উড়ি উড়ি পাখিটি উড্ডীন রেখাটি… – মেঘ অদিতি
বয়সের ব্যবধান যাই হোক, মনের কাছাকাছি যে মানুষের অবস্থান তাকে আজকাল ‘তুমি’ সম্বোধনই রীতি; এই যেন দস্তুর৷ কিন্তু বারীন দা, তাঁকে কখনও তুমি বলে উঠতে পারিনি৷ নব্বই থেকে দ্বিতীয় দশকের অসংখ্যজনই তো তাঁকে ‘তুমি’ করেই বলেন৷ আমি পারিনি, পারি না৷ অথচ বারীন দা আমার জীবনে এক অমোঘ ব্যক্তিত্ব, খুব কাছের কেউ হয়েই আছেন, থাকবেন৷
সময়টা খুব বেশী দূরের নয়৷ কলকাতা বইমেলায় যাতায়াত ছিল আগে থেকেই ৷ সেবারে ছিলো ঐহিকের আয়োজনে প্রথমবারের মতো ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা প্রদানের অনুষ্ঠান৷ সেই সম্মাননাটি নিতে ডাকা হয়েছে আমাকে৷ প্রথম বার কলকাতা চলেছি একা৷ সঙ্গত কারণেই টেনশন৷ প্লেনে চড়ব একা৷ বোর্ডিং পাস, ইমিগ্রেশন-একা৷ বেল্ট থেকে মালামাল তুলতে পারব কি না একা৷ বেরিয়ে ট্যাক্সি নেবো না কি ঐহিক থেকে কেউ আমাকে রিসিভ করতে আসবেন, নানবিধ টেনশনে জারিত হতে হতে কলকাতা পৌঁছে গেলাম৷ পরের পর্বে অতি সাধারণ এক ফালি মেঘ কি করে যে প্রেস কর্ণারে ঢুকে পড়েছে সেদিন খানিক দিশেহারা ভঙ্গীতে সে কথা কেউ জানে না৷ চেনা মুখগুলো তখন কিরকম অচেনা৷ কানে বাজছে মেঘ মেঘ… কেউ কি আমার নাম ধরে ডাকছে? ডান বামে ঘাড় ঘুড়িয়ে তেমন কিছু বুঝলাম না৷ কিন্তু ডাকটা আবার ভেসে এলো৷ এবার পাশে বসা কেউ আমাকে জানালেন, মেঘ তোমাকে বারীন দা ডাকছেন তো৷ তাকিয়ে দেখি কবি বারীন ঘোষাল আমাকে উদ্দেশ্য করেই হাত নাড়ছেন ৷ ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দাঁড়ালে আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। হাত বাড়িয়ে দেন৷ আর সেই করমর্দনের আন্তরিকতার ভেতর আমি ভিজতে থাকি৷ আবেগ আসে হুহু করে৷ চোখ তুলে তাকাই। তিনি হাসছেন৷ নিমিষে আমিও সহজ।
পরিচয় আরো ঢের ঢের আগে, তাঁর সাথে, সেই ফেসবুকে। তবু অনেকদিন কথা বলেও যে কাজটা আমার একেবারেই হয়ে ওঠেনি তা হলো কবিতা নিয়ে বারীন দাকে প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যস্ত করে তোলা৷ কেন যেন তাঁকে আমার মাটির কাছাকাছি এক অন্য ব্যক্তিত্ব বলে মনে হতো। অথচ তিনি আমার লেখা পড়তেন৷ অনলাইনে প্রকাশ পেলে সেটা খুঁজে পেতে সমস্যা হলে ইনবক্সে জানাতেন, মেঘ ওই লেখাটা এখানে দাও। পড়বো৷ এই হচ্ছেন বারীন দা৷ তরুণ কবির আশকারার এক মহা আস্তানা৷ সব সময়ই তিনি নতুন কবির বই বা লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ছেন৷ তা নিয়ে লিখছেন৷ সেই কবিকে তার কথা জানাচ্ছেন৷ অগ্রজের এই মানসিকতা আমাকে বারবার বিস্মিত করেছে৷ বরাবর তাই বারীন ঘোষাল আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়েই রইলেন৷ আর তাঁর ওই ইনবক্সে লেখা, কথা বলা এতটাই আন্তরিক ছিল যে আমার বিশ্বাস হতে শুরু করে আমি সত্যিই অনেক কিছু পারি৷
পেশায় আমি গ্রাফিক ডিজাইনার তবে ফাইন আর্টস থেকে আসিনি৷ যা কিছু কাজ আমি ভিজিটালে করি৷ টুকটাক আঁকি কখনও কম্পিউটারে, কখনও কাগজে৷ মিক্স মিডিয়ার সেটা প্রকাশ করি৷ আর কী এক অজানা রহস্যে আমার সেই আঁকাগুলো বারীন দার পছন্দের হয়ে যায়৷ তিনি একদিন লিখলেন, “তোমার আঁকা ছবি আমার ভাল লাগে। তোমার কবিতা ভাল লাগে। মানেই হল তোমাকেই ভাল লাগে। এক একজনের সাথে এরকম হয়৷” বারীন দার এ কথায় আমি তখন আবারও আবেগের পাল তুলছি হাওয়ায় ৷ উত্তরে কী বলি বুঝে না পেয়ে শেষে লিখলাম, বারীন দা আপনার মতো ব্যক্তিত্ব যখন এত ছোট কাউকে তার কাজের প্রশংসা করেন আমি কথা হারাই৷ তিনি লিখেছিলেন, “আমি কেউ না৷ কিছু না৷ তোমরা সবাই মিলে এই আমি। তোমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে আমি তৈরি হয়ে উঠি মাত্র।”
২০১8র সেপ্টেম্বর মাসে অনলাইন একটি পত্রিকার জন্য বারীনদার কাছে কবিতা চাই৷ বারীন দা কবিতা নিয়ে কথা বলার আগে আমাকে প্রশ্ন করেন, “কেমন আছো? কী হয়েছে? তোমার আঁকা কেন দেখছি না?” সেবার কবিতা তিনি দিয়েছিলেন৷ যাদের পত্রিকা তাদেরকে সে কবিতা আমি পৌঁছে দিই৷ কিন্তু সেটা প্রকাশ পাবার পর দিব্যি ভুলেও যাই বারীন দাকে তা জানানোর কথা ৷ ২০১৫র জুলাইতে বারীন দা আমাকে লিখলেন, মেঘ, ভাল আছো? গত সেপ্টেম্বর মাসে আমার একটা কবিতা নিযেছিলে কোনো পত্রিকার জন্য৷ সেটার কিছু হল? আমি স্রেফ আকাশ থেকে পড়লাম৷ ভুলেও গেছি সে কথাI বারীন দাকে উল্টে জিগ্যেস করলাম, করে নিলাম? নিইনি তো! তিনি আমার এ কথার কোনো উত্তর করেননি। ঠিক দুদিন পর খেয়াল হলো সত্যি তো কিছু যেন নিযেছিলাম৷ এবার শুরু ইনবক্সের কনভারসেশন স্ক্রোলিং৷ পেয়েও গেলাম। লজ্জার শেষ নেই তখন। বারীনদাকে লিঙ্ক দিয়ে লিখলাম, দাদা এই কবিতাটা নিয়েছিলাম। কবেই পাবলিশ হয়েছে। যাদের পত্রিকা তারাও আপনাকে লিঙ্ক দেননি, আমিও ভুলে গেছি।
বারীনদার উত্তরটা ছিলো, “হ্যাঁ, এটাই৷ যাক গে। তাহলে লেখা নিয়ে ভুলেও যাও? এই ভুলোমন শিল্পিকেই মানায়৷ সুপ্রভাত মেঘ।”
তারপর আবার অনেকগুলো দিন চলে গেলেI বেশ অনেকগুলো দিন বারীন দা অসুস্থতায় কাটালেন। ফেসবুকে ধীরে ধীরে অনিয়মিত হলেন তিনি। তাঁর অনিয়মিত হবার প্রথম দিকে ভাবতাম শিগগির আবার নিয়মিত হয়ে যাবেন। লেখা পড়ে কমেন্ট কম করলেও ইনবক্সে ঠিক জানাবেন। তিনি এলেন। অল্প অল্প ফেসবুকে থাকলেন কিন্তু সেভাবে আর তাকে পেলাম না। এবার তাঁকে মিস করতে শুরু করলাম। কিছু বা অভিমানও, আমার লেখাটা তো কই পড়েন না তিনি ।
সবটা মুখোমুখি নয়। ইনবক্স আর সামনাসামনি দুই মিলিয়েই বারীন দাকে নিয়ে আমার হরেকরকম স্মৃতি৷ কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি৷ ইচ্ছে করত ভালোপাহাড় যাই৷ কিন্তু সময়াভাব, এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে আমার মত ঘোর সংসারী (মনে মনে নই… বাধ্য হয়ে) মানুষ কতদিন থাকতে পারে? বারবার ডাক আসে ফেরো, এইবেলা ফেরো৷ সংসার যে উচ্ছন্নে যায়৷ ফিরে আসি। ভাবি পরেরবার যাবো৷ পরেরবারগুলো ঘুরে ঘুরে এলেও আমার আর যাওয়া হয় না। দেখা হয় না ভালো পাহাড়ের কবিতা যাপন৷ এখন জানি কখনও ঠিক যাওয়া হবে সে ভা£লাপাহাড়ে৷ কিন্তু ভালো সেই মানুষটি সেদিন সাথে থাকবেন না। না কি থাকবেন তখনও তিনি, যেভাবে ছায়া হয়ে সাথে সাথে থাকে আমার বাবা!
প্রিয় বারীন দা, যে কথাটা কোনোদিন আপনাকে জানানো হয়ে ওঠেনি, বইমেলার কৌরবের স্টলের বাইরেটায় যে চেয়াবে আপনি বসে থাকতেন, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে আপনি যখন হাত ধরে পাশে বসতে বলতেন তখন বাবা আর আপনার মধ্যে কোনো তফাৎ পেতাম না৷ পাশাপাশি বসে, অত কলররের ভেতরও আপনি আমি দু’জন স্বল্পবাক মানুষ নৈঃশব্দের ভেতর দিয়ে কখন যেন পিতা-পুত্রী হয়ে উঠেছিলাম৷
আসছে বইমেলা বা তার পরের যত বইমেলা হবে, কৌরবের স্টলের বাইরেটায় সেই চেয়ার আপনার জন্যই রাখা থাকবে৷ সেই চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে, ছায়ার মায়া মেখে আপনি কি আমাকে আবারও সেদিন পাশে বসতে বলবেন?
বাতাসে কি সেই কবিতাটা ভেসে বেড়াবে তখন…
নাও ঢোকো
দরজা খুলেই ঢুকে পড়
আমি আমার বাবাকে নিতে এসেছি
তোমাকেও
নাক আর কানের ইন্দ্রিয় এখন কিছুটা জিভে
এখন মৃতদের জায়গা বদলের সময়
বারীন দা… শুনছেন… !!
লেখার শিরোনাম এবং কবিতাংশ বারীনদার কবিতা থেকেই নেওয়া
‘বারীন দা… শুনছেন…!!’– বারীন দা শুনতে পেলেন কি না, জানি না। তবে আমাদের দুচোখ জলে ভিজে গেল ম্যাম। বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি প্রিয় কবিকে। যেখানেই থাকুন, অনেক ভালো থাকুন তিনি!