মঙ্গল শোভাযাত্রার গোড়ার কথা – অঞ্জন আচার্য
বাংলাদেশে বৈশাখী উৎসবের এক আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে মিশে আছে এ শোভাযাত্রার নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতি বছরই পয়লা বৈশাখে অর্থাৎ বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ তথা বাংলা নববর্ষে অনুষ্ঠিত হয় এ মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখের সকালে শোভাযাত্রাটি রাজধানী ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবার চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তোলা হয় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে। এতে অংশ নেয় চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-পেশার নানা বয়সের হাজারো মানুষ। শোভাযাত্রায় বহন করা হয় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম। থাকে বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিমূর্তি।
১৯৮৯ সাল থেকে এ মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু। বর্তমান সময়ে সেটি নববর্ষ উদ্যাপনের একটি অন্যতম আকর্ষণ হয়ে স্থান করে আছে বাঙালির মন ও মননে। জনমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় ঢাকায় আয়োজিত প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রাটি। সকালে চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পয়লা বৈশাখে এ শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রায় সেইবার স্থান পায় বিশালকায় চারুকর্ম পাপেট, হাতি ও ঘোড়াসহ বিচিত্র সাজসজ্জা। থাকে বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। তারপরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। তবে সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, সে বছর নববর্ষের সকালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে চারুশিল্পী সংসদ। শুরুতে চারুকলার এ শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকে যতটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রাটি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে নামকরণ হয়। তবে ১৯৮৯ সালে বর্ষবরণ উপলক্ষে চারুকলায় আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরোনো। ১৯৮৬ ‘চারুপীঠ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরোনো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই সেই শোভাযাত্রা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।
যশোরে প্রথম যে শোভাযাত্রাটি বের হয় সেটির উদ্যোক্তা ছিলেন চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতা তরুণ শিল্পী মাহবুব জামাল শামীম, হীরণ্ময় চন্দ, ছোট শামীমসহ আরো কয়েকজন। এর আগে এই উপমহাদেশে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শোভাযাত্রার তেমন একটা ইতিহাস পাওয়া যায় না। এরপর ১৯৯০ সালে বরিশাল ও ময়মনসিংহ শহরে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। এ প্রসঙ্গে চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর কথা তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালে যশোরের চারুপীঠের শামীম ও হীরণ্ময় চন্দের উদ্যোগে প্রথম পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সাজগোজ করে শোভাযাত্রা বের করা হয়। চারুকলা ইনস্টিটিউট ও চারুশিল্পী সংসদের উদ্যোগে আমরা ১৯৮৯ সালে ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করি। তবে যশোরের চারুপীঠ এ ক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার। তাদের চেতনা থেকেই আমরা বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শোভাযাত্রা শুরু করি।’
প্রথম শোভাযাত্রার স্মৃতিচারণা করে শিল্পী শামীম বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা থেকেই আমরা ওই সময় নববর্ষ উদ্যাপনে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করি। ওই দিন আমরা প্রভাত ফেরিতে অংশ নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। হঠাৎ মাথায় ভাবনা আসে, ভাষা তো হলো; কিন্তু আমাদের কৃষ্টি, ইতিহাস ঐতিহ্য কোথায়? বাঙালি হতে গেলে আরো কিছু করা দরকার। ওই ভাবনা থেকে আমি শিল্পী হীরণ্ময় চন্দ ও ছোট শামীম মিলে সিদ্ধান্ত নিই বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শহরে শোভাযাত্রা বের করবো। এক মাস আগে থেকেই আমরা সেটির প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ছোট শামীম প্রজাপতি, পাখি তৈরি করে। হীরন্ময় তৈরি করে মুকুট। চারুপীঠের ৩০০ শিক্ষার্থীকে আমরা নাচ-গানের প্রশিক্ষণ দিই। কেমন পোশাক হবে তাও ঠিক করি। এরপর যশোর সাহিত্য পরিষদের কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে আমরা ১৩৯২ বঙ্গাব্দ (১৯৮৬ সাল) উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের করি। ঢাক, ঢোল, সানাই বাজনাসহ বর্ণাঢ্য সেই শোভাযাত্রা এম এম কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাস চারুপীঠ কার্যালয় থেকে শুরু হয়। এরপর দড়াটানা, বড়বাজার, চৌরাস্তা, চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড হয়ে আবার চারুপীঠে এসে শোভাযাত্রাটি শেষ হয়। পরবর্তী সময়ে চারুকলার ছাত্ররা মিলে আমরা ১৯৮৯ সালে প্রথম ঢাকায় শোভাযাত্রা বের করি। বরিশাল, ময়মনসিংহে ১৯৯০ সালে যে শোভাযাত্রা বের হয়, সেখানেও চারুকলার ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।’
তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ঢাকায় আয়োজিত প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০-এর আনন্দ শোভাযাত্রায়ও স্থান পায় নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় লাভ করে নতুন মাত্রা। চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাধ্যক্ষ, বিশিষ্ট লেখক-শিল্পীসহ সাধারণ নাগরিকরাও অংশ নেয়। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে-গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ সালের শোভাযাত্রার সামনে রং-বেরঙের পোশাক পরা ছাত্রছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেই কুমিরটি। ১৯৯৩ সালে ‘১৪০০ সাল উদ্্যাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে বের করে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এতে আকর্ষণস্বরূপ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। এর এক বছর পর ১৯৯৪ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও ও শান্তিনিকেতনে।
কয়েক বছর ধরে নববর্ষ উপলক্ষে দেশব্যাপী মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হচ্ছে। তবে মানিগঞ্জের সিংগাইর থানার সারাইল গ্রামের সিদ্ধাবাড়ীর প্রাচীন মেলায় এক ধরনের লোকমিছিল বের করা হতো বলে জানা যায়। অনেকের মতে, এই লোকমিছিলের বিবর্তনরূপ এ শোভাযাত্রা। যাই হোক, সময় পাল্টেছে অনেক। এ কথা আজ স্বীকার করতেই হবে, শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত প্রতিমূর্তিগুলো নিছক পশুপাখির অবয়ব মাত্র নয়; বরং এর সাথে মিলেমিশে আছে রাজনৈতিক বাস্তবতা। চলমান রাজনীতির ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত এ শোভাযাত্রা নিঃসন্দেহে অভিনব ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের কাছে সাদা পবিত্রতা, কালো শোক আর লাল উৎসবের প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ফলে বর্ষবরণের দিনে লাল-সাদা রঙের সংমিশ্রণে সেজে ওঠে বাঙালি, উদযাপন করে আনন্দ। পাশাপাশি সমসাময়িক সমাজ-বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা অসংগতির প্রতিবাদ স্বরূপ হিসেবে মূর্ত হয় চিত্রকলার ভাষিক দিক। মঙ্গল শোভাযাত্রায় শোভিত প্রতিটি প্রতিমূর্তিই তারই সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন ধরেই। এমনকি এ উৎসবে অংশ নেয় ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বাঙালিরা সেদিন আপন সংস্কৃতিতে নিজেদের রাঙিয়ে তোলে নানা সাজে। বিশ্বের সব প্রান্তের বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে অতীত বছরের সব দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি হয় সুখ ও সমৃদ্ধময় হয়।
ছবিঃ রাকেশ কুমার দাস