সাপ – ওগাই মোরি অনুবাদ – পূরবী গঙ্গোপাধ্যায়
[লেখক পরিচিতি : ওগাই মোরি (১৮৬৭-১৯১১) বিংশ শতাব্দীর জাপানী সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব । মোরি পশ্চিমের সভ্যতার সংগে বিশেষভাবে পরিচিত হতে পেরেছিলেন কর্মসূত্রে । তাঁর বেশীরভাগ লেখাতেই বিদেশী মানে অ-জাপানী কোনো বিশেষ চরিত্র বা বিদেশী কোনো ঘটনা বা কোনো পশ্চিম দেশের মনীষির উল্লেখ থাকবেই ।
মূল গল্প পরিচিতি : সাপ গল্পটিতে একজন সূত্রধর আছেন, যিনি আসলে ওগাই নিজেই । গল্পটির মুখ্য পুরুষ চরিত্র চিতারু হোজুমির দুর্ভাগ্য, অসুস্থতা, স্ত্রীর কাছে আশানুরূপ ব্যবহার না পাওয়া , তাকে নানা কারনে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে গিয়েছিল । এটি কেবল এক বৈবাহিক সম্পর্কের করুণ পরিণতির গল্প নয় । এই গল্পে মানুষের কখনো কখনো মতিচ্ছন্নতা কতটা কষ্টের কারণ হতে পারে তারও ছোঁয়া পাওয়া যায় । এছাড়া গল্পটিতে এদো যুগ বা তোকুগাওয়া যুগে (১৬০৩ থেকে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দ) জাপানের সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প-কলা ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের ছবিও ফুটে উঠেছে]
এক বিরক্তিকর গ্রীষ্মের সন্ধ্যা-রাতে আমি অন্যমনস্ক ভাবে বাগান ঘেরা একটা বারান্দাতে বসে ছিলাম । বাগানটা বিভিন্ন নুড়ি-পাথর আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি । মশারা যেন ছেঁকে ধরেছিল । তাদের উৎপাতে অনবরত নিজের গালে নিজেই চড় মারতে মারতে ভাবতে লাগলাম কেন যে এই খুপচি, শোরগোলে ভরপূর জায়গাতে থাকতে গেলাম ।
যদিও একটা মশার ধূপ আমার বসার জায়গার ঠিক পাশে জ্বলছিল আর তার নীল ধোঁয়া ক্রমাগত-ই আমার মুখ ও চোখের সামনে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরছিল তবুও মশক বাহিনীর কেন জানি না আমার মুখটাকে খুব পছন্দ হয়েছিল আর কেবলই আমার মুখে বসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল । আজ রাতের ডিনারে দু-এক পাত্র সস্তার সাকে(১) খেয়েছিলাম । সেই সাকের গন্ধই কি মশাদের আকর্ষণের কারণ ? না খেলেই ভাল হত । কিন্তু গলাটা ভেজানোর খুব দরকার ছিল । তাই খেয়ে ফেলেছিলাম । এখন পস্তাচ্ছি । যখন আমাকে প্রথম এই জায়গাটা দেখানো হয় তখন অনেকগুলো ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমার মনে হয়েছিল যে, এই বাড়ীটার এক ইতিহাস আছে, হয়ত বা অন্ধকার ইতিহাস-ও হতে পারে । তবুও অপেক্ষাকৃত কম ভিড় বলে জায়গাটাকে পছন্দ করেছিলাম । কিন্তু আজ একটি মহিলা কণ্ঠের নিরবিচ্ছিন্ন প্রলাপ, যা আশপাশের প্রতিটি ঘরের জন্য বিরক্তিকর শব্দের সৃষ্টি করছে সেটা কেন হচ্ছে বুঝতেই পারছিলাম না । অত্যন্ত দ্রুততার সংগে জোরে জোরে সে কিছু বলেই চলেছিল । কিন্তু কি বলছে বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না । কোনো গ্রাম্য কথ্য ভাষায় কথা বলেই চলেছিল । কেবল ‘নিই’ এই অব্যয়টি প্রায় সব বাক্যের পরই উচ্চারণ করছিল । টোকিওর ভাষায় এটা ‘নেএ’ বলা হয়ে থাকে । এই জায়গাটা ‘শিনশু’-র (২) একটা ছোটো স্টেশান ।
আমি খুব কান খাড়া করে কিছুক্ষণ শোনার চেষ্টা করলাম । কিন্তু অন্য কোনো গলার আওয়াজ আমার কানে এলো না । মনে হলো মহিলা একা একাই বকে চলেছেন । কাউকে যেন কিছু অনুরোধ করে চলেছেন ।
একটু পরে একজন বৃদ্ধ খানসামা এসে ক্ষমা চেয়ে বলে গেলেন –“ একজন খুব অসুস্থ মহিলা আছেন । তাঁর গলার আওয়াজ হয়ত আপনার অসুবিধা হচ্ছে”।
একজন খুব অসুস্থ মহিলা ? অবাক লাগল । একজন অসুস্থ মহিলা এত চীৎকার করছেন? পাগল ? কি জানি । বুঝতে পারলাম না ।
যদিও তাঁর কথা আমি বুঝতে পারছিলাম না তবুও মনে হল উনি একনাগাড়ে যেন কিছু ভিক্ষা করে চলেছেন ।
দূরে কোথাও ঘড়িতে ঘণ্টা বাজল । আমিও পকেট থেকে ঘড়িটা বার করে দেখলাম । রাত দশটা ।
ছোট্টো বাগানটা চাঁদের স্নিগ্ধ হালকা দুধ-সাদা আলোয় ভরা ছিল । আগের দিন পাহাড়ে থাকার সময়ে যে বৃষ্টিটা পেয়েছিলাম তার রেশ পুরোপুরি মিটে গিয়েছিল সকালের রোদে । তাই বাগানের রাস্তাগুলো সব শুকিয়ে গেলেও ঝোপঝাড়ে একটা ভিজে ভিজে ভাব থেকে গিয়েছিল ।
পড়ন্ত বিকেলে যখন এখানে পৌঁছেছিলাম তখন সেই বৃদ্ধ খানসামা আমাকে বলেছিলেন যে, একটু শীত শীত লাগতে পারে রাতের দিকে । আর ঠিক সেই সময়ে আমি একটা ব্যাং –কে দেখেছিলাম যেটা একদম নিশ্চল ভাবে বসে আছে । কেবল মুখটা একবার হাঁ করছে একবার বন্ধ করছে । আর মশাদের খাচ্ছে । আমার সেই ব্যাংটার কথা হঠাৎ মনে পড়ল । যে পাথরের বেসিনটার ওপর সেটা বসে ছিল, সেদিকে তাকালাম । নেই । কখন যেন চলে গিয়েছে ।
বারান্দা সংলগ্ন আট-তাতামি ঘরে(৩) প্রশস্ত কালো লাক্ষার ফ্রেমে বাঁধান একটি তোকোনোমা(৪) ছিল। সেই তোকোনোমাতে তোকুগাওয়া যুগের (৫) নাঙ্গা স্টাইলে আঁকা একটি কালো রঙের ল্যান্ডস্কেপ ঝোলানো ছিল। সরাসরি বিপরীত দিকের সম্পূর্ণ বন্ধ স্লাইডিং দরজায় চীনা তাং-যুগের (৬) কবি তু ফুর একটি কবিতা বড়,ক্যালিগ্রাফি করে লেখা ছিল । হঠাৎ যেন একটি শব্দ শুনতে পেলাম এবং দরজার দিকে তাকালাম। ঠিক তখনই আমি একটি বাঁশের স্ট্যান্ডে রাখা প্রদীপের পিছনে কবিতাটিতে লেখা “সম্প্রীতি এবং প্রশান্তি” শব্দটি দেখতে পেলাম। তারপর স্লাইডিং দরজার এক পাশ খুলে গেল এবং সেই বৃদ্ধ খানসামাটি গ্রীষ্মকালীন কিমোনো (যা য়ুকাতা নামে পরিচিত) পরে ঘরে ঢুকে আমাদের জাপানী কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসে অভিবাদন করে বললেন–
—“আমি আপনার বিছানা করে রেখেছি। যে কোন সময় ঘুমাতে চাইলে যেতে পারেন”।
—“ঠিক আছে । কিন্তু আমি এখন ঘুমাতে পারব বলে মনে হয় না। আচ্ছা, তোমার কথা বলার ধরণ এখানকার মানে এই অঞ্চলের মানুষদের থেকে বেশ আলাদা। তাই না”?
তিনি তার টাক মাথা চুলকে উত্তর দিলেন- “হ্যাঁ। আমি অল্প বয়সে টোকিওতে কিছুদিন শিক্ষানবিশ হিসাবে ছিলাম। এবং তাই হয়তবা আমার কথাবার্তাও কিছুটা ভিন্ন ধরণের হলেও হতে পারে”।
ধীরে ধীরে, ঘরে একটা নীরবতা নেমে এল । সেই মহিলা কণ্ঠটি আরও স্পষ্টভাবে শোনা যেতে লাগল। আমি আমার অজানতেই মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করলাম । এবং আমার সেই হঠাৎ মনোযোগ খানসামাটি লক্ষ্য করে বললেন–
—“আমি খুবই দুঃখিত । খুবই শোরগোল হচ্ছে”।
যে ভাবে বৃদ্ধ খানসমাটি কথা বলেছিলেন তা কেবল যে একটি সৌজন্যমূলক সাধারণ কথার কথা ছিল তা নয়, কারণ তাকে সত্যিই খুবই দুঃখিত মনে হয়েছিল, এবং আমারও তার জন্য দুঃখ হল। কৌতুহল চাপতে না পেরে আমি তাকে ভদ্রমহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, যদিও আমি জানতাম এটা অত্যন্ত অভদ্রতাজনক এবং নির্বোধ কাজ।
ততক্ষণে বৃদ্ধটি মেঝেতে তার ডান হাতের আঙ্গুলগুলি স্পর্শ করে উঠতে শুরু করেছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন “আমি কি আপনার জন্য অন্য কিছু করতে পারি?”
—“তোমার অন্য কোনো কাজ না থাকলে, আমি কি একটু কথা বলতে পারি”?
বৃদ্ধ খানসামাটি আবার হাঁটু গেড়ে বসে বললেন –“ না আমি ব্যস্ত নই । বলুন কি বলতে চান”।
—“এই রকম গ্রাম্য শান্ত-নিভৃত জায়গায় তোমরা নিশ্চয়ই তাড়াতড়ি শুয়ে পড়তে অভ্যস্ত? কিন্তু আমি তোমার সাথে গল্প করলে তোমার রাত হয়ে যাবে না? ঠিক আছে তো?”
—“না, না আপনি বলুন । হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমরা সাধারণতঃ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি । কিন্তু আজ আমার বা বলতে পারেন আমাদের শুতে রাত হবে । সে আপনি গল্প করতে না চাইলেও হবে । কাল একটা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান আছে । ব্যবস্থা শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যাবে মনে হয়”।
—“শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান? ওহো, তার মানে সম্প্রতি তোমাদের কোনো আত্মীয়-প্রিয়জনের বিয়োগ হয়েছে ? আমি সত্যিই দুঃখিত” ।
—“হ্যাঁ আগামীকাল আমাদের মালিকের মায়ের মারা যাবার ২৭দিন পূর্ণ হবে”।
—আমি সত্যিই দুঃখিত। তা এই রকম সময়ে তোমরা কেন আমাকে তোমাদের বাড়ীতে রাখার প্রস্তাবে রাজী হলে? তারপর বাড়ীতে একজন অসুস্থ মহিলাও রয়েছেন । কিন্তু এখন এসেই যখন পরেছি, কি আর করা । বাইরে বেশ ঠাণ্ডা । তুমি দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে ভেতরে এসে বসো না । একটু গল্প করি”।
—“না,না স্যার অসুবিধার কি আছে । আপনি সরকারী অতিথি । আপনারই এমন একটা জায়গায় থাকতে নিঃসন্দেহে অসুবিধা হচ্ছে । কিন্তু এটা সত্যি করেই আমাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানের । আপনাকে আতিথেয়তা দিয়ে সরকারের কিছু ঋণ তো শোধ করা গেল”।
ঋণ শোধ – কথাটা কানে লাগল ।
কথা বলতে বলতেই খানসামাটি লক্ষ্য করলেন যে, মশার ধূপটার ধোঁয়া ক্রমশ কমে আসছে । তিনি উঠে গিয়ে পাশের তাক থেকে আর একটা ধূপ নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে আবার হাঁটু গেড়ে বসলেন । আর এই গল্পটা বললেন :
“হোজুমি পরিবার একসময়ে এই অঞ্চলের তিনটি ধনী পরিবারের অন্যতম ছিল ।
তাঁরা প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক হবার ফলে সরকারকে সবথেকে বেশী ট্যাক্স দিতেন । এবং ‘হাউস্ অফ ব্যারনসের’ অন্যতম সদস্য ছিলেন । কিন্তু বর্তমান গৃহস্বামীর বাবা অনেক অল্প বয়স থেকেই সব সময়ে অসুস্থতার অছিলায় সমস্ত রকম সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন । তিনি ছিলেন শিল্প-কলা ও কবিতার একজন প্রকৃত সমঝদার ব্যক্তি । তোকুগাওয়া যুগের (১৬০৩ থেকে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দ) বিশিষ্ট কবি ‘সাকুমা শোওজানের” তিনি একজন অন্ধ ভক্ত ছিলেন । শোওজানের লেখা একটি বিখ্যাত বই ‘সেইকেনরোকু’ (আমার বিভ্রান্তির প্রতিচ্ছবি) আমরণ সবসময় তাঁর সংগী ছিল । এই বইটির কবিতা চীনা ভাষায় লেখা ।
এ ছাড়াও পূর্বতন গৃহস্বামীর দুটি বিপরীত ধারণা ছিল । একদিকে উনি বৌদ্ধধর্মের অন্ধ ভক্ত ছিলেন । আবার উনি মনে করতেন যে, এখন থেকে মানুষের পশ্চিমী সভ্যতার অনুগামী হওয়া বিশেষ প্রয়োজন । তা হলেও ক্রিশ্চান সংস্কৃতিকে একদমই গ্রহণ করা উচিৎ নয় । ক্রিশ্চান ধর্মগ্রন্থও উনি পড়েছিলেন । এবং বিশ্বাস করেছিলেন যে, ক্রিশ্চান ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের ধারকাছ দিয়েও যায় না । আর তা মানুষের সার্বিক উন্নতিও করতে পারে না । কিন্তু অবশ্যই উনি পশ্চিমী সভ্যতার অনুরাগী ছিলেন ।
যাই হোক উনি আমাদের মত সাধারণ মানুষদের বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সারমর্ম ব্যাখ্যা করতেন আর বলতেন জীবনে চারটি জিনিষকে সদা-সর্বদা শ্রদ্ধা করবে ও পূজা করবে । সেই চারটি জিনিষ হল –বাবা-মা, সম্রাট, প্রাণী জগৎ, বৌদ্ধধর্মের ত্রিরত্ন (বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ)”।
এবার আমি বুঝতে পারলাম কেন খানসামাটি “ঋণশোধ” কথাটি ব্যবহার করেছিলেন । ওনার মধ্যেও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ভাল পরিমানেই ছিল ।
খানসামাটি আবার বলতে শুরু করলেন:
“পূর্বতন গৃহস্বামীর স্ত্রীও খুব সংবেদনশীল, সহানুভূতিপ্রবণ ও বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন । তিনি তাঁর স্বামীর সব রকম কাজে সহযোগিতা করতেন এবং তাঁর কথা মেনে চলতেন । আমাকে আর অন্যান্য যে সব কাজের মানুষ ছিলেন বাড়ীতে প্রত্যেককে সমান সম্মান দিতেন । আগামীকাল সেই মহিলারই মৃত্যুর ২৭দিনের অনুষ্ঠান । তিনি ৮০ বছর বেঁচে ছিলেন । মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন ১০জন করে ভিখারীকে ২৫ সেন (জাপানের মুদ্রা, ১০০ সেন বর্তমানের ১ ইয়েনের সমান) করে দান করতেন । সাম্প্রতিক কালে জেলা সদর থেকে প্রকৃত গরীবদের নাম নথিভুক্ত করে এই বাড়িতে পাঠাত দান নেবার জন্য । আড়ালে বাড়ির চাকর-বাকররা তাদের মসকরা করে বলত- ম্যাডামের বিশিষ্ট অতিথি । কিন্তু সেইসব লোকেদের অসম্মান করার ক্ষমতা কারোরই ছিল না ।
দূর্ভাগ্যবশতঃ ওই মহানুভব দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না । বহুদিন নিঃসন্তান থাকার এক বেদনা ওনাদের দুজনকেই ব্যাথিত রাখত । অবশেষে মেইজি যুগের প্রথম বছরে (১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে) গিন্নিমা ৪০ বছর বয়সে সন্তান-সম্ভবা হলেন । ওঁরা দুজনেই অসম্ভব খুশী হলেন । কিন্তু নাগানো৭ থেকে যে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে তাঁরা ডাকলেন তিনি ৪০ বছরে প্রথম সন্তান সম্ভবা মহিলার দায়িত্ব নিতে দ্বিধা করায় সকলেই নানা আশঙ্কায় সময় কাটিয়েছিলেন । শেষ পর্যন্ত সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আমাদের বর্তমান মালিক ‘চিতারু’ জন্মালেন । সেই সময় (১৮৬৮ খৃষ্টাব্দ) জাপানে শিক্ষা ব্যবস্থার এক বিশাল পরিবর্তন হল । প্রাইমারি স্কুল চালু হওয়া, প্রতিটি শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি পূর্বতন গৃ্হস্বামীকে আপ্লুত করল । তিনি সম্রাটকে এই ব্যপারে অভিনন্দন পত্রও পাঠিয়েছিলেন । আর ঠিক সেই সময়েই আমিও ব্যবসাদার হবার আশায় তৎকালীন মালিকের এক বন্ধু, যিনি টোকিওর নিহোনবাসিতে বড় পাইকারি ব্যবসা করতেন তাঁর কাছে কাজ শিখতে গেলাম । সেটাও মালিকেরই দয়ায় । তারপর একটা সময় এল । সেটা সাৎসুমা বিদ্রোহের৮ চার বা পাঁচ বছর পর মানে ১৮৮১/৮২ খৃষ্টাব্দ। আমি যে পাইকারি বিক্রেতার কাছে কাজ শিখতাম তাঁর কোম্পানীর সরকারের কাছে জিনিষ সরবরাহ করে এক বিশাল অঙ্কের মুনাফা হল । সেই সাফল্যের প্রায় পুরো কৃতিত্বই আমার বলে বিবেচনা করে সেই পাইকারি বিক্রেতা মহাশয় আমাকে একটা দোকানের সার্বিক মালিক বলে ঘোষণা করলেন এবং আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন যাতে আমি আরও মন দিয়ে কাজ করি ও অন্য কোথাও চলে না যাই ।
আমিও খুব খুশী হলাম । এতদিনে থিতু হবার সুযোগ আসছে ভেবে । কিন্তু এক ছন্দপতন হল । সেই সময়ে, আমাদের পূর্বতন গৃ্হস্বামী একদম আচমকাই হার্ট-অ্যাটাকে মারা যান ৬৪ বছর বয়সে । উনি ওনার স্ত্রীকে মৃত্যুর সময়ে বলে গিয়েছিলেন যে, ‘এবার থেকে সেইকিচির ওপর নির্ভর করো’-সেইকিচি আমারই নাম। সেই যে মালিকের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এলাম আর যাই নি । সেই থেকেই এই হোজুমি পরিবারের সব ভাল-মন্দের সাথে জড়িয়ে, সব দায়িত্ব নিয়ে এখানেই রয়ে গিয়েছি । বিয়েও করা হল না আর। পূর্বতন মালিকের কথার মর্যাদা রেখে চলেছি তখন থেকেই । তখন গিন্নিমা পঞ্চাশোর্ধ হলেও আমাদের বর্তমান মালিক তখন সবে প্রাইমারী স্কুল শেষ করে মিডল-স্কুলে ঢুকেছেন ।
বর্তমান গৃহস্বামী চিতারু অত্যন্ত বাধ্য, শান্ত ছেলে ছিলেন । পড়াশুনায় অসম্ভব মেধাবী ছিলেন । বাবার সাধ পূরণ করার জন্যে আমাদের গিন্নিমা চেয়েছিলেন যে, তাঁদের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী শেষ করুক । মিডল স্কুলে পড়ার সময়ে চিতারু একটু দূরে তাঁর বাবার এক বন্ধুর মঠাবাসে থেকে পড়াশুনা করতেন । গ্রীষ্মের ছুটিতে বা নববর্ষের ছুটিতে যখন তিনি বাড়ি ফিরতেন তখন গিন্নিমা থেকে শুরু করে বাড়ীর সকলেই আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠতেন ।
কিন্তু ক্রমশঃই চিতারু ভীষণ রুগ্ন, রোগা এক বালকে পরিণত হয়ে যাচ্ছিলেন । একটু বেশী পড়াশুনা করলেই হাঁপাতে থাকতেন । এমনকি দু-একবার স্কুলে অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিলেন । তখন সহপাঠীরা সংগে করে সেই মঠাবাসে পৌঁছে দিয়ে আসতেন । এমত অবস্থাতেও খুব ভাল নম্বর নিয়ে মিডল স্কুল পাশ করে গেলেন টোকিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার জন্য । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই অ্যাডমিশন টেস্টে পাশ করলেন না । প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ার ফলে শরীর আরও খারাপ হতে লাগল । যাই হোক অবশেষে নিজেই মনে জোর এনে টোকিওর ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যলয়ের কারিগরি শিক্ষাক্রমে ভর্তি হলেন । চিতারুর মত একজন বুদ্ধিমান মেধাবী ছাত্রের কারিগরি শিক্ষাক্রমে ভর্তি হওয়াটা আমরা বাড়ীর কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারি নি । কিন্তু অগত্যা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম ।
হঠাৎ করেই চিতারু সামরিক বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য ডাক পেলেন । পরীক্ষা দিয়ে পাশও করলেন । কিন্তু আবারও বাধ সাধল তাঁর স্বাস্থ্য । স্বাস্থ্য পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেন না। খুব মন খারাপ নিয়ে বাড়ী ফিরে এলেন ।
চিতারু বাড়ী ফেরার পর আমি লক্ষ্য করলাম যে, পড়াশুনায় ওনার যাই হয়ে থাক না কেন উনি খুব ভাল মানুষ তৈরী হয়েছেন । শিক্ষিত, মার্জিত, সুক্ষ ভদ্রতা বোধ সম্পন্ন একটা মানুষ । হোজুমি পরিবারের মত একটা পরিবারের জন্য যেটা খুবই প্রয়োজন । তাই আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিতারুর বাড়ী ফিরে আসাতে খুশীই হয়েছিলাম ।
তখন আমি বৈষয়িক অন্যান্য কাজে চিতারুকে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করলাম । কিন্তু তিনি একদমই তার বাবার স্বভাব পেয়েছিলেন । তাঁর কথা হল সেইকিচি তো বরাবরই সব দেখছেন । এখানে আমি মাথা গলাব না ।
…চিতারু বাড়ী ফিরে আসার ঠিক এক বছর পরে তিনি বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করেন । পাত্রী ছিলেন অপেক্ষাকৃত কম বিত্তবান পরিবারের মেয়ে । নাম তোয়ো । তোয়ো অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন । এমনকি একবার জাপানের এচিগো জেলার এক বাসিন্দা বলেছিলেন যে, যদিও এচিগো জেলা সুন্দরী মহিলাদের জায়গা বলে খ্যাত, কিন্তু সেখানেও তোয়োর মত সুন্দরী দেখা যায় না । তোয়ো টোকিও থেকে স্কুলের পড়া শেষ করেছিলেন । গুজব ছিল যে, চিতারু টোকিওতে পড়তে গিয়েছিলেন বলেই তোয়োও টোকিওতে পড়তে গিয়েছিলেন । ওদের মধ্যে কিছু রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল বলে গুজব ছিল । যদিও তার আগে কালে ভদ্রে অনুষ্ঠান উপলক্ষে চিতারু এবং তোয়ো র পরিচিতি হয়েছিল । ছেলের পছন্দকে সম্মান জানিয়ে গিন্নিমাও এই বিয়েতে রাজী হলেন । কন্যাপক্ষ প্রস্তুতই ছিল । বিয়ে নির্বিঘ্নে শেষ হল । সকলে আনন্দ করল । সমালোচনা করল, আলোচনা করল । প্রশংসা করল । সবই হল । কিন্তু আমার চিতারুকে দেখে একটু খটকা লাগল । যেমনটা হওয়া উচিৎ বা স্বভাবিক সেটা যেন হচ্ছে না ।
বিয়ের পরদিন । সকালের জলখাবারের সময় । হোজুমি পরিবারের ডাইনিং টেবিলে গিন্নিমা আর চিতারু পাশাপাশি বসতেন । পূর্বতন মালিক মারা যাবার পর থেকে গিন্নিমা আমাকেও ওদের সাথে একই সংগে খেতে বলে দিয়েছিলেন । এটা নিঃসন্দেহে আমার কাছে একটা বিশাল সম্মানের বিষয় ছিল । সেদিন চিতারু একদিকে তার মা অন্যদিকে তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে বসে । সেটাই তো স্বাভাবিক । আমিও ছিলাম । হোজুমি পরিবারের বহুদিনের প্রথা মত সেদিনও গিন্নিমা পাড়া-প্রতিবেশীদের কথা, তাদের প্রশংসা, নিন্দা, নানারকম খোশগল্প করছিলেন । সেদিন নিয়মিত সদস্যরা ছাড়াও আরও অনেক আত্মীয়-বন্ধু ছিলেন । হঠাৎ করেই নববিবাহিতা কাউকে কিছু না বলেই উঠে চলে গেল । সকলেই খুব অবাক হল । ঠিক সেই ঘটনাই ঘটল দুপুরের খাবার সময় । এমনকি রাতে খাবার পরও একই ঘটনা ঘটল ।
পরেরদিন থেকে বউরাণী দেরী করে খাবার ঘরে এলেন আর খাওয়া হয়ে গেলেই কাউকে কিছু না বলেই, গল্পে কোনো অংশ না নিয়েই চলে গেলেন । তখন চিতারু তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করল যে সে কেন এমন আশ্চর্য্য ব্যবহার করছে । তার উত্তরে বউরাণী সকলকে অবাক করে দিয়ে বললেন যে, তিনি শাশুড়ীমার এবং অন্যান্যদের ওই আনতাবড়ি বকবকানি শুনতে বাধ্য নন । গিন্নিমা শুনে একদম চুপ করে গেলেন । অমন হাসিখুশী মানুষটা এক্কেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল । সেইদিন থেকেই হোজুমি বাড়ীতে অকারণ স্তব্ধতা নেমে এল”।
আমি যখন এত অব্দি গল্পটা শুনলাম তখন সেই স্লাইডিং দরজাটা আবার খুলে গেল । আর একজন ৪০ বছর মত বয়সী অতি সম্ভ্রান্ত চেহারার পুরুষ গাঢ় রংয়ের কিমোনোর ওপর সিল্কের জ্যাকেট পরে ঘরে ঢুকলেন । খুব ধীর এবং অনুতপ্ত গলায় বললেন-
“ আমি এই বাড়ীর বর্তমান মালিক । চিতারু হোজুমি । ডক্টর, আমি খুবই দুঃখিত যে আপনি আমার সম্মানিত অতিথি হওয়া সত্ত্বেও আমি এর আগে আপনার সাথে দেখা করতে আসতে পারি নি । আপনাকে সেইকিচি নিশ্চয়ই জানিয়েছে যে, কাল আমার মার মৃত্যর ২৭দিনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান”।
হঠাৎ করেই অত সম্ভ্রান্ত মানুষটি কেমন যেন বিভ্রান্তের মত হয়ে বললেন – “আসলে গত দু সপ্তাহ ধরে আমার ওপর দিয়ে অসম্ভব মানসিক চাপ যাচ্ছে । আমি না আপনাকে রাখতে চাই নি । আপনার কষ্টের কথা ভেবে । কিন্তু সেইকিচি বলল যে….”।
বলে বিভ্রান্ত ভাবে সেইকিচির দিকে তাকালেন ।
… “ আমাদের না, একটার পর একটা বিপদ এসে গেছে । তাই সেইকিচি বলল যে, আমরা যদি আপনার মত একজন বিখ্যাত জ্ঞানী ডাক্তারকে আমাদের বাড়ীতে থাকার জায়গা দি তাহলে হয়ত আপনি আমাদের কোনো সাহায্য করলেও করতে পারবেন । আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই স্বার্থপরের মত কাজ করার জন্য”।
আমার ভদ্রলোকের জন্য খুব করুণা হল । বুঝলাম না কি এমন ব্যাপার ।
উনি কেমন একটা বিভ্রান্তি নিয়ে বলে চললেন – “ সেইকিচি নিশ্চয় আপনাকে বলেছেন যে, আমি ছোটোবেলা থেকেই আমার মাকে খুব জ্বালিয়েছি অসুখে ভুগে, পড়াশুনায় আশানুরূপ ফল না করে । তাই ভেবেছিলাম যে, আমি এবার থেকে মাকে শান্তিতে রাখব, নিশ্চিন্ত রাখব । কিন্তু আমার হাসি-খুশি প্রাণবন্ত মা আমার বিয়ের পরে প্রায় নির্বাসিত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন আমার পছন্দ করে বিয়ে করা স্ত্রীর জন্য । হ্যাঁ , আমি ভেবেছিলাম আমার স্ত্রীকে ডিভোর্স করব । কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম । আর এখন তো আইন-কানুনও বেশ কড়াকড়ি । আর সত্য বলতে কি আমার স্ত্রীর তো কোনো দোষ ছিলনা । উনি শুধু আমার মায়ের ব্যবহার সহ্য করতে পারতেন না । সেটা তো আর কোনো ডিভোর্সের কারণ হতে পারে না । তার মধ্যে আমাদের পরিবারের একটা খ্যাতি আছে । এইসব ডিভোর্স-টিভোর্স হলে পেপার টেপার-এ বেরোবে । আত্মীয় স্বজনদের কাছে করুণার পাত্র হতে হবে । সব ভেবে আমি আমার মার কষ্টের দিকটাকে গৌণ করে দেখেছিলাম ।
আর এই সেইকিচি নিশ্চয় করেই ভেবেছে যে আমি স্ত্রৈণ বা মোহগ্রস্ত । কিন্তু আমি স্ত্রৈণ বা মোহগ্রস্ত কোনোটাই ছিলাম না । কেবল পরিবারের কথাই ভেবেছিলাম । তাছাড়াও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী ডিঙ্গোতে পারি নি । পারিবারিক সম্পত্তিতে জীবন কাটচ্ছি । নিজের রোজগারের কোনো ব্যবস্থা করতে পারি নি । সব কিছু মিলে কেমন একটা গুটিয়ে গিয়েছিলাম আমি ।
যাই হোক প্রায় ১৩/১৪ বছর এই ভাবে কাটানোর পরে আমার মা ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন । আচমকাই আমার স্ত্রীও পাগল হয়ে গেলেন । আমি জানি না আর কি কি অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে” ।
চিতারু হোজুমি তার কান্না ছল ছল লাল চোখে আমার দিকে তাকালেন । কি বা বলব আমি বুঝতে পারছিলাম না । ওদিকে দূরের কোনো ঘড়িতে ১১টার ঘণ্টা বাজল ।
বললাম—“ তাহলে যিনি চীৎকার করছিলেন তিনি আপনার স্ত্রী””
—“হ্যাঁ । প্রতিদিন রাত ১১টা পর্যন্ত ওনাকে থামানো যায় না । উনি কিছু একটা ভিসুয়ালাইজ করেন । আর সেটা নিয়েই কথা বলে যান । ওকে থামান যায় না যতক্ষণ না উনি নিজে ক্লান্ত হয়ে যান” ।
…জিজ্ঞাসা করলাম—“ সেইকিচির কাছে শুনলাম আপনার মায়ের বিস্তারিত গল্প বা গাল-গল্প আপনার স্ত্রী পছন্দ করতে পারেন নি বলেই ওনাদের বিরোধ । কিন্তু আসল কথাটা কি ছিল এই বিরোধের তা জানতে পারি কি”?
—“ এটা সত্যই খুব খেলো এবং বোকা বোকা ব্যাপার । আমার স্ত্রী মনে করতেন পৃথিবীতে কোনো ভাল মানুষ নেই । সব্বাই শয়তান । যদিও বা একজন দুজন থেকেও থাকেন এই জগতে তাঁরা আমাদের পরিচিত বৃত্তের মধ্যে যে কেউ থাকবেন এমনটা না হওয়ার সম্ভাবনা-ই কম । অন্য কাউকে প্রশংসা করাটা তখনই হয় যখন কোনো স্বার্থ থাকে । আবার যখন কারো নিন্দা করা হয় তখনো তা করে হয় মশকরা করার জন্য বা মজা করার জন্য । তাই চুপ করে থাকাটাই তিনি শ্রেয় মনে করেন । হঠাৎ জানেন তো আমার মধ্যেএকটা মিরাকেল হল” ।
“গত বছর আমার স্কুলের এক বন্ধু এসে আমাদের বাড়ীতে কদিন কাটাল আর এক অদ্ভূত গল্প শোনাল । সে বিবাহিত । তার স্ত্রী আর অনেক ছেলে-মেয়ে । তার স্ত্রীও কারো কোনো কথা শোনে না । নিজে যা ভাল মনে করে করে যায় । এমনকি বুদ্ধ বা খৃষ্ট কাউকেই পাত্তা দেয় না । আমার বন্ধুর স্ত্রীও টোকিওর মহিলা স্কুলেরই প্রাক্তনী । বন্ধুর একটা অদ্ভূত ধারণা হয়েছে যে, টোকিওর স্কুলে পড়াশুনো করা মেয়েরা সবাই ওই রকম । ওরা মনে করে সব সময়েই ওরা অত্যাচারিত । স্কুল পাশ করা মেয়েরা ভাল হয় না । হয় হীনমন্যতা বা উন্নাসিকতায় ভোগে । মেয়েদের বাড়ীতে পড়াশুনা করাই ভাল । আমি অবশ্য ওর কথা মেনে নিতে পারলাম না । শিক্ষা কেন একজনকে অবিবেচক করে তুলবে । আপনি নিশ্চয়ই সেইকিচির কাছে শুনেছেন আমার বাবা নারী শিক্ষা, পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাবে জীবনকে উন্নত করা ইত্যাদির জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন । আমি নিজেও তাই-ই ভাবতাম । সেরকমটা ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলাম । কিন্তু আমার বন্ধু আর আমার পারিপার্শ্বিকতা আমার ধারণাকে সম্পূর্ণ পালটে দিচ্ছিল । আমি আমার বন্ধুর সাথে তর্ক করলাম যে, শিক্ষা যদি একটি ছেলের মানসিক বিকাশ ঘটাতে পারে তো একজন মেয়ের কেন সেটা হবে না ? কিন্তু আমার বন্ধুর মনে মেয়েদের অকারণ অযৌক্তিক ব্যবহারের জন্য শিক্ষাই দায়ী সেই ধারণা একদম বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল ।
সে আমাকে বোঝাতে লাগল –পুরুষরা যুক্তিবাদী এবং তারা সুবিধা এবং অসুবিধার আইন সম্পর্কে সচেতন থাকে যা সমাজ পরিচালনা করে। সে আরও বলল যে,এমনকি মহিলাদের মধ্যেও সম্ভবত যারা যুক্তিবাদী তারা একই। কিন্তু এই ধরনের মহিলার সংখ্যা অতি নগন্য।
…বন্ধু বলল যে, যখন একটা বাচ্ছা লাল আগুন দেখলে সে দিকে হাত বাড়ায় আমরা তো তার হাত চেপে ধরি । কারণ সে বোঝে না লাল আগুনটা দেখতে সুন্দর হলেও তা ভয়াবহ । সেই আগুন থেকে কতটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে তা শিশুর জানা নেই । মহিলারাও তাই । পড়াশুনা থেকে কতটা শিক্ষা নিতে হবে আর কতটা বাদ দিতে হবে জানেই না । অযোক্তিক ব্যক্তিত্ব। আচ্ছা, ডক্টর আপনার কি মনে হয় ? আমি শুনেছি জার্মানীতে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকরা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বেত দিয়ে চাবকায় । এমনকি ওখানে স্বামীরাও স্ত্রীদের চাবকায় । সেটাকে কি ভাল বলে মনে করেন”?
আমি মনে মনে হাসলাম । আমারও তো মনে মনে একটাই প্রশ্ন । কিছুদিন আগে একটা ফরাসী পত্রিকায় পড়েছি যে, ইংরেজদের সমাজে বেত দিয়ে চাবকানো বাচ্চাদের ও সংসারের রাশ ধরার এক সঠিক পদ্ধতি । এই প্রসঙ্গে জর্জ বার্নাড শ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই বলে যে, বেত দিয়ে কাউকে চাবকানো এক সামাজিক অবমাননা ।
চিতারু খুব হতাশ মুখে বললেন —“তাই নাকি । কিন্তু এখন আমার মনে হয় যেভাবেই হোক না কেন, যদি নির্দিষ্ট সময়ে আমার স্ত্রীকে আঘাত করার মতো যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি থাকত, তাহলে সম্ভবত সে এখনকার মতো হয়ে উঠত না। একজন ভদ্রমানুষের পক্ষে এই কথাটা বলা অত্যন্ত অশোভনীয় । কিন্তু এখন এটাই আমার বিশ্বাস । তাতে আমার মা এবং স্ত্রী দুজনারই বোধহয় ভাল হত”।
আমি এত শিক্ষিত মার্জিত সুসভ্য একজন সম্ভ্রান্ত মানুষের এই রকম অবাক করা মানসিকতা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম —“ আপনার কি মনে হয় আপনার স্ত্রীর এই উন্নাসিক মানসিকতাই তাঁর পাগলামির কারণ”?
উনি চুপ করা রইলেন । যেন উত্তর দেবার কিছু নেই ।
এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা সেইকিচি এবার মুখ খুললেন –-“ঘটনাটা ঘটে গিন্নিমা মারা যাবার সাত দিনের মাথায় । সেদিন ওনার সাত দিনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান । বউরাণী নিয়মানুযায়ী বাড়ীর বুদ্ধাসনে (ঠাকুরের আসন) ধুপ দিতে গেলেন । আর ঠিক সেইখানে, মানে বুদ্ধের সিংহা্নের ঠিক নীচে, যেখানে গিন্নিমার ছবিটা রাখা ছিল সেখানে একটা বিশাল সাপ ফণা তুলে ফোঁস করে উঠল । বউরাণী ভয় পেয়ে চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন । তারপর যখন জ্ঞান এলো তখন থেকেই এই পাগলামি চলছে । সাপটাকে তো আমরা ওঝা ডেকে কিছু অল্প বয়সী সাহসী ছেলেদের দিয়ে বাগানে বের করে চাপা দিয়ে রেখে দিলাম । পরদিন কিন্তু সাপটা আবারও ওই এক-ই জায়গায় চলে এসে গিন্নিমার ছবির পাশে বসে ছিল । এখনও আছে । আর আমরা তাড়াই নি । আমাদের বিশ্বাস গিন্নিমা সাপের প্রতিরূপে আমাদের মধ্যে এসেছেন । বউরাণীর কাছ থেকে যে মানসিক আঘাত উনি জীবিতাবস্থায় পেয়েছিলেন আর নিঃশব্দে সহ্য করেছিলেন তার শোধ নিয়েছেন বউরাণীর স্বাভাবিক জীবন ধারণ বন্ধ করে দিয়ে । এমনকি বউরাণীর নিজেরও মনে হয় সে রকম ধারণাই হয়েছে”।
আমার বৈজ্ঞনিক মনে ধাঁধাঁ লাগাল ।
বললাম—“সাপটা কি এখনও আছে”?
—“সম্ভবতঃ । সন্ধ্যে বেলা পর্যন্ত ছিল । আমরা আর কেউ ওকে সরাই না । কাউকে কিছু বলছে না তো । চুপচাপ শুয়ে আছে । শুধু বউরাণীকেই ……”।
আমি হাতের সিগারেটটা ফেলে সাপটাকে দেখতে চাইলাম ।
সেইকিচি আমাকে তাদের বুদ্ধাসন (ঠাকুরের আসন)-এর কাছে নিয়ে গেল । বৌদ্ধ বেদীর ভিতরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম বিশাল বুদ্ধ মূর্তি বেদীর উপর দাঁড়িয়ে আছেন। রয়েছে একটা মেমোরিয়াল ট্যাবলেট বা সদ্য-মৃতার উদ্দেশ্যে প্রতার্পিত বাণী । একটি বড় তামার ধূপ বার্নারে একটি ধূপকাঠি জ্বলছে। যেদিকে ধূপ জ্বালছে সেদিকে দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে একটি সাপ আছে।
একটি বড় নীল সাধারণ সাপ। ভয়ঙ্কর পুষ্টিকর এবং মোটাসোটা । লেজটিকে শরীরের সামনের দিকে প্রায় পাঁচ ইঞ্চি দেখা যাচ্ছে, যেটা শরীরটাকে মুড়িয়ে আছে।
আমি বৌদ্ধ বেদীর ছাদের দিকে তাকালাম। চওড়া, সূক্ষ্ম সাইপ্রাস বোর্ডের তৈরী, কিন্তু কালের গতিতে এটি পুরানো এবং কালো হয়ে বিকৃত হয়ে গিয়েছে।
বৃদ্ধ সেইকিচি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুদ্ধের নাম জপ করছে। মালিক স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো হাঁটছেন, অন্য একজন যিনি ওদের অনুসরণ করে এসেছিলেন তিনি মালিকের পিছনে অস্পষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি সেইকিচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞসা করলাম— “কাছাকাছি চালের গুদাম আছে কি”?
—“হ্যাঁ। একটি গুদাম আছে যা দরজার সামনে করিডোরের দিকে ঠিক একটা ঘর পার হয়ে” ।
—“এটা সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। পশুপাখি সহজেই অভ্যাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়,এবং একবার তারা যদি কোনো জায়গাকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে তো সেখানেই থেকে যেতে চায় । বেড়িয়ে গেলেও আবার সেখানেই ফিরে আসে। এতে অদ্ভুত কিছু নেই। এতে কিছু ভুল নেই। তবে এই সাপটি চালের গুদাম থেকে এখানে কি করে এল বলতে পারব না । যাই হোক, আমি এই সাপটি আপনাদের কাছ থেকে নিয়ে যাব। ভয়ের কিছু নেই । এর সাথে আপনাদের মৃতা গিন্নিমারও কোনো যোগ নেই বলেই মনে করছি”।
বৃদ্ধ চোখ গোল করে দেখল। বলেই ফেলল–“বিদায়,অল্প বয়সী ওঝাদের ডাকব”?
—“না। আমি সাপ ধরতে পারি। যদি এটি একটি বিষাক্ত সাপ হত তাহলে একটি লাঠি আমার দরকার ছিল। তাই দিয়ে ঘাড় চেপে ধরে পেঁচিয়ে কাবু করতাম। কিন্তু এটি তথাকথিত নীল সাধারণ সাপ। লাঠির দরকার নেই। আমার লাগেজে একটা মাছ ধরার খালুই আছে । সেই খালুইটাতে গতকাল পাহাড়ী জলা থেকে ধরা কিছু ট্রাউট বা রোহিত মাছ আছে । তুমি দয়া করে আমাকে সেই খালুইটা এনে দেবে ?”
সেইকিচি সংগে সংগেই খালুইটা এনে দিল । আমি সাপটার লেজের দিকটা শক্ত করা ধরে মাথাটা নীচের দিকে করে ঝুলিয়ে দিলাম । সাপটা প্রবলভাবে আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নিতে লাগল । আর সেই অবকাশে আমি ক্ষিপ্রতার সংগে ওটাকে খালুই-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম । ঘড়িতে তখন রাত বারোটার ঘণ্টা বাজছে ।
সবাই শান্তির, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল । একটা সাধারণ জিনিষকে কেন্দ্র করে কত ভীতিই না তৈরী হয়েছিল সকলের মধ্যে । ওঁদের বউরাণীমা বিশাল সাপটাকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে মানসিক ভারসাম্যতা হারিয়েছিলেন । অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাপারই সেখানে যে নেই তা ওঁদেরকে বোঝাতে পেরেছিলাম কিনা জানিনা ।
যাইহোক, পরদিন সকালে বিদায় নেবার সময়ে জানতে চাইলাম বউরাণীমার চিকিৎসা করা হচ্ছে কিনা? শুনলাম নাগানো থেকে একজন সিভিল ডাক্তারকে দেখান হচ্ছে । টোকিওর একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবার অনুরোধ করলাম । মালিক ও খানসামা দুজনেই বিভ্রান্তির চোখে তাকাল । এত সম্ভ্রান্ত বাড়ীর বউরাণীর মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা ? তাহলে বাড়ীর সম্মান ? কি আর বলব ?
*১ । জাপানী সুরা । চাল থেকে তৈরী । বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও ব্যবহার করা হয় ।
*২। শিনশু নাগানো প্রিফেকচারের একটি শহরতলি অঞ্চল ।
*৩। তাতামি – (Tatami ) একধরনের মাদুর যেটা প্রথাগত কায়দায় তৈরী জাপানী বাড়ীতে মেঝে করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে । তাতামির মাপ হয় ০.৯ মিটার X ১-৮ মিটার ।
*৪। তোকোনোমা—তোকোনোমা জাপানী বাড়ীর একধরণের কুলুঙ্গি । তাতে লম্বা করে কোনো ছবি, কবিতা, ফুলদানী, ইকেবানা ইত্যাদি সাজানো থাকে । বেশির ভাগ জাপানী বাড়ীরই গৃহসজ্জার এক অংগ এই তোকোনোমা ।
*৫। তোকুগাওয়া যুগ—এদো যুগ বা তোকুগাওয়া যুগ (১৬০৩ থেকে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দ) জাপানের সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প-কলাতে উৎকর্ষ যুগ বলে পরিচিত ।
*৬।–তাং যুগ —তাং যুগ (৬১৮ থেকে ৯০৬ খৃষ্টাব্দ) চীনা সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলে চিহ্ণিত । তাং যুগের বিশ্বজনীন নামডাক, বৌদ্ধধর্মের ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রচারের জন্য এই যুগের খ্যাতি।
*৭। নাগানো জাপানের হোনশু-দ্বীপের একটি প্রিফেকচার । নাগানো, পাহাড়ে ঘেরা উষ্ঞ-প্রসবণের জন্য বিখ্যাত একটি জায়গা ।
*৮। সাৎসুমা বিদ্রোহ বা সেইনানের যুদ্ধ– মেইজি যুগের নবম বছরে অর্থাৎ ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দ নাগাদ- জাপানের নতুন সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে এটি ছিল অসন্তুষ্ট সামুরাইদের বিদ্রোহ।
[অনুবাদক, পূরবী গঙ্গোপাধ্যায় জাপানী ভাষার প্রশিক্ষক । পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষা প্রতিষ্ঠানে জাপানী পড়ানর সুযোগ তিনি পেয়েছেন । বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ও কালচারের জাপানী ভাষার প্রশিক্ষক । এবং সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক । এছাড়াও জাপানী থেকে বাংলা ও ইংরেজী এবং বাংলা ও ইংরেজী থেকে জাপানীতে নিয়মিত অনুবাদের কাজেও যুক্ত]