশ, চিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ইতালিতে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে জ্বরে। তখন ল্যাবরেটরি মেডিসিনের গবেষণার ক্ষেত্রে ইতালিকে পথিকৃৎ হিসেবে ধরা হত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইতালির স্যর লিওনার্ড রজার্স কালাজ্বর নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রায় একই সময়ে ভারতে একমাত্র যে মানুষটি কালাজ্বরের ল্যাবরেটরি মেডিসিন নিয়ে অক্লান্ত গবেষণা করে চলেছিলেন, তাঁর নাম উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। এ যেন ইতালির মতো দেশের সঙ্গে ভারতের তথা বাংলার এক বিজ্ঞানীর অসম প্রতিযোগিতায় নামা।
১৯০৬ সালে ব্রহ্মচারী একটি গবেষণাপত্র লেখেন “On a Contribution To The Study Of Fevers Due To Leishman-Donovan Bodies”।
পরজীবী তো আবিষ্কার হল। কিন্তু একে মারা যাবে কী করে? এ হল তখন গবেষকদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
উপেন্দ্রনাথ যে সময়টায় কালাজ্বরের ওষুধের জন্য গবেষণা চালাচ্ছিলেন, সমসাময়িক কালে আর্সেনিক, অ্যান্টিমোনি ইত্যাদি ধাতুর যৌগ ব্যবহার করা হত সি-সিকনেস, আফ্রিকান স্লিপিং ডিজিজের প্রতিকারে। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণীর একই গ্রুপে থাকা আর্সেনিক ও অ্যান্টিমোনির মধ্যে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী অ্যান্টিমোনিকেই বেছে নিলেন গবেষণার ক্ষেত্রে। আসলে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার আগে রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে প্রেসিডেন্সি থেকে পাশ করেছিলেন উপেন্দ্রনাথ। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। রসায়নের ওপর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জ্ঞান গবেষণায় সঠিক পথনির্দেশ দিয়েছিল তাঁকে। ততদিনে অবশ্য ইতালির ডাক্তাররা পটাসিয়াম সল্ট অফ অ্যান্টিমোনিয়াল টার্টারেট প্রয়োগ করে সে দেশে কালাজ্বরের চিকিৎসায় কিছুটা ফল পেয়েছেন। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী জানতেন, এ ওষুধে বেশিদিন ভালো ফল মিলবে না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হবে। তাই তিনি প্রথমেই পটাশিয়ামের বদলে সোডিয়াম সল্ট অফ অ্যান্টিমোনিয়াল টার্টারেট নামে সংকর যৌগ নিয়ে পরীক্ষা চালালেন। কিন্তু কিছুদিন পরে তা-ও বিশেষ কার্যকর হল না। এরপর অ্যান্টিমোনি নামে ধাতব মৌলের কোলয়ডীয় মিশ্রণ দিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। মানে আজকের যুগে কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগে যেমন ফেজ-ওয়ান ট্রায়াল চলে, তখনও সেই রীতিই অনুসরণ করা হত।
যাইহোক, উপেন্দ্রনাথ দেখলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য অ্যান্টিমোনির কোলয়ডীয় দ্রবণ সংরক্ষণ করে রাখা যাচ্ছে না। তখন তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন এমন কোনও যৌগ খুঁজে চলেছে, যা দিয়ে কালাজ্বরের চিকিৎসার উপকরণও সহজলভ্য হয়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম হয়। এইভাবে অনুসন্ধান করতে করতেই একদিন রাতে পেয়ে গেলেন প্রত্যাশিত ফলাফল। আবিষ্কার করে ফেললেন ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’, যা আসলে প্যারা অ্যামাইনো ফিনাইল স্টিবনিক অ্যাসিডের ইউরিয়া লবণ। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী দেখলেন, এই সংকর যৌগ দিয়েই তিনি যেরকম ফলাফল চাইছেন, সেটাই পাচ্ছেন। সময়টা ১৯২১ সাল। ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল সাক্ষী রইল এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের। প্রথমে খরগোশের ওপর এই ইউরিয়া স্টিবামাইন প্রয়োগ করা হল। সেখান সুফল মেলায় পরে ১৯২২ সালে ক্যাম্পবেল ও কলকাতা মেডিকেল কলেজের রোগীদের ওপরও প্রয়োগ করা হল। দেখা গেল, মাত্র দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠছেন। ১৯২২ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চে কালাজ্বর রোগীদের সুস্থ করার বিবরণ এবং উপেন্দ্রনাথের ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কারের কথা সবাই জানতে পারল। প্রমাণিত হল, এক বাঙালি বিজ্ঞানীর আবিষ্কার করা ইউরিয়া স্টিবামাইনই সবচেয়ে কার্যকর, ফলদায়ী এবং কম সময়ে কালাজ্বর নিরাময় করতে পারা ওষুধ। উপেন্দ্রনাথ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন অদম্য জেদ, অধ্যবসায়ের কাছে সব প্রতিকূলতাই হার মেনে যায়। তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল ল্যান্সেট পত্রিকায় (অক্টোবর ২১, ১৯১৬) “The Preparation Of Stable Colloidal Antimony” শিরোনামে।
ইউরিয়া স্টিবামিন ব্যবহারের আগে যেখানে মৃত্যুহার প্রায় ৯০% ছিল, এ ওষুধ ব্যবহারের পরে তা বদলে গিয়ে সুস্থতার হার ৯০% হয়।
ওষুধের পেটেন্ট এবং বিপণন
ভারতীয়দের (অন্তত সেসময়ে—একদিকে জাতীয়তাবাদী প্রভাব, অন্যদিকে প্রাচীন সমাজের প্রভাব) মধ্যে আবিষ্কারের পেটেন্ট নেবার ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত ঔদাসীন্য লক্ষ্য করা যায়। জগদীশ বসু এর প্রোজ্জ্বলন্ত উদাহরণ। এর জন্য নোবেল প্রাইজ থেকেও তিনি বঞ্চিত হলেন। ব্রহ্মচারীর ক্ষেত্রেও কমবেশি একই কথা প্রযোজ্য। ওষুধের পেটেন্ট নিলেন না বা আদৌ গা করেননি। এর ফলে বিভিন্ন কোম্পানি এরকম ফলদায়ী ওষুধ নিয়ে নিজেদের মতো করে বানিয়ে (ব্রহ্মচারীর ফর্মুলা অনুযায়ী নয়) বাজারে বিক্রি করতে শুরু করে।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ (জুন, ১৯১৬) প্রকাশিত হয় “Urea Stibamine” শিরোনামে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়—“he gave the process of manufacturing to the world, but reserved the name ‘Urea Stibamine’ as a fancy or trade designation, for his own private manufacture and share of the drug”। এখানেই ইউরো-আমেরিকান বাণিজ্য বুদ্ধির সাথে ভারতীয়দের পার্থক্য। শেষ অব্দি হাই কোর্টের বিচারপতি সি সি ঘোষের রায়ে ব্রহ্মচারী সম্পূর্ণ স্বত্ব পান। বাথগেট কোম্পানিকে দেন ওষুধ বিক্রির অধিকার।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখযোগ্য।
কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনের সর্বময় কর্তা সাদা চামড়ার শাসক লিওনার্ড রজার্স সম্ভবত কালা চামড়ার উচ্চতর মেধাকে স্বীকার না করতে পারার জন্য ক্রমাগত ব্রহ্মচারীর বিরোধিতা করে গেছেন—কি গবেষণার ফলাফল নিয়ে, কি আন্তর্জাতিক দরবারে গবেষণাকে লঘু করার মধ্য দিয়ে। এমনকি রজার্সের তীব্র বিরোধিতা ছিল অন্যতম একটি কারণ যে জন্য ব্রহ্মচারী রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হিসেবেও নির্বাচিত হতে পারেননি।
উপনিবেশের মেধাকে “আপদ” হিসেবে দেখা। তাই এতকিছুর পরেও এই ওষুধের ছাড়পত্র মিলল না। দুঃখের কথা এই যে, ১৯২১ সালে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করলেও, নেটিভ ডাক্তারের আবিষ্কারকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিতে আরও প্রায় ছয় বছর সময় লাগিয়ে ফেলেছিল ব্রিটিশ রাজপুরুষরা। ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, মারা যাওয়ার আগে প্রায় আড়াই বছর রোগশয্যায় কাটিয়েছিলেন সুকুমার রায়। ওই সময়ে উপেন্দ্রনাথের ইউরিয়া স্টিবামাইন ওষুধ পেলে হয়তো অকালে প্রাণ হারাতে হত না সুকুমার রায়কে। বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হত সুকুমার সম্ভারে। ইউরিয়া স্টিবামাইনের প্রয়োগে অসমের চা বাগানের শ্রমিকদের মৃত্যুর হার নব্বই শতাংশ থেকে দশ শতাংশে নেমে আসে। এক বছরে প্রায় তিন লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচায় ইউরিয়া স্টিবামাইন। উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন অসমের গভর্নর স্যর জন খের। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রিস, ফ্রান্স, চিন-সহ বহু দেশে এই ওষুধ প্রয়োগ করা হতে থাকে কালাজ্বরের প্রতিকারে। ১৯৩২ সালে নেচার পত্রিকায় ইউরিয়া স্টিবামাইনকে ‘লেস টক্সিক অ্যান্ড মোর এফেক্টিভ’ বলা হয়।
নোবেল পুরস্কার পুরস্কৃত হত উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী পেলে
১৯২৯ সালে নোবেলের জন্য ভারত থেকে নমিনেশন পেয়েছিলেন ব্রহ্মচারী। কিন্তু কে ছিলেন তাঁর প্রস্তাবক? প্রস্তাবক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক সুধাময় ঘোষ। আন্তর্জাতিক মহলে কে চেনে তাঁকে? ফলে ব্রহ্মচারী নোবেলের জন্য নির্বাচিত হলেন না। কিন্তু নোবেলজয়ী সি ভি রমন আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং যোগাযোগের এই পরিসরটি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্য ১৯৩০ সালে তিনি যখন নোবেল প্রাইজ পান তাঁর প্রস্তাবক ছিলেন ৬ জন আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী। এঁদের মধ্যে নিলস বোর, রিচার্ড ফেইফার, ডি ব্রগলির মতো নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা ছিলেন। একই বছরে মেঘনাদ সাহা নমিনেশন পেয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবক ছিলেন ডি এন বোস এবং শিশির মিত্র, যাদের আন্তর্জাতিক মান্যতা প্রায় কিছুই ছিল না। মেঘনাদ সাহাও নোবেল প্রাইজ পাননি।
ব্রহ্মচারীর গবেষণা ১৯২৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা করেছিল। বিজ্ঞানের জগতে এ এক পরম প্রাপ্তি। আমরা যদি এর পাশে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ১৯৯০ সালে নোবেলজয়ী জোসেফ মারের কথা স্মরণ করি তাহলে আরেকটু বোধগম্য হবে বিষয়টি। জোসেফ মারে কোনো তাত্ত্বিক কাজ করেননি। ১৯৫৪ সালে পৃথিবীতে প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। কয়েক কোটি মানুষের জীবন বেঁচেছে। সমধর্মী কাজ ব্রহ্মচারী করেও নোবেল থেকে বঞ্চিত। ১৯৪৬ সালেও ব্রহ্মচারী নমিনেশন পেয়েছিলেন। কিন্তু নোবেল জয় হয়নি।
অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ১৯৩৭ সালে তাঁকে নাইটহুড দেওয়া হয়। এটাও আসলে ভারতীয়দের প্রতি ঔপনিবেশিক বঞ্চনার একটা নজির। তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর নাম দু-দুবার মনোনয়ন করে পাঠানো হলেও নোবেল সম্মান প্রাপ্তি ঘটেনি উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর।
“মেডিক্যাল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্স” এবং বিজ্ঞানের আমলাতন্ত্রর জন্য নোবেল তাঁর হাত ছুঁয়ে ধন্য হতে পারেনি। ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলের (বর্তমানের নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) যে ঘরে এই অসম্ভব গবেষণাকর্মটি করেছেন সেটা আয়তনে জেলের একটা সেলের সাইজের বেশি কিছু ছিল না।
তাঁর সেই ছোট্ট গবেষণাকক্ষে কোনো গ্যাসের সংযোগ ছিল না, ছিল না বিদ্যুৎ সংযোগ, এমনকি ট্যাপ ওয়াটারের সরবরাহও নয়। একটি পুরনো কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাত্রিবেলা কাজ করতেন আবিষ্কারের অদম্য আকাঙ্ক্ষায়।
এই হলেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী
কালাজ্বর ছাড়াও উপেন্দ্রনাথ ফাইলেরিয়া, ডায়াবেটিস, কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে রচনাবলীর মধ্যে তাঁর ট্রিটিজ অন কালাজ্বর বিখ্যাত। এই ওষুধ ব্যবহার করে ৩.২৫ লক্ষ রোগীকে সারানো সম্ভব হয়েছে।
উপেন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালে কলকাতায় বিশ্বের ২য় ব্লাড ব্যাংক স্থাপন করেন। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির বাংলা প্রদেশ কার্যালয়ের সভাপতি মনোনীত হন। তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়।
ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী নোবেল পুরস্কার পেলে উপমহাদেশের বহু গবেষক যেমন অনুপ্রাণিত হতেন তেমনই সঠিক সময়ে ড্রাগ পেটেন্সি পেলে অকালমৃত্যু হত না সাহিত্যজগতের সূর্য সুকুমার রায়ের। কত নতুন সৃষ্টি হত! সুকুমার-সত্যজিৎ পিতাপুত্রর আশ্চর্য যুগলবন্দী সৃজন পেত বঙ্গসমাজ। কে জানে ইতিহাসের এসব উর্বর সম্ভাবনা কেন যে কানাগলিতে নিষ্ফল ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর দ্বারে গিয়ে বন্ধ হয়…
টাইমমেশিনে যদি সত্যিই যাওয়া যেত অতীতে তবে এতক্ষণে ডাঃ ব্রহ্মচারী তাঁর মিরাকল ইউরিয়া স্টিবামাইন পেটেন্সি নিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছেন সুকুমার রায়কে। সৃষ্টি হচ্ছে এক নতুন আনন্দযুগের। বাঙালির চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং সাহিত্য জগৎ-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিচ্ছে।