তপন ঘোষের বিক্রিবাটা – মৃত্তিকা মাইতি
গায়ে গামছা ঘষতে ঘষতে কলঘর থেকে বেরিয়ে এল তপন। সময় নেই একদম। কোনওদিনই থাকে না।সরু বারান্দার গ্ৰিলে গিঁট মেরে দড়ি ঝোলানো। সেখানে গামছাটা শুকোতে দিয়ে তড়বড় করে ঘরে ফিরল। গীতা রান্নাঘর থেকে ভাতের থালা নিয়ে ঢুকছে। বাতে দুটো হাঁটুই নড়বড়ে। মেয়েটা যখন ছিল তখন হাতে হাতে সাহায্য করত মাকে।এখন সব গীতাকেই করতে হয়। তপন ঝটপট চুলে চিরুনি ঘুরিয়ে নিয়ে বসে পড়ল। কোনা ছেঁড়া হলেও একখানা কাপড়ের আসন এখনও বরাদ্দ আছে থালার সামনে।ভাত মাখতে মাখতে তপন বলল, ‘কাল একজনের দোকান দেখতে আসার কথা ছিল। কী হল কে জানে, এল না তো।’এ বাড়িতে মাছ আসে খুব কম। নিরামিষেই চালিয়ে নিতে হয়। আজ কাঁচকলার বড়ার তরকারি। গীতা হাতা করে ঝোল তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ওদের দোকান যদি বিক্রি না হয় , তোমার কী করার আছে?’তপন মাথা নাড়াচ্ছিল। ‘বিক্রিটা যাতে হয় সেই দায়িত্ব দিদি আমাকে দিয়েছেন। উনি মেয়েমানুষ, কোথায় কার সঙ্গে কথা বলবেন। তাছাড়া উনি আসেন ক’দিন। দোকান ওরা রাখবে না।’ঝাঁঝিয়ে উঠল গীতা। ‘ওরা যদি রাখতে না পারে তাহলে ও দোকান অন্য লোকে কিনবে কেন? তারাই বা করবেটা কী?’পায়ে ঝোল মাখা হলদে ভাত গুনতে থাকে তপন। একটা কথা গীতাকে বলতে পারে না। কথাটাও মনে মনে বারবার গোনে সে। যাকে বলার তাকেই বলতে হবে। বলেছে দু’বার দুজনকে। কাজ হয়নি। এবার যার আসার কথা তাকেও বলতে হবে।থালা থেকে চোখ তুলে বউয়ের মুখখানা পড়ার চেষ্টা করে তপন। কী ভেবে এসব বলছে গীতা? তার মনেও কি কোনও ভয় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকছে!বইয়ের দোকানে কাজ করে তপন ঘোষ। মালিকের ছাপাখানা আছে। কেজির বই থেকে শুরু করে সেভেন-এইটের সহায়িকা,বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল– এইসব ছাপত। মালকিন মাঝে মাঝে তদারকির মতো করে দোকানে এসে বসত। তবে এখন তারা দোকানটা তুলে দিতে চায়। ইসরকার এখন টেক্সট বই নিজেরাই ছাপিয়ে স্কুলে বিলি করছে। বাইরের বই কলকে পায় না। অনেক পাবলিশারই সেসব বই থেকে হাত তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। পড়ে আছে সহায়িকা। তাই দিয়ে ব্যবসা চলে না।বড় পাবলিশাররা বড় বড় জাহাজ। তারা সামাল দিতে পারলেও ছোটরা নৌকা হয়ে ভাসছে আর তাদের উপর আছড়ে পড়ছে ঢেউ। কয়েকটা ছোট বুক সেলার্স তো স্টল বেচে দিয়ে চলেই গেছে। আগে বইয়ের সিজনে আগস্ট থেকে ক্যানভাসিং শুরু হয়ে যেত। নভেম্বর-ডিসেম্বরে নতুন বই চলে যেত স্কুলে। তখন এগারোটায় দোকান খোলা। ছুটি হতে হতে সাড়ে সাতটা-আটটা। এখন আর সেরকম কোনও নিয়ম নেই। তবুও তপন বারোটায় দোকানে ঢুকে যায়।বছরখানেক আগেই দোকান বিক্রির কথা তুলেছিলেন দিদি। তপনকে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নেওয়ার কথাও বলে দিলেন। সে তখন দিদিকে বোঝাবার মতো করে বলেছিল, ‘দেখবেন, সরকার আবার বই ফেরত দিতে বাধ্য হবে। এত মানুষের ভাত মারবে না। ধৈর্য ধরুন। কত কষ্ট করে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছেন। আরো একটা বছর দেখুন।’সরকার তার জায়গা থেকে নড়েনি। বরং আরও বই ছেপে চলেছে। এখন শুধু পড়ে আছে সংস্কৃত, সংস্কৃত সহায়িকা আর জি কে। তপনের অবস্থাও ওই সাবজেক্টের মতোই।কেউ পোঁছে না। তাকে একদিন ছাপাখানায় ডেকেছিলেন মালিক। বিবেকানন্দ রোডে নিজেদের তিনতলা বাড়ির নীচে প্রেস। পৈত্রিক ব্যবসা। অফশেট মেশিন।ঘুরন্ত রোলারের শব্দ আসছিল। কালি আর কাগজের গন্ধ লেগে রয়েছে চারপাশে। আগেও এসেছে এখানে তপন। মালিকের নাম শেখর দত্ত। তিনি তপনকে সামনে বসিয়ে বললেন, ‘এই বছরই দোকান ছেড়ে দেব। ওটা নিয়ে আর ভাবছি না। ব্যবসার হাল তো আপনিও জানেন। শুধু শুধু আর ভাড়া গুনব না। প্রেসটা চালিয়ে যেতে পারলেই আমার অনেক। ব্রোকারদের বলেছি খোঁজ লাগাতে। আপনিও দেখতে পারেন। যদি কাউকে পান দিদিকে জানাবেন।’সেদিন বেরিয়ে এসে তপনের মনে হয়েছিল যে নৌকাটায় সে এখনও ভাসছে সেই নৌকাতে তাকেই ফুটো করতে বলা হল। দোকান গেলে সে যাবে কোথায়? কলকাতায় শুধু খেয়েপরে বেঁচে থাকতে গেলেও কিছু রোজগার দরকার। তার মাইনে পাঁচ হাজার। বাজারে চারাপোনা দুশো টাকা কিলো। টমেটো চল্লিশ, ঢ্যাঁড়সও তাই। বেগুন, পটল তিরিশ। জ্যোতি আলু কুড়ি। পুঁই শাক পর্যন্ত পঁচিশ টাকার নীচে নেই। মাস পেরোতে পেরোতে তপন টের পেয়ে যায় কাকে বলে নাভিশ্বাস। থালায় মাছের টুকরো দেখলে মনে হয় একশো টাকার নোট ঝোল দিয়ে মেখে মন্ড করে রাখা। খাওয়ার সময় গলায় আটকে যাবে! থাকার জন্য ভাড়া গুনতে হয় না তাই রক্ষে। উল্টোডাঙার রবীন্দ্রপল্লীতে এক কাঠা তিন ছটাক জমিতে বাবা একতলা বাড়িটা দাঁড় করিয়ে গিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রেখে গেছে। একটা ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর আর কলঘর। এই না কত। দরমা থেকে ইটের চেহারা পেয়েছে। যদিও কলোনির চেহারা বদলে গেছে। ফ্ল্যাট উঠতে উঠতে চেনাই দায়।একসময় যারা রিফিউজি ছিল তারা এখন এমন ভাব করে যেন বাপের আলবিলাতি ছেলে সব।তবে শুধু বাবা নয়। তপনের মেয়েও তাকে অনেকটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। সম্বন্ধ করে কোনওদিনই টুকটুকির বিয়ে দিতে পারত না সে। ভাগ্যিস মেয়েটা প্রেম করত। ছেলেটাও ভালো। দমকলে চাকরি। মাঝে মাঝে মেয়ে নাতিকে সঙ্গে করে আসে। তপন জানে, যখন যা পারে মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে যায় মেয়ে। কিন্তু তপনের নিজের কাজটা চলে গেলে তো সংসারে কিছুই থাকবে না।চুয়াল্লিশ নম্বর বাসে উঠে ফুলবাগানের কাছাকাছি আজ হঠাৎ একটা জায়গা পেয়ে গেল তপন। বয়স্ক নাগরিকের সিট। বসে পড়ল। বুড়ো লোক বেড়ে যাচ্ছে চারদিকে। সুবিধে পেলেও তার কম্পিটিশন আছে। তবে তার আজকের দিনটা কি ভালো যাবে তাহলে? লোকটা কি দোকান দেখতে আসবে? কথাটা তাকে বলতে পারবে তপন? ফল হবে তাতে?বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাসের জানলায় ভেসে ওঠে একটা মাটির বাড়ি। অনেকটা উঁচুতে দাওয়া। উঠোনে ধানের গোলা। একটু দূরেই গোয়ালঘর। সেখানে তিনটে গরু। সামনে পুকুর। সেখানে জলের ভেতরে মাছেরা ঘুরপাক খায়। চারপাশ ঘিরে বাগান। নারকেল, আম, জাম, পেঁপে, সবেদা হয় সময় সময়। এসব তার বাবা বলত। ঢাকার নবাবগঞ্জে তাদের বাড়ি নাকি এইরকমই ছিল। ফর্টি এইটে সব ছেড়ে আসতে হয়। সে বছরই তপনের জন্ম এপারে। বড় হতে হতে এসব শুনেও একটা কথাও বিশ্বাস করতে পারেনি তপন। তবু একটা বানানো ছবি কেন যে ভাসে কে জানে।বাস থেকে কলেজ স্ট্রিটে নামে সে। হাঁটতে হবে খানিকটা। ট্রামের ঘন্টা, অটোর হর্ন, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, টানা রিকশার ঠুং ঠুং সব এখানে ঠেলাঠেলি করছে। ফুটপাতে হকারদের জায়গা দখলের ঠেলাঠেলিতে মানুষ রাস্তায় নেমে গাড়ির কালো ধোঁয়া গিলে নিচ্ছে বেমালুম। মাল নিয়ে যাওয়ার লোহার ভ্যানগুলো কিছুই মানে না। হই হই চিৎকারে এক ভ্যানওলা তার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। তপনের প্রাক্তন হাড়ে আর একটু হলেই ঠুকে দিয়েছিল আর কী। মাথায় একটা টুপি চাপানো আছে তার। সেটায় হাত বুলিয়ে নেয় একবার। চমকে গিয়েছিল। নিজের সময়েও কিছু ভাবতে দেয় না এই শহর। গায়ে পড়ে গলা জড়িয়ে ধরে। বাবার কাছে শোনা কোনকালের বাংলাদেশের গল্প পচা কাপড়ের মতো ঝুপঝুপ করে ঝরে পড়তে থাকে চোখের সামনে।আরও হাঁটতে থাকে তপন। দু’পাশে ছোট-বড় স্টল। তাদের মাথায় বোর্ড। লম্বা, বেঁটে, চৌকো। নানা রংয়ের বাহারে স্টল নম্বর আর দোকানের নাম লেখা। কতরকমের বই পাওয়া যায় তাও আছে খুদে খুদে অক্ষরে। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাঙ্ক, রেল, পলিটেকনিক, ভোকেশনাল, সি বি এস ই, আই সি এস ই, ডব্লিউ বি বোর্ড, টেট, নেট, স্লেট অ্যান্ড অল। আট-দশ ফিটের স্টলগুলো পুরোটাই বইয়ে ঠাসা। তাছাড়াও উপচে বাইরের টুল কিংবা বেঞ্চে গাদা হয়ে রয়েছে। কাউন্টারে মালিক বসে। সামনে খোলা বিল। কর্মচারী রাস্তায় নেমে এসে হাঁকছে– ‘দাদা, কী বই লাগবে? এই যে, এদিকে আসুন। দিদি, কী বই লাগবে, বলুন না।’ কথাগুলো বলার সময়ে তারা সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। যেন পারলে খদ্দেরকে টেনে দোকানে নিয়ে গিয়ে তোলে। কম্পিটিশনের বাজার। ফসকে গেলেই গেল। পড়ার বই ছাড়া অন্য বইয়েরও স্টল আছে। তারা যদিও চেঁচিয়ে লোক ডাকতে পারে না তেমন। তবে এভাবেই তো রোজ বইপাড়া জমে উঠতে দেখছে তপন। কুড়ি বছর হতে চলল। এখানেই তো ঘুরেফিরে চারটে দোকানে কাজ করেছে এর আগে। সেই দোকানগুলো যে এখনও আছে তা জানে সে। এবারেরটাই উঠে যেতে বসেছে। খুব বিপদ তপনের সামনে।হাঁকডাক পিছনে রেখে একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়ছিল তপন। এই বইয়ের সাম্রাজ্যে এসে পড়ার আগে সে কাজ করত পেনের রাজত্বে। কারখানা ছিল মানিকতলায়। কালির পেন, বল পয়েন্ট পেন বানাতে হত। ঘটাং ঘটাং করে ডাইস মেশিনের হ্যান্ডেল টানতে টানতে ঘামে চবচবে হয়ে যেত সারা শরীর। তখন জোরও ছিল গায়ে। সেই কারখানাটা আর নেই। কালির পেন উঠে যেতে থাকল। বল পয়েন্ট তৈরিতেও হাতে চালানো মেশিন নিয়ে অটোমেটিক মেশিনের সঙ্গে আর পেরে ওঠা যাচ্ছিল না। সাঁতরাগাছি, কোন্নগর, জিরাটের অনেক কারখানা থেকে ঝপাঝপ বেরিয়ে ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন বাজার ছেয়ে ফেলছিল। একে সস্তা, তাছাড়া ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ায় আনন্দ আছে। টিকিয়ে রাখার কষ্ট পেতেই হয় না।এ গলিতে অনেক পুরনো বাড়ি। শেষ মাথায় তেমনই একটা বাড়ির ভেতরে যূথিকা বুক স্টল। আরও সাত-আটটা দোকান আছে। বাইরের আলোয় দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে ভেতরে শুধু অন্ধকার। দোকানের সামনে পৌঁছে তালা খুলল তপন। ঘড়ঘড় করে উঠে গেল শাটার। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালাল। বোতল থেকে জল নিয়ে ছিটিয়ে দিল সামনে। ধূপ ধরাল। দেওয়ালে ঝোলানো কাঠের তাকে লক্ষ্মী-গণেশের দিকে মুখ রেখে হাত ঠেকাল কপালে।উলটো দিকের, পাশের কয়েকটা দোকানও খুলছে। তারই একটা থেকে জয় নামের ছেলেটা গলা তুলে বলে, ‘কাকা, আর কতদিন কষ্ট করবে! এবার সব ছেড়েছুড়ে বাড়িতে রেস্ট নাও একটু। আরাম করো। বয়েস তো কম হল না।’পাশ থেকে হেসে ওঠে আদিত্য। ‘এই, ওরকম করে বলছিস কেন। আমাদের কাকা এখনও ইয়ং আছে। কত হল কাকা তোমার?’চুপ করে থাকে তপন। ছোটখাটো চেহারার ভেতরে বয়েসটাকে গুটিয়ে রেখে দিয়েছে সে।জয় আবার বলে, ‘সত্যি বলো তো কাকা, কত হল?’এরা ছাড়বে না। বয়েস কম। রোজ একটা না একটা কিছু মজা চাই তাদের। ইউজ অ্যান্ড থ্রো।তপন টুকরো কাপড় দিয়ে কাঠের কাউন্টারের ওপরটা মুছতে মুছতে গম্ভীর মুখে বলে, ‘পঁয়ষট্টি। সিক্সটি ফাইভ।’আরো কয়েকটা গলাও হেসে ওঠে এবার। উত্তম ঢাউস কতকগুলো প্রশ্ন বিচিত্রা সাজিয়ে রাখছিল। বলল, ‘পাঁচ বছর আগেও তো এটাই বলেছিলে কাকা। তোমার বয়েসে কি গিঁট পড়ে গেছে নাকি!’আদিত্য বলে, ‘মনে তো হচ্ছে তাই। বাড়েও না, কমেও না। টুপিটাও খোলে না যে ধরা যাবে কিছু।’ওরা হাসছে। ভালো লাগলে হাসুক। তপনের মাথা ঘেমে ওঠে। টুপিতে হাত পৌঁছে গেলেও নামাতে পারে না সেটা। মাথার পিছনের দিকের কয়েকগাছি চুল ছাড়া পুরোটাই তো টাক। টুপিটা তার ছাউনি। এমন টুপি পরত দেব আনন্দ। সামনের দিকে এগিয়ে থাকে। একসময় তার বেশ কয়েকটা সিনেমা দেখেছিল তপন। দারুণ দারুণ গান থাকত। সেই বয়েস কোথায় ফেলে এসেছে সে। পরে টাক ঢাকবে বলে দেব আনন্দের শরণ নিতে হয়েছিল। এটা আর ছাড়তে পারে না তপন।’কী রে, তোরা তপনদার পিছনে কাঠি করছিস কেন? গায়ের চামড়া কুঁচকে গেলে কী হবে, ভেতরে কিন্তু তপনদার মেশিনপত্তর এখনও স্ট্রং। কী বলো!’ হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল সরস্বতী পাবলিশার্সের বিজয়। প্যান্টের ভেতর জামা গুঁজে সবসময় বেশ ফিটফাট। পায়ে জুতো। তার মালিকেরও টেক্সট বই, তবে ইলেভেন-টুয়েলভের। তাছাড়া কয়েকটা কম্পিটিটিভ পরীক্ষার বইও ছাপে। ব্যবসা ভালোই চলে। মালিক যখন আসে না তখন ফাঁকা সময় পেলেই চল্লিশ-বিয়াল্লিশের বিজয় মোবাইলে চোখ সাঁটিয়ে বসে থাকে। কী দেখে তা জানে তপন। একবার চোখ পড়ে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠেছিল তার।তারা মা বুক ডিস্ট্রিবিউটারের ঘর থেকে বেরিয়ে এল লালু। ওটা কোনও দোকান নয়। গোডাউন বলা যায়। নানারকম চাকরির পরীক্ষার বইয়ের এজেন্সি নিয়ে রেখেছে লালু। রাস্তায় দোকান আছে তার। তিন-চারটে ছেলে কাজ করে। লালু এখন খালি গায়ে ঘুরছে এই বাড়ির ভেতরে। প্যান্ট নেমে রয়েছে খানিকটা কোমর থেকে। খ্যারখ্যারে গলায় বলল, ‘একে এমন গরম, তার মধ্যে তোরা তপনদাকে তাতাচ্ছিস! আপনি ওদের কথায় কান দেবেন না তো দাদা।’বিজয় বলল, ‘গরম তো আমাদের সকলেরই লাগছে। তুই বাড়ি চলে যা না তাহলে। তোর বাড়িতে এসি আছে তো।”আছেই তো। ঠাকুরের কৃপায় চারটে ঘরে চারটে এসি। কিন্তু ওই, বাড়ির সবাই ঠান্ডা খাচ্ছে, আমি ভোগ করতে পারছি না। সারাবছর এখানে গরমে পচতে হচ্ছে। ব্যবসা তো ফেলে রাখতে পারব না।’তপন লালুর দিকে তাকাল। বুকে ছড়িয়ে রয়েছে লালচে গোল দাগ। রোজই দুপুরবেলা চার-পাঁচজন এসে ঢোকে তার ঘরে। দরজা বন্ধ থাকলেও গাঁজার গন্ধ আটকে থাকে না। প্রতি মাসেই লালু তারাপীঠ যায়।তপন পিছন ফিরে বই গোছাতে থাকে। ক্লাস ওয়ানের একটা বাংলা বই বেরিয়েছিল তাদের এখান থেকে। একদম চলেনি। সেগুলো প্রেসে ফেরত যাবে। দড়ি দিয়ে সেসব বাঁধতে বাঁধতে তার মনে পড়ল, একদিন মালকিনকে বলেছিল, ‘আচ্ছা দিদি, আপনারা তো উঁচু ক্লাসের বই ছাপতে পারেন। ওগুলো তো সরকার নেয়নি।’চিত্রা তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা চোখে বলল, ‘ওসব ছাপতে কত ইনভেস্ট করতে হয় জানেন? আপনার দাদা এই ব্যবসায় আর কোনও টাকা লাগাবে না।’তপন তখন অন্য চেষ্টায় বলল, ‘আপনাদের ছাপাখানার কাজে আমায় নিন না। কাগজ গুছিয়ে দেব, ফর্মা সাজিয়ে দেব, বাঁধাইখানায় পৌঁছে দিতে পারি, দেখিয়ে দিলে কাটিং মেশিনও চালাতে পারব। আমি তো আগে কারখানায়…’কথা শেষ করতে দেয়নি চিত্রা। বলেছিল, ‘ওসব কম বয়েসিদের কাজ। আপনাকে দিয়ে হবে না।’হতাশ গলায় তপন বলল, ‘তাহলে এই ব্যবসা বন্ধ করে দোকান তুলেই দেবেন?”এ লাইনে থাকতে গেলে লোকবল চাই। দাদা ছাপাখানা নিয়ে ব্যস্ত। এদিকটা দেখতেই পারে না। দুই মেয়ের লেখাপড়া, সংসার– এত কিছু সামলে আমিও আর সময় দিতে পারছি না। বইগুলো চললে তাও না হয় হত। দেখছেন তো অবস্থা, বাজারই নেই। স্কুলগুলোতে ঢুকতে গেলেও কম্পিটিশন। কে কত ডিসকাউন্ট দিতে পারে। এজেন্ট ধরলে তাকেও ফিফটি কি সিক্সটি পার্সেন্ট ছেড়ে দিতে হয়। তারপর কত লাভ থাকে আর! রাঘব-বোয়ালদের কাছে আমরা তো চুনোপুঁটি। ওরা বেশি ছাপে তাই দাম কম রাখতে পারে। আমরা কী করে পারব? তারওপর টিচারদের খুশি করতে টেবিল ফ্যান, দেওয়াল ঘড়ি, হাতঘড়ি, গিফ্ট দিতে হয়। আপনি তো জানেন সবই। কতগুলো স্কুলে ক্যানভাসিং তো করেছিলেন।’জানে তপন। তাই তো চুপ করে আছে। তখন ক্যানভাসার রাখা হত। তাছাড়া তপনকেও নামতে হয়েছে। সেই সময় মাইনে ছাড়া এরা কিছু বাড়তি টাকাও দিত। তবে টিচারদের শুধু গিফ্ট দিলেই চলত না। মিষ্টির বাক্সে টাকা ভরে রাখতে হয়েছে কারও কারও টেবিলে। যাতে বইটা সেই স্কুলে তিন বছর পড়ানো হয়। সিলেবাস চেঞ্জ হলে আবার নতুন বই, নতুন টাকা।’কী হল, ঘুমোচ্ছেন কেন?’বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে গেছিল। তবু কথাটা কানে আসতেই তপন টুলের ওপর সোজা হয়ে বসে। চোখ খুলে বলে, ‘কই না তো।’সামনে ব্যানার্জি। নাম ধরে কেউ ডাকে না তাকে। জানেও না হয়তো। ওই ব্যানার্জিই চালু রয়েছে। বাইরের গলির লোকনাথ বুক স্টলে কাজ করে। থাকে বরানগরের শচীন সেন কলোনিতে। এরও চুল, গোঁফ সব পেকে সাদা। তবে তপনের চেয়ে কিছুটা ছোটই হবে। মাঝে মাঝে ভেতরে এসে দেখা করে যায়।’ঘুমোবেন না। কোম্পানি দেখতে পেলেই কিন্তু চাকরি নট। আমাদের সবসময় জেগে থাকতে হবে।’তপন নিঃশব্দে হাসে। দোকান যে বিক্রি হয়ে যাবে সে কথা এখানে রটেই আছে। তখন তো এমনিতেই চাকরি থাকবে না।’পঞ্চায়েত ভোটের কী হল? খবরটবর রাখেন কিছু?’দিন তিনেক আগে পঞ্চায়েত ভোট গেছে। এখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। এইটুকই জানে তপন। সে বলল, ‘দরকার নেই। কেন রাখব? আমাদের খবর রাখে কেউ?’ব্যানার্জি কাউন্টারে হাত ঠোঁটে। ‘এটা ঠিক বলেছেন। আমরা হলাম বুড়ো গরু। তবু এখনও চরে খেতে হচ্ছে। তাড়িয়ে দিলে কেউ নেবে না। ঠিক বলেছেন।’ কথাটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে সে বেরিয়ে যায়।উঠে পড়ে তপন। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। চা খেতে সেও বাইরে যাবে। কিন্তু দোকান দেখতে যার আসার কথা ছিল সে তো এল না। ফোনও করেনি। অন্য কোথাও কিছু পেয়ে গেল? নেবে না এটা? এক ব্রোকার দুবার দুজনকে নিয়ে এসেছিল। হয়নি কিছু। কিন্তু তাদের হাতে হলে তপনের হাতে আর থাকবে না ব্যাপারটা। সেও তাই এদিক ওদিক খোঁজ লাগিয়ে যাচ্ছিল। দুজন এসেও ফসকেছে। এই তিন নম্বর যদি না আসে তাহলে আর কাউকে পাবে তপন? খুব দরকার যে তার।এই গলি থেকে বেরিয়ে আরেকটা গলির মুখেই চায়ের দোকান । বিস্কুট, পাউরুটি, ডিম সেদ্ধ, কলা পাওয়া যায়। আবার এটা ভাতের হোটেলও। রাস্তাতেই উঁচু আর নীচু বেঞ্চ পাতা আছে। দুই ভাই মিলে চালায়। দুজনেই খালি গায়ে পৈতে ঝুলিয়ে রাখে। বাড়ি মেদিনীপুরে। ঠনঠনিয়ার কাছে ভাড়া ঘরে থাকে আরো কয়েকজনের সঙ্গে। পালা করে দেশে যায়। এইরকম একটা দোকানও যদি দিতে পারত তপন, পেটের চিন্তা থাকত না। প্লাস্টিকের কাপ ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমুক দেওয়ার সময় তপন দেখতে পেলো ফুলো ফুলো গোলাপি আঙুল দিয়ে একজন ভাত ডাল চচ্চড়ি একসঙ্গে চটকাচ্ছে থালায়। একে আগেও দেখেছে এখানে। ট্যাক্সি চালায়। এক ভাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী রে, তোর তো আজ মাথার ঠিক নেই দেখছি। মাছের ঝোলটাও ঢেলে নিলি! সকাল সকালই চড়িয়ে নিয়েছিস মনে হচ্ছে। গাড়ি চালাবি কিকরে রে?’ট্যাক্সিওয়ালা মাথা দোলাচ্ছে। গোল মুখেও গোলাপি ভাব। ‘সব একসাথহি খাব। একঠোই তো জাগা’। বলে পেটে চাপড় মারল সে। ‘আজ আর গাড়ি চলবে না। ছে বজে বেরিয়েছি। দো হাজার ছশো পাকিটে এসে গেছে। ব্যস।’‘সব তো তোর নয়, মালিককে দিতে হবে না?’আরও জোরে মাথা দোলায় সে, ‘এক পয়সাও দেবো না। চুতিয়া শালা।’মালিকের পয়সা মারার কথা কী জোর গলায় বলছে! চায়ের দু’টাকা দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে এল তপন। দোকান খোলা রেখে এসেছে।বাড়িটায় ঢোকার মুখেই একজনকে দেখে তপন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে আপনি কখন এলেন? চলুন ভেতরে চলুন।’কালো মোটা মতো লোকটি বললেন, ‘আরে ভেতরেই তো ছিলাম। আপনাকে ফোন করব ভাবলাম কিন্তু দেখলাম টাওয়ারটাই পাচ্ছি না।’‘ওটাই এখানকার সমস্যা দাদা। পুরনো বাড়ি তো। একবার ভেতরে ঢুকলে কেউ আপনাকে ধরতে পারবে না। আপনিও পারবেন না। তবে কোনো কোনো কানেকশন থাকে কিন্তু।’দোকানের সামনে পৌঁছে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে লোকটি বললেন, ‘কাল একট জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম। আপনাকে জানাতেই পারলাম না। আজ ফোন না করেই চলে এসেছি।’’বেশ করেছেন। আমাকে তো সবসময় এখানেই পাবেন। এই হচ্ছে দোকান। যা দেখার দেখে নিন। টোটাল আপনার একশ দশ স্কোয়ার ফিট। সব দেওয়ালেই তাক করা আছে। দেখতেই পাচ্ছেন বই সাজানো। ওই হচ্ছে কাঠের সিঁড়ি। ওপরেও স্টক করে রাখার জায়গা রয়েছে নীচের মাপে। চার ফিট উঁচু। চাইলে সিঁড়ি বেয়ে দেখে আসতে পারেন।’লোকটি কাউন্টারের উপর ঝুঁকে পড়ে যতটা পারলেন দেখলেন।’না, ঠিক আছে, বুঝেছি। আমরা তো ডিকশনারির এজেন্সি। মাল রাখার জায়গা দরকার। এতদিন শ্রীমানি মারকেটের কাছে একটা জায়গায় রাখছিলাম। সে বাড়ির অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু এখানে জায়গার তুলনায় সেলামি আর ভাড়া দুটোই বেশি।’তপন ঘোষ যেন যুক্তি সাজিয়েই রেখেছে। আগের দুজনকেও তো বলতে হয়েছিল। সে বলল, ‘আমার মালিক যে দামে দিয়েছিল সেই দামই আপনাকে বলেছি। একটুও বাড়িয়ে বলিনি। আর ভাড়ার কথা বলছেন– ওটা তো বাড়ির মালিকের ব্যাপার। উনি এর কমে দেবেন না। এখানে তো এটাও একটা ব্যবসা। জানেন তো। কিন্তু আপনার লোকেশন দেখুন। বলতে গেলে কলেজস্ট্রিটের মধ্যেই।’লোকটি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আমার কথা ফাইনাল করব কার সঙ্গে?’তপনের মনে আশা উজিয়ে এল। দোকান পছন্দ হয়েছে এর। সে বলল ‘কেন আমার সঙ্গে। আপনি হ্যাঁ বললে আমি দিদির ফোন নম্বর আপনাকে দেব। আপনি পষ্টাপষ্টি কথা বলে নেবেন।”ঠিক আছে। নম্বরটা আমাকে দিয়েই দিন। দোকান আমি নেব।’এবার তপন ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ল। আসল কথাটাই তো সে বলেনি এখনো। শুনে আগের দুজনের মতো ইনিও আবার উধাও হয়ে যাবেন না তো! একটু কেশে নিল সে। ‘নম্বর দিচ্ছি। কিন্তু একটা কথা বলা হয়নি। দোকান কেনার একটা শর্ত আছে। আপনি দিদিকেও সেই কথাটা বলবেন।’অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন লোকটি, ‘সেটা আবার কী?’এবার বলেই ফেলল তপন। ‘দোকানের সঙ্গে আমাকেও কিনতে হবে।’কথা শুনে লোকটি হেসে উঠল, ‘আপনাকে! আপনিও কি বিক্রী আছেন নাকি!’লোকটার সামনে নিজেকে পুরোটা দেখাবে বলেই যেন মাথা থেকে টুপিটা নামিয়ে আনল তপন। কাউন্টারের উপর রাখতেই চুপসে গেল সেটা। সেদিকে চোখ নামিয়ে তপন বলল, ‘হ্যাঁ আমিও বিক্রী আছি।’