প্রতিকৃতি – দেবাশীষ ঘোষ
স্ব-প্রতিকৃতি একটি নির্বচন। এজাহার। স্ব-এর অন্তস্থল খুঁড়ে অনুভূতি ও চেতনাপ্রবাহের অথবা নিছকই ব্যক্তির অস্তিত্বের রূপ ও রঙের উদযাপন।
ধর্মীয় বিষয়ে দাসত্ব ছেড়ে ব্যক্তির প্রতিকৃতি নির্মাণ অবধি শিল্পের বিষয়ভিত্তিক বিবর্তনের যাত্রাপথ দীর্ঘ। বহু শতাব্দী। খ্রিস্টীয় পনেরো শতকে পৌঁছে য়োরোপে যে ব্যক্তি প্রতিকৃতিতে চোখ পড়ে আমাদের তা মূলত রাজ পরিবার ও অভিজাতবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিধির সম্প্রসারণ, প্রযুক্তির অগ্রগতি, ভৌগোলিক সীমানার বিস্তার ও ইত্যাদি থেকে জন্ম নেয় যে নতুন বুর্জোয়া সম্প্রদায়, তার হাতে যে ব্যক্তির প্রতিকৃতি নির্মাণ রেনেসাঁস-উত্তর য়োরোপে এক বিচিত্র উচ্চতায় আসীন হয় এবং ব্যক্তির এই সদর্প ঘোষণা শিল্পের বিবর্তনের ইতিহাসে, তার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
প্রখ্যাত জার্মান চিত্রশিল্পী গেয়র্গ বাসলীৎজ্ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন– আমি যখন ছবি আঁকি, আমি আমার পায়ের নিচে মাটির স্পর্শ অনুভব করতে চাই। আমার স্পর্শাভিলাশ খ্রিস্টীয় য়োরোপের ন্যায় আকাশপানে স্বর্গের দিকে নয়, মাটির দিকে ধায়, যেদিকে নরক। যীশুখ্রীস্ট সহ মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতাবাদ ও মিশনারি স্বর্গের ফেরেস্তার রূপকথায় আমার বিশ্বাস নেই। কেবলমাত্র চার্চ ও ধর্মীয় বিষয়কে মহিমান্বিত করার শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী শিল্পের ইতিহাসের ধারা রেনেসাঁস-উত্তর য়োরোপে বাসলীৎজ্ অবধি এদ্দূর যে বিবর্তিত হতে পেরেছে অপেক্ষাকৃত এত অল্প সময়ে তার একটা বড়ো কৃতিত্ব অবশ্যই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণার, যার অন্যতম প্রতিবিম্ব স্ব-প্রতিকৃতিতে প্রতিফলিত হতে দেখেছি আমরা।
মডেল যোগাড় করবার আর্থিক অসুবিধা প্রভৃতি কেজো অজুহাত ব্যতিরেকেও যে প্রবল নিঃসঙ্গতা, তদুপরি অসহায়তা নিয়ে একজন শিল্পীর যাপন যা কেবল রোজ বাঁধাধরা কোনো সিঁড়ি বেয়ে উঠে কোনো নির্দিষ্ট ঘরে চাবি খুলে ঢুকে পড়া নয়, সেই সৃজনশীলতার কর্মশালায় নিজের প্রতিবিম্বকে উলটে-পালটে তার অন্তর্চেতনার দ্বন্দ্বকে শিল্পে ধরবার বাসনাও কি স্ব-প্রতিকৃতির প্রেরণাস্বরূপ নয়? ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়ের স্ব-প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নই প্রথমে আমার মাথায় আসে। গাঢ় পোশাকের রং, আয়ত গভীর দৃষ্টি, দূরগামী। সর্বত্র একটা চাপা স্বভাব ও অন্তর্মুখীনতার আভাস। কেবল ঐ একটি ফড়িং। ‘Artists are like children’, আর শিশুরা কৌতূহলী, অতএব চঞ্চল। ভাস্করের প্রতিকৃতির সমাহিত, শান্ত ভাবের মাঝখানে সেই শিশুরই চঞ্চলতার দ্যোতনা বয়ে আনে ঐ ফড়িং।
আঙ্গিকের দিক থেকে ভাস্করের স্ব-প্রতিকৃতির চাল ধ্রুপদী। কিন্তু তার আবহ ও অভিব্যক্তি আধুনিক। ব্যক্তি ভাস্করের আপাত চঞ্চলতা ও প্রগলভতা তার স্ব-প্রতিকৃতিতে, তার রঙের ব্যবহারে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কেবল ঐ এক ফড়িং।
সস্তার রং ও উপকরণ ব্যবহার করে ছবি আঁকা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব সময়ের নিরিখে তার জরিমানা আদায় করেছে কান মুলে। বিভিন্ন জায়গায় ছবিটির যে রং হারিয়েছে তার প্রযুক্তিগত পুনরুদ্ধার কদ্দূর সম্ভব জানি না। যদি অসম্ভব হয় তবে একটি অনবদ্য স্ব-প্রতিকৃতি শিশিরের শব্দের মতোই হারাব আমরা।
কোনো কিছুই হারায় না। রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যেও থাকতে পারে একটা অকারণ অহং।