ফিক্সড ডিপোজিট – সৌগত ভট্টাচার্য

ফিক্সড ডিপোজিট – সৌগত ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

“একটু তাড়াতাড়ি চলো ভাই আজ ট্রেন ঢুকতে লেট হল আমারও অনেক দেরি হয়ে গেল।” অঘোর টোটোওয়ালাকে বলে। চানখাওয়া করে জামাপ্যান্ট পরে অপেক্ষা করে দশটার ট্রেন যাওয়ার। ট্রেন চলে গেলে অঘোর লাইন টপকে টোটোতে উঠে বসে। “কোথায় যাবেন?”
“কান্ট্রি ব্যাংক!” তাড়াহুড়োয় অঘোর বলতেই ভুলে গেছে। হাওয়া লেগে হন্তদন্ত করে আঁচড়ানো কাঁচাপাকা চুলগুলো উড়তে থাকে। অঘোর বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়। আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেছে!

খুব সকালে হাঁটতে যাওয়া অঘোরের বহু বছরের অভ্যেস। পরমা চলে যাওয়ার পর তার হাঁটার গতি কমে গেলেও সকালবিকেল হাঁটতে যাওয়ার অভ্যেসটা থেকেই গেছে। এই রাস্তায় হাঁটতে আসলেই চেনা মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হয় তার। দেখা হলেই তো সেই এক সহানুভূতির কথা! হঠাৎ করে পরমার চলে যাওয়া অঘোরের সস্ত্রীক পরিচয়কে পালটে দেয়। অঘোর আজকাল খুব ভোরে একা হাঁটতে আসে! অন্ধকার তখনও কাটে না!

ব্যাংক রোডের রাস্তাটি সোজা চলে গেছে নদীর ধারে। নদীর পাশে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় কিছুক্ষণ দম নিয়ে ঘাম শুকিয়ে ঠান্ডা হয় অঘোর। জামার দুটো বোতাম খুলে হাওয়ায় দাঁড়িয়ে শূন্যদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। নেতাজি মোড় থেকে সাহেব ঘাটের রাস্তাটা বড়োই সুন্দর, পরমার খুব প্রিয় ছিল। সোজা কালো পিচের মসৃণ রাস্তার দুই ধারে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া অমলতাস ছাতিম জারুল গুলমোহর কদম গাছে ভর্তি। রাস্তায় নুইয়ে পড়া পুরোনো গাছগুলোর গায়ে নানা ধরনের অর্কিড ফুটে থাকে। সারারাত ঝরে ঝরে রাস্তার পাশে ঘাস মাটিতে পড়ে থাকে ফুলগুলো। পরমা মাঝে মাঝে এই ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যেত বাড়িতে। ব্যথা কোমর নিয়ে পরমার নিচু হয়ে ফুল তুলতে কষ্ট হলে অঘোর ফুল কুড়িয়ে পরমার হাতে দিত। ব্যাংক রোডের এই রাস্তায় কোনো জনবসতি নেই। দূরে দূরে ছড়ানো-ছিটানো কিছু সরকারি অফিস, একটা কলেজ, একটা স্কুল, খেলার মাঠ, তারপর নদীর বাঁধ আর কান্ট্রি ব্যাংকের বিল্ডিং। দশটা থেকে পাঁচটা বাদ দিলে সারাদিন রাস্তাটা জনশূন্যই থাকে। অঘোর ফেরার সময় নিঝুম ব্যাংকের বিল্ডিংটার সমানে এসে দাঁড়ায়। যাওয়ার সময় অন্ধকারে ব্যাংকের নীল গ্লো সাইন বোর্ড ছাড়া কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, এখন চশমা ছাড়াই পরিষ্কার দেখা যায় কান্ট্রি ব্যাংকের বাড়িটিকে।

উবু হয়ে বাইরের ঘরে ডিভানের ওপর বসে খবরের কাগজ পড়ে অঘোর। মালতির মা চা দিয়ে যায় অনেক্ষণ। ফ্যানের হওয়ায় ঠান্ডা হয়ে যায় চা। মালতির মা এই বাড়ির পুরোনো কাজের লোক। পরমা ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়েছিল এই বাড়ির ধরনধারণ। অয়ন আর সুকন্যা যখন ব্যাঙ্গালোর থেকে বছরে দু-একবার ছুটিতে আসে সেই কয়দিন মালতির মায়ের কাজ বেড়ে যায়, অনেক রকম পদ রান্না করতে হয় তখন তাকে। নইলে তো অঘোরের জন্য এক-তরকারি আর মাছের ঝোল, রাতে তো রুটি, তরকারি আর দুধ।

অয়ন অনেকবার বাবাকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু অঘোর যেতে রাজি হয়নি। কিছুদিন ব্যাঙ্গালোরে থাকলেই দম বন্ধ হয়ে যায় তার। টিনটিনের সঙ্গে খেলে গল্প করে যদিও কিছুটা সময় কাটে। সোসাইটির নিচে বাজারেও যায় সে। কিন্তু দশটা বাজলেই মন কেমন করে ওঠে কান্ট্রি ব্যাংকের জন্য। ব্যাংকের বিল্ডিং বাড়িটা অঘোরকে কোথাও গেলেও স্থির থাকতে দেয় না।

চাকরি জীবনে ঘড়ি মিলিয়ে ঠিক দশটার সময় অফিসে ঢুকত অঘোর। ওর কাছেই থাকত লাল কালি দেওয়ার খাতা। পরমারও কখনও অফিসের ভাত দিতে দেরি হয়নি। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের রুটিন। বড়োবাবু হওয়ার পর অফিসের দায়িত্ব বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে বাড়ি ফিরে অফিসের গল্পও। পরমাকে অফিসের সব গল্প খুঁটিয়ে করত সে। আর মাঝে মাঝে বলত, “এই ডায়ারিতে সব হিসেব লেখা আছে বুঝে নাও। কোথায় কী রাখা আছে! আমি চোখ বন্ধ করলে তো তোমরা চোখে অন্ধকার দেখবে।” প্রথম জীবনে দায়িত্ব কর্তব্য সেরে তেমন সঞ্চয় করতে পারেনি সরকারি অফিসের বড়োবাবু। চাকরির শেষ দিকে এসে অঘোর বেশ ভালোই টাকা পয়সা করেন। অয়ন তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরিতে ঢুকে গেছে, অঘোর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। “সারাদিন পাস বই নিয়ে কী দেখো বলো তো, তোমার টাকা কেউ নেবে না। খবরের কাগজে ডিএ বাড়ল কি না! আর ব্যাংকের পাসবই! এ ছাড়া তোমার কোনো পৃথিবী আছে? আড্ডা আছে?” পরমা রাগ করে বলত অঘোরকে। “কতগুলো শূন্য বলো তো, খালি চোখে দেখি গুনতে পারো কি না?” পরমার কাছে ঘেঁষে অঘোর ঠাট্টার ছলে বলে। সত্যি শূন্যগুলো পরস্পর এত গায়ের কাছে লেগে থাকা! পরমা কোনোদিন শূন্য গোনার চেষ্টা করেনি।

“পাসবইটা কালই না আপনি আপডেট করলেন!”
“হ্যাঁ করিয়েছি কিন্তু ছেলে ব্যাঙ্গালোর থেকে কাল রাতেই টাকা পাঠিয়েছে বলল। ঢুকল কি না সে জন্য!”
“আপনাকে তো বলেইছি বাইরের কিয়স্ক থেকে দিনে যতবার খুশি আপডেট করবেন।” “ওর মায়ের জন্মদিন তো তাই ছেলে পুজো দেওয়ার জন্য টাকা পাঠিয়েছে!” একটা কাচের কিউবিক্‌লে উঁকি দেয়। এখানে আগে অনিল সামন্ত বসত। অনিলবাবুর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল অঘোরের। অয়নের বিয়েতে অনিলবাবুর নেমন্তন্ন ছিল। শুধু অনিল সামন্ত নয় ব্যাংকের অনেকেই নিমন্ত্রিত ছিল ছেলের বিয়েতে। শুধু ব্যাংকে আসা-যাওয়ার পরিচয়ে এই সম্পর্কগুলো তৈরি হয় অঘোরের। শুধু ব্যাংকে চাকরি করা মানুষরা নয় ব্যাংক বাড়িটার সঙ্গেও একটা টান অনুভব করে সে। ব্যাংকের বাইক স্ট্যান্ডের সামনে নতুন পার্কিং টাইলস বসানোর সময় অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল অঘোর, একটার পর একটা কোনাকুনি জোড়া লাগানো। অঘোর প্রায় প্রতিদিন ব্যাংকে আসলেও ইদানীং কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে ব্যাংকটা। পুরোনো মানুষগুলোর জায়গায় একটা করে মেশিন বসে গেছে! ব্যাংকের সব কাজ মেশিন করছে! পুরোনো মানুষগুলো কোথায় যে গেল। “একটা মাল্টিপারপাস ফরম দিন তো!” কাউন্টারের বাইরের টেবিলে বসে থাকা লোকটিকে অঘোর বলে। টাই পড়া গলায় আই-কার্ড ঝোলানো এক ছোকরা অঘোরের পাশে এসে দাঁড়ায় “আপনি আমাদের এই মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপটা ব্যবহার করুন আপনাকে রোজ রোজ কষ্ট করে ব্যাংকে আসতে হবে না, সব কাজই বাড়িতে বসে করতে পারবেন। নইলে অসুবিধায় আমাদের হেল্প লাইন নম্বরে যোগাযোগ করবেন!” এই কথা সে অনেকবার শুনেছে। অয়ন বাবাকে একটা মোবাইল কিনেও দিয়েছিল। কিন্তু সে সেটাকে ব্যবহার করতে পারে না, আর সেই জন্য আলমারির ভেতর রেখে দেয়। অঘোর ল্যান্ড ফোনেই বেশি স্বচ্ছন্দ। মোবাইল ব্যবহার না করার জন্য বউমা অনেক বকাবকি করেছে শ্বশুরকে। “ঠিক আছে” বলে ব্যাংকের ছেলেটিকে এড়িয়ে যায় সে। মনে মনে বলে “ব্যাংকে আসাটা আমার কাছে কষ্টের ব্যাপার না বাবা, না আসতে পারাটাই কষ্টের।” রোজ ব্যাংকে আসায় আত্মীয়স্বজন বন্ধুরা অনেক ঠাট্টা তামাশা করে বিষয়ী অঘোরকে নিয়ে। সকাল থেকে ব্যাংকে যাওয়া ঘিরে তার যাবতীয় ব্যস্ততা। কিছুক্ষণ ব্যাংকের এই কাউন্টার, ওই টেবিলে এদিক-ওদিক করে, এসিতে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে অঘোরের। সে ব্যাংক থেকে বেরোনোর আগে লকার রুমের সামনে একটু দাঁড়ায়। বাইরের থেকে লকার রুমের দরজা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। লকার রুমের দিকে তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি দেয় অঘোর।

বাড়িতে রং মিস্তিরি কাজ করছে। সন্ধ্যায় কাজ শেষ হলেই কাঠ পালিশের মিস্তিরিকে খবর দিতে যাবে সে। কাঠের সোফাগুলো রং চটে গেছে পালিশ করতে হবে। সন্ধেবেলা পালিশ মিস্তিরি নিরঞ্জনের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। কী একটা চিন্তা করতে করতে কখন যে ব্যাংক রোডের দিকেই চলে আসে তার খেয়াল থাকে না!
“অঘোর দা…”
“আরে সুভাষ যে!”
“আপনাকে তো ফোন করে করে পাওয়াই যায় না।”
“আরে কী হয়, আমি মোবাইল ফোনটা ঠিক ব্যবহার করতে পারি না। সবাইকে নম্বর দিয়ে এই এক মুশকিল হয়েছে। বলো বলো কী খবর!”
“আরে কত দিন দেখা নেই, সাক্ষাৎ নেই! ব্যাংকে আসা কমিয়ে দিয়েছেন নাকি!”
“আরে আর বোলো না কত কাজ থাকে বাড়ির! এই এখন রঙের কাজ চলছে”
“কি হবে এত বড়ো বাড়ির পিছে খরচা করে? অয়নরা তো আর ফিরবে না আমাদের এই মফস্‌সল শহরে!”
“দেখো আমার করার আমি করে যাই… ওরা কী করবে ওদের ব্যাপার!”
সারাবছর ধরে অঘোর বাড়িতে টুকটাক কিছু কাজ করায়। অঘোর বিশ্বাস করে অয়নরা এই বাড়িতে একদিন ফিরে আসবেই। ব্যাঙ্গালোরের ফ্ল্যাটকে কখনোই বাড়ি বলে মানতেই পারে না সে।

ফাঁকা ব্যাংক রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুভাষ আর অঘোর গল্পে গল্পে কখন যে নদীর ধারে চলে এসেছে খেয়াল থাকে না। নদীর হওয়াটা মন্দ লাগছে না। হওয়ার সঙ্গে ভেসে আসে কদমের হালকা গন্ধ। বর্ষা আসার আগের সময়টা পরমার বড়ো প্রিয় ছিল। “বৃষ্টির জলে ধুলো ধুয়ে গাছগুলো কেমন সবুজ হয়ে গেছে বলো!”, পরমা বলত। “ওই আমাদের ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেট যে প্লাস্টিকের প্যাকেটে দেয় তার পেছনে যেমন সবুজ রং ঠিক তেমনি…”, অঘোর বলেছিল।

“ফিক্সড ডিপোজিটে আবার ইন্টারেস্ট কমালো তো সরকার!”, সুভাষ বলে। অঘোর খেয়াল করে নদীর ওই পারে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সঙ্গে ছাতা আছে যদিও। ফিরতে হবে। অঘোর উত্তর দেয়, “হ্যাঁ। এবার ব্যাংকে টাকা রাখলে সরকারকে উলটে টাকা দিতে হবে!”
“কোথায় আমাদের মতো মানুষ টাকা রাখবে।”
“শোনো সুভাষ, কোথাও কোনো গ্যারান্টি নেই। এখন তো ব্যাংকে গেলে কিছুই বুঝি না। সব নাকি মেশিন করে। সেই মেশিনকে ওরা বলে সিস্টেম। আগে হিসাব করতে অ্যাকাউন্ট জানা লোক লাগত। এখন শুনি সিস্টেম কাজ করে না, সফ্টওয়্যার কাজ করে না। মানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আর মেশিন সব হিসেব রাখে, ব্যাংক চালায়!”
“তাতে মানুষের কি লাভ হল?”
“বুঝি না এগুলো। এত উন্নতি নাকি ব্যাংকিংয়ের কিন্তু এক টাকাও সুদ বাড়ল সিনিয়ার সিটিজেনদের?”
“সেটাই…”
“প্রতিদিন ব্যাংকে লোক কমছে, মেশিন বাড়ছে। একটাও পুরানো লোক নেই!”
“ব্যাংকের স্টাফরা আমাদের মতো বুড়ো মানুষ দেখলে অনেক সময় বিরক্ত হয়। আমরা বুড়োরা কিছু বুঝি না তো!”
“পুরোনো লোক, সেই আমলই ভালো ছিল বুঝলে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিল। এখন মানুষ আর মেশিনের সম্পর্ক।”
“এখন টোকেন নিয়ে হাঁ করে ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার নেই। কিছুই ধরতে পারি না।”
“… বলে মোবাইল ছাড়া নাকি কিছুই হবে না। ওটিপি টোটিপি কী সব বলে!”
“আমি তো মোবাইলে মেসেজ পড়তে পারি না। চোখটা দেখাতে হবে! ইদানীং দেখছি মেসেজও আসছে না ফোনে!”
“ওই যে তোমাকে বললাম এই সবকিছুই মানা যেত যদি একটাকাও ইনকাম বাড়ত। উলটো ইনকাম কমে যাচ্ছে দিন দিন!”
কথা বলতে বলতে অঘোর কখন ব্যাংকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। “ওই ঘরে একজন নন বেঙ্গলি ভদ্রমহিলা বসেন ওনার কাছে তোমাকে যেতে হবে! ফোনে মেসেজ না আসার যে সমস্যা বললে উনি সেটা দেখেন!”, বলে ব্যাংকের বাইরের অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে অঘোর হাত দিয়ে ইশারা করে একটা ঘর দেখায় সুভাষকে। এই ব্যাংকের প্রতিটা কোণ অঘোর চেনে। ব্যাংকটাকে পিছে ফেলে হাঁটতে শুরু করে দুজন।

সন্ধে হতেই মশারি টাঙিয়ে টিভিতে খবর চালিয়ে একটা সিঙ্গল সোফায় বসে অঘোর। আগে উলটো দিকের বেঞ্চ সোফায় বসে পরমা আর অঘোর সিরিয়াল দেখত। পরমা চা করে পানের ডাবরটি নিয়ে বসত। একবারে দশটার সময় খাবার গরম করতে উঠত। এখন শুধুই খবর শোনে অঘোর। তখন সিরিয়াল আর খবর শোনা নিয়ে কত মনোমালিন্য। পরমা চলে যাওয়ার পর থেকে ওই সোফায় আর বসেনি অঘোর। এই সময় পরপর ল্যান্ড লাইনে দুটো ফোনের অপেক্ষা করে অঘোর। প্রথমটি বউমা করে, সেই ফোনে একমাত্র নাতি টিনটিনের সঙ্গে অনেক কথা হয় দাদুর। পরের ফোনটা–
“বাবা…”
“বল…”
“শরীর ঠিক আছে তো?”
“আমি একদম ঠিক…”
“রঙের কাজ কতদূর হল আজ?”
“তোর মায়ের ঠাকুর ঘরটা হয়েছে। তোর পড়ার ঘরটা তো গতকালই শেষ হয়ে গেছিল!”
“হাঁটতে গেছিলে আজ…”
“এই তো ফিরলাম কিছুক্ষণ আগে…”
“কোন্ দিকে গেছিলে?”
“হ্যালো হ্যালো হ্যালো তোর ওখানে বড্ড গাড়ির আওয়াজ কিছু শোনা যাচ্ছে না বাবু…”
ফোনে গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ শুনে অঘোরের মানুষহীন শব্দহীন একলা ব্যাংক রোডটার কথা মনে হয়। দিনের বেলায় তা-ও কিছু লোক চলাচল হয়। সন্ধ্যার পর থেকে শুনশান। শুধু হওয়ার শব্দ। সংসারী মানুষের চলাচলের রাস্তায় অনেক ভিড় শব্দ হয় বোধহয়। একা মানুষের রাস্তা ব্যাংক রোডের মতোই নিঃসঙ্গ, নির্জন।

শরীরটা আজ ভালো নেই সকাল থেকে, গা ম্যাজম্যাজ করছিল অঘোরের। জোর করেই সকাল বেলায় হাঁটতে গেছে সে। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক রোড জুড়ে রাস্তার পাশের ঘাসের উপর জারুল কৃষ্ণচূড়া পড়ে ভেজা রাস্তার রং বদলে দিয়েছে। অঘোর আজ নদী অবধি যেতে পারেনি। তার আগেই ঘুরে এসেছে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি বারবার বাথরুমে গেছে। সকালে হেঁটে ফেরার পর বারবার নাক টানছিল অঘোর। দশটার ট্রেন চলে যাওয়ার পর আজ বাড়ির সমানে থেকে টোটোতে উঠে বলে, “কান্ট্রি ব্যাংক যাব…”

“লকারের নম্বর বলুন”, অঘোরকে জিজ্ঞেস করে এক ব্যাংক কর্মী।
“বি-সিক্সটিন।”
“সই করুন…”
অঘোর লকার রেজিস্টারে সই করে ঝাঁ-চকচকে লকার রুমে যায়। বি-সিক্সটিন লকারের সামনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়ায়। লকার খোলে অঘোর। এক এক করে পরমার সমস্ত গয়না বের করে অঘোর। সঙ্গে পরমার প্রিয় ছোট্ট পানের ডাবরটিও রাখা। প্রতিটা কানের দুল, হাতের বালা, গলার হারে পরমার হাত-কান-গলার স্পর্শ পায় অঘোর। কোন্ অনুষ্ঠানে কোন্ গয়না পরেছিল পরমা সব স্পষ্ট মনে পড়ে অঘোরের। গয়না পরা পরমার মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। লোকে অঘোরকে ব্যাংকে আসা বিষয়ী একজন মানুষ বলেই চেনে। কিন্তু কেউ জানে না এই গায়নাগুলোর মধ্যে পরমার ছোঁয়া খুঁজে পায় নিঃসঙ্গ অঘোর। তাই এই ব্যাংক রোডে তার সকালবিকেল চলাচল, ব্যাংকে ঘুরঘুর। ব্যাংক তার কাছে বিষয়সম্পত্তির সুরক্ষার জায়গা শুধু নয়, এক নির্ভরতা আস্থার জায়গা যেখানে পরমার স্পর্শগুলো নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। পারমাকে বিয়ের রাতে দেওয়া আংটিটা হাতে নেয় অঘোর। সামান্য সোনা আর নকল পাথর দিয়ে দিয়ে তৈরি। অঘোরের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সে পরমার গয়নাগুলোতে অনেকবার আদরের হাত বোলায়।

অঘোর হাতব্যাগ থেকে একটা সাদা রুমাল সযত্নে বের করে। রুমালের ভেতরে দুটো কদম ফুল। কদম ফুল খুব ভালোবাসত পরমা। আজ সকালে হাঁটতে গিয়ে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা দুটো কদম ফুলকে পরমার গয়নার পাশে রাখা পানের ডাবরের ভেতর আলতো করে রেখে লকারের চাবি বন্ধ করে দেয় সে।

লকার রুম থেকে বেরোনোর সময় বি-সিক্সটিন লকারটির দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বেশ জোর দিয়ে অঘোর বলে, “শুভ জন্মদিন পরমা!”

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২