গরুমারার অন্দরমহলে – প্রবুদ্ধ বসু
গরুমারা জাতীয় উদ্যান এর চারটি বিট, ‘যাত্রাপ্রসাদ’ নজর মিনার, ‘মেদলা’, ‘চুকচুকি’ ও ‘খুনিয়া’। মেদলা টাওয়ারের সবচেয়ে নিকটবর্তী হল ‘কালীপুর ইকো ক্যাম্প’ ও ‘রামসাই ইকো রিসর্ট’। ২০১১ সাল, লাটাগুড়ির বনবিভাগের সামনে প্রায় মাঝরাত থেকে লাইন দিয়ে মেদলা ওয়াচটাওয়ারের টিকিট জোগার করা গেল। জীপ সাফারি করে পৌঁছোলাম যাদবপুর চা-বাগানের উলটো দিকে অবস্থিত কালীপুর বনবস্তি। এখানে বন ও বসতির গলাজড়াজড়ি। এখান থেকে মোষের গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় মেদলা ওয়াচ টাওয়ার। এইখানেই গড়ে উঠেছে বনবিভাগের তৈরি করা ইকো ক্যাম্প। ‘কালীপুর ইকো ক্যাম্প’। সেই প্রথম দেখি গরুমারা অন্দরমহলে লুকিয়ে থাকা ক্যাম্পটিকে। অভয়ারণ্যের গা-ঘেঁষে বিস্তৃত সবুজ ঘাসের লনের উপর বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি চারটি কটেজ। মাঝখানে ডাইনিং রুম। ‘মধুয়া’ ও ‘চেপটি’ এই দুটি কটেজ ডাইনিং রুম সংলগ্ন ও ‘মালশা’ ও ‘ধাঁদ্দা’ নামক দুটি কটেজ পৃথকভাবে অবস্থিত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে করমর্দন করা যায় গরুমারা জঙ্গলের গাছপালার সাথে। কটেজের উলটোদিকেই দিগন্তব্যাপী চা বাগান। ক্যাম্পটির অবস্থানগত সৌন্দর্য ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমাকে পাগল করে তুলেছিল। অস্বীকার করব না প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ি তার। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকার পার্মিসন নেই, ওয়াচ টাওয়ার দর্শন করেই ফিরে যেতে হবে। এদিকে বাকি পর্যটকদের চিৎকারে প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেইদিনই উপলব্ধি করেছিলাম অরণ্যকে সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করার জন্য প্রয়োজন নির্জনতার, একাকিত্বের। মনে মনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই আবার ফিরে আসার। যদিও কালীপুর বনবাংলোর কাছে ফিরে আসতে আমার লেগেছিল প্রায় সাত বছর।
২০১৮, ডিসেম্বর। ভুটান রোড ধরে এগিয়ে, বড়ো রাস্তা থেকে বাঁদিকে নেমে প্রবেশ করলাম জংলি পথে। গাড়ির জানালার কাচ নামাতেই নাকে ভেসে এল বুনো গন্ধ। ফরেস্ট চেক পোষ্টে, নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র দেখিয়ে আবার যাত্রা শুরু। শাল, শিমুল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পৌঁছেছিলাম ‘কালীপুর ইকো ক্যাম্প’। এই সাত বছরে পরেও সে একই রকম রূপবতী। এবার, শুধুমাত্র দেখা করে চলে যাওয়া নয়, একটি সম্পূর্ণ নিশিযাপন। আমরা থাকব ‘মধুয়া’ কটেজে। ঘরে মালপত্র রেখেই বেরিয়ে এলাম ডাইনিং সংলগ্ন বারান্দায়। চেয়ারে বসে শুধুমাত্র জঙ্গলের দিকে চেয়ে থেকে কাটিয়ে দেওয়া যায় পুরো দিন। কটেজের সামনে বনদপ্তরের তৈরি পদ্মপুকুর। এখানে আড্ডা জমেছে রঙ-বেরঙের পাখির। পদ্মপাতার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘ব্রোঞ্জ টেইলড জাকাণা’। পুকুরটিকে ঘিরে রয়েছে সার দেওয়া কাঞ্চন ফুলের গাছ। মাঝে মাঝেই নাকি এই জলাশয়ে বন্য পশুরা আসে তেষ্টা মেটাতে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম সবুজ ঘাসের লনে। মখমলে সবুজ ঘাসের উপর এলিয়ে দিলাম শরীর। চোখের সামনে এখন শুধু নীল আকাশ। মনে পড়ে গেল বিভূতিভূষণের আরণ্যক “পেয়ালার মতো উপুড় করা নীল আকাশের তলে মাঠের পর মাঠ, আরণ্যের পর আরণ্যে, যেখানে তৈরি রাজপথ নাই, ইটের ঘরবাড়ি নাই, মোটর হর্নের আওয়াজ নাই।”
বনবস্তির ছেলেমেয়েরাই পর্যটকদের দেখভাল করে। ভাত, ডাল, ঝুড়ি আলু ভাজা ও স্থানীয় মাছের ঝোল দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সম্পন্ন করা হল। গেটের বাইরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মোষের গাড়ি। তাদের মধ্যে একটি আমাদের জন্য নির্দিষ্ট। বাকিগুলো লাটাগুড়ি থেকে ডে-ভিজিটে আসা পর্যটকদের জন্য। আমরা মোষের গাড়িতে না উঠে প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য হেঁটে যাওয়াই স্থির করলাম। বাঁদিকে গরুমারা জঙ্গল ইলেকট্রিক ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা আর ডাইনে যাদবপুর চা বাগান। হাঁটার রাস্তায় বিভিন্ন জংলি ফুল ও প্রজাপতির মেলা বসেছে। মিনিট দশেক হাঁটার পরই একটা চড়াই রাস্তা শুরু হয়। মোষের গাড়ি ওই পর্যন্তই আসে। বাকি পথটা হেঁটে আপনাকে নজর মিনার পৌঁছতে হবে। এই রাস্তাটি ভীষণ সুন্দর। ডানদিকে বহমান মূর্তী নদী, বাঁদিকে গভীর অরণ্য। পথে প্রচুর গাছ। নজর মিনার থেকে পর্যটকদের চিৎকার ভেসে আসছে, আর ভেসে আসছে আশেপাশের গাছ থেকে অসংখ্য পাখির কলতান। আমরা পাখির কলকাকলি শোনাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে নজর মিনার থেকে কিছুটা দূরে এই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। পাখিদের মধ্যে দেখলাম কয়েক প্রজাতির ব্যাবলার, বার থ্রোটেড মিনলা, পায়েড ফ্লাই ক্যাচার, গ্রে হেডেড ক্যানারি ফ্লাই ক্যাচার। একদল পুরুষ ও স্ত্রী স্কারলেট মিনিভেট এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে গেল। তাদের গায়ের উজ্জ্বল লাল ও গাঢ় হলুদ রং যেন অরণ্যে আগুনের ঝলক ছড়াল। ‘রোজ-রিংড প্যারাকিট’ মাথার উপর দিয়ে তীব্র স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে। এদিকে নজর মিনারের থেকে চিৎকারের তীব্রতা ক্রমশই বাড়ছে। সল্টলিকে একটি গন্ডার তার শাবক সহ নুন আহরণে এসেছে। উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু তারাই। আমরা নীচে দাঁড়িয়েছিলাম। মূর্তী নদীতে মাহুতেরা হাতি স্নান করাচ্ছে। বেশ লাগছিল দেখতে। ডে-ভিজিটের পর্যটকরা চলে গেলে পরিবেশ শান্ত হল। এবার আমরা উঠলাম নজর মিনারের উপরে। ওয়াচটাওয়ারের পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে এলাম দোতলায়। এখান থেকে জঙ্গল আর নদীর প্যানোরমিক ভিউ। মাঝে মাঝেই ময়ূরের কেকা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জঙ্গল জুড়ে। মূর্তী নদীতে জল খেতে এসেছে একদল গাউর। একজন বনকর্মী বললেন ‘দূরে হাতির পাল আছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীতে আসবে’। আমরা বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলেও হাতির পাল এসে পৌঁছোল না। কিন্তু কথায় বলে সবুরে মেওয়া ফলে। হাতির জন্য উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকতে থাকতেই, একজোড়া ‘রাজধনেশ’ আমাদের একদম চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেল। এত কাছ থেকে হর্নবিল দর্শন এই প্রথম। অন্ধকার হয়ে আসছে, পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ তুলে ফিরছে তাদের ঘরে। আমরাও গুটিগুটি পায়ে ফিরে এলাম কটেজে।
‘এন্ট্রান্স গেটের’ সামনে ‘আদিবাসী নাচনী আখড়া’। সন্ধেবেলা এখানে আদিবাসী নৃত্যের আসর বসল। ঢোল, মাদলের তালে নেচে উঠল শরীর, মন। আমার স্ত্রী ও কন্যাও পা মেলাল স্থানীয় মহিলাদের সাথে। অনুষ্ঠান শেষে ‘শিবু ওরাও’(নাম পরিবর্তিত) এর সাথে পরিচয় হল। উনি নাচুনি দলের স্থানীয় নেতা। দলের সকলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। শিল্পীরা প্রত্যেকেই স্থানীয় বাসিন্দা। শিবুবাবুর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চলল। উনি জানালেন ওনারা প্রত্যেকেই প্রায় চা শ্রমিক। আগে নিজেরাই ধান, আলু চাষ করতেন, কিন্তু বাড়বাড়ন্ত হাতির উপদ্রবে আপাতত ইতি টেনেছেন। শিবুবাবু অত্যন্ত সঙ্গীতপ্রেমী, জানালেন তাদের দৈনন্দিন জীবন থেকেই এই সঙ্গীতগুলি সৃষ্টি হয়েছে। গানের বিষয়বস্তু মূলত পৌষ মাসের ধান কাটার উৎসব, মহাকালকে (হাতির দেবতা) তুষ্ট করার গান ও স্থানীয় বিবাহ রীতি নিয়ে গান ইত্যাদি। উনি আমাদের কিছু শহুরে গান শুনতে চাইলেন। তার উৎসাহ দেখে আমিও হেঁড়ে গলায় শোনালুম “ও নদী রে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে।” এরপর একে একে আরও কয়েকটা। উনি প্রত্যেকটা গানের শব্দের মানে বুঝে নিচ্ছিলেন। আশ্চর্য হলেন কবীর সুমনের ‘পাগল’ গানটি শুনে।
“তার ভোট চাইবে না গণতান্ত্রিক কোনো প্রার্থী,
সরকারে দরকার নেই তাই নিজের সুড়ঙ্গে,
পাগল, পাগল—-
সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে—”
জানালেন একটি ‘পাগলকে’ এই দৃষ্টিতে দেখা যেতে পারে তা শিবুবাবুর ধারণা ছিল না। অভিভূত হয়ে জানালেন ‘এমন কবির পায়ে শতকোটি প্রণাম’। বেশ কিছুক্ষণ সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পরে আড্ডা সমাপ্ত করতেই হল। এখানে তাড়াতাড়ি রাত্রের খাওয়া সেরে ফেলাই নিয়ম। যাওয়ার আগে সতর্ক করে গেলেন গত “দু-তিন দিন গ্রামে হাতি আসেনি, আজ নিশ্চয়ই আসবে। আপনারা সতর্ক থাকবেন।”
রাত নামলে জঙ্গল অন্য রূপ ধারণ করে। রাতচরা পাখি ডেকে চলেছে অনবরত, দূরের কোনো গ্রাম থেকে ধামসা মাদলের শব্দ ভেসে আসছে। গরম গরম রুটি আর দেশী মুরগির মাংস দিয়ে ডিনার করা হল। আজ বাকি তিনটে কটেজে যাদের বুকিং ছিল তারা কোনো অজ্ঞাত কারণে আসেননি। অতএব পুরো চত্বরে আমরা, মাত্র তিনটি মানুষ থাকব। ম্যানেজারবাবুর কোয়াটার কটেজ থেকে ৫০০ মিটার দূরত্বে। ক্যাম্পের এক কর্মী সঞ্জীব এসে একটা হাই পাওয়ারের টর্চ দিয়ে জানিয়ে গেল রাত্রে যেন কোনো কারণেই দরজা খোলা না হয়। আর জানালেন, “ঘরের জানলা থেকে টর্চ মেরে রাতের জঙ্গল দেখতে পারেন, অনেক সময় গাউড় বা হাতির পাল চলে আসে কটেজের সন্নিকটে।”
শোওয়ার আগে জানলা খুলে জঙ্গলের দিকে দেখলাম, একেবারে জমাট বাঁধা অন্ধকার। লাইট অফ করে শুয়েছি, চোখে একটু তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় জঙ্গল থেকে কোনো এক বন্য জন্তুর ডাক ভেসে এল, ডাকটা কুকুরের ডাকের মতই, কিন্তু কুকুর যে নয় তা বুঝতে পারছি। ডাকের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকল, পরিষ্কার বুঝতে পারলাম কটেজের ৫০ গজের মধ্যেই সে আছে। জানলা খুলে টর্চ মারলাম জঙ্গলে, কিছুই দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ বাদে শব্দের তীব্রতা কমতে বোঝা গেল সে চলে যাচ্ছে। আমার গিন্নি তো একেবারে নিশ্চিত ওটা চিতা ডাকছে, কোন্ বইতে নাকি ও পড়েছে চিতার ডাক অনেকটা কুকুরের চিৎকারের মতো। নির্জন, শান্ত আরণ্যক পরিবেশে সেই ডাক বেশ ভয় মিশ্রিত ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। এরপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। ঘুম ভাঙলো হাতির বৃংহণে, ঘড়িতে দেখি রাত সাড়ে তিনটে। বৃংহণ এর সাথে সাথে তীব্রতা বাড়ছে ক্যানেস্তারা ও গ্রামবাসীদের চিৎকারের আর চলছে ক্রমাগত পটকা ফাটানো। কাছাকাছি কোনো গ্রামে হাতি প্রবেশ করেছে, শুরু হয়েছে হাতি মানুষের জীবন সংগ্রাম। মনে পড়ে গেল শঙ্করবাবুর সতর্কবাণী। পরেরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল সঞ্জীবের ডাকে। চা নিয়ে এসেছে, গুড মর্নিং জানিয়ে জিজ্ঞেস করল “কাল রাতে সম্বরের ডাক শুনলেন?” আমি আর গিন্নি একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম।
আজ আমাদের হাতি সাফারি। তিনজনে উঠে বসলাম গজরাজের পিঠে। এখানে হাতির পিঠে হাওদা নেই। পুরু মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। হেলতে-দুলতে এগিয়ে চলেছি, চতুর্দিকে প্রচণ্ড কুয়াশা, দৃশ্যমানতা একেবারে নেই বললেই চলে। মেদলা নজর মিনারের উলটোদিকের মূর্তী নদী পেরিয়ে প্রবেশ করলাম হাতি ঘাসের জঙ্গলে। বেশ গভীর জঙ্গল। ভাগ্য ভালো থাকলে এখানে প্রায় মুখোমুখি দর্শন হয় একশৃঙ্গ গন্ডারের। যদিও আমরা দেখা পাইনি, তবে শীতের কুয়াশামাখা অরণ্যে এক অপূর্ব সূর্যোদয়ের সাক্ষী হয়েছিলাম।
ফিরে এসে ব্যালকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে গেলাম, অজস্র পাখির কনসার্ট শুনে কেটে গেল অখণ্ড অবসর। এবার ফেরার পালা। সবুজ গহন অরণ্য, সূর্যের নরম আলো, কুলকুল বয়ে চলা নদী, পাখির ডাক, স্থানীয় অধিবাসী, সব মিলিয়ে অপূর্ব কাটল একটা দিন। গাড়ি এগিয়ে চলেছে জংলি মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে, ধুলোর মেঘ ভেদ করে দেখতে পেলাম ‘কালীপুর বনবাংলো’ তাকিয়ে আছে একই দৃষ্টিতে, যেমন ভাবে সে চেয়ে ছিল সাতটি বসন্ত আগে।