দ্বজর : অনিরুদ্ধ চাকমা – অনুবাদ : ড. পদ্ম কুমারী চাকমা
গ্রামের নাম কুদুকছুরি। গ্রামবাসীরা অভাবী হলেও সৎচিন্তা, সদ্ভাবনা ও ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার মানসিকতা রাখে। শহরের হাওয়া থেকে অনেক দূরে তাদের অবস্থান। গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, নেই ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা, নেই স্কুল, নেই হাসপাতাল। অসুখ-বিসুখে একমাত্র অবলম্বন ওঝা, বৈদ্য। জীবিকা বলতে জুমচাষ ও শিকার। গ্রামের নাম কুদুকছুরি হওয়ার পেছনে একটি সুন্দর কাহিনি রয়েছে। কাহিনিটি হল — একদিন মানেকচান নামে এক শিকারি শিকারে যায়। সেই রাতে সে দেখতে পায় ভয়ংকররূপী এক সজারু। সজারুর মাথায় ছিল এক মণি। মানেকচান প্রথমে দেখে সামান্য ভয় পায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে মন্ত্র পড়া সর্ষে বন্দুকের গুলির সঙ্গে ঢুকিয়ে গুলি ছোঁড়ে। এক গুলিতে সজারু কুপোকাত। কিন্তু সজারুটি পুনরায় উঠে হাটতে থাকলে মানেকচান অবাক হয়। শেষে সে সজারুর পিছু নেয়। যেতে যেতে শেষে এক ঘন জঙ্গলে পৌঁছায়। সেখানে অনেক সজারু, হরিণ, জংলি শূকর আর নানা পশুপাখির আনাগোনা। পরের দিন মানেকচান বাড়ি এল। সেদিন আর শিকারে বেরল না। মনে একটু ভয়। শিকার জীবনে এই প্রথম আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী সে। এর আগে এমনটি ঘটেনি। সে, রাতে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটি — “মানেকচান তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে কিছু করব না। আমি হলাম সজারু দেবতা। তুমি সজারু শিকার করতে পারো। কিন্তু শনি-মঙ্গলবার, পূর্ণিমা-অমাবস্যা, অষ্টমীতে শিকারে যাবে না। সেদিনগুলিতে অন্য কেউ শিকার করলেও সে শিকারের মাংস তুমি খাবে না।”
অনাবাদী জমি আর শিকার চাকমাদের অতি প্রিয়। অনাবাদী জমিতে মানেকচান আর প্রচুর চাকমা পরিবার নতুন বসত গড়ে তোলে। বসতির পাশেই একটি ছোটো নদী বয়ে চলেছে। সেই নদীটির নাম রাখল কুদুকছুরি। স্বাভাবিকভাবে নতুন বসতের নামও হল কুদুকছুরি গ্রাম। কিন্তু এখন আর সেই অনাবাদী জমি নেই, নেই সজারু দেবতার সম্পদ, নেই হরিণ, গণ্ডার শূকর। যেসব জন্তুরা রয়েছে তারা এতই চালাক, মানুষের আওয়াজ পেলেই পালিয়ে যায়। এখন জুমচাষ করেও খাবার জোটে না। আছে শুধু মানেকচানের সেই শিকারের গল্পকাহিনি আর চাকমাদের প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার ইতিকথা। যারা একসময় সবকিছু ভাগাভাগি করে নিত এবং খেত।
সেই গ্রামে জন্মেছে দ্বজর। দ্বজর পড়াশোনায় মেধাবী এবং চাকমা অক্ষরজ্ঞানে সুপণ্ডিত। সে বিজ্ঞান বিভাগে দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে এনআইটি খড়্গপুরে পড়তে যায়। বাবা ধর্মজয় খুব কষ্টে তাকে পড়াচ্ছে। ছেলেও মা-বাবার কষ্ট বুঝতে পারে। সে মনে মনে পণ করে মা-বাবার শেষজীবনে তাদের সুখে রাখবে। অজ পাড়া-গাঁ থেকে এনআইটি পড়াও সহজ ব্যাপার নয়। দ্বজর এমনই একজন মানুষ সে যেখানে থাকুক না কেন তার গ্রামের কথা, জাতভাইদের কথা, কীভাবে স্বজাতিকে উন্নত করা যায় সে চিন্তায় বিভোর থাকে। মাতৃভূমির জাতভাইদের কাছে আধুনিক যুগের চিন্তা-চেতনাকে তুলে ধরার প্রবল আগ্রহ তার। সে কোনোভাবেই কোনো যুবতীর ভালবাসার ফাঁদে পা বাড়ায় না। এ ব্যাপারে সে ভীষণ সতর্ক। তাই শত চেষ্টা করেও কোনো সুন্দরী যুবতী তাকে ফাঁদে ফেলতে পারেনি।
চাকমা জাতির উন্নতিকল্পে তৎপর চাকমা বাবুরা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স (ICC) করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ কনফারেন্সে বিশেষ করে CADC (মিজোরাম)-এর অবদান বেশি। কনফারেন্সে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন দেশ-বিদেশের (ভারত-বাংলাদেশ) গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। যাদের চাকমা অক্ষর আর কাস্টমারি ল’ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রয়েছে। এছাড়াও কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী ও সাংস্কৃতিক দলকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দ্বজরও সে কনফারেন্সে নিমন্ত্রিত অতিথি। কেননা সে চাকমা অক্ষরজ্ঞানে সুপণ্ডিত আর একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। চাকমা অক্ষরের সফ্টওয়্যার বিষয়ে তার ভালো জ্ঞান রয়েছে। কনফারেন্সে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে সাধুবাদ দিয়ে সম্মানিত করে। সবার যুক্তি বয়স কম হলেও দ্বজরের জ্ঞান আছে। সেই কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হয়েছে এক বিশিষ্ট কবি ও সঙ্গীত শিল্পী সুজাতা। কনফারেন্সে কবিতা পাঠ ও গান গেয়ে সে-ও সুনাম অর্জন করে।
সুজাতার বাড়ি মোনচুরি গ্রামে। মা-বাবা দুজনেই চাকুরীজীবী। কলকাতার যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ছে। সে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। বিশিষ্ট শিল্পী ও কবি হবার স্বপ্নে বিভোর সে। মা-বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। প্রথম প্রথম কলকাতায় গিয়ে মা-বাবার জন্য মনখারাপ হত, কাঁদত। পরে সে মানিয়ে নেয়। কনফারেন্সেই দ্বজর ও সুজাতার পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, তারপর ভালোলাগা। তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে ইন্টারনেট আর ফোন। এভাবে তাদের ভালোলাগা গভীর থেকে গভীরতর হয়। ধীরে ধীরে তারা ভালোলাগার সমুদ্রের ঢেউয়ে মিশে যায়। মানুষের মন বোঝা দায়। ভগবানও এ ব্যাপারে অপারগ। মানুষের মন পরিবর্তনশীল, বাতাসের চেয়েও দ্রতগামী। বন্ধুত্ব, রং বদলে প্রেমে রূপান্তরিত হল। দুটি মন একসাথে কাটানোর স্বপ্নে বিভোর। তারা এখন একমন একপ্রাণ। আসলে ভালোবাসা তেতো না মিষ্টি না টক, যে প্রেমে পড়ে সেই-ই বোঝে।
ভালোবাসা একদিকে যেমন মহান সৃষ্টিকারী তেমনি ধ্বংসকারীও বটে। আসলে ভালোবাসা একটা নেশা, এই নেশা মদের নেশা থেকেও মারাত্মক। ভালোবাসা অনেক সময় জীবনকে ধ্বংস করে দেয়, মেরে ফেলে দেয় জীবনের ইচ্ছা, আশা, নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম। তবুও মানুষ ভালোবেসে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপিচুপি কথা বলা, এক জায়গায় বসে থাকা এসবের আনন্দই আলাদা।
ভালোবাসার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে দ্বজর আর সুজাতা। প্রতিদিন প্রেমালাপ চলে SMS আর ইন্টারনেটে। প্রিয় মানুষের নেশা, আশা, স্বপ্ন…। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন। এদিন সুজাতা ভালোবাসার উপহারস্বরূপ লাল গোলাপ আর কার্ড পাঠিয়েছে। কার্ডে লিখেছে –“আমরা হব চাকমা জাতির প্রথম ভালোবাসার দিন সৃষ্টিকারী প্রেমিক-প্রেমিকা। দিনটির নাম হবে ‘লরবো-মিদুঙি’ দিন। এই দিনটি ভ্যালেন্টাইন ডে’র থেকেও স্মরণীয় করে তুলব। ভালোবাসার সোনার সেতু তৈরি করে দেখাব। যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকব প্রত্যেক প্রেমিক-যুগলের কাছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনটি হোক প্রেমিক যুগলের স্বপ্নের দিন, ভালোবাসার দিন।”
দ্বজরও ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে পাঠিয়েছে একটি নাগেশ্বরী ফুল। সাথে একটি কার্ড। কার্ডে লিখেছে –“ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ এই নাগেশ্বরী ফুলটি দিলাম। মনে করো না আমি নাগেশ্বরী ফুল ভালবাসি, তার সুগন্ধে আহ্লাদিত হই। তুমি যদি আমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে পারো তাহলে কেন এই নাগেশ্বরী ফুলটি দিলাম তা বুঝতে পারবে। ফুলটি যত্ন করে রেখো। ইতি তোমার ভালোবাসা – দ্বজর।”
নদীর জলের স্রোতের মতো তাদের ভালোবাসার সুখের দিনগুলি বয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনা শেষ হল। দ্বজর চাকরি পেল এক নামী সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে। মাসিক বেতন ত্রিশ হাজার টাকা। দুজনেই ভীষণ খুশি। তাদের স্বপ্ন বাস্তবরূপ পাচ্ছে। সংসার জীবন কীভাবে সাজিয়ে তুলবে, কার কী স্বপ্ন এই বিষয়ে আলোচনা করতে সুজাতা বলে, — বিয়ের এক বছর পর আমরা শহরে জায়গা কিনব, যদি কিনতে না পারি তাহলে বাবার কাছ থেকে এক কাঠা জায়গা নিয়ে ভালো এবং সুন্দর ঘর বানাব। আমি তোমার সেই জঙ্গলে পড়ে থাকতে পারব না। তুমি আমাকে স্বাধীনতা দেবে। আমার ইচ্ছেগুলোর মর্যাদা করবে।
— প্রিয় তুমি বুঝেও না বোঝার ভান করছ? তুমি তো আমার সাথেই আমার চাকরিস্থলে যাবে। কেন এসব কথা বলছ? স্বাধীনতার কথা যে বলছ আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না। নাকি তুমি আমাকে ভালোবাসো না। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়কে সম্মান করবে, ভালোবাসবে, দু’জন দুজনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে। তুমি কি মনে করছ বিয়ের পর তোমাকে কষ্ট দেব? যা করব তোমাকে জানিয়ে করব। দু’জনে মিলে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
— কথাগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে তুমি আমাকে সারাজীবন রান্নাঘরেই রাখতে চাও। আমি কি চাকরি করব না? এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি!
— তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করে দেখছ? নাকি ফাজলামো করছ? আমি কি তোমাকে চাকরি করতে মানা করেছি?
— এখানে ফাজলামোর কথা নয়, জীবনের সিরিয়াস কথা চলছে। তুমি আমার দাবি মানতে পারলে বলো মানতে পারছি আর না পারলে বলো পারছি না। মানতে না পারলে বিয়ের পর ঝামেলা তৈরি হোক সেটা আমি চাই না, এটাই আমার শেষ কথা।
— শুধু তোমার দাবি নয়, আমারও দাবি রয়েছে। তোমাকে ভালোবেসে যেমন তোমার ইচ্ছে বা দাবি পূরণ করব, ঠিক তেমনি আমার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন রয়েছে, স্বজাতির কথাও ভাবতে হবে। শুধু একগুঁয়ে হলে চলে না। (একটু রাগত স্বরে)
— ঠিক আছে, ঠিক আছে। ভালো হয়েছে। আমি এত ঝামেলা মাথায় নিতে পারব না। আজকে তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। তুমিও আমার খবর নেবে না, আমিও তোমার কোনো খবর নেব না। তোমার আমার সাতদিনের ভালোবাসার নাটক এখানেই শেষ। গুড বাই, সুখে থেকো, আফসোস কোরো না।
শেষ হল দীর্ঘদিনের ভালোবাসার সুখস্বপ্ন। ভালোবাসা কি এতই খারাপ, এতই অন্ধ, ধনদৌলতের নেশায় সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যায়! আসলে বর্তমান দিনের ভালোবাসা তিনদিনের পাগলামো ছাড়া কিছুই নয়। হারিয়ে গেছে লরবো-মিদুঙি, রাধামন-ধনপুদির ভালোবাসার ইতিহাস।
আলাদা হওয়ার পর সুজাতার খবর কে রাখে! এদিকে বেচারা দ্বজরের মনে শান্তি নেই, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, কখন চোখ দিয়ে জল পড়ে সেদিকে হুঁশ নেই। হাজার হোক প্রথম ভালোবাসা। অনেক মেয়েই তো তাকে প্রেম নিবেদন করেছে, কিন্তু সে রাজি হয়নি। কীভাবে যে সুজাতার ভালোবাসার ফাঁদে পড়েছে তা তার অজানা। সবাই অবাক। ভালোবাসার দুঃখ ভোলার জন্য চাকরি থেকে একমাস ছুটি নিয়ে গ্রামে যায়। গ্রামে গিয়ে তার জ্ঞাতিভাইদের দুর্দশা দেখে সে স্তম্ভিত। এমএ, বিএ পাশ করে বাড়িতে রয়েছে, মাধ্যমিক টুয়েলভ পাশ করা ছেলেমেয়ের কথা বলে লাভ নেই। চাকরির বাজার মন্দা। খেটে খাবে তারও উপায় নেই। চাকরির সুযোগ কমে গেছে। চাকরি পেতে গেলে রাজনীতির মদতপুষ্ট হতে হবে, নতুবা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে হবে। রাজনীতিতেও স্বচ্ছতা নেই। এমএলএ-র সিট সংখ্যাও সীমিত। যে জায়গায় তিনজন এমএলএ-র সিট বরাদ্দ সে জায়গায় শুধু একজনকে সিট দেওয়া হয়। জাতির জন্য কোনো কথা বলার সুযোগ নেই, বললেও কাজ হয় না। এই হল পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে সে আর স্থির থাকতে পারে না। কী করা যায়, জাতিকে কীভাবে রক্ষা করা যায় এই চিন্তা করতে থাকে। এই ডামাডোলে সে সুজাতার কথা বেমালুম ভুলে গেল। শেষ পর্যন্ত বিশিষ্ট কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনায় বসে। সমস্যার গভীরতার কথা সবাই অনুধাবন করলেও কেউ এগিয়ে আসতে চায় না। দ্বজর চেষ্টা চালিয়ে যায়। আর একটি আলোচনা সভার ডাক দেয়। ঘোষণা করে, চিঠি দিয়ে ডাকা হবে না। যারা জাতিকে ভালোবাসে তারা আসবে।
যথারীতি ১ তারিখ শামুকছড়া গ্রামে আলোচনা সভা বসে। উপস্থিত সদস্য সংখ্যা ত্রিশ-চল্লিশ জন। দ্বজর সভায় দাঁড়িয়ে বলে, “ভাই সকল ভেবে দেখ, শুধু সরকারের উপর ভরসা করে থাকলে চলবে না। এভাবে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। জাতির জন্য জীবন বিসর্জন দিতে কি তোমরা রাজি আছো? আমাদের সময় এসেছে। ছলে-বলে-কৌশলে না হলে বলপ্রয়োগ করতে হবে। কে কে রাজি আছো হাত তোলো।” সবাই হাত তুলে চিৎকার করে বলল, “জাতির উন্নতির কথা ভেবেই তো আমরা কষ্ট করে জমায়েত হয়েছি।” আলোচনা সভায় গঠন করা হল ‘চাঙমা ভালেদি জধা দল’ (‘চাকমা উন্নয়ন দল’)। এই দল সরকার থেকে অধিকার আদায়ে পথে-ঘাটে, শহর-বন্দরে আন্দোলনে নামবে। প্রয়োজন পড়লে রাজনৈতিক পথকে অনুসরণ করা হবে। দলের নেতার নাম দিকবন। তার কাজ হল চাকমা জাতির উন্নয়নকল্পে যে ন্যায্য অধিকার রয়েছে সেগুলি আদায়ের জন্য গণআন্দোলন শুরু করা।
দ্বজর প্রায় একশো জন শিক্ষিত যুবককে নিয়ে জঙ্গলে তাঁবু গাড়ল। গঠন করল CET (চাঙমা ইঞ্জেবী তম্বা)। সবাই শিক্ষিত ও জ্ঞানী। গরিব মানুষদের কষ্ট-দুঃখ দেওয়া তো দূর তাদের সুখী রাখাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তাদের কাছে রয়েছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। ক্রমান্বয়ে সরকারের উপর আক্রমণ শুরু করল। পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ করাতে সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু TSR- এর সঙ্গে সংঘর্ষে দু’জন শহিদ হয়েছে। সে দুজন হল দ্ববাদা আর সুবিজয়। দু’জনেই বিএ পাশ। শেষে সরকার বুঝতে পারে চাকমাদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। একদিকে চাকমা উন্নয়ন দল আর অন্যদিকে CET-এর অবিরাম যুদ্ধ আর যুদ্ধ। শেষপর্যন্ত কেন্দ্র আর রাজ্য সরকার যুগ্মভাবে আলোচনা সভার ডাক দেয়। সে ডাকে সাড়া দিয়ে দ্বজর আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়। আলোচনা সভায় কিছু দাবি উত্থাপন করে। দাবিগুলি হল –
১) বিধানসভার ইলেকশনে পাঁচজন MLA আর ADC ইলেকশনে তিনজন MDC-র সিট বরাদ্দ করতে হবে।
২) চাকমা হরফে চাকমা লেখা চালু করতে হবে।
৩) দশম শ্রেণি পর্যন্ত অর্থাৎ মাধ্যমিক অব্দি চাকমা ভাষায় একটি বিষয় থার্ড Language হিসেবে চালু করতে হবে।
৪) পড়াশোনা জানা সবাইকে চাকরি দিতে হবে।
৫) চাকমা রাইফেল বানিয়ে দিতে হবে।
আলোচনায় CBJD (চাঙমা ভালেদি জধা দল)-এর নেতা দিকবনের ডাক পড়েছে। সে-ও দ্বজরের দাবিগুলি সমর্থন করে। এছাড়া সে-ও চাকমা জাতির উন্নয়নের জন্য এক্সট্রা প্যাকেজ এবং চাকমা রাইফেল গঠন করার দাবি জানিয়েছে। একদিকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার অন্যদিকে CET এবং CBJD চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ সাত বছরের সমস্যা মিটে গেল। আলোচনায় প্রথম ও শেষ দাবি সংশোধন করা হয়েছে। পাঁচজন MLA-র জায়গায় তিনজন MLA আর তিনজন MDC-র জায়গায় দু’জন MDC-র সিট বরাদ্দ বলে চুক্তিপত্রে লিখিত হল। বাকি দাবিগুলিও মেনে নেওয়া হল। যথাসম্ভব পড়াশোনা জানা চাকমাদের চাকরি দেওয়া হবে।
চাকমা জাতির উন্নতিকল্পে একটি প্যাকেজ কেন্দ্র সরকার পুরো ভারতে চালু করবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে অধিকার আদায় করতে হলে দলের প্রয়োজন। কেউ কাউকে যেচে কিছু দেয় না। চিৎকার করে, জোর করে আদায় করে নিতে হয়।
আজকে দ্বজর ও দিকবনের সৎ সাহস ও সৎ চিন্তার ফলে চাকমারা ন্যায্য অধিকার পেল। দু’জনের মধ্যে দ্বজরের নাম পত্রপত্রিকার হেডলাইনে জ্বলজ্বল করছে। চাকমা জাতির অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। কেননা সে যে দাবিগুলি করেছে সে দাবিগুলি সবই ‘Human Rights’-এর Agenda-র মধ্যে পড়ে। মানবাধিকার আইনে সবার আন্দোলন করার অধিকার আছে।
সকাল এগারটায় সুজাতা স্কুলে যায়। তার স্কুলের স্টাফ ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকাটি পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করে, “সুজাতা এই ছেলেটিকে চেনো, নাম দ্বজর?” ফটো এবং নাম দেখে সুজাতা অবাক। সাত বছর আগের প্রিয় মানুষটি আজকে চাকমা জাতির অগ্রদূত। তার জন্য আজকে চাকমা জাতি ভালোভাবে বাঁচার অধিকার পেল। ভাবছে, কী ভুল করেছি। তুষের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে সে। কাউকে বলার নয়। ভুলটা তো তারই ছিল। সে বুঝতে পারছে। স্কুলেও মন বসছে না। ছুটি নিয়ে সোজা বাড়ি। আজকে বার বার দ্বজরের কথা মনে পড়ছে। কত ভালো ছিল দ্বজর। তার ভালোবাসায় কোনো খুঁত ছিল না। জানালার দিকে তাকাতেই নাগেশ্বরী ফুলের গাছটি চোখে পড়ল। বুঝতে পারল দ্বজরের উপহার দেওয়া নাগেশ্বরী ফুলের মূল্য। তড়িৎগতিতে গাছ থেকে নাগেশ্বরী ফুল পেড়ে এনে ফুলের তোড়া বানাল। তারপর পত্রিকা থেকে ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অনেক কষ্টে সে খুঁজে পেল। কিন্তু দ্বজরের সামনে যাবে কী করে? এদিকে দ্বজর ভবিষ্যতে চাকমা জাতির উন্নয়নকল্পে অন্যদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। যাইহোক, অপেক্ষা করে সুজাতা। এছাড়া উপায়ও নেই। সে তার সমস্ত অধিকার হারিয়েছে। আলোচনা শেষে দ্বজর দেখে নাগেশ্বরী ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগে।
– আমাকে চিনতে পারছ, আমি সুজাতা, পত্রিকায় তোমার নাম দেখে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল। না এসে পারলাম না।
– তোমার হাতে নাগেশ্বরী ফুলের তোড়া?
– সরি, আমি তোমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছি। তখন বুঝতে পারিনি তোমার ভালবাসার চিহ্ন নাগেশ্বরী ফুলকে। তুমি আমাকে যত্ন করে রাখতে বলেছ। আমিও রেখেছি। কিন্তু আজকে এই ফুলের তোড়া তোমাকে ফেরত দিতে আসিনি। পুরোনো প্রেম আর ফিরে আসবে না। আজকে আমরা দু’জনে মিলে এই নাগেশ্বরী ফুলের তোড়া বুদ্ধ মন্দিরে গিয়ে দান করব। এজন্য আমি এসেছি। এই ফুল দানের ফল পাব অনেক যুগ পরে। যখন আর্যমিত্র বুদ্ধ পৃথিবীতে জন্ম নেবেন তখন তুমি হবে এক বড়ো চক্রবর্তী রাজা আর আমি হব তোমার প্রথমা রানী।
এম্মাহি দোল ওয়েদে। অসাধারণ।