তৌফিক জায়েদ ও সামি আল-কাসেমের কবিতা তর্জমা: সোহেল ইসলাম

তৌফিক জায়েদ ও সামি আল-কাসেমের কবিতা তর্জমা: সোহেল ইসলাম

শেয়ার করুন

[তৌফিক জায়েদ: প্যালেস্তানীয় নেতা, কবি, সক্রিয় বামপন্থী কর্মী, নাজারেথের মেয়র এবং সমাজ আন্দোলের সঙ্গে যুক্ত তৌফিক জায়েদের জন্ম ১৯২৯ সালের ৭ মে প্যালেস্তাইনের নাজারেথে। চার ভাইবোনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা জায়েদের পড়াশোনা শুরু হয় নাজারেথ সরকারি বিদ্যালয় থেকে। মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই জায়েদ রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে পড়েন। ব্রিটিশদের ইহুদিপ্রেম এবং প্যালেস্তাইন দখল জায়েদের শৈশবকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৪৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে ইহুদিপন্থী ব্রিটিশ নীতির প্রতিবাদে এক ছাত্র আন্দোলন রাস্তায় নেমেছিল। ১৯৪৮ সালে পুরো প্যালেস্তাইন জুড়ে নাকবা শুরু হলে তিনি ওই বছরই ইজরায়েলের দখলকৃত মাটিতে ইজরায়েল কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। এরকম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই চল্লিশের দশকের শেষের দিক থেকে তৌফিক জায়েদ কবিতা লিখতে ও ছাপতে শুরু করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের দিকে কবিতাকেই তিনি প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। শুধুমাত্র তৌফিক জায়েদ নন আমরা প্যালেস্তাইনের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে ঘাটতে গেলে দেখব, অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে কবিতার এক বড়ো ভূমিকা রয়েছে। কবিতার পংক্তি হয়ে উঠেছে স্লোগান। দেওয়ালে, পোস্টারে, প্ল্যাকার্ড-এ জায়গা করে নিয়েছে কবিতা। আবার জায়েদের কথায় ফিরে আসা যাক,১৯৫৪ সালে জায়েদ আররাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করলে ইজরায়েলি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে এবং শান্তি ভঙ্গ করা ও পুলিশের উপরে হামলা করার অভিযোগে তাঁর ৪০ দিনের কারাদণ্ড হয়, এই সময়টায় তিনি টিবেরিয়াস কারাগারে ছিলেন।

প্রতিরোধের কবিতা ও তার রূপ তৌফিক জিয়াদের লেখালেখির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। তিনি বিশেষভাবে তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে ভেতরের ক্ষোভ ও প্রতিবাদকেই তুলে আনতেন। তিনি আজীবন মাতৃভূমি প্যালেস্তাইনের জন্য ইজরায়েলের বিরোধিতা করে গেছেন। ১৯৬০ এর পর থেকেই তিনি সমগ্র আরব জুড়ে প্যালেস্তাইনের ‘বিপ্লবী কবি’ হিসেবে পরিচিতি পেতে আরম্ভ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ইহুদিদেরও অধিকার রক্ষার অধিকার রয়েছে, তবে তা কখনোই প্যালেস্তানীয়দের অধিকার কেড়ে নিয়ে নয়। প্যালেস্তাইনের লেখক, আন্দোলনকর্মী, শরণার্থী ঘাসান কানাফানি, তাঁর ‘দখলকৃত প্যালেস্তাইনের প্রতিরোধ সাহিত্য ১৯৪৮-১৯৬৬’ নামের প্রবন্ধে মাহমুদ দারবিশ, সালেম জুবরান, সামি আল-কাসেমের সঙ্গে তৌফিক জায়েদকেও প্যালেস্তাইনের ‘প্রতিরোধের কবি’ বলে উল্লেখ করেছেন। কানাফানি জায়েদ নিয়ে বলতে গিয়ে আরও বলেন যে, প্রতিরোধের পরিস্থিতিই জায়েদ ও জায়েদের কবিতার জন্ম দেয়।

আজীবন বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী তৌফিক জায়েদ ১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে মারা যান, কিন্তু তাঁর কবিতা প্যালেস্তাইনের মাটিতে এবং প্যালেস্তানীয়দের মধ্যে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে থেকে গেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটা বই হল―Harder on Your Hands, Bury Your Dead and Rise, Songs of Revolution and Anger, Communists, Words of a Fighter.]

আগুন

আমরা অনায়াসে
আলো দিয়ে অন্ধকারের গিঁট খুলতে পারি
যত্নে লালন করতে পারি স্বপ্ন
পাম গাছের ছায়ায় ঠান্ডা করতে পারি
গরম বালি

যদি কোনোদিন হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই
আমাদের শেকড়
ঠিক সোজা করে দাঁড় করাবে
কেন-না
আমরা পিঁপড়ের কাছে শিখেছি
কীভাবে দলবেঁধে বাঁচতে হয়

মনে রেখো
আমরা কোনও ফুলকি নই
চুল্লির আগুন
জানি, কীভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে হয়

আমাদের বিশ্বাস দিগন্তের মতো
আমরাই ইতিহাসের ঘোড়াকে ছুটিয়েছিলাম

তুঁত গাছ

যখন ওরা
তুঁত গাছকে মাড়িয়ে এগোতে থাকল
গাছটা একটাই কথা বলেছিল:
তোমরা যা ইচ্ছে করতে পারো
কিন্তু মনে রেখো
ফল দেওয়ার অধিকার কেবল আমার
তোমরা তা কখনই কেড়ে নিতে পারবে না

আমার আছে

আমি কখনও কাঁধে করে
বন্দুক বয়ে বেড়াইনি
টিগারও টানিনি কোনওদিন

আমার একটা বাঁশি আছে
আছে সুর
স্বপ্ন আঁকার তুলি আছে
রং আছে
আর আছে বিশ্বাস ও ভালোবাসা

কষ্টে থাকা আমাদের দেশের মানুষগুলোর জন্য


[সামি আল-কাসেম: লেখক, কবি ও সাংবাদিক সামি আল-কাসেমের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১১ মে জর্ডনের জারকাতে, যা বর্তমানে জর্ডনে অবস্থিত। কিন্তু জন্ম সাল নিয়ে বলতে গিয়ে সামি আল-কাসেম উল্লেখ করেন, তাঁর জন্ম 1948 সালে, কেন-না এই বছরই তাঁর প্যালেস্তাইন ইজরায়েল দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর এই বছরই তাঁর প্যালেস্তাইনকে বন্দি করা হয়। ‘প্যালেস্তাইন যখন আক্রান্ত হয় তখন আমি নাজারেথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। সেই স্মৃতি ও ছবি কোনোদিনই আমাকে ঘুমোতে দেয়নি।’ তাঁর অধিকাংশ লেখাই নাকবা ও তার পরবর্তী স্মৃতিকে ঘিরে উঠে আসা।

জন্মভূমি প্যালেস্তাইনের হয়ে কথা বলা ও ইজরায়েলের বিরোধিতা করার অপরাধে ১৯৬০ সালের পর থেকে তাঁকে বেশ কয়েকবছর জেলে কাটাতে হয়। জেল থেকে বেরিয়েও দীর্ঘদিন গৃহবন্দির জীবন কাটাতে হয়েছে আল-কাসেমকে। ১৯৬৭ সালে অর্থাৎ প্যালেস্তাইনের মাটিতে ইজরায়েল দ্বারা ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ শুরু হলে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি হাদাশে যোগদান করেন। যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই ইজরায়েলি পুলিশ তাঁকে আটক করে এবং ড্যামন কারাগারে স্থানান্তর করে। ‘ছয়দিনের যুদ্ধ’ শেষে ইজরায়েল জয় লাভ করলে, প্যালেস্তানীয়রা ইজরায়েল ছেড়ে প্যালেস্তানীয় ভূমিতে চলে যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু আল-কাসেম হাজার কষ্ট-অত্যাচার সহ্য করেও পরিবার নিয়ে ওখানেই থেকে গেছিলেন। এই থেকে যাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে আল-কাসেম জানান, ‘রামেই আমার জন্মভূমি, রামেই আমার প্যালেস্তাইন, ইজরায়েল হয়তো যুদ্ধে জিতে আমার জন্মভূমিকে দখল করেছে ঠিকই, কিন্তু আমার প্যালেস্তাইনকে ও আমাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না।’

আল-কাসেম ১৮ বছর বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম কবিতা সংকলনের নাম ‘সূর্যের মিছিল’। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দু-দুটো যুদ্ধ তাঁর লেখায় জাতীয়তাবাদ নিয়ে আসে। প্রথম বই থেকেই তা সামনে আসতে আরম্ভ করে। পরবর্তীতে তাঁর এই লেখা ‘প্রতিরোধী তরুণ কবি’-র আখ্যা এনে দেয়। প্রতিরোধের কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে আল-কাসেম জানান, এটা আমার উপরে সম্পূর্ণ চাপিয়ে দেওয়া, সারাজীবনের চাপিয়ে দেওয়া সব কিছুর মধ্যে এই বিষয়টাই আমাকে আনন্দ দিয়েছে।

তাঁর কবিতা, নাটক, উপন্যাস ও রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলোতে যেভাবে প্যালেস্তাইন জায়গা করে নিয়েছে একইভাবে জায়গা করে নিয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক হিংসা, ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আন্দোলন। তিনি মনে করতেন গোটা বিশ্বজুড়ে দখলদারি চলছে। এর বিরুদ্ধে কলম ধরা উচিত। তিনি এক সাংবাদিকের করা প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আমার জন্ম কবিতার জন্য বন্দুকের জন্য নয়, আমার কলম আছে, তাই আমার বন্দুকের দরকার নেই।

দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে কবি আল-কাসেম ২০১৪ সালের ১৯ অগাস্ট নিজের বাসভবন রামেইতে মারা যান। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটা বই হল – Sadder Than Water, All Faces But Mine, Victims Of Map, Just An Ashtray.]

জেলারের সঙ্গে কথোপকথন

গাছগুলো আমাকে দেখে হাসছে
আর জেলের ছাদে
পরিবার নিয়ে ভিড় করছে

যে জানালা দিয়ে
এসব দেখছি আমি
সেই ছোটো জানালাটাও চোখে জল নিয়ে
প্রার্থনায় বসেছে
আমার জন্য

টিকিট

আমাকে যেদিন হত্যা করা হবে
হত্যাকারী আমার পকেট হাতড়ে পেয়ে যাবে
ক’টা টিকিট

একটা শান্তির
একটা খোলা মাঠের
একটা বৃষ্টির
আর অবশ্যই একটা মানবতার

প্রিয় হত্যাকারী
সময় নষ্ট কোরো না
তারচেয়ে বরং হত্যা করো আমাকে
আর টিকিট নিয়ে বেরিয়ে যাও ভ্রমণে

তুমি চাইলে

তুমি চাইলে আমাকে হারাতে হতে পারে প্রতিদিনকার খাবার
হারাতে হতে পারে বিছানা-বালিশ
তুমি চাইলে
আমাকে পাথর ভেঙে দিন গুজরান করতে হতে পারে
করতে হতে পারে কুলির কাজ
কিংবা সুইপারের

খিদের জ্বালায় হয়তো পশুর গোবর তুলে নেব হাতে
কিংবা অনাহারে ভেঙে পড়ব
নগ্ন হয়ে পড়ে থাকব রাস্তায়
তবুও আমি আপোষ করব না
শেষ পর্যন্ত লড়াই জারি রাখব

চাইলে শেষ মাটিটুকুও কেড়ে নিতে পারো
জেলে পুড়ে রেখে দিতে পারো আজীবনের জন্য
পূর্বপুরুষের
যে ক’টা আসবাব, জামাকাপড়, বাসনপত্র আছে
তাতেও আগুন লাগিয়ে দিতে পারো
জ্বালিয়ে দিতে পারো
আমার কবিতা
আমার বই

তোমার পোষা কুকুর দিয়ে
ছিঁড়ে, খুবলে নিতে পারো আমার মাংস
ঘুমের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারো দুঃস্বপ্ন

আপোষ আমি করব না
শেষদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবো

আমাদের জন্য সুসংবাদ ও উল্লাস অপেক্ষা করছে
অপেক্ষা করছে আনন্দ আর গান
নৌকার পাল বাতাসকে উপেক্ষা করে এগিয়ে আসছে
সমুদ্রের গভীরতা আজ তার কাছে তুচ্ছ
এ যেন সূর্যের প্রত্যাবর্তন
এ যেন ক্ষমতাচ্যুতদের প্রত্যাবর্তন

আমি তাদের হয়ে শপথ করছি
আপোষ আমি করব না
লড়াই চলবে শেষ পর্যন্ত

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২