পশুরাজের সুখ-দুঃখ – প্রবুদ্ধ বসু

পশুরাজের সুখ-দুঃখ – প্রবুদ্ধ বসু

শেয়ার করুন

ছেলেবেলায় দুর্গা বিসর্জনে বড্ড ভয়ের ব্যপার ছিল ঠাকুর প্রণাম। কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রণামে ‘নো প্রবলেম’, কিন্তু দুগ্গার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলেই ভয়ে বুক দুরু দুরু। একে তো জাদরেল মহিষাসুর খর্গ হাতে মারতে উদ্যত, তার ওপর আবার ইয়্যা বড়ো একটা সিংহ হাঁ করে কামড়াতে আসছে। নেহাত পূণ্যি লাভটা খুব দরকার তাই কোনো রকমে প্রণামটা সেরেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচা। যত বড়ো হতে থাকি ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনী, সত্যজিৎ-এর ছবি বা লম্বা সাদা দাড়িওলা লোকটার লেখনীর প্রভাবে খুব শীঘ্রই উপলব্ধি করি প্রণামে পূণ্যলাভের অসারতা। দুগ্গাপুজো তখন শুধুমাত্র দুর্গা উৎসব। কিন্তু ততদিনে তেজস্বী, ক্ষিপ্র, মাংসাশী, দুর্গার বাহনটির প্রতি বেড়েছে তীব্র আকর্ষণ। তবে তার কারণ অবশ্যই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়স তখন বোধকরি ১৫-১৬ হবে। হাতে এল তাঁর সেই বিখ্যাত উপন্যাস। উগান্ডায় রেলের কাজে যোগ দিয়েছে শঙ্কর। সেখানে হানা দেয় মানুষ খেকো সিংহ। তুলে নিয়ে যায় মাসাই কুলি ও তার বন্ধু থিরুমলকে। এক রাতে শঙ্কর যখন সাহেবের তাঁবু থেকে নিজের তাঁবুতে ফিরছে, দেখে কুঁড়ের ওপর উঠে খরের চালে থাবা দিয়ে আঁচরাচ্ছে পেল্লাই একটা সিংহ। এমনই সব হার হিম করা প্রেক্ষাপটে বিভূতিবাবুর রচনা ‘চাঁদের পাহাড়’। যদিও চাঁদের পাহাড়ের সিংহ ও দুর্গার বাহন সিংহের মধ্যে পার্থক্য আছে। চাঁদের পাহাড়ের সিংহগুলি আফ্রিকান প্রজাতি আর মহিষাসুরকে হত্যা করতে দেবী দুর্গার বাহন হয়েছিল যে সিংহটি সেটি এসিয়াটিক লায়ন (যদিও কোনো পুরাণেই উল্লেখ করা নেই, তবুও আমরা ধরে নিচ্ছি), যাকে ভারতীয় সিংহও বলা হয়ে থাকে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Panthera Lio Persica। আজ ভারতীয় সিংহের সুখ-দুঃখ নিয়েই আলোচোনা করব।

প্রথমেই নজর দেওয়া যাক সিংহের বাহ্যিক গঠন ও তাদের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। ভারতীয় সিংহের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৯ ফুটের কাছাকাছি। একটি পুরুষ সিংহের ওজন মোটামুটি ১৭০ কিলোগ্রাম ও একটি স্ত্রী সিংহের ওজন মোটামুটি ১২০ কিলোগ্রামের কাছাকাছি হয়। এদের গায়ের ধূষর হলদে রং জঙ্গলের রংয়ের সাথে মিশে থাকতে সাহায্য করে। আফ্রিকান সিংহ ভারতীয় সিংহের থেকে সাইজে একটু বড়ো হয়, এছাড়া ভারতীয় সিংহের পেট বরাবর একটা চামরার ভাঁজ থাকে, যা আফ্রিকান সিংহেরর থাকে না। সিংহ মূলত খোলা সমতলভূমিতে থাকতে পছন্দ করে। এরা দলবদ্ধ জীব। বেশিরভাগ সময় দুটি স্ত্রী সিংহ ও তাদের বাচ্চারা একটি দলে থাকে। সিংহীরাই মূলত শিকার করে। একজন সিংহী শিকারের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে, আর অপর সিংহী শিকারকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে। পুরুষ সিংহেরা খুব অলস প্রকৃতির হয়। এদের কাজ হল বহির শত্রুর আক্রমণ থেকে দলকে রক্ষা করা। খুব খাদ্যাভাব না হলে এরা শিকারে বেরোয় না। পুরুষ সিংহের চেহারার মূখ্য বৈশিষ্ট্য হল ‘কেশর’। কেশরর আধিক্য টেস্টোস্টেরনের আধিক্যের উপর নির্ভর করে। কেশরের রং যত গাঢ়, সিংহের বয়স তত বেশি। এই কারণেই কালো কেশরের সিংহ বহু সংখ্যক সিংহীকে আকর্ষণ করে। সমগ্র বিশ্বে, বর্তমানে শুধুমাত্র আফ্রিকা এবং ভারতবর্ষে গির অরণ্য ছাড়া আর কোথাও সিংহের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ‘কেশরী’, ‘কেহরী’, ‘বব্বর শের’, ‘উন্তিয়া বাঘ’ আমাদের দেশে সিংহকে এইসব নামে ডাকা হয়। মনে করা হয় সিংহ ভারতবর্ষে ঢুকেছিল দক্ষিণ-পশ্চিম পথে, ইরান-ইরাক-বালুচিস্থান হয়ে তারা সিন্ধু প্রদেশে প্রবেশ করে। সম্রাট আলেকজান্ডারের সৈন্যরা যখন এই পথ দিয়ে ফিরছিল তখন সিংহরা এদের খুব হয়রান করে।

আলিপুর চিড়িয়াখানার নেহাতই নিষ্প্রভ, নীরস সিংহ ছাড়া, বন্য হিংস্র সিংহ দর্শন করতে আমাদের পাড়ি দিতে হয় সুদূর গুজরাটের জুনাগড় জেলার গির অরণ্যে। আজ থেকে শ-দেড়েক বছর আগে জন্মালে হয়তো পশুরাজ দর্শনে অতদূর যেতে হত না। একদা ইউরোপ থেকে মধ্যএশিয়া হয়ে সিংহের বিস্তৃতি ছিল অধুনা ঝাড়খণ্ডের পালামৌ পর্যন্ত। ১৯০০ সাল বা তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত বিহার, দিল্লি ও আরাবল্লী পর্বতের আশেপাশে সিংহের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৮১০ সালে ঝাড়খণ্ডে, পূর্ব গুজরাটে ১৮২০ সালে, মধ্য প্রদেশে ১৮৬০ সালে এবং রাজস্থানে ১৮৭০ সালে শেষ বারের মতো সিংহ দেখতে পাওয়া যায়। মধ্য ও পশ্চিম ভারতে সিংহ বিলুপ্ত হওয়ার দায় অবশ্যই মানুষের। ‘জাহাঙ্গীরনামা’র বর্ণনা অনুযায়ী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ৩৯ বছরের রাজত্বকালে শুধুমাত্র পানিপথ, মথুরা অঞ্চলে বাদশা স্বয়ং ৮৬টির বেশি সিংহ হত্যা করেন। শিকারিদের রোষ থেকে বাদ পড়ত না আরও অন্যান্য বন্য প্রাণী যেমন হরিণ, বুনো শুয়োর ইত্যাদি। ফলে টান পড়তে শুরু করে সিংহের স্বাভাবিক খাদ্যে। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে তারা মাঝে মাঝেই লোকালয়ের গবাদি পশু শিকার করতে শুরু করে, এর ফলে পড়তে হয় স্থানীয় অধিবাসীদের ক্রোধে। স্থানীয় মানুষরা বেশকিছু সিংহকে বিষ দিয়ে হত্যা করে। ফলে ক্রমাগত কমে আসতে থাকে সিংহের সংখ্যা। এহেন অবস্থায় গুজরাটের মাটি, গুজরাটের অরণ্য সংরক্ষণ করতে পেরেছে ‘Asiatic Lion’ বা ভারতীয় সিংহকে।

উন্মুক্ত, পর্ণমোচী এবং কাঁটা গাছে ঘেরা বিস্তীর্ণ গির অরণ্যে সিংহ সংরক্ষণের ইতিহাস প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো। এশিয়া, ইউরোপ এবং সর্বোপরি সারা ভারত থেকে সিংহ যখন প্রায় নিশ্চিহ্ন, তখন জুনাগড়ের নবাব মহব্বত খানজী প্রথম সিংহ সংরক্ষণে আগ্রহী হন। সালটা ১৮৭৯, তাঁর রাজত্বের মধ্যে শিকার নিষিদ্ধ করেন। বলা বাহুল্য গির অরণ্য তখন তাঁর রাজত্বের অংশ। যদিও প্রতিবেশী প্রদেশের রাজা এবং ব্রিটিশরা নবাবের বিশেষ অনুমতিতে সিংহ নিধন চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর উত্তরসূরি রাসূল মোহাম্মদ খানজী ক্রমাগত কমে আসা সিংহের সংখ্যায় চিন্তিত হয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জনের শরণাপন্ন হন। তিনি লর্ড কার্জনকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন ‘this novel race will be extinguished by the hands of common people, unless the prohibition of destroying it is strictly enforced in all surrounding places (neighbouring states and smaller principalities) alike’। এরপর লর্ড কার্জন গুজরাটের সিংহ সংরক্ষণে এগিয়ে আসেন। ১৯০৮-০৯ সালের মধ্যে গিরকে সিংহ সংরক্ষণের জন্য মনোনীত করে বন বিভাগ। পরবর্তীকালে লর্ড কার্জনের উদ্যোগে কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্যকেও একশৃঙ্গ গন্ডার সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয়। প্রায় ১৫৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পশুরাজ-এর সংরক্ষণস্থল হিসেবে চিহ্নিত হল। রাসূল মোহাম্মদ খানজীর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার গির অরণ্যে শিকার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়। কথিত আছে ১৯২১ সালে রাসূল মোহাম্মদ খানজীর পরবর্তী নবাব তৃতীয় মহব্বত খানজী নভাংগড়ের রাজা, বিখ্যাত ক্রিকেটার রঞ্জিত সিংজী-কেও শিকার এর অনুমতি দেননি। তৃতীয় মোহাম্মদ খানজী তার প্রাণপাত করে গির অরণ্যে সিংহ সংরক্ষণে ব্রতী ছিলেন। তিনিই প্রথম ১৯৩৬ সালে সিংহ গণনা শুরু করেন। এর পরেই আসে ১৯৪৭ এর ভারত বিভাজন। ধর্ম নামক অলীক সত্যের ভিত্তিতে হওয়া দেশ ভাগের শিকার শুধুমাত্র দুই সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই দেশের প্রকৃতি ও বন্য সম্পদও। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করে মোহাম্মদ খানজী পাকিস্তান চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, পড়ে থাকে তার প্রিয় গির অরণ্য ও অভিভাবক হারানো সিংহের দল। এর প্রায় ১৮ বছর পরে ১৯৬৫ সালে গুজরাট সরকার ১৮১২ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। ১৯৬৮ সালে গণনা করে দেখা যায় গিরে আর মাত্র ১৭৭ টি সিংহ জীবিত আছে। কিন্তু সরকার ও কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায় ২০২০ সালে সিংহ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় ৬৭৪ টি।

সিংহ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় সিদ্ধি উপজাতির মানুষের কথা। গির অরণ্যের মধ্যে ছোট্ট গ্রাম ‘সিরওয়ান’, এখানেই বসবাস সিদ্ধি সম্প্রদায়ের মানুষের। মাথার কোকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট ও কুচকুচে কালো বর্ণের এই মানুষগুলাকে দেখেই বুঝতে পারা যায় এরা সেই দুর্ধর্ষ বলশালী মাসাইদের বংশধর যারা একদা বল্লম দিয়ে সিংহ শিকার করত। নবাব স্যার রাসূল মোহাম্মদ খানজী আফ্রিকা থেকে এদের নিয়ে আসেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন পর্তুগীজদের সঙ্গে এদের ভারতবর্ষে আগমন হয়। ক্রীতদাস হিসেবে তাদের সংগ্রহ করেন মোহাম্মদ রাসুল খান। সে যাই হোক, সিংহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তিনি তাদের আতিথেয়তা দেন। বর্তমানে অধিবাসীরা কেউ নিয়োজিত বনকর্মীদের কাজে, কেউ-বা সাফারি জিপ চালক। দীর্ঘদিন গুজরাটে থাকার ফলে গুজরাটি ভাষা ও জীবনযাত্রার সঙ্গে এরা একাত্ম করে নিয়েছে নিজেদের। এমনকি আপন করে নিয়েছে ভারতীয় সু্ফি ধর্মকে। কখনও গির অরণ্যে গেলে অবশ্যই প্রত্যক্ষ করবেন ভারতীয় মাসাইদের জীবনযাত্রা।
গুজরাটবাসী ও সরকার সাফল্যের সাথে সংরক্ষণ করলেও গির অভয়ারণ্যে সিংহ বেশ কিছু কারণে বিপদের সম্মুখীন।

১) গির অরণ্যের বেশ কিছুটা অংশ স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের গবাদিপশু চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করছেন, ফলে অরণ্যের তৃণভোজীরা তাদের নিজস্ব চারণভূমি হারাচ্ছে। এর ফলে হরিণ, নীলগাই এবং আরও যেসব তৃণভোজী পশুরাজের স্বাভাবিক খাদ্য, তারা পরিযায়ী হচ্ছে অন্য অরণ্যে।

২) গবাদি পশু পালনের ফলে দূষিত হচ্ছে অরণ্যের জল। বাড়ছে অরণ্যে পশুদের ব্যাধির সংক্রমণ।

৩) সিংহের স্বাভাবিক খাদ্যে টান পড়ায় তার ঝোঁক বাড়ছে অন্যান্য অরণ্য সংলগ্ন গ্রামের গবাদি পশুর প্রতি। ফলে বাড়ছে স্থানীয় মানুষ ও পশুরাজের সংঘাত।

শ্রী বলরাম বসু ‘এখন আরণ্যক’-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন উপরোক্ত কারণগুলোর জন্য শুধু সিংহ নয় সমগ্র গির অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র বিপদের মুখোমুখি। কোনো দাবানল বা মহামারী যদি অরণ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অচিরেই আমরা ‘এশিয়াটিক লায়ন’ প্রজাতিটিকে চিরদিনের মতো হারাবো। তার এই আশঙ্কাকে সত্য করে ২০১৮ সালে সিংহেরা আক্রান্ত হয় CDV (Canaine Distemper Virus) নামক একটি ভাইরাস দ্বারা। এই Single stranded RNA virus টির আক্রমণে প্রায় ২৩টিরও বেশি সিংহের মৃত্যু হয়। ঠিক এইসব কারণগুলির জন্যই দরকার গির ছাড়াও অন্য কোনো অরণ্যে সিংহের বাসস্থান তৈরি করা।

দ্বিতীয় বাসস্থানের ভাবনা প্রথম ভাবা হয় ১৯৫৭ সালে। উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর কাছে চন্দ্রপ্রভা অভয়ারণ্যে প্রথম সিংহ পুনর্বিন্যাস করা হয় ১৯৫৮ সালে। এখানে গির থেকে একটি সিংহ ও দুটি সিংহীকে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৬০ সালে সেখানে সিংহের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫-টিতে। ১৯৬২ সালে তা হয় ৭ টি এবং ১৯৬৫ সালে সিংহের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২-টিতে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এরপর চন্দ্রপ্রভা অভয়ারণ্যে আর একটি সিংহকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা নিশ্চিত ভাবেই নিহত হয়েছিল চোরা শিকারিদের হাতে। অরণ্য বিভাগের তীব্র বিচক্ষণহীনতার জন্য সম্ভাবনা জাগিয়েও এই প্রোজেক্ট সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৩-৯৪ সালে আবার পাঁচটি অরণ্যকে বাছাই করা হয় ‘বব্বর শের’-এর পুনর্বিন্যাসের জন্য। এই পাঁচটি অভয়ারণ্য হল, গুজরাটের ‘বরোদা’, রাজস্থানের ‘সীতামারা,’ ‘দারবা’ ‘কুম্ভলগড়’ ও মধ্যপ্রদেশের ‘কুনো’। এবারে কিন্তু পশুরাজ এর বাসস্থান ঠিক করতে বেশ আটঘাট বেঁধে নামে বনদপ্তর। সিংহ পুনর্বিন্যাসের জন্য যে কয়েকটি বিষয়ে জোর দিতে হয় তা হল:

১। পর্যাপ্ত পরিমাণে তৃণভোজী পশু যেমন চিতল হরিণ, ‘সাম্বর’ এর উপস্থিতি, যা সিংহের স্বাভাবিক খাদ্য।

২। পশুরাজ এর পর্যাপ্ত বিচরণভূমি। একটি সিংহীর বিচরণের জন্য প্রায় ৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ও সিংহের জন্য ১৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রয়োজন।

৩। অরণ্যে বসবাসকারী স্থানীয় মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়া ও আশপাশের গ্রামের মানুষকে এই প্রোজেক্টের উপকারিতা সম্বন্ধে যথেষ্ট শিক্ষিত করে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজন।

৪। অভায়ারণ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে জলাশয়ের প্রয়োজন।

সবকটির যোগ্যতা বিচার করে মধ্যপ্রদেশের কুনো অভায়ারণ্যকে নির্বাচিত করা হয় ‘এশিয়াটিক লায়ন’-এর পুনর্বিন্যাসের জন্য। বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে মধ্যপ্রদেশের কুনো অরণ্যকে প্রস্তুত করা হল পশুরাজের সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু বাধ সাধল স্বয়ং গুজরাট সরকার। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের সাথে সিংহ সংরক্ষণের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে তাদের তীব্র আপত্তি। সরকারের দাবি সিংহ তাদের ঐতিহ্য, সিংহের বাসস্থান অন্য কোনো রাজ্যে গেলে ভাগ বসবে তাদের পর্যটনে, তাদের গর্বে। ফলে মামলা গড়াল সুপ্রিমকোর্ট অবধি।

সুপ্রিমকোর্টকে গুজরাট সরকার জানায় এশিয়াটিক লায়ন, গুজরাটিদের পারিবারিক সদস্যের মতো, গুজরাটের সংস্কৃতি থেকে সিংহকে সরিয়ে অন্য কোনো রাজ্যে নিয়ে গেলে তা অত্যন্ত অনৈতিক কাজ হবে। এছাড়া মধ্যপ্রদেশের ‘পান্না ন্যাশনাল পার্ক’-এ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে কোর্টকে তারা জানায় যে মধ্যপ্রদেশ সরকার ও বনদপ্তর কখনোই সিংহ সংরক্ষণে সফল হবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট পশুরাজ-এর দ্বিতীয় বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৫ ই এপ্রিল ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশের কুনো অরণ্যকেই সিংহ সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ২০২১ সালে এসেও ‘এশিয়াটিক লায়ন’ পেল না কোনো দ্বিতীয় বাসস্থান। গুজরাট সরকার তাদের নিজস্ব রাজ্যের মধ্যেই পুনর্বাসনের কথা ভাবছে। তবু তারা সিংহকে নিজের রাজ্যের বাইরে কোনো ভাবেই পাঠাতে রাজি নয়, যা অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক ও নীচু মানসিকতার পরিচয়। পৃথিবী থেকে যুগে যুগে বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে প্রকৃতির নিয়মে, কিন্তু শুধু মানুষের কারণেই অজস্র প্রাণী আজ বিলুপ্তির পথে। ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী চিন্তা ত্যাগ করে আমরা যদি না বেরিয়ে অসতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম শুধু বইয়ের পাতাতেই পশুরাজকে চিনবে।

তথ্যসূত্র:-

১। How the Gir Lions were saved- by Krutika Haraniya; Snapshot history; October 08, 2020.
২। Junagarh State and its Lions; Conservation in Princely India 1879-1947; Vol 4; Issue 4, Page 522-540; 2006.
৩। ‘এখন আরণ্যক’; August 2016.
৪। Asiatic Lion Reintroduction project- Wikipedia.

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২