বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ১৫) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ১৫) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

পর্ব ১৫

পুলিশ ছাত্রদের সরে যেতে অনুরোধ করছে। তাঁরা কোনোমতেই রাজি নয়। প্রচুর ছাত্রছাত্রী জমা হয়েছে ওয়েলিংটনে।

টি এর পরে ক্রিস্টোফানীর বলে হুক করে নির্মল আবার চার মারেন। তারপরেই পার্থসারথী (৪) আউট (১৩০/৯)। শেষে ক্রিস্টোফানীর হাতে প্রাইসের বলে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন নির্মল (১১)। পূর্বাঞ্চল ১৩০ অল আউট।
ব্যাট করতে নামল অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস। এদিকে উত্তাপ বেড়েই চলেছে ওয়েলিংটনে। পুলিশের সংখ্যা বাড়ছে। অনুরোধ করা হচ্ছে অবস্থান তোলবার জন্য। কিন্তু কোনো কিছুই নিরস্ত করতে পারছে না ছাত্রদের। তাঁরা অবস্থান তুলতে রাজি নয়।

এদিকে প্রথম বলেই হোয়্যাটিংটিন ফলসারকারের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট। দলের রান ০/১। বোলার শুঁটে। পেটিফোর্ড নেমেই দুটো চার মারলেন নিম্বলকারের বলে। বল করতে এলেন পুঁটু। এসেই পার্থসারথীর হাতে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে আউট করালেন ওয়ার্কম্যানকে (৫)। দলের রান ১৬/২। প্রাইস এলো, দু রান করে স্লিপে শুঁটের হাতে ক্যাচ (১৮/৩)। দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়ার দল ২৯/৩। তখন ৫টা।

পুলিশের ডিউটি বদল হল। নতুন পুলিশ এল। সমস্যা বাড়তে লাগল। ঠিক ছ’টা বাজার কিছু আগে একজন পুলিশের আরদালি এক ছাত্রকে ব্যাপক মারধর করল, অনর্থক, এতে ছাত্ররা প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে ইঁট ছুঁড়তে শুরু করল, ফল হল মারাত্মক। প্রথমে ব্যাপক লাঠিচার্জ ও শেষে ৬টার সামান্য পড়ে কয়েক রাউন্ড গুলি চালিয়ে দিল পুলিশ। লুটিয়ে পড়লেন ছাত্র রামেশ্বর ব্যানার্জী ও শ্রমিক আবদুস সালাম। ওখানেই তাঁদের মৃত্যু হয়। ব্যাপক গণ্ডগোল শুরু হয়। তখন গোটা শহর জুড়ে রীতিমতো ঝামেলা শুরু হয়। দলে দলে ছাত্র, যুব, শ্রমিক ধর্মতলা চত্বরে জমায়েত করে। সারারাত ধরে অবস্থান চলে। এই ঐতিহাসিক ঘটনা কে স্মরণ করেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন:

“মৃত্যুকে তুমি উপহাস করে
করেছো জয়
রক্তস্নানের মধ্যে হয়েছে অরুণোদয়,
প্রাণ সমুদ্রে এনেছো বন্যা কি দুর্জয়”।

অত্যাধিক উদ্বেগ নিয়ে এক আড়াইশ বছরের প্রাচীন নাগরিক জনপদ দিন শেষ করল।

২২ নভেম্বর, ১৯৪৫। ভোরবেলা থেকেই শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমেই ঘটে ভবানীপুর অঞ্চলে। জগুবাবুর বাজার এলাকায় একটি মিলিটারি ট্রাক পিষে মারে একজনকে। ট্রাকটি ছিল আমেরিকান সৈন্যের। তাঁরা তখন দক্ষিণ কলকাতার কিছু এলাকায় তাঁবু ফেলেছিল। বমপাস সাহেবের লেকটি তাঁদের জল সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল (বর্তমানে রবীন্দ্র সরোবর লেক)। টালিগঞ্জের কুঁদঘাট এলাকায় ওয়্যারলেস স্থাপন করানো হয়; আজও এলাকাটি ওয়্যারলেস মাঠ নামে পরিচিত। পাশের একটি মাঠে ঘোড়া রাখার আস্তাবল করা হয়, যার নাম আস্তাবলের মাঠ। এই মাঠেই প্রাক্তন ক্রিকেটার অটল দে বর্মণের কোচিং সেন্টার, যেখান থেকে উত্থান অশোক দিন্দার। এই মাঠেই প্রাকটিস করতেন তিনি। আমেরিকান সৈন্যদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বর্তমানে বিজয়গড় কলোনী নামে পরিচিত (মূলত উদ্বাস্তু এলাকা)।

যে ট্রাকটি পিষে মারে, সেই ট্রাকটি চালাচ্ছিলেন এক মার্কিনি নিগ্রো সৈন্য। স্থানীয় জনগণ তাঁকে গণপিটুনি দেয়। তাঁকে আহত অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে। তিনটি মিলিটারি ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মিলিটারি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন এরপরে যদি কোনো মিলিটারি সম্পত্তির ক্ষতি হয় তাহলে সেনাবাহিনী ব্যবস্থা নেবে।

এই ডামাডোল মিটতে না মিটতেই হাজরা মোড়ের বিখ্যাত আশুতোষ কলেজের প্রভাতকালীন মহিলা বিভাগ (বর্তমানে যোগমায়া দেবী গার্লস কলেজ)-এর ছাত্রীরা মিছিল শুরু করে ডালহৌসি চত্বরের দিকে। সকাল ন’টার মধ্যে তাঁরা পৌঁছে যান তাঁদের গন্ত্যব্যে। ইতিমধ্যে ছাত্র ফেডারেশন ও অন্যান্য সংগঠন স্থির করে যে ওয়েলিংটন থেকে ডালহৌসি মিছিল করে পৌঁছনো হবে। সেই উদ্দেশ্যে সকাল সাড়ে বারোটার সময় ওয়েলিংটনে জমায়েত হয়।

এই ডামাডোলে এম ব্যানার্জী মাঠেই আসতে পারেননি। যেহেতু তিনি আম্পায়ার ফলে জে বি প্যাটেল তার জায়গায় আম্পায়ার হিসেবে নামলেন। ১২:১৮ মিনিটে যখন দ্বিতীয় দিনের খেলা শুরু হচ্ছে তখন মাত্র হাজার খানেক লোক মাঠে।

এদিকে ওয়েলিংটনে হঠাৎই ছাত্র নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে ডালহৌসি যাওয়া চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এক বিরাট অংশের জনতা ধর্মতলার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। সেই মুহূর্তেই অর্থাৎ ১২:৩৮ নাগাদ পেটিফোর্ড (১৫) শুঁটে ব্যানার্জীর বলে এল বি ডব্লু হন। অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস ৪ উইকেটে ৪৮। নামলেন হ্যাসেট।

হ্যাসেট নেমেই ক্যাচ দিলেন। কিন্তু ফলসলকর ধরতে পারেননি। অন্য ব্যাটসম্যান রোপার শুঁটের বল হুক করে চার মারেন। ১২:৪৮ এ দলের রান ৫৩/৪। ধর্মতলা তখন জনতার দখলে। দশ মিনিট পরে হ্যাসেট পরপর দুটো চার মারলে দলের রান দাঁড়ায় ৭০/৪। পুঁটুর বদলে বলে এলেন চন্দ্রশেখর ত্রিম্বকরাও সারভাতে। দলীয় ৮৫ রানের মাথায় এগিয়ে মারতে গিয়ে রোপার (২৮) বোল্ড। ৫ উইকেটে ৮৫। মিলার নেমেই পার্থসারথীর হাতে ক্যাচ (কট বিহাইন্ড) দিলেন সারভাতের বলে ১ রান করে। ৬ উইকেটে ৮৬। হ্যাসেট তখনও মারছেন। পেপার চার মারলেন সারভাতের বলে ফাইন লেগ দিয়ে। দলের রান ১০০/৬। তখন বাজে প্রায় দেড়টা। প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি তখন শরৎ বসুকে পাঠায় জনতা ও ছাত্রদের শান্ত করতে। তিনি প্রাদেশিক অফিস থেকে বেরিয়ে এগোনো শুরু করলেন ডালহৌসির দিকে।

ঠিক তখনই পেপার বোল্ড। দলের রান ৭ উইকেটে ১০০। নামলেন ক্রিস্টোফানী। নেমে হুক পুল মারতে শুরু করলেন। একটা বেজে ৫৩ মিনিটের মাথায় হ্যাসেট ৭৫ মিনিটে ৫০ রানে পৌঁছলেন। দুপুর ২টার সময় দল পৌঁছল ১৫০ রানে।

মিনিট দশেক বাদে সি এস নাইডুর বদলে বল করতে এলেন শুঁটে। এসেই দশ রান দিলেন। ১৭৫ রানের সময় পুঁটু এলেন সারভাতের বদলে। ঠিক সেই সময় বাজে দুপুর দুটো। শরৎ বসু ডালহৌসি ঢুকলেন।

শরৎ বসু এসে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু জনগণ খুব একটা মানতে রাজি নয় তখন। সেই সময় একদল চৌরঙ্গী থেকে আর একদল ওয়েলিংটন থেকে ডালহৌসির দিকে যাচ্ছিল। ২:১৫ নাগাদ পুলিশ একপ্রকার বিনা প্ররোচনায় মিছিলে লাঠিচার্জ করে। ঠিক সেই সময়ে ৮ নম্বর চার মেরে ক্রিস্টোফানী পৌঁছলেন ৫০ রানে। তখন দলের রান ১৮৬/৭। মুস্তাক আলী বল করতে এলেন। মুস্তাক যখন বল হাতে তুলছেন ইডেনে, সেই সময় পুলিশ ধর্মতলার মুখে আবার গুলি চালাল। কারণ মিছিলে লাঠিচার্জ করতেই জনতা ইঁট ছুঁড়তে থাকে। কোনোভাবেই আটকাতে না পেরে লাঠিচার্জ করে পুলিশ, তাতে না থামলে গুলি চালায়। তিনজন আহত হয়ে পড়ে যায়। তাতেও না থেমে জনতা এগিয়ে যায়; তাতে ভয় পেয়ে পুলিশ আবার গুলি চালায়। এদিকে গুলির শব্দ শুনে শরৎ বসুর (উল্লেখ করা যায়, ইনি সুভাষ চন্দ্র বসুর দাদা; যাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়েই এত লড়াই) সভাস্থল ছেড়ে জনগণ দৌড়ে যায় ধর্মতলার দিকে। ব্যাপক হট্টগোল দেখে পুলিশ নিজেদের সংযত করে, না হলে আরও বড়ো ঘটনা ঘটে যেতে পারত। এই সময় অর্থাৎ দুপুর আড়াইটার সময় ইডেনে লাঞ্চ হয়। অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস ১৯৫/৭। হ্যাসেট ও ক্রিস্টোফানী দুজনেই ৫৮ অপরাজিত।

এই সময়ে ছাত্র ও জনতার একটি মিছিল ওয়েলিংটন থেকে কলেজ স্ট্রিট হয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে যাচ্ছিল, সেটা হঠাৎই মুখ ঘুরিয়ে হ্যারিসন রোড হয়ে সি আর এভিনিউ (সেন্ট্রাল এভিনিউ) তিনটের সামান্য আগে করপোরেশন স্ট্রিট দিয়ে ম্যাডান স্ট্রিট এসে পৌঁছয়। এই একপ্রকার অঞ্চল পরিক্রমা জনসমাগমকে মাত্রা ছাড়িয়ে দেয়।

তিনটের সময় লাঞ্চের পরের খেলা শুরু হল। হ্যাসেট নেমেই সারভাতের বলে চার। অস্ট্রেলিয়ার দল ২০০/৭। ২১৭ রানের মাথায় সি এসের পরপর দুটো বলে হ্যাসেট চার মেরে নিজে ৮০ রানে পৌঁছয়। দল ২২৫/৭। ২৩০ রানের মাথায় নতুন বল নেওয়া হল (তখনকার নিয়ম)। হাইকোর্টের দিকে শুঁটে, ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে পুঁটু। তখন এটাকে পল্টন প্রান্ত বলা হত। ক্রিস্টোফানীকে পুঁটু এসেই বোল্ড করলেন (২৩৬/৮)। ক্রিস্টোফানী তখন ৭০ মিনিটে ৬৯ করেছে (১০×৪)। নামলাম উইলিয়াম। নেমেই হুক করে ফাইন লেগে চার মারলেন শুঁটের বলে। পরের বলেই ক্যাচ তুললেন, কিন্তু স্লিপে মুস্তাক আর সি কের মধ্যে দিয়ে চার হয়ে গেল। এরপরেই শুঁটের বলে চার মেরে হ্যাসেট করলেন ১০০ রান। আউট আর হচ্ছেন না। সি এস, নিম্বলকার চেষ্টা করছেন, কিন্তু চার ছয় হয়েই যাচ্ছে। ১৮৭ মিনিটে ২৫০ হল। ২১৭ মিনিটে হল ৩০০। শেষ ১০০ রান হল মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে। কিন্তু ৩০০ হতেই হ্যাসেট সি এস কে হুক করতে গিয়ে (সি এস মাঝে মাঝে বাউন্সার দিতেন, স্পিনার হয়েও) উঁচু ক্যাচ দিলেন সি কের হাতে মিড অনে। হ্যাসেট ১৫৫ মিনিটে ১৭টা ৪ মেরে ১২৫ রান করলেন। দল ৩০০/৯। ব্রেমনার এলেন। উইলিয়াম হুক করলেন এই সময় সারভাতের বলে। পুঁটু স্কোয়ার লেগে দশ গজ দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচ লুফলেন। ২১৪ মিনিটে অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস ৩০৪ তুলল মাত্র ৬৩.৫ ওভারে।

সাড়ে তিনটার সময় পূর্বাঞ্চল নামল ২৮১ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে। ৩:৪০ নাগাদ শুঁটে স্লিপে ক্যাচ তুলে আউট(৬)। পূর্বাঞ্চল ১৫/১। উইলিয়াম উইকেট নিলেন। মুস্তাক তখন অন্য মুডে।

রোপারের প্রথম বলে চার, দ্বিতীয় বলে ফাইন লেগ দিয়ে চার, তারপর ওই ওভারে আরও একটা। বুঝিয়ে দিলেন তাঁর লক্ষ্য কী। এক ওভারে তিনটে চার। ওভার শেষ হল ৩:৪৫। পূর্বাঞ্চল ২৮/১। তখন পুলিশ সরে গেল অবরোধ থেকে।

ঠিক হল মিছিল শুরু হবে। সব দলের পতাকা থাকবে। লীগের চাঁদ তারা খচিত সবুজ পতাকা, কংগ্রেসের চরকা দেওয়া তেরঙ্গা ও কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকায় হলুদ কাস্তে হাতুড়ি পতাকা নিয়ে ডালহৌসি চত্বরে মিছিল শুরু হল। শিক্ষাবিদ জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর মেয়ে) তখন ওই এলাকা থেকে গাড়ি করে প্রস্থান করলেন, কিন্তু বালিগঞ্জে মিলিটারি ট্রাক তাকে পিষে দিয়ে গেল ইচ্ছাকৃতভাবে।

তখন ঠিক চারটে। টি টাইম হল। পূর্বাঞ্চল ৪৫/১। ডালহৌসি এলাকা কাঁপিয়ে মিছিল চলছে, স্লোগানে স্লোগানে কাঁপছে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘লাল কেল্লা তোড় দো’, ‘সুভাষ বসু জিন্দাবাদ’, ’ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘বন্দেমাতরম’, ‘নারা-এ-তাকবীর’…।

সারভাতে চায়ের পর এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়লেন। দল তখন ৪৬/২। সারভাতে ১৩। ক্রিস্টোফানীর বলে আউট হন। নামলেন ডেনিস কম্পটন। নেমেই ক্রিস্টোফানীকে হুক আর লেট কাট। মুস্তাকও মারছে। ৬১ মিনিটে হাফ সেঞ্চুরি করলেন। ৪:৪৮ নাগাদ পূর্বাঞ্চল ১০২/২। কম্পটনও পেটাচ্ছে। দিনের শেষে মুস্তাক ৫৪ রানে ব্যাটিং, কম্পটন ৩৯ রানে ব্যাটিং, ৩০ ওভারে পূর্বাঞ্চল ১২২/২। তখন বাজে ৫টা।

খবরে জানা যাচ্ছে যে শহরে সারাদিন বাস ট্রাম চলেনি, আগামীকাল হরতাল ঘোষণা করেছে সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন। এদিকে পূর্বাঞ্চল দলের লক্ষ্য ১৫৯। সারাদিন হাতে। তখন দুই টেস্ট ব্যাটসম্যান ব্যাট করছে। সি কে, সি এস, নিম্বলকারের ব্যাট করা বাকি।

সন্ধেবেলায় দেখা গেল মোহনবাগান ক্লাব অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দলকে চায়ের নিমন্ত্রণ করেছে। রাগে ফেটে পড়লেন মোহনবাগানের অধিনায়ক অনিল দে। তিনি সেই রাতেই ক্লাব ছাড়ার কথা ঘোষণা করে চিঠি দিলেন সংবাদপত্রে। যোগাযোগ করলেন কিছু আন্দোলনকারীদের। কাল ইডেনে কিছু একটা করাই তাঁর লক্ষ্য।

পরের দিন খবরের কাগজের পাতায় পাতায় চমক। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বিবৃতি দিলেন ‘বিক্ষোভ প্রদর্শন নাগরিকদের জন্মগত অধিকার’। এদিকে মৃত্যুর সংখ্যা তখন দাঁড়িয়েছে ২১-এ। এর মধ্যে একজন ছিলেন আশুতোষ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের (বর্তমানে শ্যামাপ্রসাদ কলেজ) প্রথম বর্ষের ছাত্র অনিমেষ চৌধুরী।

সেই দিন (২৩ নভেম্বর) পূর্ণ হরতালের ডাক দেওয়া হল। এদিকে মোহনবাগান অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দলকে চা-পানে আমন্ত্রণ করার কারণে অনিল দে পরের দিন বিবৃতি দিলেন খবরের কাগজে:

‘(বার্ত্তা সম্পাদক, যুগান্তর)

প্রিয় মহাশয়,

              যেদিন সাম্রাজ্যবাদী সরকারের গুলীতে আমাদেরই শত শত দেশবাসী আত্মবলীদান করিলেন সেইদিন সন্ধ্যায় মোহনবাগান ক্লাব অস্ট্রেলিয়ান সামরিক দলকে চা-পানে আপ্যায়িত করায় আমি মর্মাহত হইয়াছি। জাতির এই সঙ্কটকালে মোহনবাগানের ন্যায় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষরা বিদেশীদের চা-পানে সম্বর্ধিত করিয়া কি কোনও গৌরব লাভ করিলেন? ক্লাব কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে জনসাধারণ এই কার্য্যের জন্য কৈফিয়ত তলব করিবার অধিকার নিশ্চয়ই আছে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।
            যে প্রতিষ্ঠান জাতীয় স্বার্থের বিরোধে কাজ করে তাহার সহিত আজি হইতে আমি সকল সংস্রব শেষ করিলাম। আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন কোন ব্যক্তিরই এই প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্ক থাকিতে পারে না।
                                                                                           আপনাদের বিশ্বস্ত
                                                                                                   অনিল দে
                                                                            ৫৮/১ এইচ রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট
                                                                                                   কলিকাতা’

এই চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘অনিল দে’র মোহনবাগান ক্লাব ত্যাগ’ হেডিং দিয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ নভেম্বর, চতুর্থ পাতায়।

দুপুর বারোটার সময় সি এ বি সভাপতি মিস্টার লেসলি, সি কে নাইডু, লিন্ডসে হ্যাসেট, সি এ বি সম্পাদক পি গুপ্ত, এবং আম্পায়ারদ্বয় তিন মিনিটের নীরবতা পালন করলেন শহর জুড়ে চলা অনভিপ্রেত ঘটনায় মৃতদের উদ্দেশ্যে।

নীরবতা শেষ হতেই দর্শক আসন থেকে স্লোগান শুরু হয়ে যায় ‘জয় হিন্দ’….. ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’…..।

এরপরেই ১২:১০ নাগাদ খেলা শুরু হল। প্রথম বলেই রোপারের বলকে লেট কাট করে বাউন্ডারি সীমানা পার করিয়ে দিলেন মুস্তাক। কিন্তু উইলিয়াম এসেই বোল্ড করলেন মুস্তাককে। মুস্তাক ৫৮ করে আউট (৭৬ মিনিট, ৮×৪)। পূর্বাঞ্চল ১২৭/৩। নামলেন নির্মল চ্যাটার্জী। কিন্তু পেপারের বলে এল বি ডব্লু হয়ে ফিরলেন। দল তখন ১৩১/৪। নির্মল মাত্র ১ রান করেছেন।

নামলেন সি কে নাইডু। এরপরেই গ্ল্যান্স করে কম্পটন দলকে ১৫০ রানে পৌঁছে দিলেন। উইলি তখন দারুণ বল করছেন (৬-৩-১১-১)। ক্রিস্টোফানী এলেন। কোনো কাজ হচ্ছে না। সি কে বেশ খেলছিলেন। হঠাৎই স্টাম্পড হলেন। দলের রান তখন ১৭০/৫। পেপারের বলে আউট হওয়ার সময় তাঁর রান ১১। নামলেন সি এস।

দুপুর একটা। পূর্বাঞ্চল ১৮৬/৫। কম্পটন তখন ৮৬ রানে ব্যাট করছেন। সি এস ২। অনিল দে কিছু সঙ্গী নিয়ে মাঠে ঢুকে পড়ে কম্পটন এর দিকে এগিয়ে গেলেন। খেলা বন্ধ। অনিল দে গিয়ে বললেন “Mr Compton, you very good player, but the match must stop now.” কম্পটন সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দিলেন লিন্ডসে হ্যাসেট কে। বললেন, অতিথি দলের অধিনায়ক মাঠে থাকতে তিনি কীভাবে খেলা থামাতে পারেন? হ্যাসেট এসে প্রথমেই বললেন যে তাঁরা মৃতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শোক প্রকাশ করেছেন খেলা শুরুর আগে। ততক্ষণে গ্যালারী থেকে স্লোগান ভেসে আসছে ‘জয় হিন্দ…. সুভাষ বসু জিন্দাবাদ….লাল কিল্লা তোড় দো… ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। হ্যাসেট জানতে চাইলেন তাঁদের কাছে সিগারেট আছে কিনা। নেই জেনে সবাইকে মাঠের বাইরে আলোচনায় ডাকলেন। খেলা বন্ধ হল লাঞ্চের ৪৫ মিনিট আগে লাঞ্চ ঘোষণা করে।

উল্লেখ করা যাক, এই সময়ে মাঠে কিথ মিলার ছিলেন। তখনও সরকারি টেস্ট খেলেননি। যখন এরপর খেলা শুরু করেন, তারপর যতবার মাঠে কম্পটনকে নামতে দেখেছেন, সামনে গিয়ে বলেছেন “Mr Compton, you very good player, but the match must stop now”। তাঁদের বন্ধুত্ব প্রায় নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, যে কারণে আসেজে এখনও স্পিরিট অফ ক্রিকেট মেডেলটা মিলার-কম্পটনের নামে দেওয়া হয়। সেই স্পিরিটের মূল ভিত্তি কোনো ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া দলের ম্যাচ নয়।

আলোচনায় কী হয়েছিল বলা মুশকিল। তবে বিক্ষোভকারীদের বিলিতি সিগারেট খাইয়ে শান্ত করে হ্যাসেট বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কিছু ছাত্র ছিল যাঁরা মাঠে আগে থেকেই ঢুকে দর্শক আসনে বসে ছিল। ১:৪৫ মিনিটে পুনরায় খেলা শুরু করা হয়। ২:১৫ নাগাদ হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে পেপারের বলে দুটো চার মারেন সি এস নাইডু। দলের রান ২০০। ১৬০ মিনিট ব্যাট করে। ২০৬ রানের মাথায় পেপারের বলে আবার চার মারেন সি এস। পূর্বাঞ্চল ২১০/৫। উইলিয়ামস এলেন ক্রিস্টোফানীর জায়গায়।

তখন ২১৩ রান। এই ওভারে মিড অফ আর স্লিপ দিয়ে দুটো চার মারেন কম্পটন। এরপরেই উইলিয়ামসের বলে ১ রান নিয়ে কম্পটন ১৪২ মিনিটে ১০০ রান পূর্ণ করেন (১৫×৪)। এটি ভারতের মাটিতে প্রথম শ্রেণির খেলায় ১৩ ইনিংসের মধ্যে তাঁর ষষ্ঠ শতরান। এই ইনিংসেই তিনি ভারতের মাটিতে মাত্র ৯টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ১০০০ রান করে ফেলেন। এরপর আর একটাই ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ ভারতে খেলেন তিনি।

পরের ওভারেই রোপারের বলে কম্পটন বোল্ড (১০১, ১৫৬ মিনিট, ১৫×৪)। ৬৩ রান খুবই দ্রুত যোগ (৪৫মিনিটে) করে জুটি ভঙ্গ হল। নামলেন বাউসাহেব নিম্বলকার। কিন্তু ২৩৮ এর মাথায় সি এস ৩৩ করে রোপারের বলে বোল্ড(৫২ মিনিট)। এলেন ফলসনকার। ১৯৫ মিনিটের মাথায় রোপারের বলে কাট করে চার মারলেন নিম্বলকার। ২৫০। একটু বাদে আবার চার। একই বোলারের বলে। ২৫৫ হল। এর পরেই হ্যাসেটের হাতে কভারে ক্যাচ দিয়ে ফলসনকার আউট ১ রান করে ক্রিস্টোফানীর বলে। পূর্বাঞ্চল ২৫৫/৮। তখনও ২৬ রান বাকি।

ওদিকে কলকাতা জুড়ে প্রচার চলছে জনগণকে শান্ত করার। বীণা দাশ সেই বালিগঞ্জের কাছে প্রচার করছেন যেখানে গতকাল জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর মৃত্যু হয়। ঠিক সেই সময় অস্ট্রেলিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পেপারের বলে একটা স্ট্রেট ড্রাইভে চার মারলেন নিম্বলকার। ২৬৫/৮। এরপরই ক্রিস্টোফানীর বলে স্কোয়ার কাট ও হুক করে পর পর চার। ওই ওভারের পঞ্চম বলে রান সমান। তারপরেই চার মেরে খেলা শেষ। ২১২ মিনিটে ৭৪.৫ ওভারে ৮ উইকেটে ২৮৪। অসম্ভব লড়াই করে জিতল পূর্বাঞ্চল। দর্শকরা মাঠে ঢুকে নিম্বলকারকে কাঁধে নিয়ে মাঠ ছাড়ছে। তিনি ৫ টা চার মেরে ৩৩ করে অপরাজিত।

জয়ের আনন্দের রেশ কেটে ওঠবার আগেই ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের প্যাভিলিয়নের বাইরে বিশাল হইচই। বিরাট গণ্ডগোল লাগল। একদল লোক বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তাঁদের স্লোগান হল ‘নো মুস্তাক, নো টেস্ট’। মুস্তাক আলীকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে টেস্ট ম্যাচে নির্বাচিত করা হয়নি। অথচ প্রিন্স ইলেভেন দলের হয়ে শতরান করেন অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে। পূর্বাঞ্চলের হয়ে করেন ৪৬ ও ৫৮। ফলে বাদ পড়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বেসরকারি টেস্টে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি প্রথম বেসরকারি টেস্টেও খেলানো হয়নি। স্বভাবতই ‘ডার্লিং অফ ক্যালকাটা’ মুস্তাক আলী বাদ পড়ার খবরে বিরাট ঝামেলা শুরু হয়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেরোতে যাওয়ার মুখে ঘেরাও হন প্রিন্স দলীপ সিং (প্রধান নির্বাচক) ও হোমি কন্ট্রাক্টর (অন্যতম নির্বাচক)।

এরপর বিক্ষোভকারীদের প্রতিনিধি দল ক্লাব হাউসে ঢোকে (আজকের বি সি রায় ক্লাব হাউস নয়, পুরোনো)। সেখানে পঙ্কজ গুপ্ত তাঁদের জানান যে তিনি বিশেষ ভাবে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। বিক্ষোভকারীদের দাবী ছিল তিনটি :-

(১) মুস্তাক আলীকে বাদ দিয়ে কলকাতায় টেস্ট করা যাবে না। তাঁকে দলে নিতেই হবে।
(২) বিজয় মার্চেন্টকে সরিয়ে মুস্তাক আলীকে ভারতীয় দলের অধিনায়ক করতে হবে।
(৩) অবিলম্বে দলীপ সিংকে সরিয়ে সি কে নাইডু কে প্রধান নির্বাচক করতে হবে।

সি কে পরে ভারতের প্রধান নির্বাচক হন। পরের বেসরকারি টেস্টে মুস্তাক দলে ফেরেন, যদিও ক্যাপ্টেন হননি। ওই ম্যাচে কেন, কোনোদিন জাতীয় দলের অধিনায়ক হতে তাঁকে দেখা যায়নি। ওই বেসরকারি টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৩১ ও ৩।

কলকাতা মুস্তাককে কোনোদিন খালি হাতে ফেরায়নি। এরপরে টেস্টে শতরান করেছেন, হাফ সেঞ্চুরি করেছেন, রঞ্জি জিতেছেন অধিনায়ক হিসেবে, তাঁর পুত্র গুলরেজ আলী স্কুল ক্রিকেটার হিসেবে কলকাতায় এসে কুচবিহার ট্রফিতে দারুণ বল করেছেন, গুলরেজ কোচ থাকাকালীন মুস্তাকের পৌত্র আব্বাস আলী মধ্যপ্রদেশের হয়ে উইলস ট্রফি খেলতে এসে অসম্ভব জায়গা থেকে উইলস ট্রফি ফাইনাল জয়ী হয়েছেন।

দেশের জনতা সেদিন জেগে উঠেছিল। প্রায় অভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছিল কলকাতায়। ১৯৪৫-র নভেম্বর এর রেশ কাটিয়ে ভোরের কুয়াশা কাটিয়ে বোম্বে শহরে নৌ বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, জেগে উঠেছিল মহা ভারতের জনতা। কল্লোলিত হয়েছিল নগর কলকাতা। রশিদ আলী দিবসকে ঘিরে ফেব্রুয়ারি মাসে তোলপাড় হয়েছিল। এই নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসের সময় যখন কলকাতা হয়ে উঠত ব্রিটিশ নয়নের মণি, সেই সময়টায় ব্রিটিশ হৃদয়ের ত্রাস হয়ে উঠেছিল। সুকান্ত লিখেছিলেন ‘এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ/ দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ/… নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট’…। সলিল লিখেছিলেন ‘গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বরু পিনাকির বেজেছে বেজেছে বেজেছে/ মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরণী ভাসানো ঢেউ উঠছে’…..।

সেই জোয়ারেই চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে ব্রিটিশ পুলিশ পালাতে বাধ্য হয়, সেই জোয়ার গুলির আঘাত সহ্য করেও এগিয়ে যায় দৃপ্ত ভঙ্গিতে, মাঠে খেলা থামায়, এবং রাজতন্ত্রী বা বড়ো বুর্জোয়ার বদলে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি দলে না থাকলে বা অধিনায়ক – প্রধান নির্বাচক না হলে খেলা আটকে রাখার দাবী তোলে।
তাই সুকান্ত লিখেছিলেন:

‘….. আর কতদিন দু চক্ষু কচলাবে
জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু
সে পথে আমাকে পাবে
জালালাবাদের পথ ধরে ভাই ধর্মতলার মোড়ে
দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে
ক্ষুব্ধ এদেশের রক্তের অক্ষরে’….

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২