শহরের একমাত্র লাশ – রাজীব কুমার ঘোষ

শেয়ার করুন

রাজেশ খান্নার লিপে এবার কিশোর কুমারের গেয়ে ওঠার কথা ছিল, “ভালো তো লাগে না” কিন্তু তার বদলে রাজেশ খান্না সোজা তাকালেন এবং বলে উঠলেন, “এপ্রিল মাসের দশ তারিখ, ভোটের দিন, মারা যাবে বিপ্লব, সাবধান।”

এই ঘটনাটা মার্চের সাত তারিখ ঘটেছিল। বসন্তনগরে তখন রাত আটটা পেরিয়ে গেছে। জলসা মুভি চ্যানেলে ‘আরাধনা’-র বাংলা ভার্সন চলছিল। নয় নয় করেও বিগত যৌবন, মধ্যবয়স্ক কিছু পরিবার কর্তা-কর্ত্রী এবং অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দেখছিলেন অতীত যুগের এই ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রটি। সংখ্যায় তারা হাজার দশেক বা হাজার পনেরো হবেন। একাধিকবার দেখা এই চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলি ও সংলাপ সবারই স্মরণে আছে আর গানগুলি তো একপ্রকার কণ্ঠস্থ বললেই হয়। তাই গানের মাঝে রাজেশ খান্নার এই ডায়ালগে প্রথমে সবাই চমকে উঠলেও বিশেষ অবাক হলেন না কেউ। বসন্তনগরে এমনই হয় প্রতিবার।

যারা সিনেমা দেখছিলেন তারা দ্রুত মোবাইল ফোনে পর পর ফোন করে চললেন। যারা হোয়াটসঅ্যাপ বা অপরাপর অ্যাপে সিদ্ধহস্ত তারা মেসেজের পর মেসেজ পাঠিয়ে চললেন। খবর চলে গেল সব কটা দলের পার্টি অফিসেও। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো সবকটা পার্টি অফিসে সাজ সাজ রব। কর্মীরা বসে পড়ল ভোটার তালিকা নিয়ে। কোন্ পার্টি আগে খুঁজে বার করবে বিপ্লবের নাম-ধাম। পৌঁছে যাবে বিপ্লবের কাছে।
বসন্তনগরে এমনই হয় প্রতিবার। ভোটের দিনে যখন আশেপাশের নগরে, গ্রামে বা শুধু আশেপাশেই বা কেন সমস্ত রাজ্যেই লাশের মিছিল পড়ে যায় এই বসন্তনগরে কেবলমাত্র একজনের প্রাণ চলে যায়। মাত্র একজনের। তাই নির্বাচন কমিশনের তালিকায় বসন্তনগর অতি শান্তিপূর্ণ জনপদ।

বসন্তনগরে এমনই হয় প্রতিবার। ভোটের দিনের আগেই কখনও কথা বলে ওঠেন শহরের কেন্দ্রে ঝাউতলায় ইংরেজ আমলের সৌধে খচিত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড অথবা শহরের খ্যাতনামা কলেজের প্রাচীন অট্টালিকার কোনো থাম কথা বলে ওঠে। কখনও ঘোষণার ফাঁকে স্তব্ধ পড়ে থাকা ফেরিঘাটের মাইক কথা বলে ওঠে অথবা জেলখানার সামনে মাটিতে গেঁথে থাকা প্রাচীন কামান কথা বলে ওঠে অথবা বসন্তনগরের ছোটোদের একমাত্র পার্কের সিমেন্টের হাতিটি কথা বলে ওঠে।

কী কথা বলে তারা? তারা বলে দেয় একটি নাম, যে নাম লাশ হয়ে যাবে আসন্ন নির্বাচনের দিনটিতে, শহরের একমাত্র লাশ। তাদের কথা কখনও শুনতে পায় বসন্তনগরের জনা পাঁচেক সাধারণ বাসিন্দা। কখনও আবার শুধু একজন, যেমন সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের মুখ থেকে শুনেছিল বসন্তনগরের হাবু পাগলা। হাবু অনেকসময় রাতের দিকে শুয়ে থাকত সৌধের তলায়। এইরকম এক রাতেই সে শুনেছিল নামটা। অনেক সময় শুনতে পায় বহু লোক, যেমন হয়েছিল ফেরিঘাটে মাইকে ঘোষিত নামের ক্ষেত্রে বা কলেজের থামটির ক্ষেত্রে। কখনও আবার শুনতে পান কোনো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যার কথা অবিশ্বাস করা যায় না, যেমন হয়েছিল কামানের ক্ষেত্রে। কামানের মুখে উঠে আসা নাম শুনেছিলেন বসন্তপুরের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলির চোখের মণি, সুন্দর বিশ্বাস। আবার পার্কের সিমেন্টের হাতিটি বলেছিল ছোটো বাচ্চাদের, তারা ভয় পায়নি বরং হৈহৈ করে মাঠে ছুটে বেড়িয়েছিল আসন্ন লাশের নাম চিৎকার করে বলতে বলতে।

বসন্তনগরে এমনই হয় প্রতিবার। কোনো উপায়ে ভোটের আগে নাম হাওয়ায় ভেসে আসলেই হৈহৈ পড়ে যায়। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় বসন্তনগরের মানুষজন, সমস্ত বৈধ ভোটার। মাত্র কয়েকজনের নিশ্বাস শুধু আটকে আসে, যাদের নাম মিলে যায় ভেসে আসা নামের সঙ্গে। বসন্তনগর তার বাসিন্দাদের কখোনোই আসন্ন লাশের পুরো নামটি বলে না। শুধু প্রথম নামটিই কোনোভাবে উচ্চারিত হয় বসন্তনগরের আকাশে বাতাসে। পার্টিগুলি ভোটার তালিকার ওপর হামলে পড়ে প্রাণপণে খুঁজে চলে সেই নামটি, দ্রুত পৌঁছে যেতে চেষ্টা করে সেই নামগুলির কাছে। যে পার্টি আগে পৌঁছাতে পারে সেই পার্টি তার দলে অন্তর্ভুক্তি করে নেয় সেই নামের লোকদের মোটা অর্থের বিনিময়ে। আর নামগুলিও তো আতঙ্কে থাকে। পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মোটা টাকা নিতে তাদের দ্বিধা হয় না। অতীতে এই নামগুলি নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া হলেও বিগত কয়েক বছরে একধরনের সমঝোতা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। যে দল আগে কোনো নামধারীর কাছে পৌঁছাতে পারবে সেই লোক তাদের। বিপুল খরচ কমানোর প্রচেষ্টায় এই সমঝোতা। আগে মওকা পেয়ে এইসব নামধারীরা নিজেদের একধরনের নিলামে তুলে দিত, ফলে খরচা বাড়ত পার্টিগুলির। এখন আর তা হয় না, ফলে খরচ অনেকটা বাঁচে।

বসন্তনগরে এমনই হয় প্রতিবার। ভোটের দিন সবাই আগ্রহ নিয়ে থাকে এক নামের এই লোকেদের বা ভোটারদের মধ্যে কে প্রকৃতপক্ষে লাশ হবে। শোনা যায় এই নিয়ে বাজি ধরাও হয়, বিপুল টাকার লেনদেন হয়। আর কী আশ্চর্য, প্রতি ভোটেই এদের মধ্যেই কেউ লাশ হয়ে যায়। এদের কেউ না কেউ শত সাবধানে থেকেও পড়ে যায় কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাঝে আর বোমা বা ছুরি বা ছুঁড়ে দেওয়া পাথরেরা তাদের কাজ করতে থাকে। যদিও বসন্তনগরের কিছু অবিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী বলেন সবকটাই পার্টি চায় তাদের দলভুক্ত লোকেদের কেউ মারা যাক তাহলেই তারা সেই লাশ নিয়ে আন্দোলনে নামতে পারে। বসন্তনগরে সহানুভূতির হাওয়া বইয়ে দিতে পারে পরবর্তী সময়ের ভোটবাক্সের দিকে। এইসব বুদ্ধিজীবীরা বলেন লাশগুলি মোটেই ঘটনাচক্রে পড়ে না। অবশ্য বসন্তনগরের এই প্রাচীন ঐতিহ্যের দিকে নজর দিলে এসব কথা উপেক্ষা করতেই হয়। যেখানে শত শত লাশ পড়ে সেখানে বসন্তনগরে আশীর্বাদস্বরূপ মাত্র একটি লাশ পড়ে। মাত্র একটি।

বসন্তনগরে এমনই হয় প্রতিবার। নাম ভেসে আসা মাত্র ভোটার লিস্টের ওপর হামলে পড়ে সবকটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। স্টার জলসায় রাজেশ খান্নার মুখে বিপ্লবের নাম উচ্চারিত হবার পনেরো মিনিটের মধ্যে বসন্তনগরের রাস্তা জুড়ে বাইকের স্রোত বইতে থাকে প্রতিটি পার্টি অফিসের দিকে। রাত বাড়ে, ভিড় বাড়ে। বন্ধ হতে চলা বিরিয়ানির দোকানগুলিতে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। প্যাকেট প্যাকেট বিরিয়ানিরা প্রস্তুত হতে থাকে। সারা রাত কাজ হবে।

কিন্তু বসন্তনগরে এমন হয়নি কোনোবার। পার্টির অনুগত রাতজাগা লাল চোখগুলি ভোটার লিস্ট থেকে বার করতে পারল না বিপ্লব নামের কাউকেই! এমনকি কোনোবার যা হয় না সেই ঘটনাই ঘটল ভোররাতের দিকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের মধ্যে ফোন চালাচালি শুরু হয়ে গেল। প্রশ্ন একটাই, বিপ্লবকে খুঁজে পাওয়া গেল কি? বসন্তনগরে সূর্যের আলো পড়ার আগেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে জনপদের ভোটার তালিকায় কোনো বিপ্লব নেই।

বসন্তনগরে এমন হয়নি কোনোবার। প্রতিবারই নগর যে নাম হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে সেই নামের অনেকজনকেই পাওয়া গেছে। আগের বার একটা কঠিন নাম উচ্চারিত হয়েছিল, সাম্য। কিন্তু দেখা গেছিল এই নামের তিয়াত্তর জন আছে বসন্তনগরে। এই সব সাম্যদের বিভিন্ন পার্টি দখল করে পার্টি মেম্বারশিপ দিয়েছিল। যথাসময়ে এক সাম্য লাশ হয়েও গিয়েছিল। কিন্তু এবারে এত কমন একটা নাম—বিপ্লব, সেই নামের কেউ যে বসন্তনগরে নেই সেটাই পার্টিগুলো বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না। পুরোনো ভোটার তালিকা ঘেঁটে দেখা গেল বসন্তনগরের শেষ বিপ্লবের মৃত্যু হয়েছে এক বছর আগেই। এখন সরকারি ভোটার তালিকায় কোনো বিপ্লব নেই। তাহলে কি এই বিপ্লব বহিরাগত কেউ বা এমন কেউ যার নাম ওঠেনি ভোটার তালিকায়?

বসন্তনগরে এমন হয়নি কোনোবার। লাশ হতে চলা নামেরা সবসময়ই ভোটার তালিকার নাম ছিল। একটিও ব্যতিক্রম নেই। এবারে খোঁজ খোঁজ শুরু হয়ে গেল বিপ্লবের। ভোটের প্রচার মাথায় উঠে গেল রাজনৈতিক নেতা আর কর্মীদের। বসন্তনগরে চিরুনি তল্লাশি শুরু হল, এমন কি কোনো বিপ্লব রয়ে গেছে, আসন্ন ভোটে যার ভোটদাতার তালিকায় নাম ওঠেনি সরকারের গাফিলতিতে? এমন কি কোনো সম্ভাবনা যে তালিকায় নামে ভুল রয়ে গেছে আর বিপ্লব নামের আসন্ন লাশ সেই নাম ঠিক করায়নি। হয়তো বিপ্লবের বদলে নামটি লেখা হয়েছে বিপুল বা বিলুপ্ত? আবার ভোটার তালিকায় হামলে পড়ল কর্মীরা বিপ্লবের সম্ভাব্য ভুল নামটি চিহ্নিত করতে। বিপ্লবকে তাদের খুঁজে বার করতেই হবে। খুঁজে পেলে তার নাম সংশোধন করে ভোটার তালিকায় সংশোধিত বিপ্লবকে ঠাঁই দিতেই হবে না হলে কী যে হবে তা কেউ ভেবে পাচ্ছে না। তবে একটা ভয়ানক কিছু হবে সে বিষয়ে সবাই সুনিশ্চিত।

বসন্তনগরে এমন হয়নি কোনোবার। বসন্তের হাওয়ায় শহরে ছড়ানো পলাশগাছগুলি বরাবরের মতো লাল হয়ে উঠেছে। কোকিলেরা বরাবরের মতো ডেকে চলেছে অথচ ভোটার তালিকায় থাকা জনপদের মানুষগুলোর বুকে স্বস্তি নেই। সবাই লাশ হয়ে যাবার সম্ভাবনায় ভীত-সন্ত্রস্ত। যত দিন যাচ্ছে মানুষগুলো ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে।

ওই যে বেকার ছেলেটি নদীর ধারে একা বসে আছে, সেই আসলে বিপ্লব নয় তো? এই বয়সে একা কেউ বসে থাকে! ওই যে বস্তির ওই লোকটা, ওকে এই শহরে আগে দেখা যায়নি তো! ও কি পরিযায়ী শ্রমিক? বহুবছর পরে ফিরেছে শহরে রক্তাক্ত পা নিয়ে। ওই বিপ্লব নয় তো?
রোজ রাস্তায় দেখা বন্ধ কারখানার ওই শ্রমিকটা বিপ্লব নয় তো? হয়তো ভোটার তালিকায় নিজের ভুল নামটা পাল‌টাবার প্রয়োজন মনে করেনি।

কোনো সাইড করা আদর্শবাদী পার্টিকর্মীর ছেলের নাম বিপ্লব নয় তো? হয়তো বাড়ির ডাক নাম বিলু আর সেই নামটাই ভোটার লিস্টে উঠে গেছে।

কোনো মেয়ের নাম বিপ্লব নয় তো? আদিখ্যেতা করে হয়তো বাপ-মায়ে মেয়ের নাম বিপ্লব রেখেছে। বাড়ির নাম হয়তো বুলু, পলি বা মলি। ওই নামেই হয়তো বন্ধুরাও ডাকে। ভোটার লিস্ট চেক করার সময় কর্মীরা মেয়েদের নামগুলোকে উপেক্ষা করে গেছে। এভাবেই বিপ্লব চোখ এড়িয়ে গেছে। হতেও তো পারে।

বসন্তনগরে এমন হয়নি কোনোবার। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের একটি নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসছে আর বসন্তনগরের মানুষেরা সবাই সবাইকার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। সামনের মানুষটি আসলে বিপ্লব নয় তো? এমনকি আয়নার সামনে দাঁড়ালে সন্দেহ হচ্ছে নিজেরাই তারা বিপ্লব নয় তো! হয়তো নামটা বদলে গেছে। হয়তো তারা জানেই না আসলে তাদের নাম বিপ্লব।

বসন্তনগরে এমন হয়নি কোনোবার। বসন্তের নির্ঘোষে এবার লাশের নয়, বিপ্লবের খোঁজ চলছে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *