তালকানাদের সংসার – সাদিক হোসেন
বিকেলে সন্ধ্যা সমাগত – এমনি কাজল মেঘ। পশ্চিমের ঝঞ্ঝা তবে শুরু হবে এখনি। তার আগে মফস্বলের গাছগুলো খানিক থ। বুঝি নিজেদের সংসার এইবার গুছিয়ে নেবার সময় হল। পাখিরা ফিরে যায় গানের মত। হাল্কা, উদাসী; তবু সচল। তারে মেলা কাপড় তুলতে ব্যস্ত গৃহবধূ। তার নাকছাবিটি আচমকা উজ্জ্বল। পাড়ার রাস্তায় কাগজের ঠোঙা উড়ছে। খবর উড়ছে। বামুনপাড়া, মোল্লাপাড়া, পালপাড়া, নয়াপাড়ার খবর উড়ে যাচ্ছে। যেন কানাঘুষো। কার কাছে কার সংবাদ যে পৌঁছে দিচ্ছ তার হদিস জানে কে? কে জানে কার হাঁড়ির খবর? কার হাঁড়ি ভেঙে গেল হাটে? বাজারে আলু ও পেঁয়াজ, মাছ ও তরিতরকারি – যেন পরিক্রমা শেষে সফল পরিব্রাজক ফিরিছে আপন গৃহে; আর মাঝখানে এই বিপত্তি। সামনে দিয়ে সোঁ সোঁ বেগে যা ছুটে গেল, তা তো ঝড় নয়; সাইকেলের ক্রিং ক্রিং। এমন গতি যেন উন্মাদ-দশা প্রাপ্ত হয়েছে তার। উপর নিচ সব বেসামাল। তালগাছে ঝুলছে হাতির শুঁড়। হা-করা নর্দমা মুহুর্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে মালকিনের কাছে। তবু দুলছে পাগল প্রায় তাল গাছ। একবার এইদিক তো আরেকবার ঐদিক। আমরা ক’জনে সেই রোগা-লম্বাটে সাইকেল আরোহীকে দেখে অবাক। এই বুঝি পড়ল ঐ ডোবার জলে। তখন কানাঘুষো খবর হবে। বামুনপাড়ায়, মোল্লাপাড়ায়, পালপাড়ায় ছুটে যাবে পাগলের মহাপতন। এমন পতন যেন ইহলোকে এই প্রথম – এই শর্তে রটে যাবে সচেতন বাণী। তবু পড়ল কী ঐ তালগাছ? তাকিয়ে দেখোঃ নিশানা চুকে যাক – এমনি মনোবাঞ্ছা নিয়ে তিনি প্যাডেলে পা দিয়েছেন। সামনে নদী। ভেবে দেখোঃ সেখানে এখন প্রবল জলোচ্ছ্বাস। আর তার মধ্যে তিনি কোনোমতে সাইকেলটা রেখে একা দাঁড়িয়েছেন জেটির উপর। নোঙর ছিঁড়ে লঞ্চ ছুটবে কবে? আলখাল্লার মতো নবনির্মিত আশ্রম কী উড়বে কখনো! গানের মত পাখি ওড়ে। ঘুরপাক খায় মাথার ভেতর। কার সংবাদ কার কাছে পৌঁছে দিচ্ছ হে? গৃহস্থের অকল্যাণ করাই বুঝি তোমার একমাত্র কাজ! তাই এমন বেখেয়ালি? বেয়াদপি? তাই এমন ভিক্ষাবৃত্তি যে শত অপমানেও রা নেই! কুহু ডাক নেই! কুঞ্জে ফিরে অতিরঞ্জিত গল্প বলার ভার নেই? মানে, খানিক ধাতস্থ হলে বুঝবে কি সংসার শুধু মান ভাঙানোর খেলা নয় – আলু, পেঁয়াজ, মাছ ও তরিতরকারির অধিকারবোধও তা! আহা, বিকেলে সন্ধ্যা সমাগত আর সংসারের কোণে আপনজনের ঝঞ্ঝা। যেন তারে ঝোলা পতপতে পাজামাটি গৃহবধূ তুলতে ভুলে গেছে একেবারে! এখন চেয়ারে পা তুলে ডানহাত থুতনিতে ঠেকিয়ে বসেছে। আশ্চর্য্য, এত কালো চারদিকে, তবু তার আংটিটি কেন দৃশ্যমান হল! আসলে ফাঁদে পা দাও তুমিও। ঐটুকু আলোর এত ঔজ্জ্বল্য কী অতিরঞ্জিত গল্পের প্রেক্ষাপট নয়? তুমি কি সংসারী ব্যোমভোলা! চতুর? মালকিনের কাছে পোষ মেনে যাওয়া হা-মুখ নর্দমা? নিজের মুখের রঙ নিজেই চটিয়ে ফেলতে পার – সেটার প্রমাণ দিয়েছ আগেই। কিন্তু ঐ যে ট্যারাব্যাকা জানলা – যা দিয়ে বটের চূড়া দেখা যায়! তুমি কি তোমারই পূর্বাভাস!
আসলে ছিল না কোনো আভাস। এমনকি ইঙ্গিত। বন্ধু অতনু যখন খবর দিল সে তোমার পেইন্টিং দেখে এসেছে – আমি তখন নিতান্তই ছাপোষা, মানে অফিসে গুটিপোকা সদৃশ। আমিও দেখব একদিন – এমনি কিছু সংলাপের পর ঘণ্টা বেজে যায় – যবনিকার পতন হয় না তবু – কিন্তু মিছে এই আহ্লাদে যদি বা কিছু থেকে থাকে তা তো কাটিয়ে দেওয়ার প্রবণতা – তখন আর অন্য কিছু ছিল না, নিশ্চিত।
থাকি পাশের পাড়ায়। তবে প্রতিবেশী নই। আদানপ্রদান আর কোথায়। ঐ যে বলছিলাম ঝড়ের মাঝে দেখা সাইকেল আরোহী – একগুঁয়ে – এইটুকুই, বাকি যা, তা তো এড়িয়ে চলবার ভঙ্গিমা, ভণিতা এবং যে যাই-বলুক বেপাড়ায় কে আর নোঙর বাঁধতে চায় – এইসময় – তাই, হেঁটে পেরিয়ে আসা তার ভূতুড়ে বাড়ির প্রতি খানিক সম্ভ্রম জাগলেও, জাগেনি ইচ্ছা – ঐ যে বন্ধুর বাণী পাওয়া সত্ত্বেও – যেন থাকুক না এভাবে, প্রাকৃতিক তিনি – তাই মীমাংসায় যাব না – থাকুক না ওভাবে, যেভাবে থাকে বটের চাড়া ঐ ভূতুড়ে বাড়িতে – একদম সংসারের প্রান্তে – এঁটো থালার মত অচ্ছুৎ – অথচ এঁটোটা তো আমাদেরই, তাই থাকুক – এমনি ভাব, বলা যাক বোধ, খণ্ডিত বোধ নিয়ে ক্রমে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রয়াস – এখনো, বেপাড়ায়।
তবু বাঁধন যখন নিয়তি – যেতে হয়, না গেলে উপায় কী? গিয়ে দেখি দোতলার ঘর টিকটিকির বিষ্ঠায় আহত। খাটের উপর অগোছালো চাদর, কাঁথা, পোড়া বিড়ি – আর যে কত কী – সেকথা থাকুক, বরঞ্চ বলে ফেলি, আলমারির ভেতর থেকে, খাটের তলা থেকে যেসব বেরতে থাকে – মানে, ক্যানভাস – তাতে শুধু ধুলো নয়; ধারগুলো খেয়েছে ইঁদুরে – এই ঘর তবে টিকটিকির একার অধিকারে নেই; ও হরি, আছে তো উৎপাত – তা কখনো মানুষের, কখনো জোলো হাওয়ার – কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে রঙ, কাগজ, এমনকি মাথাটাও, ক্রমাগত। তা না হলে কেউ গান গেয়ে ওঠে? সুকুমারের ছড়া আওড়ায়, এই এখানে – ধ্বংসের সামনে দাঁড়িয়ে – মুখের আগুন কখন যে নিভে গেছে – অতনু দেশলাই জ্বালালো।
কী যে কথা হল! কী যে কথা হতে পারে! বৃক্ষ, দেবতা, অলৌকিক… এই সব আর কী! শুনছিলাম, যেমন শোনে শাসক; আসলে দেখছিলাম ছবি, যেমন দেখে প্রতিবেশী!
ধানক্ষেতের মধ্যে বটবৃক্ষ। পতনশীল শিশু – যা তিনি নিজে, এমনি বলছিলেন। একজন অচেনা কিশোর – সহোদর। স্কেচে আড্ডা, দুই বন্ধুর – মাঝখানে ল্যাম্প। প্যাস্টেলের আঁকিবুঁকি – কিশোরীর পাশে মুরগী – জমাট মেঘ। পাথর!
বললাম, তবে কি প্রেত?
– প্রেত নয়?
– ভগবান?
– হা ঈশ্বর!
– মহাপুরুষ?
– সে কী সে? এত সহজ? আমার পিতা ডাক্তারি করতেন। কত যে সেবা তাঁর। এই এত এত পাখি, গাছ, ঘরবাড়ি… ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? মানে, কী বললাম বুঝলে কি?
বুঝিনি কী আর, যাকে বলে বাংলাদেশ – সেতো জলের ইতিবৃত্ত! অতএব, থাক এখানে, যা তালকানা আপনি, দিক নেই, বিদিক নেই, টালমাটাল!
– হাঃ হাঃ, ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? কী বলতে চাইলাম বুঝলে কী!
বুঝলাম ডাইনিং টেবিল। টেবিলের উপরে তিনটে চারটে তাল রাখা। তালকানাদের সংসার। চেয়ার ফাঁকা। খেতে বসেছে টেবিলের উপর। উবু হয়ে। খেতে বসে গুজগুজ-ফুসফুস করছে। কী যে কানাঘুষো। কার সংবাদ কাকে যে দিচ্ছে। কার খবর কে যে জানতে পারল না। কে যে বেখবর, মাথা নীচু করেছে টেবিলের উপর – যেন প্রকৃত তালরূপী মানুষ! পেছনের দরজা দিয়ে যে ফ্যাটফ্যাটে আলো আসছে – তা অতি সংসারী – বাইরে কোমল – ভেতরটা কৃপণ, একেবারে মোরগের ঝুঁটি! যদিও ধুলোর চোটে প্রথমে আলো দেখতে পাইনি। যখন দেখলাম – যেন মর্মাহত – তালকানাদের সুখী পরিবার!
– হাঃ হাঃ, ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড! কী বলতে চাইলাম বুঝলে কী!
এখানে অট্টহাসির বাজনা বাজুক। আমি ফিরে চলি খানিক আগে। তখনো অফিসে। ফোন এলো দুপুরে। ফোন করেছে অতনু।
– কী ব্যাপার!
– সে-সাংঘাতিক ঘটনা। আঁকাগুলো বাঁচাতেই হবে। যেভাবে হোক। ওর বাড়িতে রাখলে আর রক্ষে নেই। আমি যতগুলো পারি বয়ে বয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছি। তুই একবার এসে দেখে যা।
যাব কী বেপাড়ায়? এখন, এই অসময়ে? দূরে ঝড় উঠছে যখন। ধুলো ঝড়। আর তার মাঝখান দিয়ে বন্ধু প্রতিবেশীর শিল্পকর্ম নিয়ে ছুটেছে ঘরের দিকে। ছবিগুলো ঘর পাক, সংসার পাক – আদর যত্নে আলুথালু হোক – নিয়তি সঙ্গ দিলে বৃত্তিও কি জুটবে না! তাতে চিকিৎসা, আলু-তরকারি-মাছভাত জুটবে আঁকিয়ের। বেখেয়ালিকে খেয়ালে রাখার স্নেহ – আর কিছু নয়।
ওদিকে বিপদ কাটে না মোটে। তিনি রাস্তায় অপেক্ষা করেন। প্রথম সুযোগেই পাকড়াও করবেন। ঘাড় ধরে নিয়ে যাবেন ভূতূড়ে বাড়িটায়। কী যে স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে, কী যে পুরাতনী ঢঙ! ভয় লাগে। তিনজন আস্ত তাল, যারা পরস্পরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসেছে, যেন দীনতা ও অবহেলার জটিল মিশ্রণ – এদের দেয়ালে টাঙিয়ে বন্ধু কিভাবে দাম্পত্যে নামবে? নিত্য কলহ সুখ তবে? ফ্যাটফ্যাটে আলো এখন? আমাদের বাসা নিলয় হল না কখনো! খানিক ধাতস্থ হও, বুঝবো, সংসারে কতটুকু অকল্যাণ ঘটল। বোঝাপড়া করা যাবে পরশু – তাড়াহুড়ো নেই।
তালকানাদের সংসার বেয়াদপ বড়।
‘তালকানা’ শব্দের ব্যবহার ভালো লাগল। যেন একটা সংবাদ পরিক্রমা।