স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (৩য় পর্ব)

শেয়ার করুন

Diego.

Truth is, so great, that I wouldn’t like to speak, or sleep, or listen, or love. To feel myself trapped, with no fear of blood, outside time and magic, within your own fear, and your great anguish, and within the very beating of your heart. All this madness, if I asked it of you, I know, in your silence, there would be only confusion. I ask you for violence, in the nonsense, and you, you give me grace, your light and your warmth. I would like to paint you, but there are no colors, because there are so many, in my confusion, the tangible form of my great love.

F.

Today Diego kissed me.

Every moment, he is my child, my new born babe, every little while, every day, of my own self

ডায়েরি’র একটি পাতা, দিয়েগো’কে লেখা একটি চিঠি অথবা মনোলগ।

পাতাটির দিকে চুপ করে বসে থাকতে হবে বহুক্ষণ, তারপর ভেসে উঠবে একটি রক্তসমুদ্রের আভাস। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে, ঢেউয়ের পর ঢেউ তার চিহ্ন একবার রেখে ও পরমুহুর্তে মুছে নিয়ে চলে যাচ্ছে দৃষ্টি-সীমানার বাইরে।

তীরে ক্রমাগত তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করবে এক ভয়ংকর ক্রন্দন; পৃথিবীর চির-পরিচিত কান্নার বাইরে সে এক পবিত্র আক্রোশ অথবা কান্না অথবা তুষার রায়। পৃথিবীর কোনও কান্নার সঙ্গে তার সাদৃশ্য নেই; সে কান্না শিল্পের কাছে বসে থেকে… শিল্পের পায়ের কাছে বসে থেকে নিজের হৃদপিণ্ড উপড়ে এনে নিজেই তান্ত্রিক হয়ে উঠে তার বন্দনা করা।

শিল্পের কাছে একদিন ছুটে এসেছিল একজন; তার রক্তমজ্জা শুষে শিল্প প্রতিদিন পুষ্ট হয়েছে। শিল্প তার আয়ু শুষে বেঁচে উঠেছে প্রতিদিন, শিল্প’ই তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে,

‘বার বার বুক চিরে দেখিয়েছি প্রেম, বার বার

পেশী অ্যনাটমি শিরাতন্তু দেখাতে মশায়

আমি গেঞ্জি খোলার মতো খুলেছি চামড়া

নিজের শরীর থেকে টেনে

তারপর হার মেনে বিদায় বন্ধুগণ,

গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখার

রুমাল নাড়ছি

নিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন

পাপ ছিল কি না’। (দেখে নেবেন)

-অথবা একটি তুষারক্ষেত্রের সন্ধান’ও করা যেতে পারে, ব্যক্তিগত ‘তুষারক্ষেত্র’; সেখানে ‘সকলেই নেমে যায় নীচে বিখ্যাত পাকদণ্ডী রেলপথ বেয়ে / শীতের মেঘলা দিনে ছেড়ে দার্জিলিং / কোলাহল শান্ত, শুধু গোম্ফার ডং ডিং ঘণ্টাধ্বনি বাজে…।’ নিজের সত্তাকে দু’হাতে লোফালুফি করতে করতে সেই ঘণ্টাধ্বনির মধ্যে বসে আছে কেউ; ক্ষতবিক্ষত কেউ। সব শেষে শিল্পের পায়ের কাছে বসে, এক অসম্ভব শূন্য বেদনার মধ্যে বসে সে আবিষ্কার করবে, ‘ঘণ্টার শব্দ শুধু ভেসে আসছে তিব্বতী গোম্ফার, / ব্যস আর কেউ নেই, কিছু নেই, শুধুই তুষার, শুধু / ধূ ধূ প্রান্তরে বনের কেবলই তুষার ঝরছে, শুধুই তুষার’।

দিয়েগো রিভেরা’কে লেখা শব্দগুলির মধ্যে জ্বলজ্বল করছে চার’টি শব্দ, Today Diago kissed me’। জ্বলজ্বল করছে, কারণ শব্দগুলির ওপর শুয়ে আছে কালো শরীরের একটি সরিসৃপ অথবা ‘কাটা-দাগ’।

দিয়েগো চুম্বন করেছিল অথবা ‘করেনি’; বিষয়টা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ দিয়েগোর চুম্বন ছাড়া শব্দগুলি লিখিত হত না; একবার লিখিত হবার পর সেটিকে মুছে দিতে চাইছেন চুম্বনের প্রাপক।

বরফের উপর দিয়ে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে হাওয়া; নীচে শুয়ে আছে ‘ডেস্টিনড’ এক মানুষ। সারাজীবন তাঁকে ছুটে বেড়াতে হবে এক বরফের প্রান্তর থেকে আরেক বরফের প্রান্তরে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে শিল্পের দিকে চেয়ে থাকা তাঁর জন্য নয়।

ক্যানভাসে তিনি যে ব্রাশের স্ট্রোক দিয়েছেন তা আসলে রক্তে-ভেজা; নিজের শিরা-ধমনি’র ভিতর ব্রাশ ডুবিয়ে তিনি ক্যানভাস ভরিয়ে তুলেছিলেন। তির-বেঁধা হরিণীর মতো বারবার তাঁকে ছুটে যেতে হয়েছে অন্ধকার বনের মধ্য দিয়ে; এ নিয়ে তাঁর বিখ্যাত একটি ছবিও আছে। সে ছবিটির কাছে আমরা ফিরে আসব অবশ্যই।

ফ্রিডা কালহো’র জীবন ও শিল্পের সঙ্গে তার গূঢ় সংযোগ সাইকোবায়োগ্রাফি’র ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ এক মাত্রা যোগ করতে পারে। বারবার তাঁর জীবনে ‘অপ্রত্যাশিত’ সব ঘটনা ঘটেছে এবং তিনি নিজে দুমড়ে-মুচড়ে গেছেন। মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে এসেছেন কোনওক্রমে; সৃষ্টি করেছেন একের পর এক শিহরিত করে তোলা ছবি। নিজে যত ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে গেছেন তত ক্যানভাসের স্পেস দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছেন। জীবনে অসংখ্য আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন।

ফ্রিডার আত্মপ্রতিকৃতিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় ফ্রিডা’র ভেতর বাস করেছিল ‘অসংখ্য’ ফ্রিডা। একের সঙ্গে অপরের বিরোধ নেই কোথাও, সব ‘ফ্রিডা’ দিনের শেষে এক বিন্দুতে এসে মিশে গেছে। কিন্তু ফ্রিডা প্রতিটি ‘ফ্রিডা’কে খুঁজে দেখতে চেয়েছেন। চেয়েছেন প্রতিটি ফ্রিডা’র চিহ্ন ধরে রাখতে ক্যানভাসে।

‘টাইম ফ্লাইজ’ ফ্রিডা’র এমনই এক আত্মপ্রতিকৃতি; ছবিটির মধ্যে ফ্রিডা দুটি প্রতীক’কে প্রকাশ্য করে দিচ্ছেন। ক্যানভাসের সব থেকে বেশি জায়গা অধিকার করে রয়েছে ফ্রিডা’র মুখ, তাঁর পিছনে কার্টেন সরিয়ে রাখা হয়েছে।

একটি এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে এবং ক্যানভাসের ডান-দিকে একটি স্ট্যান্ডের উপর রাখা টেবিল-ক্লক… দুপুর, তিনটে বাজতে ঠিক সাত থেকে আট মিনিট বাকি।

ছবিটি সৃষ্টি হয়েছিল ১৯২৯ সালে; এই ১৯২৯-এর ২১ অগাস্ট ফ্রিডা বিবাহ করেন দিয়েগো রিভেরা-কে।

রঙের উজ্জ্বলতায় ভরা ছবিটি, উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন ও ঘড়ি নিশ্চিতভাবে বয়ে যাওয়া সময়-কে চিহ্নিত করে। ফ্রিডার পরনে মেক্সিকান পোশাক, কানে ও গলায় ভারী গহনা। এবং ফ্রিডার অভিব্যক্তি-তে রয়ে গেছে এক অদ্ভুত কাঠিন্য।

(Time Flies- Self Portrait, 1929)

-ছবিটিকে ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ফ্রিডার শরীরের অনুপাতে গ্রীবা দীর্ঘ। যেন দীর্ঘ কোনও উৎকণ্ঠা তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁকে।

যে কাঠিন্যের বিষয়টি এ ছবিতে ফুটে উঠেছে তা বেশি করে প্রকাশিত ফ্রিডার ঠোঁট ও তার চারপাশে।

ফ্রিডার প্রায় প্রতিটি পোর্ট্রেটে এই যে কাঠিন্যের উৎস-সন্ধান করতে চেয়েছি আমি বারবার। সে সন্ধান প্রক্রিয়া একান্ত আমার মতো, তবে এই সন্ধানে সহায়তা করেছে ফ্রিডা’কে নিয়ে লেখা বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থ। অদ্ভুত এক বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায় Gerry Souter-এর লেখা ‘Frida Kahlo- Beneath the Mirror’ গ্রন্থটিতে। সাইকোবায়োগ্রাফির যে ধারা আধুনিক শিল্পীদের শিল্পকর্ম’কে দেখার পৃথক দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং যে ধারাটিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় সে ধারা বেয়ে কিছুটা অগ্রসর হলে দেখা যাবে ফ্রিডার বাবা উইলহেইম কাহলো ফ্রিডা’কে শিশু বয়স থেকেই পুত্র-সন্তান হিসাবে বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। ফ্রিডা’কে তিনি পুত্র-সন্তান হিসাবেই গণ্য করতেন।

হয়তো সেই শিশু বয়স থেকে বাবার অদ্ভুত ‘ইচ্ছা’ ফ্রিডা’র মধ্যে কোথাও একটি সুপ্ত পুরুষ সত্তা বুনে দিয়ে যায়, যা অবচেতনে কাজ করতে থাকে সূক্ষভাবে। ফ্রিডা’র আত্মপ্রতিকৃতি’তে আরেকটি বিষয় লক্ষ্ করার; একটি এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে ফ্রেম ছাড়িয়ে।

দিয়েগো’র সঙ্গে বিবাহের পরেও যে ফ্রিডা’র মধ্যে পুরুষ নিয়ে তুমুল তোলপাড় খেলা করে চলেছে এবং তাঁর ‘পুরুষ’ যে সুস্থির হবে না কোনও দিন তার যেন একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এর মধ্য দিয়ে।

আরও একটি বিষয় কিছুতেই চোখ এড়াতে পারে না; ঘড়ি-রাখার স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে পর্দা বেঁধে রাখার দড়ি- সব কিছুর মধ্যে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকা সাপের ইশারা খেলা করছে।

জীবন যে এভাবেই নাগপাশে বেঁধে রাখবে তাঁকে তার ইশারা স্পষ্ট এখানেও।

ফ্রিডার সব থেকে বেশি চর্চিত পোর্ট্রেট সম্ভবত ‘টু ফ্রিডাস’, যেটি সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৩৯ সালে।

দিয়েগো’র সঙ্গে বিবাহের পর থেকে ফ্রিডা’র জীবন সুস্থির ছিল না; পতঙ্গের মতো একের পর এক পুরুষ এসেছে জীবনে। একের পর এক পুরুষ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ছিন্নভিন্ন জীবন নিয়ে একজন শিল্পী নিজেকে সঁপে দিয়েছেন শিল্পের কাছে।

এই আত্মপ্রতিকৃতি’টি সৃষ্টি হবার আগে ফ্রিডার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার হদিশ পাওয়া জরুরি।

১৯৩৪ সাল নাগাদ ফ্রিডার দিয়েগো তাঁরই বোন ক্রিস্টাইনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দিয়েগো ও ফ্রিডার মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে থাকে ও ফ্রিডা ইশামু নগুশি নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান।

আরও দু’টি অতির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে এ-সময়ে, ট্রটস্কি মেক্সিকো’য় আশ্রয় নেন শরণার্থী হিসাবে।

আন্দ্রে ব্রেঁতো, ট্রটস্কি, ফ্রিডা’র মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ফ্রিডার শিল্পচর্চার ইতিহাসে এ পর্ব খুব ঊর্বর।

এ সময়ে (১৯৩৭) ফ্রিডা ও ট্রটস্কি’র মধ্যে ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়। সাররিয়্যাল শিল্পচর্চা-পদ্ধতির দিকে বেশ কিছুটা ঝুঁকে পড়তে দেখা যায় ফ্রিডা’কে।

এবং ১৯৩৯ সালে ফ্রিডা ও দিয়েগো’র বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়।

এবার আসা যাক ‘টু ফ্রিডাস’ ছবিটির কাছে।

(Two Fridas, 1939)

-ক্যানভাসের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুঁসে রয়েছে মেঘের দল। তীব্র আলোড়নে সে মেঘ ক্যানভাসের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করছে; সূচিত করছে ফ্রিডার মানসিক অবস্থাকে।ছবিটিতে যে ‘দু’জন’ ফ্রিডাকে দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে একজন মেক্সিকান পোশাকে এবং বাম-দিকের ‘ফ্রিডা’ ইউরোপীয় পোশাকে।

যেন ক্লোজ-সার্কিটে আবদ্ধ দুই নারী, একজনের ধমনি রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে অন্যজনের শিরায়। অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে এক ফ্রিডা হাত রেখেছেন আরেক ফ্রিডার হাতের ওপর। ইউরোপিয়ান পোশাক পরা ফ্রিডা কিছুটা আড়ষ্ট, কিন্তু মেক্সিকান পোশাক পরা ফ্রিডার দুটি পা কিছুটা শিথিল, আবেদনপূর্ণ।

দুই ফ্রিডার পোশাকের রঙে তৈরি হয়েছে কন্ট্রাস্ট; কিন্তু শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নেমে যেতে শুরু করবে দুই ফ্রিডার প্রকাশ্য হৃদপিণ্ডের দিকে তাকিয়ে। রক্তনালীগুলি প্রত্ন-তারের মতো জড়িয়ে রয়েছে তাদের শরীর।

শিল্পী ফ্রিডা তাদের প্রকাশ্য করে তুলতে চাইছেন প্রকটভাবে এবং এখানেই তাঁর শিল্পের সব থেকে বড় আবেদন।

এরপর ছবিটির সব থেকে ‘বিভৎস’ দুটি জায়গায় নজর দিতে আমরা বাধ্য; ডান-দিকের নারী-শরীর তার হৃদপিণ্ড থেকে নেমে আসা রক্তনালীটিকে কেটে দিচ্ছে একটি ছুরি দিয়ে।

ডান-দিকে বসে থাকা ফ্রিডা’র বাম-হাতে ধরা রয়েছে একটি ছোট্ট পোর্ট্রেট, যেটি দিয়েগো’র।

গুমরে ওঠা মেঘের নীচে এক ফ্রিডা ছুঁতে পারছে না আরেকজন’কে। অসহ্য বেদনার মধ্যে দাঁড়িয়ে সংঘটিত হচ্ছে এক আত্মহত্যাপ্রক্রিয়া। রক্তের ফোঁটা মিশে যাচ্ছে পোশাকের কারুকাজের সঙ্গে; যেন কিছুক্ষণ পরে এসে কেউ আবিষ্কার’ই করতে পারবে না, পৃথক করতে পারবে না রক্তের সঙ্গে পোশাকের কারুকাজ’কে।

শিল্প কি আসলে এই এবং এই-ই? শিল্প কী ধীরে ধীরে শিল্পীকে প্রস্তুত করে এমন ভাবলেশহীন মুখে মৃত্যু’কে বরণ করবার জন্য? সে মুহুর্তেও কি সত্তার একটি অংশ এমনভাবেই হাত রাখে আরেকটি অংশের সঙ্গে?

অথবা কিছুই হয় না; শুধু এক মৃত্যুর পায়ের কাছে বসে থাকা এবং ধূ ধূ প্রান্তরে ‘তুষারের’ মতো নিঃশব্দে রক্ত ঝরে যায় শুধু।

In 1946, a German physician, Henriette Begun, composed a clinical history of Frida Kahlo. Its entry for September 17, 1925 reads: Accident causes fractures of third and fourth lumbar vertebrae, three fractures of pelvis (11) fractures of the right foot, dislocation of the left elbow, penetrating abdominal wound caused by an iron hand rail entering the left hip, exiting through the vagina and tearing left lip. Acute peritonitis. Cystitis with catheterization for many days. Three months bed rest in hospital. Spinal fracture not recognized by doctors until Dr. Ortiz Tirado ordered immobilization with plaster corset for nine months… From then on has had sensation of constant fatigue and at times pain in her backbone and right leg, which now never leaves her…

এক কিশোরীর শরীরে থাবা বসিয়েছিল পোলিও; ডান-পা ক্রমশ শুকিয়ে এসেছিল। আর আঠারো বছর বয়সে তাঁকে নিয়ে শহরের রাজপথে চলেছিল একটি বাস; ট্রামের সঙ্গে ধাক্কা হয়েছিল বাসটির। দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল কিশোরীর শরীর। তারই একটা বর্ণনা রয়েছে উপরের অংশটিতে, তিন ও চার-নম্বর লাম্বার ভার্টিবা ভেঙে খণ্ড-বিখণ্ড, পেলভিসে তিনটি ভাঙন, ডান-পায়ে এগারোটি… একটা লোহার হ্যান্ডরেল যোনি’র কাছ বরাবর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে… মেরুদণ্ডের চোট-আঘাত নির্ণয় করতে পারবেন না চিকিৎসক’রা তখন।

তিন-মাস অসহ্য শারীরিক কষ্ট ভোগ করবার পর মেয়েটি প্রবল যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ফিরে এসেছিল মেক্সিকো সিটি’তে, গিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রথম প্রেমিক অ্যলেজান্দ্রোর বাড়ির দরজায়।

ক্রিসমাসের আগের দিন; দরজা খুলে বেরোয়নি অ্যলেজান্দ্রো।

খুব বড় যন্ত্রণাকে ধারণ করতে না-পারলে হয়তো শিল্পের মহাকাশ’কে স্পর্শ করা যায় না।

জীবনে বারবার সে যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফ্রিডা। দিয়েগো ও তিনি সন্তানের জন্ম দিয়ে চেয়েছিলেন প্রবলভাবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছিল এই পদ্ধতির থেকে দূরে থাকার; ফ্রিডা অগ্রাহ্য করেছিলেন।

১৯৩২ সালের ২১ অগাস্ট গর্ভপাত হয়ে সে স্বপ্ন ভেঙে যায়।

কিন্তু শিল্প’তো ‘নিষ্ঠুর’; গর্ভপাতের পথ ধরে সে শিল্পীর হাতে তুলি তুলে দেয়। এ পর্বের শুরু থেকে ফ্রিডার ছবিতে জন্মদান পদ্ধতি বারবার ছায়া ফেলতে শুরু করে। ১৯৩২-এ সৃষ্টি হয় ‘মাই বার্থ’ নামে অবিস্মরণীয় ছবিটি।

ফ্রিডার এ পর্বের শিল্প’কে ‘নাইভ আর্ট’ বলে অনেকে চিহ্নিত করতে চান; তেলরঙে চিত্রিত এ শিল্প সমস্ত আদিম, গূঢ় রহস্যের প্রান্তে দোল খাচ্ছে।

আবলুশ-রঙের খাট’টি ঘরের মাঝখানে পাতা।

(My Birth – 1932)

-শাদা চাদর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মাতৃ-আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসছে এক সদ্যজাত। মায়ের মুখ চাদরে ঢাকা, মাথার কাছে দেওয়ালে ‘ভার্জিন অফ সরজ’-এর ছবি। কিন্তু এ ছবি কি আপন প্রসবক্ষণের দিকে চেয়ে থাকা শুধু?

‘জরাসন্ধ’ কবিতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন,

‘কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র! তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস। অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র স’রে যাবে শীতল সরে যাবে মৃত্যু সরে যাবে।

তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিল জীবনের ভুলে। অন্ধকারে আছি, অন্ধকারে থাকবো, বা অন্ধকার হবো।

আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’।

-শিশুটির মাথা তুলনায় ‘বড়’; মাতৃজঠরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে। রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে মাতৃযোনি।

অথচ এ পরম-আশ্রয় থেকে আশ্রয়হীনতার পৃথিবীতে এসে পড়া ছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই।

জীবনের অনন্ত যন্ত্রণায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে সে, অথবা রক্ত ভেসে যাওয়া প্রসব-পদ্ধতি এমনই। শুভ্র, পেলব, সুবিন্যস্ত যা কিছু তার ওপর এসে পড়ে রক্তের গাঢ় দাগ। এবং সে সময় প্রসবদাত্রীর চোখ থাকে আবৃত। ছবিটির আরেকটি আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য, তার ‘কেন্দ্রিকতা’; এমনকি প্রসবদাত্রী’র মাথা রয়েছে বালিশ বা টাওয়েলের ঠিক মাঝ-বরাবর। সৃষ্টির কেন্দ্রে ঘটে যাচ্ছে এ ঘটনা। ফ্রিডা যেন দেখিয়ে দিতে চাইছেন সমস্ত ‘ডিসটর্শান’-এর মধ্যে এটি একমাত্র স্থির-ঘটনা।

এ পর্বের আরও দু’টি অতিবিখ্যাত ছবি ‘হেনরি ফোর্ড হসপিটাল’ ও ‘ফ্রিডা এন্ড দ্য সিজারিয়ান সেকশন’।

‘হেনরি ফোর্ড হসপিটাল’ ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডে শিল্প-শহরের ইশারা। ধাতুগন্ধের মাঝখানে একজন হারিয়ে ফেলছে তাঁর রক্তমাংসের সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতা।

যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে শত আলোকবর্ষ দূরে শুয়ে রয়েছেন একজন নারী; ব্যাকগ্রাউন্ডের বাম-দিক অপেক্ষাকৃত বেশি বস্তুউপাদান। সেটিকে প্রশমন করতে হসপিটালের বেড’টিকে উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ বরাবর স্থাপন করা হয়েছে।

যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকা এক নারীর শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে ছয়’টি তার; তারা ছয়টি বস্তুর সঙ্গে যুক্ত। বস্তুগুলির মধ্যে রয়েছে একটি পুরুষ ভ্রূণ, জরায়ুর আবছা আদল অথবা ল্যাম্পশেড, শামুক। ভাসমান এ তিনটি জিনিসের সঙ্গে মেঝেতে পড়ে রয়েছে পেলভিক-বোন, হালকা-বেগুনি অর্কিড ও একটি যন্ত্র।

ফ্রিডা ও দিয়েগোর স্বপ্নসন্তান ভেসে বেড়াচ্ছে; তার জন্ম দূর… বহুদূর। তার মুখ ফেরানো (যদিও চোখ দুটি বোজা) জরায়ু-আদল অথবা ল্যাম্পশেডের দিকে।

একটি ভ্রূণ হাহাকারে হাহাকারে হারিয়ে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে চলেছে। কিন্তু পুরুষ-ভ্রূন কেন? এখানেও কি সেই উইলহাইমের ফ্রিডা’কে পুত্র হিসাবে বড় করে তোলার ‘অদ্ভুত’ ইচ্ছাই কাজ করে গেছে?

(Henry Ford Hospital- 1932)

-মেঝেতে পড়ে থাকা পেলভিক-বোন অতি-অবশ্যই দুর্ঘটনায় ফ্রিডা’র ভেঙে যাওয়া পেলভিক-বোনের কথাই মনে করিয়ে দেবে। পড়ে থাকা অর্কিড তাঁকে দেওয়া দিয়েগোর উপহার, আর যন্ত্রটি আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের অবদান।

এবং রয়েছে ভাসমান শামুক; অতি-দীর্ঘ হয়ে পড়ছে ফ্রিডার সন্তান জন্ম দেবার সময়। শম্বুক গতি’তে অতিবাহিত হচ্ছে গর্ভসঞ্চার। প্রতিটি ‘জিনিস’ই সংযুক্ত হয়ে রয়েছে ফ্রিডার সঙ্গে।

ছবিটি থেকে চোখ ফেরবার সময় হঠাৎ হয়তো কেউ আবিষ্কার করবে মেঝেতে পড়ে থাকা পেলভিক-বোন’টির আদল ক্রমশ হয়ে উঠছে খুলি’র মতো… জীবনের ভুলে মৃত্যু প্রসব করবার এ এক অন্ধ-প্রহর।

গর্ভপাত যে ফ্রিডার জীবনে কী গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘ফ্রিডা এন্ড সিজারিয়ান সেকশন’ (১৯৩২) ছবিটিতেও।

জীবনে যা ঘটবে না, অথচ যা ঘটতে পারত; যে সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে অথচ যা স্বপ্ন-বাস্তব সেটিই ধারণ করে রয়েছে ছবিটি।

নগ্ন ফ্রিডার পাশে তাঁর সদ্যজাত সন্তান, মুখের আদলহীন এক শিশু। শিশুটির মাথার কাছে ভেসে রয়েছে দিয়েগোর মুখ; গম্ভীর। ক্যানভাসের বাম-দিকের উপরের কোণে কয়েকজন চিকিৎসক ট্রলি’র উপর সিজারের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত, সম্ভবত।

ক্যানভাসের উপরের দিকে ফ্রিডা ঘন থেকে অধিকতর ঘন লালাভ রঙ ব্যবহার করেছেন।

লক্ষ করার, দিয়েগোর চোখ দু’টি খোলা, কিন্তু ফ্রিডা স্বপ্নে প্রসবের পর চোখ বন্ধ করে শুয়ে। বাঁ-পায়ের উপর তোলা ডান-পা সে মুহুর্তে সমস্ত রকম ঝঞ্ঝার থেকে প্রতিরোধ তৈরি করেছে। দিয়েগোর মাথার কাছে দু’টি পাত্র স্থাপন করেছিলেন ফ্রিডা ছবিটিতে। একটি শূন্য, অপরটি অর্ধ-পূর্ণ।

(Frida and Caesarean Section- 1932)

জীবন’ও কী আসলে এই এবং এই-ই? হওয়া ও হয়ে না-ওঠার মধ্যে এই পূর্ণ ও অপূর্ণের খেলা কি থেকেই যায়? অথবা, বাস্তবে যা শূন্য, স্বপ্ন-সম্ভাবনায় তাই পূর্ণ হয়ে রয়ে যায় আমাদের কাছে?

রক্তে কলম ডুবিয়ে যে ডায়েরির পাতা ভরিয়ে তুলতেন ফ্রিডা তা তাঁর যাপনের সঙ্গে সংগমের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ পর দিয়েগো রূপান্তরিত হতে শুরু করে সদ্যজাত শিশু’তে, মনে পড়ে একদিন ফ্রিডা লিখেছিলেন, ‘Every moment, he is my child, my new born babe…’

১৯২৮ সালে ফ্রিডা মেক্সিকান কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। সারাজীবন তীরবিদ্ধ এক তরুণী, এক মানবীর কাছে নিশ্চয় কিছুটা উপসম হয়ে দেখা দিয়েছিল সে মতবাদের প্রতি সমর্পণ।

ব্যক্তিগত জীবনে ছারখার হয়ে গিয়েছিলেন বারবার; কিন্তু শিল্পী তো জলের গভীরে হারপুন-বিদ্ধ ডলফিনের মতো। সে হারপুন দেখাবে না, স্রোতের উপর মাথা তুলে তার সংকেত ছুড়ে দিয়ে আবার ডুবে যাবে জলের গভীরে। শুধু মাইলের পর মাইল জলস্রোত রক্ত-রঙে ভরে থাকবে। তীর থেকে সেদিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যাবে মানুষ; সন্ত্রাসের দেখা পাবে।

‘মাই ড্রেস হ্যাঙস দেয়ার অর নিউ ইয়র্ক’ বা ‘ফোর ইনহ্যাবিট্যান্টস অফ মেক্সিকো সিটি’ ছবিগুলিতে সে সন্ত্রাসের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

আমেরিকার পুঁজিবাদী সংস্কৃতি, অন্তঃসারশূন্য দানবীয় নির্মাণ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ফ্রিডার এ-ছবি একা জেগে থাকবে বহুদিন।

ছবিটিতে স্কাইস্কেপার্স থেকে শুরু করে গির্জা, ইন্ডাস্ট্রি’র দানব-লিঙ্গ থেকে উড়ে যাওয়া ধোঁয়া থেকে শুরু করে ধূসর সমুদ্রের বুক চিরে চলে যাওয়া বাণিজ্য-জাহাজ- সবই রয়েছে। রয়েছে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র ছায়া। ডাস্টবিন থেকে শুরু করে কেসমেন্ট থেকে তাকিয়ে থাকা নারী মূর্তির মধ্যে, তীব্র গাঢ় রঙের খেলার মাঝখানে ফ্রিডা ক্যানভাসের ফোরগ্রাউন্ডে দুটি কলাম স্থাপন করলেন। বাম-দিকের কলামের উপর রাখলেন একটি কমোড এবং ডান-দিকের কলামটির উপর সোনালি বাতিদান। কমোড থেকে বাতিদান পর্যন্ত টাঙিয়ে রাখা দড়িতে ঝুলতে লাগল ফ্রিডার মেক্সিকান পোশাক… তাঁর অস্তিত্বের চিহ্ন।

(My Dress Hangs There or New York-1933)

চার্চ থেকে ফেডারেল-হল পর্যন্ত সংযোগ স্পষ্ট। ছবিটির মধ্যে উপাদানের বাহুল্য এনেছেন ফ্রিডা ইচ্ছাকৃতভাবে, ক্লসট্রোফবিক আবহাওয়া ঘনিয়ে তোলার জন্য।

ছবিটি আমাদের মনে করাবেই, এক অতিকায় কচ্ছপের পিঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি… তার থেকে বহুগুণ দ্রুত-গতির পুঁজির হাঙর গিলে নিচ্ছে সব কিছু। ফ্রিডার আত্মপরিচয়ের সংকট আসলে আমেরিকার সংকট’কেই প্রতিষ্ঠা করেছে। ধূসর সমুদ্র আমেরিকার অন্তর্গত বিষাদ ও বিষণ্ণতাকে সূচিত করছে।

এবং এসব বিষয়গুলি অতিক্রম করলেও ছবিটি আপনাকে ‘মুক্তি’ দেবে না; কারণ আপনি আবিষ্কার করবেন মার্চিং-জনগণের পাশে, ছবিটির ডান-দিকের নীচের কোণে অতিকায় ডাস্টবিন। উপচে পড়া, মুরগির কাটা পা থেকে শুরু করে শুকনো, বাসি ফুল।

এবং আপনি এসবের মধ্যে আবিষ্কার করবেন রক্তমাখা দস্তানা (অথবা কাটা হাত), ডাস্টবিনের প্রান্ত থেকে ঝুলে রয়েছে। ধাতব দানব-পাইপের ভেতর থেকে কে যেন আর্তনাদ করতে করতে পালাতে চাইছে। পুঁজি আর দমবন্ধ-আবহাওয়া থেকে কেউ পালাতে চাইছে। তার রক্তাক্ত হাত ফুটে রয়েছে; অথবা হাত-পা কেটে নিয়ে মানুষগুলিকে পুরে ফেলা হয়েছে ডাস্টবিনের ভেতর।

১৯৩৭-এ ফ্রিডা কাহলো আরেকটি অসামান্য ছবি সৃষ্টি করেছিলেন, ‘ফোর ইনহ্যাবিট্যান্টস অফ মেক্সিকো সিটি’।ছবিটি নিয়ে নানা ব্যাখ্যা রয়েছে, শহরের স্কোয়ারে চার’টি মূর্তি অবস্থান করছে।

একটি শিশু মাটিতে বসে, তার ডান-দিকে একজন পুরুষ। বাম-দিকে পৃথুলা নারী এবং নারীটির পাশে একটি কঙ্কাল। দূরে নীল-রঙের বাড়ি। বাড়িগুলি সুষম চতুর্ভুজের ধারা মেনে নির্মিত।

মাটিতে বসে থাকা শিশুটিকে দেখে মনে হয়, সবাই তাকে বিমূঢ় করে ফেলে রেখে গেছে এ চরাচরে। মেক্সিকোর ঐতিহ্যের সঙ্গে অনেকে এক করে ছবিটিকে দেখেন, কিন্তু ছবিটি দেখতে দেখতে আরেকটি সম্ভাবনা মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে।

গুরু-নিতম্ব ও ভারী-বুকের ঊর্বরা নগ্ন নারী ও পুরুষের মধ্যে বসে থাকা এই শিশু কি সৃষ্টির আদিম ফসল? লক্ষ করার, পুরুষের দৃষ্টি ক্যানভাস থেকে বেরিয়ে এসেছে,নারীটি চেয়ে রয়েছে পুরুষটির দিকে এবং কঙ্কালের দৃষ্টি ক্যানভাস ভেদ করে ডান দিকে ছুটে গেছে। শিশুটির দিকে কেউ’ই চেয়ে নেই।

সন্তান উৎপাদন কি তা হলে যৌনতার ক্ষেত্রে ‘সেকেন্ডারি’ ভূমিকা পালন করেছে কোথাও? সে কারণেই কি শিশুটি পরিত্যক্ত? এ কঙ্কাল কি ‘সময়’? সমস্ত উৎপাদন ও শরীরের খেলা শেষে সে কি এভাবে হাসতে হাসতে কাল থেকে কালান্তরের দিকে ছুটে যায়, তাকিয়ে থাকে?

পশুর পিঠে চেপে সোনালি পোশাক পরিহিত রাজা কি অফুরন্ত শস্যের ইশারা? অফুরন্ত জীবন ও মৃত্যু এক সঙ্গে খেলা করছে ফ্রেমে।

যদিও ছবিটিতে রাত্রির অনুসঙ্গ নেই, তবু এটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে যায় জীবনানন্দের সেই পঙক্তি’গুলি,

‘নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মন হয়

লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।

তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব- অতিবৈতনিক,

বস্তুত কাপড় পর লজ্জাবশত’। (রাত্রি)

(Four Inhabitants of Mexico City- 1937)

‘চারিদিকে বৃষ্টিপাণ্ডু মূর্তির কুয়াশা

আকাশ রোদ্দুর মেঘ লাট্টুর মতন ঘুরে যায়

দ্রুত নিজেদের চারদিকে

আর তার অদৃশ্য প্রভাবে

বুনো নীল উৎকণ্ঠা ঘোরায় আমার রক্তে

উপকথাটির সেই গানাহত জননীর মতো

পাথুরে কলসী ফেলে নিজের শিশুকে বেঁধে নিচে

কুয়োয় নামায় অন্ধকারে

তেমনি আদিত্য ঠিক তুমি

আমাকে ছিটকে ফেলে বারে বারে

আমার সুলভ প্রবণতা

দর্পণ অঞ্জলি দিতে বলো

টরটর শব্দ বলে ‘চলো চলো

এবার বিকেল’

জোর করে টানো ঐ লম্বা লাগাম

কত গ্রাম গাছ রাস্তা সার্কিট হাউস ফেলে রেখে

যেতে হবে সমুদ্রের ধারে।

নিসর্গ সমস্ত ভুলে ভেসে উঠল সবুজ নীল বন

ভূতগ্রস্ত একাকার এলো চুল দোলায় বিমানে

আমাকে ছুটিয়ে এনে সূর্য কোন্‌খানে ডুবে গেলে?’

-এক একদিন এমন হয়, একটি পঙক্তি, আগে বহুবার পড়া… বর্শার মতো হৃদপিণ্ড ফুঁড়ে চলে যায়। শান্ত আগুনের নাভিদেশ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না, দেবারতি মিত্র’র ‘সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সমুদ্রের ধারে’ কবিতাটির প্রথম পঙক্তি’টি সেভাবেই আমাকে গ্রাস করে রেখেছিল কিছুদিন। ‘চারিদিকে বৃষ্টিপাণ্ডু মূর্তির কুয়াশা’। কবিতাটির মধ্যে যতবার প্রবেশ করার চেষ্টা করেছি ততবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছি; নিজের পান করা গরল-ভারের দিকে চেয়ে রয়েছেন একজন মানুষ। নিছক ভাল-মন্দ, কষ্ট আর বেদনার থেকেও বেশি রহস্যময় জগতের মধ্যে প্রবেশ করছেন একজন মানুষ।

এবং শেষ লাইনে এসে আবিষ্কার করি সেই মহা-সত্য, শিল্প আসলে চরম স্তরে গিয়ে শিল্পী’কে দাঁড় করায় শূন্যকে অতিক্রম করে যাওয়া আরেক শূন্যের ভিতর। সেখানে সব পরিত্রাণ, সব প্রাপ্তি গৌণ হয়ে আসে। কোনও অস্তিত্ব থাকে না তার, থাকে শুধু পবিত্র অন্ধকার। ছুটিয়ে নিয়ে এসে সূর্য যে ডুবে যাবে সে কথা কি শিল্পী অনুধাবন করেন না বহু আগে? করেন, এবং করেন বলেই তিনি ছুটে যান সে প্রদেশের দিকে,

(Memory, the Heart, 1937)

১৯৩৭-এ ‘মেমোরি, দ্য হার্ট’ ছবিটির দিকে তাকিয়ে আজ দেবারতির কবিতাটির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। ১৯১৬ সালে পোলিও থাবা বসিয়ে ছিল ডান পা’য়ে। বিশেষ প্যাড ব্যবহার করতে হত ডান পায়ের ভঙুর ও অসমান দশা লুকিয়ে রাখতে।

তবু এক নারী এসেছেন সমুদ্রের ধারে। তাঁর এক পা জলে আর এক পা স্থলে। উপড়ে ফেলা হৃদপিণ্ড পড়ে আছে স্থলে, রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে জলের দিকে। স্পেস’কে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন ফ্রিডা, ডিপ-এ ঝোলা পোশাকটি শাদা-নীল। অ্যজুর ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে সেটি মিশে যাচ্ছে, ফোরগ্রাউন্ডে ঝোলা পোশাক মেক্সিকান।

দুটি পোশাকের থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি করে হাত, ইউরোপিয়ান পোশাক থেকে বেরিয়ে আসা হাতটি ছুঁতে পারছে না নারী’টিকে, অথচ মেক্সিকান পোশাক থেকে বেরিয়ে আসা হাত ঘনিষ্ঠভাবে ছুঁয়ে রয়েছে তাঁকে।

নারী’টির বুক ভেদ করে চলে যাওয়া দণ্ড’টি রূপান্তরিত হয়েছে ‘দোলনা’য়। পরী’র মতো একটি শিশু দোল খেয়ে চলেছে সেখানে।

‘কত গ্রাম গাছ রাস্তা সার্কিট হাউস ফেলে রেখে’ সমুদ্রের কাছে আসা মেয়েটিকে ছুঁয়ে রয়েছে তার ঐতিহ্য, কিন্তু সে ঐতিহ্য’ও তাকে রক্ষা করতে পারছে না।

জীবন আসলে এক মহাজাগতিক দোলনা, দুলতে দুলতে সময় উপড়ে নিয়েছে তার হৃদপিণ্ড।

কেন দু’টি পোশাক থেকে একটি করে হাত বেরিয়ে এসেছে সেটি নিয়ে বহুবার ভেবেছি; শিল্পের সব রহস্যের ‘সমাধান’ হয় না।

জীবন আসলে ‘অসম্পূর্ণ’, হয়তো সে কারণেই দু’দিক থেকে ছুটে আসছে একটি করে হাত।

ফ্রিডার এ ছবিটিতে আরেকটি বিষয়’ও আছে, বাম-দিকে পড়ে থাকা হৃদপিণ্ড’র (লালাভ সন্ত্রাস) সঙ্গে ডান-দিকে মেক্সিকান পোশাকের উজ্জ্বল রঙ ফ্রেমটিকে সুষম করেছে। মেক্সিকান পোশাকটিতে অনেক বেশি তরঙ্গ, অনেক বেশি রহস্য। আসলে সমস্ত ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে প্রকাশ্য দিবালোকে ‘সূর্য ডুবে’ যাওয়া এক বালুতটে দাঁড়িয়ে রয়েছে শিল্পী। এই দাঁড়িয়ে থাকাই তাঁর নিয়তি।

পতঙ্গের ধর্মে ফ্রিডা বারবার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, ১৯৩৮ তাঁর জীবনে ভীষণ গুরত্বপূর্ণ। তাঁর ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়েছে, আন্দ্রে ব্রেঁতো’র সঙ্গে রাজনীতি ও শিল্পের নানা ধারা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হচ্ছে। এ সময়ে তিনি ফটোগ্রাফার নিকোলাস মুরে’র সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। এ পর্বের ‘ফ্রুটস অফ আর্থ’ ছবিটিতে তাঁকে একটু ভিন্ন ঘরানায় পাওয়া যায়। আকাশে রহস্যময় উন্মাদ মেঘ,

(Fruits of Earth- 1938)

-কাঠের টেবিলে রাখা পাত্র-ভরা ফল, উপচে পড়ছে। বামদিকের ভুট্টাকৃতির দুটি খোলস-আবৃত ফল পুরুষ-যৌনতাকে চিহ্নিত করছে। পাত্রের ডান-দিকে বিস্ফোরিত ফলের ভেতর বীজ নারী-যৌনতার প্রতীক। পাত্রের ভেতর রাখা ফলগুলির মধ্যে নারী-যৌনাঙ্গের স্পষ্ট ইশারা। এবং একটি ফলের বৃন্ত প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর লিঙ্গের মতো উঠে গেছে আকাশের দিকে। অবরুদ্ধ যৌনতায় যেন সে কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে গেছে কোনও এক অনিবার্য পরিণতির কথা ভেবে।

ফ্রিডার আত্মপ্রতিকৃতির সংখ্যার কথা সকলেই জানে। নিজেকে বারবার প্রিজমের মধ্য দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন ফ্রিডা।

(Self Portrait with Monkey- 1940)

১৯৪০-এ ফ্রিডা’র জীবনে আবার ফিরে আসেন দিয়েগো; তাঁরা আবার বিবাহে আবদ্ধ হন। এ সময়ে তাঁর সৃষ্টি ‘সেলফ পোর্ট্রেট উইথ মাঙ্কি’ অন্য এক ফ্রিডার প্রকাশ। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, অথচ ঠোঁটে খেলা করছে গাঢ় লাল-রঙ। চিবুকের কাছে পুরুষালি কাঠিন্য, ডান-কাঁধের পাশ থেকে উঁকি মারছে বাঁদর।

প্রিমিটিভ ট্রপিক্যাল অরণ্যে যেন ঘুচে যাচ্ছে মানুষ আর পশুর দূরত্ব। ফ্রিডার গলায় ধাতুর মোটা হার’টি সাপের আভাস নিয়ে ফুটে। প্রকৃতি-কন্যার কাঁধে হাত রেখেছে বাঁদর। সমস্ত মেধার শ্রান্তির শেষে এ যেন এক পরম শান্তি’র দেশ।

ফ্রিডা’কে কেন দুর্জ্ঞেয় টেম্পেস্ট বলে মনে হয় তার সপক্ষে আরেকটি ছবির দিকে চলে যাওয়া যেতে পারে, ছবিটির নাম, ‘দ্য ড্রিম অর দ্য বেড’। এটিও ১৯৪০-এ সৃষ্টি হয়েছিল। স্ট্রেট-লাইনে, চতুর্ভুজ আকৃতি প্রদান করে ফ্রেম’কে ব্যবহার করা ফ্রিডার বৈশিষ্ট্য। এখানেও সেটিই ঘটেছে; দ্বিতল ঘাটের নীচের ধাপে শুয়ে ফ্রিডা। গাঢ় আবলুশ-রঙের খাটে শুয়ে থাকা ফ্রিডার শরীরে ছড়িয়ে রয়েছে হলুদ চাদর। জীবনের বর্ণময় চাদর, অথচ হলুদ-রঙ বিষণ্ণতা ও মৃত্যুর অনুসঙ্গ বয়ে আনছে। খাটের ওপর থেকে বিনীদ্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে একটি কঙ্কাল, তার সারা শরীরে অসংখ্য ধাতব পাত। তার দিয়ে সংযুক্ত। টুকরো টুকরো এই ধাতব-পাতগুলি তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বাস-দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেবেই। মনে করিয়ে দেবে ফ্রিডা অসংখ্য ভাঙা হাড় নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।

(The Dream or the Bed- 1940)

জীবনের দিকে মৃত্যুকে এভাবেই তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলেন ফ্রিডা। এই মৃত্যুবোধ দিনে দিনে তীব্র হয়েছে তাঁর কাছে।

এ কারণেই হয়তো ১৯৪৩-এ এসে তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল ‘থিংকিং অ্যবাউট ডেথ’ নামক ছবিটি।

(Thinking about Death- 1943)

ক্রমশ অবনতি হচ্ছে তাঁর স্বাস্থ্য; মৃত্যুবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলছে তাঁকে। সবুজ পাতার ভিড়ে ফ্রিডার মুখ, জোড়া-ভ্রূ। তৃতীয় নেত্রে স্থির হয়ে রয়েছে কঙ্কালের ছবি। পোশাক ও জামার গাঢ় লালাভ বর্ণ মনে করিয়ে দিচ্ছে ফেলে আসা যৌবনের কথা।

শুধু দুঃসহ বেদনার মতো ফ্রিডা চোখের নীচে খুব হালকা ক্লান্তির ছাপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুটে থাকা পাতা’র জালক অতি-স্পষ্ট; জীবনের সমস্ত জটিলতা আর গূঢ় সফরকে চিহ্নিত করে চলেছে তারা।

এ পর্বের আরেকটি ছবি ‘উইদাউট হোপ’ (১৯৪৫), এটিও অয়েল-পেন্টিং। শয্যাগত ফ্রিডা,

(Without Hope – 1945)

তাঁর মুখের ভিতর প্রবেশ করছে খাদ্য, প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের মাংস-মজ্জা প্রবেশ করছে তাঁর মুখে। বহুক্ষণ চেয়ে থাকলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করবে খাদ্যের ভেতর ফুটে থাকা অক্টোপাসের আদল।

মৃত্যু-অক্টোপাস ঘিরে ফেলছে তাঁকে। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন নিয়ে এসেছে খাদ্যপুঞ্জ।

ছবিটির ডিপ-স্পেসে ফ্রিডা টিলা ও সূর্য স্থাপন করেছেন। এ টিলা ফ্রিডার কাছে দূরের হাতছানি; টিলা’টিকে অতিক্রম করে যেতে চাইছেন তিনি। অথচ শয্যাগত তাঁর কাছে এই ইশারা ও ইচ্ছাটুকুই সম্বল। কমলালেবুর মতো সূর্য এখনও জীবনের দিকে আলো ফুটিয়ে তুলতে চাইছে। ফ্রিডা সে আলো’কে ছুঁতে অক্ষম।

ফ্রিডা’র ছবির পাশে খোলা রয়েছে দেবারতির বই। হয়তো এই ঐশ্বরিক সমাপতন ছাড়া ফ্রিডা ও দেবারতি- দু’জনকেই চেনা অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। অথবা এই সমাপতনের হাত ধরে দীর্ঘ (এবং বাধ্যতামূলকভাবে ‘অসম্পূর্ণ’) এক সফরের শুরু হল। পড়ছিলাম,

‘বাড়ির পায়ের কাছে

হরিণের চামড়ার মতো বন জ্বলে ওঠে,

ডাকে,

ডাকে এখনো কি?

কে কোথায়?

শূন্যতায় কি করে রয়েছি আজ,

কেন আছি?

আমার চোখের জল

আকাশের কাঁচে লেগে ফিরে আসে

কোল ভিজে যায়’। (বিদেশে দেওয়ালি)

দেবারতি মধ্যরাতে আমাকে উপহার দিয়ে গেলেন ‘আকাশের কাঁচে লেগে ফিরে’ আসা চোখের জল।

(The Wounded Deer- 1946)

ফ্রিডা’র ছবির কাছে বসে থাকতে থাকতে সে জল ঝরে পড়তে দেখছিলাম আকাশের কাঁচ থেকে।

তীব্র গতি’তে পাতা-ঝরা বৃক্ষের ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে একটি হরিণী।

ক্যানভাসের ডান-দিকে ন’টি বৃক্ষের সারি।

ন’টি তির বিঁধে রয়েছে হরিণীর শরীরে। সামনে ফেলে রাখা পাতার দিকে তার দৃষ্টি নেই, সে শান্তভাবে ধারণ করছে তিরগুলি।

সে কি বলে উঠতে চাইছে,

‘এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন

শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে’!

ধূসর-কালো-হরিদ্রাভ-খয়েরি রঙের শেডস একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে সাবলীলভাবে। এবং অবধারিতভাবে তিরগুলি ছুটে এসেছে বিভিন্ন দিক থেকে। ছবির ভেতর যে কত চিহ্ন ছড়িয়ে রেখেছিলেন ফ্রিডা! এখানেও দেখার, পাতাগুলি ছড়িয়ে রয়েছে ফ্রেমের বাম-দিক থেকে ডান-দিকে; হরিণীর গতি ফ্রেমের ডান-দিক থেকে বাম-দিকে।

জীবনের সমস্ত শস্য’কে উপেক্ষা করে সে ছুটে চলেছে বিপরীত দিকে, মৃত্যুর দিকে। প্রবল যন্ত্রণায় তার লেজ প্রবেশ করেছে পিছনের দু’টি পায়ের ভেতর, অথচ মুখে মৃত্যুর প্রসন্নতা। উদাসীনতা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্রিডা হয়তো মৃত্যুর থেকেও বেশি জীবনের। প্রবলভাবে বেঁচে ওঠার, বেঁচে থাকার। ১৯৫০-এ তাঁর মেরুদণ্ডে ন’টি অপরেশন হয়েছিল। সারা জীবনে অশক্ত শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেও তিনি জীবনের অনন্ত সম্ভাবনা দেখেছিলেন হয়তো। অথবা মৃত্যুর দিকে হেঁটে যেতে যেতে অনুভব করেছিলেন জীবনের বিস্তৃর্ণ খামার, তরমুজ-খেত।

১৯৫৪-এ তিনি সৃষ্টি করলেন ‘ভিভা-লা-ভিডা’; একটি নিটোল তরমুজ’কে ঘিরে থাকা ছয়’টি তরমুজ-ফালি অথবা তরমুজ। কেন্দ্রের তরমুজ’টি নিটোল, ফ্রেমের ডান-দিকের উপরের কোণের তরমুজটিও তাই। বাম-দিকের আধফালি তরমুজটির ভেতর কালো বীজ তার ঊর্বরা শক্তির প্রকাশ। তার ঠিক ডান-দিকের তরমুজটি কিউবিজমের পথ বেয়ে নির্মিত। বাকি তিনটি তরমুজের ফালি নারীর যৌনতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। ফ্রেমের ডান-দিকের গাঢ় স্ট্রোক’গুলিকে ব্যালেন্স করছে বাম-দিকের distortion।

(Viva-la-vida, Watermelons- 1954)

একটি অখণ্ড তরমুজ’কে কেন্দ্রে রেখে যেন চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে চলেছে জীবনের আরক্তিম উল্লাস, পবিত্র উল্লাস। পূর্ণ-অপূর্ণ’কে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে এ এক অনিবার্য চক্র।

ছবিটিতে ফ্রিডা তাঁর দস্তখত রেখে গিয়েছেন।

মনে পড়ছিল কোনও দিন মুখ দেখতে না-পাওয়া এক নারী’র প্রতি ‘অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা’ লিখে গিয়েছিলেন এক কবি।

লিখেছিলেন,

‘পর্দায়, গালিচায় রক্তাক্ত রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,

রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!

তোমার নগ্ন নির্জন হাত;

তোমার নগ্ন নির্জন হাত’।

এক বিলুপ্ত নগরে দীর্ঘ হয়ে উঠছে ফ্রিডা কাহলোর নগ্ন, নির্জন হাত; ক্ষত-বিক্ষত জীবনের রক্তিম তরমুজ-মদ।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *