আট নম্বর মেয়ে – ফেরেস্তা ঘানি অনুবাদ – দীপাঞ্জন মজুমদার

আট নম্বর মেয়ে – ফেরেস্তা ঘানি অনুবাদ – দীপাঞ্জন মজুমদার

শেয়ার করুন

[লেখক পরিচিতি: ফেরেস্তা ঘানি একজন আফগানি লেখক। আফগানিস্তান–পাকিস্তান সীমান্তের কুনার জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি লেখালেখি করছেন। ইস্কুলে থাকতে থাকতেই তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তিনি আফগানি মহিলা লেখক সমিতির সদস্য। বছর খানেক আগে তালিবানদের প্রচার মাধ্যমের ওপর জোরজুলুম ও হুমকি দেওয়ার সময় ফেরেস্তা ঘানি দেশত্যাগ করেন। সেইসময় তিনি রেডিও আজাদীতে সাংবাদিকতা করতেন। বর্তমানে তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে তাজিকিস্তান-এ থাকেন।]

বিকেল হয়েছে। মগরিবের নামাজের এখনও অনেক দেরি। খিদে পেলেও কিছু করার নেই, কারণ আমি উপোস রেখেছি। আমার পা’দুটোয় খুব একটা জোর নেই, হাতগুলো কাঁপছে। সারা রান্নাঘরে চুপচাপ শান্ত ভাব। কুকারের সিটির শব্দে হঠাৎই চারপাশ খান্‌খান্‌ হয়ে গেল। ভয়ে আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, পাঁচটা বেজে সতেরো মিনিট হয়েছে। উনুনে মাংস চাপানো। আগুনের আঁচটা একটু কমিয়ে দেওয়া উচিত। এক আঁটি পালংশাক এক্ষুণি কেটে ধুয়ে রান্না করে রাখতে হবে। অতিথিরা যে কোনো সময়ে চলে আসতে পারে। রান্নাঘর জুড়ে জিনিসপত্র ছড়ানো। চারপাশে কেমন দম-বন্ধ-করা অবস্থা। শাকের আঁটিটা খুলে পাতাগুলো পরিষ্কার করার পর, একটা বড়ো ছুরি হাতে নিলাম সেগুলো কাটার জন্য। কাটতে কাটতে পালংশাকের উপরে রাগ জাহির করে ফেলি, তখন কাটার জোর এমনিই বেড়ে যায়। শাক রান্না হবার আগেই আমি ভাত নিয়ে ভাবতে শুরু করি; এখনই চাল ভিজিয়ে রাখলে পরে ভালো সিদ্ধ হবে।

হায় আল্লা, কোনো কাজই আজ ঠিক মতো হচ্ছে না। কীভাবে যে সবকিছু সামলাব কে জানে। বড্ড ভয় করছে। কেউ যেন হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে বুকের মধ্যে। ভাতের হাঁড়িটা পর্যন্ত ছেড়ে যেতে পারছি না। তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করতে হবে। মাংসের গন্ধ এসে নাকে লাগল–প্রায় সিদ্ধ হয়ে এসেছে। খিদেও পাচ্ছে খুব। উপোস ভাঙার পরে একটু খেতেই হবে। আল্লা আমার উপোস কবুল করুন। আপনার রহমত আমার উপরে ছড়িয়ে পড়ুক। এবার যেন ছেলে হয়, আর আমার কীই বা চাওয়ার আছে। ভাগ্যিস কাল রাতে ঢ্যাঁড়স আর বেগুনের তরকারি রান্না করে রেখেছি। এখন একটু গরম করে নিলেই দিব্যি খাওয়া যাবে।

পাশের ঘরে আমার শাশুড়ি আর ননদ বেশ জোরে কথা বলছে। এখান থেকে ওদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ওদের যে কীসের এত কথা!–আমি মনে মনে ভাবি। আল্লাই জানে শারিফা আর নাজানিন এখন কোথায়। আট মাসের পোয়াতি আমি, অথচ একবারও কেউ আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। আমার মন বলছে এবার ছেলে হবে, কিন্তু ভয়ও হচ্ছে; কোনো অঘটন না ঘটে বসে। খুব মিষ্টি গলায় কথা বলছে কেউ, কার গলা? ওহ্‌ এ আমার সেজ মেয়ে, বাসমিনা; স্যালাডের প্লেটগুলো সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। ওর ছোটো ছোটো হাতগুলো দেখতে আমার এত ভালো লাগে। ও যখনই আমার জন্য কিছু করে, আনন্দে আমার মন ভরে ওঠে।

শাক আর মাংস রান্না শেষ। কিন্তু এত বড়ো ভাতের হাঁড়িটা আমি একা তুলব কী করে? শরীর যেন ভেঙে আসছে। কেউ একজন একটু আসলে পরে কত ভালো হত! শেষবার যখন পোয়াতি হই, জলের বালতি তুলতে গিয়ে খালার কাছে ধমক খেতে হয়েছিল। এই হাঁড়িটা তার চেয়েও বড়ো।

মসজিদে আজান শুরু হয়েছে। হয়তো পাশের ঘর থেকে হঠাৎই কেউ বেরিয়ে এসে ভাতের হাঁড়িটা তুলে দেবে। ততক্ষণে বরং উপোস ভেঙে ফেলি। সবে এক কামড় বসিয়েছি, তখনই আমার বড়ো ননদ রান্নাঘরে এসে বলল, “বাহ্‌, দারুণ! যাদের নেমন্তন্ন তারা এখনও এসে পৌঁছল না আর তুমি হ্যাংলার মতো গিলতে আরম্ভ করেছ!”   

আমার মুখের খাবার এখন গলায় আটকে আছে। এত ভয় পেয়ে গেছি যে সেটা গিলতে পর্যন্ত পারছি না। থালাটা সরিয়ে রাখলাম–এর পর আমার আর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আমার যা কিছু বলার তা শুধু মনের মধ্যে জমছে। মা বলেন যে শ্বশুরবাড়িতে কখনও তর্ক করতে নেই, সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। আমার ননদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর আমার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।

একটা বড়ো সসপ্যান পরিষ্কার করে সেটা স্টোভের ওপরে রাখলাম। স্টোভের আঁচ দিলাম বাড়িয়ে। আমার জীবন এই ফুটন্ত জলের মতো, যা কিছু আনন্দ ছিল তা এই ধোঁয়ার মতো আস্তে আস্তে উড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ভাতটা একটু নরম হয়েছে। জানালার বাইরে তাকালাম, কিন্তু হাঁড়িটা নামিয়ে রাখার মতো কাউকে দেখতে পেলাম না। বেশ, তাহলে আমিই নামিয়ে রাখি। কী আর এমন হবে।

হাঁড়িটা তুলতেই শিরদাঁড়া জুড়ে শিন্‌শিন্‌ করে উঠল। দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে এখন গড়িয়ে পড়ছে জল। ভাতের মাড় গেলে, তাতে তেল মশলা মিশিয়ে আবার সেটা তুলে রাখলাম স্টোভের উপরে। আগুনের আঁচ একেবারে অল্প। আমার পা দুটো প্রায় অবশ হয়ে এসেছে। পেট আর কোমরের ব্যথাটা হঠাৎই এত বেড়ে গেল যে ইচ্ছে হল চিৎকার করে উঠি। টাল সামলাতে না পেরে, পা পিছলে আমি মেঝের উপরে পড়লাম। ঠিক তখনই রান্নাঘরের দরজাটা খুলে গেল। আমার সবচেয়ে ছোটো দেওর, হাসমত, সেখানে দাঁড়িয়ে; সে বলছে, “রান্না হয়ে গেছে? অতিথিরা চলে এসেছে কিন্তু।”

রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকতেই হাসমত দেখতে পেল যে আমি মেঝের উপরে পড়ে আছি। শুনতে পেলাম, সে বলছে, “বৌদি, কী হয়েছে?” আমার চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে, ভালো করে একবার দেখে নিয়ে, সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘরের বাইরে। একটু পরে দেখি, আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাশুড়ি আর বড়ো ননদ।

শাশুড়ি বলল, “নাটক করতে পার বটে। রান্না করতে যখন এতই অসুবিধা তখন আগে বললেই পারতে। বলি তুমি মরে গেলে গ্রামে মুখ দেখাব কী করে? কুটুমদেরই বা কী বলব?” আমার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। হাসমত তার মা আর দিদির উপরে রেগে গিয়ে কিছু একটা বলছে, কিন্তু আমি ঠিক শুনতে পেলাম না। এবার আমি হয়তো মরে যাব। বুঝতে পারলাম আমায় গাড়িতে তোলা হচ্ছে। এখন আমি পেছনের সিটে শুয়ে আছি। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।

*  *   *

হাসপাতালে আজ আমার তৃতীয় দিন। চারপাশে নানা রকমের গন্ধ। আমার এক হাতে স্যালাইন চলছে। প্রসবের ব্যথায় যে সমস্ত মহিলারা চেঁচিয়ে উঠছে, তাদেরকে ধমক দিতে এগিয়ে আসছে একজন নার্স। প্রত্যেক মহিলার চোখে আমি যন্ত্রণা দেখেছি। আমার ঠিক পাশের বেডের মহিলা এখন তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। তাকে দেখে আমার নিজের বাচ্চার কথা মনে পড়ে গেল। নার্সকে ডেকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার বাচ্চা কোথায়?”

নার্স আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে, তার ঠোঁট দুটো ঢেকে রয়েছে গোলাপি লিপস্টিকে। আমার ফাইলটা হাতে নিয়ে সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর কোনো কথা না বলে সেখান থেকে হঠাৎই চলে গেল। প্রায় আধাঘণ্টা পরে সে যখন ফিরে এল, তাকে সেই একই প্রশ্ন করে ফেললাম।  

সে বলল, “আপনার বাচ্চাটা খুবই দুর্বল, তাই তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। ডাক্তার আপনাকে সব বলবে।”

সঙ্গে সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি, “আমার মেয়ে হয়েছে না ছেলে?”

একটু ভেবে সে উত্তর দিল, “আমি ঠিক জানি না। ডাক্তার এলে তাকে জিজ্ঞাসা করবেন।”

আমার ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। আমি মনেপ্রাণে চাই যে আমার ছেলে হয়েছে। আল্লা নিশ্চয় এবার আমার প্রার্থনা শুনেছেন, কিন্তু আমার যদি মেয়ে হয়ে থাকে তাহলে আমি কী করব? আমার জীবন তো নরক হয়ে যাবে। আমার বুক এখন রীতিমতো ধড়ফড় করছে। আল্লা, আমার প্রার্থনা যেন সত্যি হয়। আমার যেন ছেলে হয়ে থাকে। তোমার দিব্যি আমি গরিবদের ভালো কিছু দান করব। তোমার দিব্যি দরগায় যাব, উপোস রাখব। 

পাশের বেডের মহিলার কাছে সময় জানতে চাইলাম। এগারো’টা বাজে, অথচ এখনও আমি আমার বাচ্চাকে দেখতে পাইনি। ডাক্তারেরও কোনো দেখা নেই। নিজের হাতের দিকে তাকালাম। সারা হাতে কালশিটে পড়ে গেছে। এরকম হল কীভাবে? মনে হয় গত কয়েক দিন, যখন খুব অসুস্থ ছিলাম, আমার হাতে অনেক বার ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে।

একজন বয়স্ক ব্যাটাছেলে আর একজন বয়স্ক মহিলা ঘরের মধ্যে এসেছে। মনে হয় এরা হাসপাতালের লোক। না না, ভুল বললাম। পাশের বেডে যে মহিলা শুয়ে রয়েছে তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে এরা। বাকি রুগিরাও চিৎকার করছে, কিন্তু পাশের এই মহিলার চিৎকার এত বেশি যে মনে হচ্ছে আমার মাথাটা এবার ছিঁড়ে পড়ে যাবে।

এতক্ষণে ডাক্তার-ম্যাডাম এসেছেন। আমাদের ঘরে একজন ব্যাটাছেলে ঢুকেছে দেখে তিনি ভীষণ বিরক্ত, “তোমাদের না হাজারবার বলেছি, বাইরের কোনো পুরুষমানুষ এলে এখানে ঢুকতে দেবে না? কোনো কথাই কি তোমরা বোঝো না?” রীতিমতো চিৎকার করে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা। ওনার রাগ দেখে আমার বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে যখন কথা বলতে গেলাম, ততক্ষণে উনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেছেন। এখন উনি চিৎকার করছেন সেই মহিলার উপর যে রুগিদের ঘরে বাইরের লোকজনকে ঢুকতে দেয়।

উফ্‌, আমি কী করব? ঘরের ভিতর থেকে কাবাবের গন্ধ ভেসে আসছে, আর এদিকে খিদের জ্বালায় নেতিয়ে পড়ছি আমি। হাসপাতালের দু’জন কর্মচারী ঘরের ভিতরে এসে সবাইকে ভাত-তরকারি আর একটা করে কলা দিয়ে যাচ্ছে। আমার পাশের বেডের মহিলা ঝুঁকে পড়ে তার অংশের কিছুটা খাবার দিতে চাইল। তার বারবার বলা সত্ত্বেও সেই খাবার আমি ছুঁয়ে দেখলাম না। খিদে আমার পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনো খাবার আমার গলা দিয়ে এখন নামবে না। এবারও যদি আমার ছেলে না হয়ে থাকে আমার জীবন বিষাক্ত হয়ে যাবে। মাথার মধ্যে শুধু এই চিন্তাই ঘুরতে থাকে। খাবারের থালাটা একপাশে সরিয়ে রেখে আমি এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

কোনো এক বাচ্চার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেল। একজন পেশেন্টের সবে বাচ্চা হয়েছে, তার আরও একটা বাচ্চা আছে, এক কি দেড়’বছর বয়স হবে তার। এই বাচ্চাটাই গোটা ঘরে সবচেয়ে বেশি কাঁদছে। আমি তার মা’কে ডেকে বললাম যে ছেলেটাকে বাড়িতে রেখে এলেই তো হত। উত্তরে মহিলা বলল যে বাড়ির লোকেরাই তাকে হাসপাতালে দিয়ে গেছে; মা’কে দেখতে না পেয়ে সে ক’দিন ধরে কেঁদেই চলেছিল। বাচ্চা ছেলেটার মা’র দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, “আল্লা ওর মঙ্গল করুক।”

দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। এখনও আমি আমার বাচ্চার কোনো খবর পাইনি। বাথরুম ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি আমার নেই। ডাক্তাররা ভিজিটের সময়ে বলে গেছে যে আমার এখন শুধু বিশ্রাম করা উচিত, কিন্তু নিজের বাচ্চাকে ছেড়ে কোনো মা কি শান্তিতে শুয়ে থাকতে পারে? এ কেমন বিচার?

সকালে একজন অল্পবয়স্কা ডাক্তার ঘরে এলেন। বেশ সতেজ আর সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে, তার মাথায় বাঁধা ছিল এক আকাশি রঙের স্কার্ফ। “আমার বাচ্চা কি এখন ভালো আছে?” আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। “ও কেমন আছে? ও কি ছেলে হয়েছে না মেয়ে? নার্স বলল যে আমার বাচ্চা নাকি খুব দুর্বল, ওকে না কি ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে?”

ডাক্তার আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, “আল্লার পরম দয়া যে আপনার বাচ্চা এখনও বেঁচে আছে। ও যা দুর্বল হয়েছিল, আমরা তো ভাবলাম যেকোনো মুহূর্তে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। কী করেছিলেন সত্যি করে বলুন তো?”

উত্তরে বললাম, “আমার খালা বলেছিল পেটে বাচ্চা এলে ক’দিন উপোস রাখতে, তাতে হয়তো ছেলে হতে পারে।”

সুন্দরী ডাক্তার খুবই রেগে গেছে। “এই আপনারা উপোস করবেন আর দোষ হবে ডাক্তারদের। বাচ্চা দেওয়ার সময় পেশেন্ট মরে গেলে সমস্ত দোষ গিয়ে পড়বে আমাদের ওপর। পেটে বাচ্চা এলে কেউ কখনও উপোস করে? কী করে যে এরা বেঁচে থাকে কে জানে?” রাগের চোটে সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। আমার বুকের ধড়ফড়ানি এখন শতগুন বেড়ে গেছে। আমকে যে করেই হোক জানতে হবে যে আমার ছেলে হয়েছে না মেয়ে।

কয়েক সেকেণ্ড বাদে একজন নার্স এসে জানিয়ে দিয়ে গেল—যাদের বাচ্চা ইনকিউবেটরে আছে তারা আজ বিকেলের মধ্যেই বাচ্চা পেয়ে যাবে। আমার হাত-পাগুলো রীতিমতো কাঁপছে। তখন পাশের বেডের পেশেন্টকে ঘন ঘন সময় জিজ্ঞেস করছিলাম। নিজের বাচ্চাকে আমি এখনই দেখতে চাই, আমার আর তর সইছে না।

দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমার একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না। পাশের বেডের মহিলা বলল, “একটু  অন্তত খেয়ে নাও। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হবে তো, শরীরে শক্তি না এলে পারবে না।” ইচ্ছা না থাকলেও আমি খাওয়া শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালের বয়স্ক মহিলা কর্মচারী চলে এল এঁটো থালাগুলো নিয়ে যেতে। 

সারাদিন ঘর জুড়ে শুধু গুনগুন শব্দ; আমি বেডে শুয়ে শুনতে পাই যে মহিলারা নিজেদের মধ্যে গল্প করে চলেছে। কাল রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। এ নিয়ে হাসপাতালে আমার পাঁচ দিন হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ডাক্তাররা আমার বাচ্চাকে দিয়ে গেছে; এবার আমি নাকি বাড়ি যেতে পারব। আমার বড়ো ভাসুর আর জা আমায় নিতে এসেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, “আমার ছেলে হয়েছে তো?”

তারা এখন নীচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আমি তার শরীরে জড়ানো কাপড়টা তুলে দেখলাম; আমার মেয়ে হয়েছে।

নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এলাম, সঙ্গে রয়েছে বড়ো ভাসুর আর তার বৌ। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেছে, হাত-পাগুলো কাঁপছে। জানি না খুব ঠান্ডা পড়েছে কিনা, না কি আমি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেছি। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, “তুই ছেলে হলে কীরকম হতিস? মনে হচ্ছে বাড়ি ফেরার আগে এখানেই মরে যাই।”

*   *    *

বাড়ির কাছে আসতেই কানে এল নাচগানের শব্দ। প্রথমে মনে হল পাশের বাড়ির ছেলেটার হয়তো বিয়ে ঠিক হয়েছে। না, শব্দটা আসছে আমাদের বাড়ির ভেতর থেকে। বাহ্‌, তার মানে আমার ছোটো দেওরের আজ বিয়ে—আমি মনে মনে ভাবলাম। তা-ও ভালো, বিয়ের আনন্দে সবাই মেতে থাকবে। মেয়ে হওয়া নিয়ে আমাকে তেমন কথা শুনতে হবে না।

বাড়ির উঠোনে যেই ঢুকতে যাব, আমার কাছে দৌড়ে চলে এল আমার ছোটো মেয়ে। তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তার মুখ অপরিষ্কার, সালোয়ারের খুঁট দিয়ে তার নাক মুছে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাড়িতে কী হচ্ছে মারওয়া?”

সে তার সরল মিষ্টি গলায় বলল, “জানি না মা। সবাই কী সুন্দর সাজগোছ করেছে। এই দ্যাখো আমার নতুন জামা।” কী হচ্ছে জানার জন্য আমার মন উসখুস করে উঠল।

ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা আমার মাথায় শুকনো মিষ্টি আর মুড়কি ছড়িয়ে আমায় বরণ করে নিল। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। বিশ্বাস করতে পারছি না যে মেয়ে হওয়ার পরেও এরা আমাকে এত আপ্যায়ন করছে, অভিনন্দন জানাচ্ছে। নিজের অজান্তেই, আজ প্রায় এতদিন পর, আমি হেসে ফেললাম। সবাইকে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, হঠাৎই আমার বাঁ-পাশ থেকে একজন বলে উঠল, “জীবনে এই প্রথম দেখছি যে কোনো মেয়ে নিজের বরের বিয়েতে খুশি হতে পারে।”  

মনে হল যেন পায়ের উপরে কেউ ফুটন্ত জল ঢেলে দিল। পায়ে কোনো শক্তি নেই, গলার কাছে প্রচণ্ড যন্ত্রণা, চোখদুটো শুকনো। আমি ধপ্‌ করে মেঝের উপরে বসে পড়লাম। আরেকটু হলে আমার কোল থেকে মেয়েটা হড়কে পড়ে যেত; পাশের এক মহিলা ঠিক সময়ে বাচ্চাটাকে ধরে নিয়েছে। ওর চিৎকার এখন আমার কাছে অসহ্য মনে হল। ওর মুখ পর্যন্ত আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। চুপ করে বসে রইলাম, বুঝতে পারছি আমার মনের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে।

চারপাশে বড্ড আওয়াজ, বড্ড চেঁচামেচি। মহিলাদের কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরে থাকলেও আমি এখনও আমার ভাবনার জগত থেকে পুরোপুরি বেরোতে পারিনি। হঠাৎ মাইওয়ান্দকে ঘরে ঢুকতে দেখে, ছুটে গিয়ে তার মুখের উপরে থুতু ছিটিয়ে ফেলতেই, ও বেশ জোরে আমার গালে এক থাপ্পর মারল। আমি মেঝের উপরে ছিটকে পড়লাম। বুঝলাম ও ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে।

নার্গিসের চাচী তার মেয়ে, পালশাওয়াকে, ডেকে বলল যে সে যেন আমার জন্য দুধ গরম করে নিয়ে আসে; আমার সবে বাচ্চা হয়েছে, তাই। মেয়েটা কোনোমতে আমায় ধরে তুলল। সারা রান্নাঘর জুড়ে বাসনকোসন ছড়ানো। পালশাওয়া স্টোভে দুধ চাপিয়ে হঠাৎই বেরিয়ে গেল; পাশের ঘর থেকে গানবাজনার শব্দ ভেসে আসছে। আমি খুব বিরক্ত হলাম। মনে হল আওয়াজটা এত বিচ্ছিরি যে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।   

স্টোভের দুধ এখন ফুটছে।

দুধের বাটিটা তুলে নিজের মাথায় ঢেলে ফেলতেই আমি ছিটকে পড়লাম মাটিতে। সারা শরীর জ্বলে উঠল।

কয়েকজন মহিলা রান্নাঘরে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন দৌড়ে এসে আমায় তুলে ধরল। “বেচারির বর আবার বিয়ে করেছে”–কথাগুলো বলার সময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।

আরেকজন মহিলা, যার গলা বেশ ভারী, বলে উঠল, “মেয়েটার ভাগ্য খুব খারাপ। আট বারের বারও সেই মেয়ে হল। আহা রে, বেচারি।”

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২