পথ, পন্থা, সময় – মৃদুল দাশগুপ্ত

শেয়ার করুন

কোন্ পথ? কবিতাপ্রয়াসের বিশ, পঁচিশ বছরে কোনাে-না-কোনাে সময়ে, বােধ করি, সকল প্রয়াসীকেই এই আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়। প্রয়াসী হয়ে ওঠেন সন্ধানীই, সাধনার পথ, পন্থা কিছু-না-কিছু বেছে নিতেই হয় তাঁকে। আত্মানুসন্ধান, সত্যানুসন্ধান, তা যাই বলি-না কেন! নাস্তিকেরও এক আধ্যাত্মিক সাধনাই তা, জীবনযাপনে দুঃখদুর্যোগে কবিতা হয়ে ওঠে আশ্রয়ই।

কৈশােরের উচ্ছ্বাসে, সদ্যতারুণ্যের স্ফুর্তিতে প্রেমিকমনের স্বপ্নচারিতায়, হয়তাে এই আত্মজিজ্ঞাসা মনের নিভৃত আড়ালে সুপ্ত থাকে। তাৎক্ষণিকতা ঘটনাপ্রবাহ, উত্তেজনা, ক্রোধ, অভিমান, অপমানেও প্রতিক্রিয়াজনিত স্বাভাবিকতায় অতিতারুণ্যে কবিতা সম্ভব। অন্তত আজ থেকে পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে তরুণ-কিশাের প্রয়াসীদের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছিল। পিছনে ফিরে দেখলে, এও মানতে হবে তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহের তাৎক্ষণিকতাতেও ইতিহাসের ছায়া পড়েছিল; ওই সময়, ভেবে দেখলে, অন্তত এ-উপমহাদেশে এক সন্ধিকাল বলেই মেনে নিতে হয়, সব যুগে তা ঘটে না।

আজ থেকে পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে আমার সমসময়ের কবিতাপ্রয়াসীরা সময়ের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন, নিছক প্রেমার্তিও হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী তরুণ হৃদয়ের স্বপ্নিল শ্লোক। ঠিক এই সময়, এখন, সময়ের হেরফেরে, কোনাে কবিকিশাের কাল্পনিক প্রয়াসেও এ-জাতীয় প্রণয়পদ রচনায় সম্মত হবেন না, তা যুগােপযােগী নয় বলেই। প্রেম নেই, তা নয়, তবে মনে হয় স্রেফ প্রেমার্তিতে আজ আর কোনাে কিশােরীই তুষ্ট হবেন না।

সময়ের স্নেহ-করুণা আজকের অতিতরুণেরা পাচ্ছেন না, এমন ভাবা ভুল। পক্ষপাত তাে বটেই, এটা একরকম অস্বচ্ছতাও। বস্তুত গত দশ-বিশ বছরেই একরকম যুগপরিবর্তন ঘটেছে। বৈদ্যুতিন তৎপরতায়, সাড়ম্বরে, মিডিয়াদানবের সর্বগ্রাসী ব্যবস্থাপনায়, আবার গােপনে, নিভৃতে বিবিধ সংযােগে, তথ্যপ্রযুক্তিতে মানুষ হয়ে চলেছে শ্রেণিসমষ্টিতে আলাদা আলাদা বাজার। বিশ্বায়নের ছায়া বাংলা কবিতায় এসেই পড়েছে, ভাবছি এখন। এখনই তাে হয়ে ওঠা উচিত বাঙালি কবির হাতে পৃথিবী একটি ছােট্ট ক্রিকেট বল। লাল নয় তা, নীল-সবুজ,কোথাও কোথাও ধূসর, কমলা। বাংলা ভাষায় বৈদ্যুতিন সংকেত, এমনকী অন্তর্ঘাতও কুহক-নিঃশ্বাস ফেলবে, আশায় রয়েছি এখন।

আবার বাজার যখন, মুদ্রার ঝমঝম বেজে উঠেছে আমাদেরও সমাজে। শুধু নগরেই নয়, মফস্সলে গঞ্জেও ঘুরপাক খাচ্ছে যুগবদলের হাওয়া। কোন তৃণমূলতক ছড়িয়ে পড়ল ক্রোড়পতি হওয়ার বাসনা! সে-কথা মাথায় রেখেই ভাবছি, এই সময়, হয়তাে জটিল, কঠিন সময়ই তা, তবু নিষ্করুণ নয়। নিশ্চিতই তরুণতম কবিতাপ্রয়াসীরা কেউ কেউ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় এই সময়ের ভেতর থেকেও শুষে নিতে চাইছেন জীবন। এই তীব্র অভিজ্ঞতা আমাদের কৈশােরে ঘটেনি। আবার এমনও হতে পারে আমি এই জটিলতায় প্রবেশ করতে পারিনি বলেই নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ লাগছে, সবসময়ের স্বাভাবিকতায় সহজে সাবলীলভাবেই কিশাের প্রয়াসীরা ঢুকে পড়েছেন, খুলে নিয়েছেন জটিলতার ফাঁসগুলি বা তাদের কাছে জটিলতা বলে কিছু নেই।

অর্থাৎ তা যদি হয়ে থাকে অতি অল্প বয়সেই পথ ও পন্থা খুঁজে নিতে হয়েছে তাঁদের। স্বপ্ন কুহকে, প্রেমার্তিতে, দিনবদলের আশায় আশায় হাতড়ে বেড়াতে হয়নি তাদের। আমি আগেই বলেছি, আমার ভাবনায় এই পথ ও পন্থা আত্মানুসন্ধান বা সত্যানুসন্ধান, বলতে চেয়েছি আঙ্গিক বা প্রকরণ নয়। আমার মনে হয়, আজকের কবিরা এই অনুসন্ধান আত্মস্থ করেছেন বলেই আবেগ–বর্জিত, ফলে পাঁচ-ছয় বছরের কবিতাপ্রয়াসেই আমার সমসময়ের বন্ধুদলের মতাে নজরে পড়ছেন না।

আর আমরা আত্মানুসন্ধানের পথে এই বয়সে পৌছে কেউ দিশাহারা কেউ পুনরাবৃত্তি করছি। তরুণতম কেউ কেউ আমাদের আঙ্গিক, প্রকরণ অনুসরণ করছেন বটে, তাতেই আমাদের তৃপ্ত থাকার কথা নয়।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *