আলুরি – নন্দেশ্বর দৈমারি অনুবাদ: তপন মহন্ত

আলুরি – নন্দেশ্বর দৈমারি অনুবাদ: তপন মহন্ত

শেয়ার করুন

[নন্দেশ্বর দৈমারি—সমসাময়িক কালের বোড়ো ঔপন্যাসিক ও শক্তিশালী ছোটোগল্প লেখক নন্দেশ্বর দৈমারির জন্ম ১৯৫৫ সালে। বোড়ো সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য এই লেখকের ছোটোগল্পের তিনটি বই রয়েছে। বইগুলি হল: ‘থাংনাইনি দাওহা’ (১৯৮৫), ‘বক্সিং’ (১৯৯৩) এবং ‘ও বে নুহারনাই দালাঙা বাইগ্রেবনাইসী’ (২০০২)। ‘মঞ্জুবালা দেবী’ নামে একটি উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। ‘বক্সিং’ গ্রন্থটির জন্য বোড়ো সাহিত্য সভা প্রদত্ত সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ]

“বিরক্তিকর ভাবে তুমি কিচিরমিচির করছ কেন? তুমি কি একটু চুপ করে থাকতে পারো না?… অ্যাই! আলুরি! আর, তুমি কি অন্য কোথাও বাসা তৈরি করার চেষ্টা করছ?… তুমি ধুলোয় শুয়ে আছো কেন? তুমি কি খাড়া হয়ে থাকতে পারো না?… আলুরি, তোমাকে এখানে বিক্রি করার জন্য আনা হয়েছে! তুমি কি বুঝতে পারছো না?… তুমি কি বাজার দেখছ না, হে অন্ধ বন্ধু!

…কেউ জিজ্ঞেস করে না তোমার দাম কত এবং কেউ তোমাকে স্পর্শ করার সাহসও করে না। যদিও বা কদাচিৎ কেউ তোমার কাছে আসে কিন্তু তোমার কান্না শুনে চলে যায়। অন্য বিক্রেতারা তাদের কাছে টেনে নেয়, এত চাহিদা… তুমি আবার কাঁদছ… চুপ করো, আলুরি। শুধুমাত্র এখনই তুমি তোমার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছ! তুমি আশা করো, আমার কাছ থেকে ভালো কিছু পাবে…?”
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে, ওকে মারধর করতে না পেরে আলু রাগান্বিতভাবে ওকে খুব জোরে টান দেয়। টানা-হেঁচড়ায় আলুরির, যে এক জায়গায় ডিম পাড়তে পারে না, চারদিক ধুলোয় ভরে গেল। মুরগিটাকে এই অবস্থায় দেখে আলুর রাগ কিছুটা কমে।

আলু আমবাগানের বাসিন্দা। তার আসল নাম সৌমদ্রৌ। গায়ের রং ঘন কৃষ্ণবর্ণ হওয়ায়, সম্ভবত তার বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন সৌমদ্রৌ। রাখাল বালক হিসেবে ওনারির ওখানে থাকার পর তার নাম সৌমদ্রৌ থেকে আলু হয়ে যায়। প্রথম যেদিন সে কাজ করতে যায় সেদিন সে প্রচুর আলু খেয়ে ফেলে। তারপর থেকে তার নাম সৌমদ্রৌ থেকে আলু হয়ে যায়। ওনারির মা পরের দিন থেকেই তাকে আলু ডাকতে শুরু করেন।

যদিও এরপর অনেক বাড়িতে গোপালক হিসেবে কাজ করেছে এবং তারপর সেই অবস্থা থেকে ওপরে উঠে গৃহভৃত্য হয়েছে, তারপর বিয়ে করেছে, তবুও সৌমদ্রৌ তার আসল নাম আর ফিরে পায়নি। আলু নামেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সে। নিজের কাজে কতটা দক্ষ তা প্রচার করতে পছন্দ করত না আলু। কিন্তু আলু তার বিয়ের আগে অলসভাবে শুয়ে-বসে সময় কাটায়নি। কিছু মহাজন বা অন্য মানুষেরা সর্বদা কাজের জন্য তার খোঁজ করতেন। তাই আলুকে কখনোই কর্মহীন অলস ভাবে বসে থাকতে হয়নি।

গোপালক বা গৃহভৃত্য হিসেবে কত অর্থ উপার্জন করত তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু তার মনে আছে যে, আবরা মহাজনের বাড়িতে পাঁচ বছর কাজ করার পর, তাঁর বাড়িতে কাজ করা একটি অনাথ মেয়েকে সে বিয়ে করেছিল। আর তখন থেকে ডালির সাথে সে একটি পরিবারিক জীবন শুরু করার সুযোগ পেয়েছিল।
যদিও তিন বছরের বিবাহিত জীবন যাপন করে আলু কোনো সন্তানের মুখ দেখেনি, তবুও ডালির সহযোগিতায় সে সংসারটা সুষ্ঠভাবে চালাতে পারত।

ছোটো দুই সদস্যের পরিবারের দেখাশোনার জন্য প্রতিদিন আলুকে দিনমজুরের কাজ করতে হত। সন্ধ্যায় আলু তার সাথে করে যে সামান্য চাল নিয়ে আসত, ডালি তার নিজের সংগ্রহ করা সবুজ শাকসবজি দিয়ে একসাথে খাবার তৈরি করে আলুকে খেতে দিত।
মাঝে মাঝে ডালি মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে এক-দুই কেজি চাল কিনত।

আশেপাশে কোনো বাজার না থাকায় সেই জায়গাটিকে আবসু সাপ্তাহিক বাজার হিসেবে ঘোষণা করে। দিনটা ছিল শনিবার। দিন নির্ধারণ নিয়ে আবসুর ছেলেদের পছন্দটা সঠিক ছিল। বাজারের আশেপাশের লোকজন ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। তারা শনিবারে বাজারে আসার সুযোগ পেত।

আলু খুব কাছ থেকে বাজারটা দেখে আসার সুযোগ পেয়েছিল। গ্রামে গ্রামে মাইকে নতুন বাজার নিয়ে যে প্রচার করা হয়, তাও শুনেছে আলু। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এই প্রচার সমানে চলে। কোথাও কোথাও পোস্টারও লাগানো হয়।

আলু সেই জায়গাটিও দেখেছিল যেটা একসময় আগাছায় ভরা ছিল যা ট্র্যাক্টর চালিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। আবসুর ছেলেরা কিছুক্ষণ আগে জায়গাটিকে বাজার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পরিষ্কার করেছিল।
যারা স্টল চেয়েছিল তাদের ছোটো ছোটো প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। ছেলেদের সহায়তায় এক মাসের মধ্যে দোকানগুলো উঠে আসে। সবাই নিজেদের স্টল তৈরি করে নেয়।

কোথায় বিভিন্ন স্টল বসানো হবে তা হয়তো আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। যে কারণে কাপড়ের দোকানগুলো ছিল এক সারিতে, জুতার দোকান আরেক সারিতে আর মাংসের দোকানগুলো এক সারিতে।

চার পাশেই ছিল চায়ের স্টল। মাঝখানে সবজি বিক্রির জায়গা। ছেলেদের মতে এই জায়গাটি সেরেংদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সম্ভবত তাদের ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিছু সেরেংরা বাঁধাকপি, আলু, বেগুন ইত্যাদি বিক্রি করছে।

আলু দেখতে পায়, উদালগুড়ি, টংলার মতো শহর থেকে সবজি আনা হচ্ছে। উদালগুড়ি বাজারে হাওয়া মেঠাই বিক্রি করা বিহারিরা এই বাজারে নিজেদের জায়গা খুঁজে পেয়েছে। কিছু বাঙালি দোকানদার আসবাবপত্র বিক্রি করছে। বরপেটা থেকে আগত সুপারি ব্যবসায়ীদেরও সুপারি কিনতে দেখা গেছে। নারকেলের কারবার করা এক বৃদ্ধও সেখানে ছিলেন। আলুর মতে, প্রথম দিনের বাজার বেশ জমজমাট ছিল।

ছেলেদের ইচ্ছা অনুযায়ী, বোড়ো সমাজের লোকেরাও তাদের বাড়ির সামনের বাজারে কিছু না কিছু করার জায়গা খুঁজে পেয়েছে। মানুষ যেন ব্যবসা-বাণিজ্যের সব সুযোগ হাতের কাছে পেয়ে গেছে! আলুর মতে, বোড়ো জনগণের কাছে এ যেন এক ধরনের বিপ্লব।

একজন নবিস হিসেবে আলু এসবই ভাবত আর সে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করত ঘটমান বিষয়গুলো। বিভিন্ন ভাবে বোড়োল্যান্ড আন্দোলন বোড়োদের মাঝে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

আন্দোলন বোড়োদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আলু এভাবেই সব পর্যবেক্ষণ করত।

আন্দোলনের পর বোড়োরা চায়ের ব্যবসা শুরু করে। তারা ট্রাক্টর ব্যবহার করে উন্নত চাষাবাদ করা শিখেছে। তারা শহরে দোকান বসাতে শিখেছে। তারা শিলং এবং গুয়াহাটিতে তাদের বোনা কাপড় বিক্রি করার মতো আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে। তারা ঠিকা নিতেও শিখেছে। তারা বাস ও মোটর চালানো শিখেছে। তারা অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে চাকরি আদায় করতে সফল হয়েছে। তারা কাঠের ব্যবসা এবং গাঁজার ব্যবসাও করতে শিখেছে। তারা অটোরিকশা ও ঠেলাগাড়ি চালিয়ে সংসার চালানো শিখেছে। তারা ভাড়ায় ট্যাক্সির ব্যবসাও শিখেছে। তারা পড়াশোনায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেও সক্ষম হয়েছে। আলুর মতে এসবের মূলে রয়েছে বোড়োল্যান্ড আন্দোলন। আন্দোলনের সময় থেকে বোড়োরা সব কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছে।

এই শিক্ষায় শুধু আলু পিছিয়ে ছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আলু অনেক পিছিয়ে আছে। অন্যের বাড়িতে গৃহভৃত্যের কাজ করে করে সে আরও পিছিয়ে পড়েছিল। সে কোনো কৌশল আয়ত্ত করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সে এমন একটি জায়গায় বসবাস করলেও সে কিছুই শিখতে পারেনি যেখানে তার চোখের সামনে সামাজিক পরিবর্তনগুলো ঘটে চলছিল। অদূর ভবিষ্যতে যখন এই চকবাজার বড়ো শহরে পরিণত হবে তখন হয়তো আলুকে কোনো হাদানে স্থানান্তরিত হতে হবে। সে যতই ভাবে ততই তার মনে হয় যে সে নিজেই একজন নবিস।

যদিও সে জানত যে তার বাড়ির কাছে একটি নতুন বাজার আসছে সে না পেরেছে নিজের জন্য একটি জায়গা রাখতে, না পেরেছে একটি দোকান বসাতে। সে এটা নিয়ে কখনো ভেবেই দেখেনি।

গতকাল যখন সে নতুন বাজার উদ্বোধনের ঘোষণা শুনল, তখনই আলু অনুভব করল যে সে-ও একটা কিছু করতে পারত।

এলাকার বিধায়ক বাজারের উদ্বোধন করবেন। ছবি তোলা হবে। এই ঘোষণা শুনে আলু অনুভব করে যে সে একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছে। এই দিনটি এই এলাকার জন্য ভবিষ্যতে একটি স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে আর তখন আলুকে পস্তাতে হবে। একটি মাইলফলক! একটি ইতিহাস!

ঐতিহাসিক গুরুত্বের এই স্থানে যদি একটি দোকান স্থাপন করা সম্ভব হত, কতই না ভালো হত! অন্তত আলু আর ডালি একটা ছবি তুলতে পারত! তারা তাদের নাতি-নাতনিদের দেখাতে পারত!

“নাতি-নাতনি কোথা থেকে আসবে?” একথা ভেবে আলুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। আলুর মনে পড়ে ডালি নিঃসন্তান। এসব ভেবে ভেবে কাল রাতে আলু ঘুমোতে পারেনি। সে ঘুমাতে পারছে না দেখে ডালি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু আলু কোনো উত্তর দেয়নি। বাজারে সে কী বিক্রি করবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে আলু।

…সকাল হতেই আলুর বাজারে যাওয়ার সময় এসে গেল। আলুর তিনটি সুপারি গাছ ছিল। কিন্তু সুপারিগুলো খুবই কচি, খাওয়ার উপযোগী ছিল না। একটি পানের গাছ ছিল কিন্তু তা প্রায় মরেই গেছে। পাতা নেই। একটা লেবু গাছ ছিল। কিন্তু লেবু নেই। ফল শেষ হয়েছে অনেক দিন হল। এখন অন্য ফলের মরশুমও নয়। শুধু এক টুকরো জমিতে আর কী থাকবে?

আলু সবজি বাগানে যায়। সেখানে প্রায় কিছুই ছিল না। গোটা দুয়েক পালংশাক ছিল যা অন্যের মুরগিতে নষ্ট করে ফেলেছে। আলুর মনে পড়ে, তার নিজেরও একটা মুরগি আছে। আলুরি। সে যেখানে সেখানে ডিম পাড়ে। কিন্তু ডিমে তা দিয়ে ডিম ফুটিয়ে কীভাবে বাচ্চা বের করতে হয় সেটা আলুরি জানে না। আলু ভাবে, এমনটা কি ভূমিকম্পের জন্য হয় নাকি অন্য কোনো কারণে মুরগিটা জানতই না কীভাবে ডিম ফোটাতে হয়। সব ডিম খারাপ হয়ে যায়। খারাপ ডিমগুলো খেয়ে ফেলে আলুরি খালি খাঁচায় বসে থাকে।

আলুরির কথা মনে পড়তেই আলু বাগান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে আলুরিকে ধরে বাজারে নিয়ে যায়।
বাজারে এসে নতুন বিধায়ককে (এমএলএ) দেখার সুযোগ পায় আলু। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সে জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ছবি তোলার সময়ও সে সেখানে ছিল। আলু নিশ্চিত ছিল না যে সে ছবিতে ধরা পড়েছে কিনা।

কিছুক্ষণ পর বিধায়ক চলে যান। জমজমাট হয়ে ওঠে বাজার।

গ্রাহকরাও তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে শুরু করে। এটা ক্রিসমাসের কেনাকাটার সময়। দুদিন পর বড়োদিন আসবে। অনেকেই কাপড়-চোপড় কিনছিলেন। স্যান্ডেল আর জুতো। অনেকে সবজিও কিনছিলেন। শুকরের মাংস বিক্রির জায়গায় প্রচুর ভিড় ছিল।
যেখানে শুকরের মাংস বিক্রি হচ্ছিল তার বিপরীতে দিকে বসে আলু। আলুকে নিয়ে আরও পাঁচজন মুরগি ব্যবসায়ী ছিল। আলু দেখে, গ্রাহকরা তাদের পরিচিত ব্যবসায়ীদের সাথে দরদাম করছে এবং তাদের কাছ থেকে দু-তিনটি মুরগি কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

আলুকে কেউ বিরক্ত করেনি। তারা তাকে দেখে চলে যায়। আলুর মুরগিটাকে ছুঁলেই চিৎকার করে ওঠে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, “ওমে বসা মুরগি কিনা?”

সত্য কথা বলবে কি বলবে না ভেবেও আলুর মুখ দিয়ে সত্য কথাই বেরিয়ে আসে। আলু জন্মের পর থেকে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি। তাই আজও সে মিথ্যে কথা বলতে পারল না।

অন্য বিক্রেতারা অসুস্থ মুরগি দিব্যি বিক্রি করছিল এই বলে, “মুরগিটা ভালো আছে। এইমাত্র সে খাবার খেয়েছে।”

কিন্তু আলু তার ঘর চালানোর জন্যও কখনো মিথ্যা বলেনি।

আলু এবার উঠে দাঁড়ায়। সে নিজে বেশ সুস্থ অনুভব করে। সে সবকিছু গুছিয়ে নেয়।

আলুু মংলা বুড়োকে একেবারে কোনার দিকে দেখে। তিনি ফার্মেসির কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর লাঠিতে ভর দিয়ে কিছু একটা দেখছেন। তাঁর চোখে চশমা। সম্ভবত তাঁর কেনার কিছু নেই। সঙ্গে কোনো ব্যাগও নিয়ে আসেননি। কিছু কিনলেও তিনি তা বহন করতে পারবেন না। সম্ভবত, মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর বাড়ির পাশের নতুন বাজারটি দেখতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর নাতি-নাতনি। নাতি তার দাদুকে কিছু দেখানোর জন্য আঙুল নির্দেশ করে। মংলা বুড়োর অভিব্যক্তি থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি বাজার দেখে কতটা খুশি হয়েছেন!

তিনি হয়তো ভেবেছেন, আবসুর ছেলেরা একটা ভালো কাজ করেছে। সম্ভবত তিনি নিঃশব্দে ছেলেদের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে ভাবছিলেন যে তাঁরা এতদিন যা করতে পারেনি তা ছেলেরা পেরেছে। তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।

তাঁরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে বিবারি আর মনবারি আঠালো চালের ভাত আর মাংস বিক্রি করছিল। ছেলেরা তাদের দোকানে দল বেঁধে বসে ছিল। তারা দুজনেই কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এবং তাই তাদের দোকানে ছেলেদের ভিড় বেশি। ক্ষুধা না পেলেও তারা অকারণে খাচ্ছিল।

দেউবারি এবং অন্যরা যারা এসেছিল তারা ছেলেদের ভিড় দেখে হোঁচট খেয়েছিল।

সমস্যা ছিল আলুর সাথে।

তখন দুপুর ১টা বেজে গেছে। গ্রাহকদের ফিরে যাওয়ার সময়। যে নতুন বাজারটি এক পর্যায়ে জমজমাট হয়ে উঠেছিল তা ধীরে ধীরে পাতলা হতে থাকে। মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। শুকরের মাংস প্রায় শেষ। মুরগিও। বাকি ছিল শুধু আলুর আলুরি।

আলুর খিদে পেয়েছে। বাজার খালি হওয়ার আগেই চুপচাপ চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আলু। আলু আবার মুরগিটাকে তোলে। মুরগিটাকে আরেকবার পরখ করে। মুরগিটার গলায় কোনো পালক ছিল না। কেউ যদি তার দিকে একাগ্রভাবে তাকায় তবে তাকে বুনো মুরগির মতো দেখতে পাবে। ঘাড় খালি মুরগিটাকে দেখলে ঘেন্না লাগে। ওজন নেই। তার সারা গায়ে পোকা ভর্তি। এ কারণেই তার শরীর ভালো ছিল না। আলু ওর দিকে ঘুরিয়ে পেটের দিকে তাকাল… ওহ! আরও পোকা… আলুরির পেটের তলা ভরে আছে এই পোকায়। সর্বত্র এই কীট।
আলু আবারও মুরগিটাকে খোলা অবস্থায় ছেড়ে দিল…ক্রক…ক্রক…

আলুরি, তুমি আবার কাঁদছ? তোমার কি কান্নার জায়গা নেই?

আমি তোমাকে বিক্রি করতে পারি না, আমি আর চেষ্টাও করব না! আজ রাতে তোমাকে খাবো… জ্যান্ত পুড়িয়ে খাবো!

…আলুর আর বসতে ভালো লাগছে না।

আলুরির পা দুটো বেঁধে নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির দিকে রওনা দিল আলু।


আলুরি— যে মুরগি ডিম পাড়ার জায়গা বদল করে আর ডিমে তা দিয়ে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করতে না পেরে নষ্ট ডিম খেয়ে ফেলে বোড়ো ভাষায় তাকে আলুরি বলে।

আবসু— অল বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (ABSU) বোড়োভাষী ছাত্রদের সংগঠন।

সেরেং— মুসলমানদের বোড়োরা সেরেং বলেন।

হাদান— বনভূমির এক টুকরো জমি যা পরিস্কার করে বাসস্থান ও ধান চাষের জন্য ব্যবহার করা হয়।

আলু/ডালি- ছেলে/মেয়ে গৃহভৃত্যের ডাক নাম। যখন তাদের গৃহস্থ বাড়িতে কাজের জন্য আনা হয়, প্রথম দিন আলু অথবা ডাল দিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হয়। যার ভাগ্যে আলু জোটে সে ডাক নাম পেয়ে যায় ‘আলু’; যার ভাগ্যে ডাল জোটে তাকে ‘ডালি’ নামে ডাকা হয়!

বিবারি— ফুলের মতো সুন্দর মেয়েদের নাম।

মৌনবারি— মেয়েদের নাম।

দেওবারি— রবিবারে জন্মানো মেয়েদের ডাকনাম।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২