অর্ণব রায়ের গুচ্ছ কবিতা
আমাদের কান্না একফসলী জমি
আর
যে যার শষ্য তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেছে
১/
আর একটু ভালোবাসা পেলে হয়তো বেঁচে যেতাম। যেন পৃথিবীর আর কেউ নেই। দেশে খেতে বসার আকাল লেগেছে। এত এত প্রার্থনার ভার। কেউ জগতের হেঁশেল উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে অবেলায়। সে একা, থরথর কাঁপতে কাঁপতে ছুটছে। তার কক্ষপথপিছলে যাচ্ছে।
পৃথিবীপৃথিবীর মনে গোলগোল ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝেই আনমনে থেমে নিজের শরীরে দেখে নেয়, দিনরাত সত্যি সত্যি হচ্ছে! ছুঁড়ে দেওয়া লাথি মেরে ছুঁড়ে দেওয়া একটুকরো সাদা হাড়ের মতো হাসির চিহ্নমাত্র এলে জঙ্গলে হিল্লোল খেলে যায়। যেন এল সে বারতাঃ
এই বেঁচে থাকা বর্ণে-স্পর্শে-স্বাদে-ধাক্কায়
আপাদশীর্ষ মিথ্যে,
বাতাস বাতাস নয়
জল আসলে তৃষ্ণারই রকমফের,
দুহাতেরলৌহনিগড়ে সংসার
বালু বা বড়োজোর সুগোল সাবানের বুদবুদ।
দড়ি কে রেখে গেছে এইখানে মেঝেতে আলগোছে?
নিরীহ গোল এলিয়ে আছে,
একটি যথার্থ আংটা ছাদ থেকে,
একটু নায়কোচিত অবকাশ,
তার ঘুম ভেঙে যাবে, টানটান
একটি চাকু একটি বঁটি বা একটি কাটারির
হুড়মুড়ে আতঙ্কিত অপেক্ষায়
অপেক্ষায় কিম্ভুত সব আদিম জন্তুরাও থাকত। এলেই ছুটে বেরিয়ে পড়বে দূরের দূরের সব গাছে গাছে খবর পৌঁছোতে। দৌড় শুরু করবার গতিশীল স্থির ভঙ্গীতে তারা পাথর হয়ে রয়েছেঅরণ্যেরকোনাখামচিতে।
হাসি ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গলের ভেতর। যেখানে মানুষ নেই, মানুষের দেখায় এঁটো হয়ে যাওয়া নেই, সেখানে হাসি ছুটে চলেছে রাতের আবডালে।
২/
সমস্ত খোলা লাল বারান্দার বুকের ওপর গ্রিল বসে গেল,
যে সব নিকোনোউঠোন থেকে আমবাগান শুরু হত
তাদের শিরায় শিরায় পোড়া ইঁটের পাঁচিল উঠল,
আমাদের মাঠের রক্ত শুকিয়ে আসছে
আমাদের নদীর বুকের জল, জলের বুকের জল
কীরকম যেন ভয়ে কাঠ হয়ে হয়ে নেই হয়ে যাচ্ছে,
জলের মনে জল কোনদিক পানে যেন তাকিয়ে তাকিয়েবয়ে যায়
তাতে ডুব ডুবডুব স্নান করে করেও তৃষ্ণা গেল কই,
তার কণ্ঠ ভরে শুকনো শুকনো খাত ও মীনের ছোটোবড়ো ঝুরঝুরে কঙ্কাল।
জগতে কোথাও গোল এক খল হাসির চিহ্ন লেগে আছে
প্রতিপর্বচন্দ্রকলায় তা বাড়ে বাড়েবাড়ে,
সর্বোচ্চ জ্যোৎস্নায় মোহময় যুগলমোহন কালে
দশহাতেছড়ানো গাছের কঙ্কাল থেকে নীরব বিষ নামে,
নর-দের কানে কানেঢোকে
নারী-দের প্রাণে প্রশ্নসঞ্চার করে,
আমরা যুগলরূপে এ মায়ায় বসে থেকে থেকে কালচে নীল,
আমাদের কথা আমাদের দেহপরিসর ছেড়ে
আমাদেরই পাশটিতেকাচেরবাসন হয়ে স্থির, চকচক করে,
আমাদের দেখায় অন্য কেউ দেখে
আমাদের চোখের মণি চিরে গেছে
কে আমাদের এখনও ধরে রেখেছে কৃতাঞ্জলিপুটে?
কার বেঁকে যাওয়া প্রার্থনায় আমরা হলাম?
একটি ছায়া মনুষ্য অবয়ব পেতে না পেতে
তার থেকে লাফ দিয়ে আর একটি বেরিয়ে দুই ও নৃত্যপর,
সংযোগ ও বিভাজনের দুনিয়া অতঃপর একটি কিলবিলেনৃত্যক্ষেত্র,
কোনও এক হিসাবমতে বা কারও মুচকি হাসি ঠিকরে
ঠিক একসময় একটি মাপমতো উল্কা নেমে আসে,
এই লেখা সেই আগুনের আঁচড়
এই লেখা সেই আকাশের গালে উল্টোনো তীক্ষ্ণ হাসি
৩/
আমাদের হাতে আর কিছু নেই
আমাদের হাতে আর কিছু নেই
শুধু হাতেই কেন থাকবে? চক্ষুকোঠরে নেই? কর্ণপটাহে নেই! নেই দুখানা হাঁটুর চাকতিতে? দেহভার নিজ নিজ ক্রমে তো এরাও বহন করে!
হাতটি দেখে মায়া হয়। সেই কোন ধূলার পৃথিবীতে দুখানি অঙ্কুর শরীরের দুইপাশফুঁড়ে বের হল। জন্মগত লতা। ‘আমার কি কেউ কোথাও নাই’ বলে শুরু করে শূন্যে অতঃপর কতই আঁকাড়ানোর মরিয়া আলপনা এঁকে ‘আমার কেউ কোত্থাও নাই’ বলে শূন্যেই অসহায় থিতু হল। হাতে কিছু নাই। কররেখা ছেড়ে চলে গেছে কবে। একদাওদেরকেমরুময় জীবনের মাঝবরাবরহাইওয়ে ভাবা হয়েছিল।
৪/
মৃত পাখি তুলে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন ধরে ধরে এই অরণ্যে এসে পড়েছি
আকাশে চোখ তুলে দেখে নিয়েছি তাদের খসে পড়ার দাগ,
ওই তো নিশানা বাঁকানো তেঁতুল গাছ
যিশুরক্রশের ভঙ্গীতে ছড়ানোশেকড়ের তলে
দুহাততিনহাতপাঁচহাত গর্ত করে
কাপড়ে জড়িয়ে দড়িতে ঝুলিয়েনামানো হয়েছিল,
কীভাবে যত্নে রাখা অস্ত্রগুলি রোগা রোগা মানুষের লাশ হয়ে গেল?
৫/
পরাজিত সৈনিকের রক্তের এক কণা অপর কণার থেকে দূরে চলে যেতে চায়। তার কোমর থেকে বাকি শরীর খুলে আসে। তার দৃষ্টির চারকোনাপুড়েদুমড়ে কালো হয়। জিভের পেছনদিকে বর্ণমালা গুটিয়ে জড়িয়ে এক কিম্ভুত নীরবতা অন্ধকারের রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসে সে হাঁ করলে। আকাশে এত তারা, সকালে এত আলো— সব আস্তে আস্তেকুঁকড়ে কালো হয়ে গুটিয়ে তার ভেতরে মৃত ভ্রূণের আরামে পাশ ফিরে গুটিশুটি মেরে শোয়। তার এত যুদ্ধ, এত তলোয়ার চালানো, সব ছাইয়ের বাদুড় হয়ে একটিই বাক্য গঠন করতে সমর্থ হয়। সেই বাক্য, ভয়ানক একটিই বাক্য পকেটে রেখে তার ঘুম আসে।