স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (৪র্থ পর্ব)

স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (৪র্থ পর্ব)

শেয়ার করুন

পার্থজিৎ চন্দ

স্তব্ধ রেখার পাশে

The Circus

At the sight of horses, who are always in a state of ecstasy, 1 think: are they not, perhaps, happier than we? You can kneel down peacefully before a horse and pray. It always lowers its eyes in a rush of modesty. I hear the echo of the horses’ hooves in the pit of my stomach. I could race on a horse for the first time and the last time, to the brilliant arena of life. I would be aware of the transcendence, of no longer being alone among the silent creatures whose thought of us only God can know. These animals, horses, cows, goats among the trees and hills: they are all silent. We gossip, sing, write poems, make drawings which they do not read, which they neither see nor hear. I would like to go up to that bareback rider who has just reappeared, smiling; her dress, a bouquet of flowers. I would circle her with my flowered and unflowered years. On my knees, I would tell her wishes and dreams, not of this world. I would run after her horse to ask her how to live, how to escape from myself, from the world, whom to run to, where to…

একজন মানুষ একটি ঘোড়ার কাছে গিয়ে তার কানে কানে জিজ্ঞেস করছেন কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়, কীভাবে পালাতে হয় ‘সেই’ মাটি আর আলোবাতাসের দগদগে ক্ষতের থেকে… কীভাবে ক্রমশ মুছে নিতে হয় নিজেকে। স্মৃতির ভেতর বেঁচে থাকা এক একটা সোনালি বীজকে কীভাবে মেরে ফেলতে হয়, কীভাবে ক্রমশ ধাতুর ছুরি দিয়ে উপড়ে ফেলতে হয় একের পর এক স্মৃতির সফর।

কোথায় চলে যায় মানুষ! কোথায় চলে যেতে বাধ্য হয় সে? একবার শিকড় থেকে উপড়ে ফেলার পর সে কি ‘এক’ই মানুষ থাকে? সে কি ‘অপরাধী’র মতো বারবার ফিরে আসতে চায় তার স্মৃতির কাছে, তার শিকড়ের কাছে?

সব ইউলিসিসের ঘরে ফিরে আসা আসলে তাঁর জীবন জুড়ে ঘটে চলা দীর্ঘ যাত্রার দিকে চেয়ে থাকা। যাত্রার এ স্মৃতির ভেতর বেঁচে থাকে মানুষ।

মানুষ আসলে ‘স্মৃতি’ দিয়ে নির্মিত এক প্রাণী; মানুষের ‘মৃত্যু’ আসলে তাঁর স্মৃতির মৃত্যু। শুধু ঘরে ফেরার গান ও আকাঙ্ক্ষার থেকেও বেশি সে ‘নস্টালজিয়া’।

ব্রিজের ওপর দিয়ে ঝমঝম করে চলে যাওয়া ট্রেনের শব্দ আমার নিউরনের মধ্যে ঢুকে গেছে সেই কবে থেকে। বৃষ্টির দিকে দীর্ঘ ট্রেন চলে যেত দূরে, জনপদের ওপর ভাসতে থাকত তার বাঁশির শব্দ।

ট্রেনের কাছাকাছি থাকা প্রতিটি মানুষের কাছে একটি ‘ব্যক্তিগত’ নির্জন স্টেশন থাকে, আমারও ছিল। মার্ক শাগালের ছবির কাছে ফিরে সে স্টেশনটিকে আজকাল বড় বেশি করতে দেখতে পাই।

প্ল্যাটফর্মের ওপর গজিয়ে উঠেছে পুরু ঘাসের দল; তখনও কাঠের ওভারব্রিজ। কয়েকটি পাটাতন বৃষ্টির জল পেয়ে বিপদজনকভাবে ফুলে উঠেছে। স্টেশনের পাশের ঝিল থেকে উড়ে এসে কাছের বটগাছের ওপর বসল একটা পানকৌড়ি। তার ডানা-ঝাড়া ও উড়ে যাবার মধ্যে ডুবে যাবে সূর্য।

স্টেশনের বেঞ্চে বসে থাকতেন একজন মানুষ।

সমাজ তাঁর প্রেম’কে স্বীকার করবে না, করেওনি। তিনিও বেরিয়ে আসতে পারেননি তাঁর সামাজিক পরিসর থেকে। ছোট্ট একটা বাড়ি করেছিলেন স্টেশনের কাছে; শহর থেকে দূরে সে ঘরে থাকতেন তাঁর ভালোবাসার মানুষ। মাঝে মাঝে তিনি ‘চোরের’ মতো পালিয়ে আসতেন তাঁর কাছে। ফিরেও যেতেন; অপেক্ষা করতেন আবার কবে চোরের মতো তিনি শহরে ছেড়ে পালিয়ে আসার সুযোগ পাবেন তার।

এক একজন মানুষকে সারাজীবন নিয়তি পাগলের মতো তাড়া করে ফেরে। সেই পুরুষটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভালোবাসার নারী হঠাৎ একদিন রাত্রে ঘুমের মধ্যে মারা গেছিলেন।

তারপরেও সেসব সূর্য ঢলে পড়া বিকেল-সন্ধ্যায় দেখতাম, তিনি ট্রেন থেকে নেমে বসেছেন স্টেশনের বেঞ্চে। একা, স্থির। বাড়ি পর্যন্ত যেতেন না, স্টেশনে বসে থাকতেন। এখন মনে হয় তিনি স্মৃতি কুড়িয়ে নিতে আসতেন।

মানুষ তাঁর যাবার রাস্তার দু’ধারে ছড়িয়ে রেখে যায় স্মৃতির পাতা। একদিন একাকী মানুষ সে পাতাগুলি কুড়িয়ে নিতে আসে। হঠাৎ একদিন সে আর কোনও পাতার হদিশ পায় না; সে তার স্মৃতির সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। এক অসহায় অবস্থায় ছটফট করতে করে মৃত্যু ঘটে তার।

ছটফট করে না কি সে দৃশ্যের ‘দর্শক’? তার কাছেও তো এই সমস্ত দৃশ্য অবিরাম রূপান্তরিত হতে থাকে স্মৃতি হিসাবে।

এ ভাবে ছটফট করতে করতেই একদিন পড়ে ওঠা যায় বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের ‘হিমঘরের মাছ’,

‘একদিন রাতে

পদ্মানদী চুরি হয়ে গেল।

তার সঙ্গে

গোয়ালন্দ ঢাকা মেল

তারপাশা খাল নৌকো

বিকেল বিকেল বাড়ি-

সব চুরি গেল।

তখন ভেবেছি বুঝি বাঁচব না

তারপর কতদিন ধরে

ধীরে ধীরে চুরি হল

স্বপ্ন স্মৃতি প্রাণ।

দিব্যি বেঁচে আছি’। (পদ্মাঃ ১)

-বিজয়া’র এই কবিতাটির কাছে বহুক্ষণ বসে থাকি; ধীরে ধীরে সব শব্দ অস্পষ্ট হতে হতে জেগে থাকে শুধু, ‘দিব্যি বেঁচে আছি’। কিন্তু তার আগেই বিজয়া জানিয়ে দিয়েছেন, অতি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ধীরে ধীরে চুরি হল / স্বপ্ন স্মৃতি প্রাণ’। এরপরেও যে তিনি ‘দিব্যি বেঁচে আছেন’ তা আসলে মৃত্যুর নামান্তর। দেশ থেকে দেশান্তরিত হতে হতে, ভয়ার্ত পশুর মতো আগুনের কাছ থেকে পালাতে পালাতে কে যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে।

People often talk about what way, and in what forms, and in what Movement color should be placed. But this colour thing is innate. It does not depend on the manner or the form on which you place it. Nor does it have anything to do with the mastery of the brush. It is outside of all Movements. The few Movements which have endured throughout history have all possessed that innate colour… the movements are forgotten.

শাগালের ছবির কাছে যতবার এসেছি ততবার মনে হয়েছে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি একজন মানুষ, কিছুটা ভয়ার্ত, ক্রমাগত ছুটে চলেছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। বারবার তিনি আশ্রয় নিচ্ছেন স্বপ্নের কাছে; কোনও মতবাদ বা শিল্প-আন্দোলন নয়; শুধুমাত্র এক পারাপারহীন স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে। ঠিক কী সমুদ্র-সমান স্বপ্নের মধ্যে বাস করতেন শাগাল?

১৯১১ সালে তিনি সৃষ্টি করেন ‘দ্য ভিলেজ এন্ড আই’ ছবিটি; শান্ত রঙের এ যেন এক উৎসব, জীবনের সব রূপরসগন্ধ ভরে রয়েছে ছবিটিতে। যে ‘জন্মস্থান’ ছেড়ে শাগাল’কে চলে যেতে হয়েছিল বহুদূর, যেখানে তিনি ফিরে এসেছিলেন এবং যেখান থেকে তাঁকে আবার চলে যেতে হয়েছিল সে গ্রাম (ভিটেস্ক) মাথার ভেতর নিয়ে ঘুরতেন শাগাল। মিশ্র-সংস্কৃতি’তে বড় হয়ে ওঠার আনন্দ ও আত্মপরিচয়ের সংকট একই সঙ্গে খেলা করেছিল, তাড়া করেছিল তাঁকে সারা জীবন।

(দ্য ভিলেজ অ্যন্ড আই- ১৯১১)

ছবিটির দিকে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি ছাগলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা একজন সবুজ মানুষের মুখ। শাগালের ছবিতে ফিরে ফিরে আসে ছাগল, গরু, ষাঁড় থেকে শুরু করে গৃহপালিত পশু। ঘোড়া।

‘দ্য ভিলেজ এন্ড আই’ ছবিটিতে শাগাল ক্যানভাসের সমতল’কে ভেঙে দিয়েছিলেন সন্তর্পণে। সে ভাঙচুরের মধ্যে কোথাও উচ্চকিত বিষয় নেই।

ছাগলের মুণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটির গলায় পুতির মালা এবং সে মালা থেকে একটি ক্রশ ঝুলছে। মানুষটির চোখে কোনও মণি’র ইশারা রাখেননি শাগাল, অথচ ছাগলের মণি’টি উজ্জ্বল। পরম বিস্ময়ে একটি ছাগল ও এক মানুষ তাকিয়ে রয়েছে পরস্পরের দিকে। ছাগলের মুণ্ডের ভেতর আরেকটি ছাগলকে স্থাপিত করেছেন শাগাল, এক গ্রাম্য-নারী দুধ-দুয়ে চলেছে। ছবিটিতে কিউবিস্ট-ছায়া দীর্ঘ হতে হতেও হয়নি; শাগাল ক্যানভাসের উপরের দিকে বাম থেকে ডান-দিক বরাবর গির্জা ও ছোটছোট বাড়ি এঁকে রেখেছেন। দু’টি বাড়ি যেন মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম অগ্রাহ্য করে হেঁটমুণ্ড হয়ে রয়েছে। এবং গির্জার ভেতর থেকে সমস্ত দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক বালক।

শুধু কি দু’টি বাড়িই মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম অগ্রাহ্য করেছিল? একটি নারী’ও কি করেনি? সেও তো ক্যানভাসে ভাসছে সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করেই।

কিছু শিল্পী অতি-শান্তভাবে ক্যানভাসে মাত্রার পর মাত্রা যুক্ত করে যান; শাগাল’ও তেমনই। ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে বোঝা যাবে বাম-দিকের নীচের দিকে রয়েছে গ্রহণের চাঁদ। একদম মাঝখানে রয়েছে বৃত্তাকার সৌরপথ। আবর্তন। গাছপালার ইশারা। কিছুই অতিরিক্ত বা প্রক্ষিপ্ত নয়; এ মহাজগতে সবকিছু একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বয়ে চলেছে জীবনের, সময়ের চক্রাকার ধারা।

আরেকবার ছবিটির দিকে তাকাই, দেখি শাগাল সবুজ-মুখের মানুষটির চোখ ও ছাগলটির চোখের মধ্যে এঁকে রেখেছেন অস্পষ্ট পথরেখা। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এই রেখাটিকে সরাসরি সংযোগ বোঝাতে ব্যবহার করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষ ও মানুষের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ানো পশুদের মধ্যে ‘অদৃশ্য’ এক সম্পর্ক খেলা করে চলেছে।

আঠারো-শো সাতাশি’তে রাশিয়ার ভিটেস্কে জন্মগ্রহণ করা শাগালের ছবির দিকে তাকালে বোঝা যায় শিল্প কোনও লিনিয়ার পথ মেনে নির্মিত হতে পারে না। এমনকি একজন স্রষ্টার ‘হয়ে ওঠার’ মধ্যেও লিনিয়ার-প্রবণতার সন্ধান করা হয়তো বৃথা। জীবনের মিশ্র-উপাদান শাগাল’কে চিরকাল তাড়া করে বেড়িয়েছে। তিনি যে স্মৃতির জাদুঘর নির্মাণ করেছেন তা মিশ্র-সংস্কৃতির জাদুঘর। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে পোলান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক, রাশিয়ার পোলান্ড অধিকার ভিটেস্ক’কে প্রভাবিত করেছিল। শাগাল জন্মেছিলেন পূর্ব-প্রান্তে; সেখানে বসবাসকারী ইহুদিরা ছিলেন সহজ-সরল, পরিশ্রমী। অর্থোডক্স ইহুদিদের বাস ছিল পশ্চিমদিকে। বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার ভিটেস্ক অঞ্চলের ইহুদি’রা রাজনৈতিকভাবে ‘ক্ষমতাহীন’ ছিলেন; কিন্তু স্বচ্ছল ছিলেন। রেল-সংযোগ থাকার ফলে ভিটেস্কের গুরুত্ব’ও কম ছিল না।

শাগালের ছবি দেখতে দেখতে আমাদের মনে হওয়া স্বাভাবিক, ভিটেস্ক… তাকে ঘিরে থাকা শান্ত বন, বৃক্ষের সার, ধুধু বরফ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। হয়তো এ মনে হওয়া অসংগত নয়, তবে কোথাও গিয়ে যেন মনে হয় বাস্তবের ভিটেস্কের থেকেও অন্য এক ‘ভিটেস্ক’ তাঁকে গ্রাস করে রেখেছিল।

নস্টালজিয়া, হোম-কামিং, ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে ‘নিজস্ব’ দ্বীপ থেকে দূরে সরে যাওয়া- সব একসঙ্গে ঘটতে থাকে তাঁর জীবন ও শিল্পে।

বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়া’র সেন্ট পিটাসবার্গে ইহুদি’দের থাকার কোনও অধিকার ছিল না; থাকতে গেলে বিশেষ পারমিটের ব্যবস্থা করতে হত। ১৯০৭-এ শাগাল সেন্ট পিটাসবার্গে এসে কোনও ক্রমে পারমিট জোগাড় করে থাকতে শুরু করেন; ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি অতিবাহিত করেন প্যারিসে।

La Ruche (দ্য বিহাইভ)-এ থাকার সময়ে তিনি আভা-গার্দ ও ইউরোপিয় ধারার সঙ্গে বেশি করে পরিচিত হতে শুরু করেন। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অ্যপলনিয়ারের সঙ্গে। এ সময়ে তাঁর দুটি বিখ্যাত সৃষ্টির দিকে তাকানো যেতে পারে, ছবি দু’টির নাম ‘দ্য ফিডলার’ এবং ‘পোর্ট্রেট উইথ সেভেন ফিঙ্গারস’।

‘দ্য ফিডলার’ ছবিটিতে শাগাল ক্যানভাসের একদম মাঝখানে স্থাপন করলেন একজন বেহালা-বাদক’কে। এখানে তাঁর প্যারিসে বসবাসের চিহ্ন স্পষ্ট; শিল্পীর মুখ এখানেও গাঢ় সবুজ রঙে ছেয়ে রয়েছে। ছবিটির ডিপ-স্পেসে ছোট ছোট ঘরবাড়ি, ত্রিভুজাকার শীর্ষদেশ তাদের। শাগালের প্রো-জিওনিস্ট অবস্থান যেন একটু একটু স্পষ্ট হচ্ছে ছবিটিতে। যতবার ছবিটির দিকে তাকিয়েছি ততবার মনে হয়েছে বেহালা থেকে নেমে আসা সুরের ঝর্না ভাসিয়ে দিচ্ছে বেহালা-বাদক’কে। তার বিভঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আনন্দের উৎসব; সে মগ্ন। তাঁর সমস্ত ঐতিহ্য ও ‘সংস্কার’ নিয়ে সে বাজিয়ে চলেছে বেহালা। সুর। আরেকটি বিষয়’ও ভাবিয়েছে বারবার, ‘শিল্পী’ দাঁড়িয়ে রয়েছেন একটি অর্ধবৃত্তের উপর। তাঁর পায়ের নীচে ঘরবাড়ি, তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে চলেছে পৃথিবী। অর্ধবৃত্ত’টি ‘পৃথিবী’ নামক গ্রহের কথা মনে করাবেই। আর ছবিটির দর্শক আবিষ্কার করবেন, শিল্পীর হাতে থাকা বেহালাটির গায়ে ভাইব্রান্ট হলুদের খেলা। বামদিকের কোণ থেকে একটি নারী-মূর্তি চেয়ে রয়েছে সে সুরের ঝর্নার দিকে। একটি নারী’র তিনটি মুখ, দুটি মুখের আদল’কে ঘিরে রেখেছে রহস্যময় লাল-ফুলের উচ্ছ্বাস।

শিল্প কি এভাবেই চারপাশের পৃথিবীকে আবিষ্ট করে রাখে? তৈরি করে গোপন সংযোগ, যে সংযোগের কোনও ব্যাখ্যা বা ‘মানে’ নেই আমাদের কাছে? তার হয়ে ওঠাই কি অন্তিম সত্য? না-হলে কেন শাগাল শিল্পী’র মাথার উপর রাখলেন ভাসমান নগ্ন, আদিম পুরুষ’কে? শিল্পী কি আসলে ওই ভাসমান পুরুষটির মতো, যে অগ্রাহ্য করেছে পৃথিবীর সমস্ত শর্ত?

খলিল গিব্রান তাঁর ‘প্রফেট’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘And since you are a breath in God’s sphere, and a leaf in God’s forest, you too should rest in reason and move in passion’

(দ্য ফিডলার- ১৯১৩)

শাগালের এ ছবিটিতে গিব্রান-কথিত ‘মুভ ইন প্যাশন’-এর ছাপ অতি-স্পষ্ট।

এই একই পর্বে শাগালের ‘পোর্ট্রেট উইথ সেভেন ফিঙ্গারস’ ছবিটিতে সাররিয়ালিজম ও কিউবিজমের ছাপ অনেক বেশি স্পষ্ট।

শাগাল এ ছবিটিতে ক্যানভাসের স্পেস’কে ভেঙেচুরে দিয়েছেন; তীব্র কন্ট্রাস্ট তৈরি করে এমন রঙের ব্যবহার করেছেন। ক্যানভাসের বাম-দিকের উপরের কোণে আইফেল টাওয়ার। ডান-দিকের কোণে যেন স্বপ্নের ভেতর ভেসে বেড়ানো খামার-বাড়ি ও চরে বেড়ানো গৃহপালিত পশু। বাম ও ডান-দিকের উপরের দুটি কোণ একে অপরের পরিপূরক। শাগাল প্যারিসে থেকেও বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁর গ্রাম’কে, তাঁর ‘রুট’কে। ড্রিম-লাইক এক ‘স্টেট’এর ভেতর সৃষ্টি হয়ে চলেছে একটি ছবি। ছবির ভেতর ছবি; সে ছবিতেও গৃহপালিত পশু ও জিওনিস্ট-চিহ্ন।

‘ছবি’র ভেতর যে শিল্পী ছবি এঁকে চলেছেন তাঁর প্যালেট ধরে থাকা হাতে পাঁচ’টি আঙুল। কিন্তু অপর হাত’টিতে সাত’টি আঙুল।

(পোর্ট্রেট উইথ সেভেন ফিঙ্গারস- ১৯১৩)

ছবিটি ডিপ-স্পেস থেকে যত সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে তত হরিদ্রাভ হয়ে উঠেছে। এ হলুদ ভ্যান গগ-এর হলুদের থেকে পৃথক। হলুদের মাঝে বিভিন্ন শেডের সবুজের ছোঁয়া এক ধরনের হ্যালুশিনেশন তৈরি করে।

কিন্তু এ-ছবির সব থেকে চর্চিত বিষয় শাগালের বাম-হাতের সাত’টি আঙুল। শিল্পীর সত্তার যে অংশটি ‘কনসাস’ সেখানে ‘রিজন’কে অতিক্রম করলেন না তিনি। কিন্তু যে হাত তুলি ধরে নেই সেখানে তিনি সাত’টি আঙুল রেখে দিয়ে গেলেন। এ ‘অতিরিক্ততা’ কি শিল্পী’র স্বাধীনতা বা ‘প্যাশন’-এর প্রকাশ?

শিল্পের সঙ্গে রাজনৈতিক-ক্ষমতার সম্পর্ক কতদূর পর্যন্ত থাকা সংগত (শিল্প পার্টিজান রাজনৈতিক অবস্থান’কে কতদূর পর্যন্ত সহ্য করতে পারে) তা নিয়ে অনন্ত বিতর্ক আছে ও থাকবে। শাগালের প্রো-কম্যুনিস্ট (সাময়িক হলেও) ও প্রো-জিওনিস্ট অবস্থান, রাশিয়ান বিল্পবের পর তার সঙ্গে একাত্ম অনুভব করা ও অল্প সময়ের মধ্যে তার থেকে দূরত্ব তৈরি করা ইত্যাদি সব মিলিয়ে বহু বিতর্কের জন্ম হতে পারে।

১৯১৪ সালের জুন মাসে ভিটেস্কে বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে ফিরে এসে একজন মানুষ দেখছেন সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হতে চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তিনি আর ফিরতে পারছেন না প্যারিসে।

১৯১৭ সালে তিনি দেখছেন রাশিয়ার বিপ্লব এবং চলে যাচ্ছেন ইউক্রেনের দিকে। সেখানে তিনি অনাথ বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করছেন ইদিশ সাহিত্য। দিচ্ছেন শিল্পের পাঠ।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি ক্লান্ত, ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন ‘পলিটিক্যাল-লেফট’ ও ‘আর্টিস্টিক-লেফট’ বিষয়ে। ১৯২২-এ তিনি চলে যাচ্ছেন বার্লিনে।

এ সমস্ত কিছুই হয়তো শাগালের ভেতর ঝর্নার জন্ম দিয়েছিল; এমন এক ঝর্না যার ভেতর এসে পড়ে রামধনুর রঙ।

সারা-জীবন প্রবল রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলেন শাগাল। তাঁর চারপাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আগুনের স্রোত; কিন্তু তিনি মাথার ভেতর বহন করে নিয়ে চলেছেন এক আশ্চর্য স্মৃতি ও নস্টালজিক জগৎ।

সারা-জীবন তিনি আঁকড়ে ধরে থাকলেন ‘ওয়ান্ডারিং’ ইহুদি মিথ; তিনি বহন করে চললেন দেশান্তরিত হয়ে যাওয়া এক মানুষের সত্তা। অবিরাম খোঁজের মধ্য দিয়ে হয়তো একদিন মিলে যাবে সে দেশ, স্বপ্নের থেকেও বাস্তব সে ভূমি।

শাগালের জগতের দিকে তাকিয়ে মনে হয় তিনি ‘টেন কম্যান্ডমেন্টস’-এর দ্বিতীয়টিতে বিশ্বাস রেখেছিলেন সব থেকে বেশি, ‘Thou shalt not make unto thee graven images.’

‘লাভার্স ইন দ্য লাইলাক্স’ এমনই এক ছবি। স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন দেখছেন একজন শিল্পী; অতিকায় বোকে’র ভেতর, ফুলের ভেতর শুয়ে রয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকা। সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম’কে লঙ্ঘন করবার শক্তি তারা অর্জন করেছে প্রেমের কাছ থেকে। সবুজ পাতার আড়ালে থোকা থোকা ফুল, যুবতীর স্তনের কাছে যুবকের হাত। দিগন্তে ব্রিজ ও চাঁদের ইশারা। অ্যজুর-ব্যাকগ্রাউন্ড ছবিটিকে স্বপ্নের মায়াবী আলো দিচ্ছে।

ছবিটি দেখতে গিয়ে চমকেও উঠেছিলাম; এ অনন্ত শান্তি ও আনন্দের মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে প্রেমিক-প্রেমিকা কেউ কারো দিকে চেয়ে নেই। প্রেমিকের দৃষ্টি মেয়েটির মুখ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মেয়েটি ঈষৎ বাম-দিকে চেয়ে রয়েছে। শুধু তাদের ঘিরে রয়েছে রঙের খেলা, শান্ত-সন্ত্রাস। প্রকৃতির ক্রোড়ে একদম নির্ভার হয়ে অবস্থান করার সময় কি মানুষ এমনই উদাসীন ও ‘সহজ’ হয়ে পড়ে? সে কি তখন সংযোগ করতে শুরু করে অন্য কোনও মাত্রায়, সেখানে এসে তুচ্ছ ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে দৃষ্টি-পথ?

(লাভার্স ইন দ্য লাইল্যাক্স, ১৯৩০)

প্রায় এই পর্বেরই আরেকটি ছবি ‘ইক্যুয়াস্ট্রিয়ান’ (১৯৩১)। শাগাল সারা-জীবন তাই সৃষ্টি করেছেন যা তিনি সর্বস্ব দিয়ে বিশ্বাস করতেন, ‘Our whole inner world is reality- perhaps even more real than the visible world.’

দৃশ্যমান পৃথিবীকে অতিক্রম করে যে বাস্তবতা, যার সন্ধান একমাত্র পাওয়া যার রূপকথায় এবং যে ‘রূপকথা’কে বিশ্বাস করার সব থেকে বড় কারণ, সেটি ‘রিয়েলিটি’কেই আমাদের কাছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফিরিয়ে দেয়- শাগালের ‘ইক্যুয়াস্ট্রিয়ান’ তার সন্ধান দিয়ে যায়।

ছবিটির ঘোড়া রূপকথা থেকে নেমে আসা। একটি রূপকথার ঘোড়ার পিঠে এক যুবতীকে নিয়ে ছুটে চলেছে এক যুবক। তাদের ঠোঁটের মধ্যে সামান্য দূরত্ব। ভেলভেট-রঙের পোশাক পরা যুবতী বসে রয়েছে চিত্রিত আসনের উপর, ছবিটির নীচের ডান-কোনে আরও অনেক বেহালা-বাদন ও গাঢ়-বেগুনী রঙের পশু-মুখ, চঞ্চলতা। মিথ থেকে নেমে আসা ঘোড়া। বাম-দিকের কোণে একলা বেহালা বাজিয়ে চলেছে একজন পুরুষ। এবং ঘোড়াটি তার গলায় চেপে রেখেছে একটি বেহালা। মানুষ থেকে তার চারপাশে ঘুরে বেড়ানো পশু পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে এক সুর; সুরের মধ্যে মগ্ন দুই নর-নারী।

শিল্প সমস্ত রকম পরাধীনতাকে ভাঙতে ভাঙতে অগ্রসর হয়; কোনও ‘ইজমের’ ঘেরাটোপে শাগাল নিজেকে বন্দি রাখতে চাননি। ফলে ১৯৩৯-এ এসে, আভা-গার্দ ও কিউবিজমের প্রবল স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি সৃষ্টি করলেন ‘অটাম ইন দ্য ভিলেজ’। এখানেও শাগালের সেই স্মৃতির ভেতর ঘনিয়ে থাকা গ্রামের ইশারা। ‘লাভ ইন দ্য লাইলাক্স’ ছবিটিতে বোকের আকৃতির সঙ্গে এ ছবির গাছটির অদ্ভুত মিল। পল্লবিত জীবনের উদ্ভাসের ভেতর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে হলুদ ও সবুজ। তার মাঝখানে এক কিশোর, তার বুকের কাছে যত্নে ধরা বেহালা ও সামনে সেই চির-পরিচিত ছাগল। ক্যানভাসের নীচের দিকে শাগাল ব্যবহার করেছেন অস্তগামী সূর্যের আভা। ছোট ছোট বাড়ি, ডান-দিকের কোণে ভাসমান নারী। উন্মুক্ত স্তনের নারী। এ নারী কি ঊর্বরতার প্রতীক? আবহমান জীবন ও যৌনতার প্রতীক? প্রকৃতির মধ্যে খেলা করা অনন্ত জীবনের ইশারা-মাখানো সে-নারীর হাতে ধরা রয়েছে ফুলের গুচ্ছ।

(অটাম ইন দ্য ভিলেজ, ১৯৩৯)

সে যেন ওই মানুষ, ছাগল, ঘরবাড়ি, আকাশের একফালি চাঁদকে যুগিয়ে যাচ্ছে ‘প্রাণ’। এ পূর্ণের মাঝখানে এক তিল শূন্যতা নেই; সমস্ত পূর্ণ হয়ে আছে মায়ায়, ভালোবাসায়।

এক ক্যালাইডস্কোপের মধ্য দিয়ে শাগাল পৃথিবীকে দেখেছিলেন, সেখানে রঙের উৎসব। ‘সার্কাস হর্স’ ছবিটি তিনি সৃষ্টি করেন ১৯৬৪ সালে। এ ছবিটির কাছে যাবার আগে তাঁর বিখ্যাত উক্তিটির কাছে একবার যাওয়া যাক, ‘When I work from my heart almost everything comes right, but when from my head, almost nothing.’

( সার্কাস হর্স- ১৯৬৪)

‘সার্কাস হর্স’ ছবিটির ক্যানভাস শাগাল পাঁচটি কিউবিক্যালে ভেঙে নিয়েছিলেন। প্রতিটি কিউবের মধ্যে তীব্র গতি ও উৎসব। দর্শকেরা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে সার্কাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে। শাগাল ফোকাল-পয়েন্টের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থাপন করছেন ঘোড়ার পিঠে চড়ে ব্যালেন্সের খেলা দেখানো এক রাশিয়ান শিল্পী’কে। ডান-দিকে ট্রাপিজের খেলা, বাম-দিকের নীচের কোণে দর্শকের মনোরঞ্জন করবার জন্য এক বিদুষক। বাম-দিকের উপরের কোণে জিমন্যাস্ট ও ঘোড়া। ধকধক করে কেঁপে উঠছে রঙ, প্রতিটি স্ট্রোকে শাগাল বুনে দিচ্ছেন জীবনের রঙ। ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ পর মনে হতে বাধ্য সেটি ঘুর্ণায়মান; এবং সেটি ক্লকওয়াইজ বা অ্যন্টি-ক্লকওয়াইজ- দুই’ই হতে পারে। দর্শক যদি একবার সেটিকে ক্লক-ওয়াইজ মনে করতে শুরু করেন তা হলে মনে হবে সময়ের তীব্র গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে এ সার্কাস। হয়তো সে সময়কে পরাজিত করে এগিয়ে যাচ্ছে; জীবনের শুদ্ধ আনন্দ তিরতির করে কেঁপে চলেছে কোথাও। আর যদি দর্শক সেটিকে অ্যন্টি-ক্লক-ওয়াইজ হিসাবে দেখতে শুরু করেন তা হলেও মনে হবে সে আসলে সময়’কে পরাজিত-ই করছে।

স্মৃতির ভেতর ঘটে যাওয়া সার্কাস- সময়কে পরাজিত করার আশ্চর্য উপাদান তার মধ্যে বিদ্যমান।

কিন্তু শাগালের মতো একজন শিল্পী কি শুধুই স্মৃতি-পথের পথিক? কোথাও কি তাঁর শিল্পের মধ্যে ফুটে থাকে না দেশান্তরিত ইহুদি-সত্তা এবং তার সঙ্গে কি ওতপ্রতো ভাবে এসে মিশে যায় না ‘রাজনৈতিক’ সব উপাদান? প্রত্যক্ষ ও অতি-দৃশ্যমানতার বাইরে কি রয়ে যায় না শিল্পের আরেকটি পিঠ, চাঁদের উলটো পিঠের মতো, যে পিঠ’টিকে আবিষ্কার করে চলতে হয় আমাদের?

একজন প্রকৃত শিল্পী তো ক্রান্তদর্শী’ই… তিনিই তো সব থেকে আগে আবিষ্কার করেন গ্যাস-চেম্বার ও গনহত্যার ভিত্তি’টিকে। ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হন, শিল্পের মধ্যে রেখে দিয়ে যান তাঁর সফর-চিহ্ন।

‘হোয়াইট ক্রুশিফিকেশন’ ছবিটির দিকে তাকিয়ে শিহরিত হয়ে যেতে হয়। মনে রাখা জরুরি ছবিটি নির্মিত হচ্ছে ১৯৩৮ সালে, নরকের বনে বেড়ে উঠছে বিষবৃক্ষ।

(হোয়াইট ক্রশিফিকেশন, ১৯৩৮)

যারা শাগাল-কে ‘শুধুমাত্র’ স্বপ্ন-আক্রান্ত একজন শিল্পী বলে মনে করেন, যারা শাগালের আর্টিস্টিক-লেফট ও পলিটিক্যাল-লেফটের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা সংকট’কে পলায়নবাদ বলে আখ্যায়িত করতে ভালোবাসেন তার নিশ্চয় এ ছবিটির সামনে থমকে দাঁড়াবেন।

এখানে যিশু একজন ক্রুশবিদ্ধ-ইহুদি। ডান-দিকের উপরের কোণে একটি সিন্যাগগ, অগ্নিদ্বগ্ধ। বাম-দিকে আগুন, নৌকায় চেপে ভয়ার্ত মানুষের পলায়ন, বুকে তোরাহ আঁকড়ে যিশু’র দিকে শেষবার তাকিয়ে প্রাণভয়ে ছুটে চলেছে একজন ইহুদি।

মানুষের হাতে মানুষের এ হত্যালীলার মধ্যে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে রয়েছেন যিশু, মাথা বাম-দিকে এলিয়ে পড়েছে।

শাগাল যেন দেখতে পাচ্ছেন যে পথ ধরে একদিন ‘ইহুদি-যিশু’কে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল সে পথ ধরেই এগিয়ে আসছে নরকের আগুন; গিলে খাবে ইহুদি’দের। ছুট, ছুট এবং ছুটে বহুদূর পালিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত পশুর মতো দেশান্তরের জীবন যাপন করা ছাড়া আর কিছুতেই তাদের ‘মুক্তি’ নেই।

ছবিটির বেশিরভাগ অংশই অসম্ভব শাদা, রঙের ব্যবহার প্রান্তের দিকে বেশি। সমস্ত্ গণহত্যার কেন্দ্রে কি থাকে এমনই শাদা ও ফ্যাকাসে সন্ত্রাস? মৃত-মানুষের হাড় ও করোটির মতো ফ্যাকাসে এক শূন্যতা!

ছবিটি দেখতে দেখতে হঠাৎ থেমে যেতে হয়, ডান-দিকের কোণে পলায়নরত ইহুদি-বণিকের পায়ের নীচে কোলের-শিশু’কে স্বান্তনা দিচ্ছেন মা।

বহ্নুৎসবের মধ্যে, গণহত্যার অমোঘ আয়োজনের মধ্যে শিশু’কে স্বান্তনা দিয়ে চলেছেন একজন মা। কী বলছেন তিনি?

একদিন আমরাও খুঁজে পাব আমাদের নিজস্ব ভূমি… অথবা, আমাদের জন্ম হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে ছুটে চলার জন্য… ভয়ার্ত পশুর মতো ছুটে বেড়ানোর জন্য!

যে শিল্পী ‘অতীতের’ স্মৃতি বয়ে বেড়ান আজীবন তিনি কি ‘ভবিষ্যতের’ স্মৃতিকেও লালন করতে পারেন? এ পথ ধরেই কি শিল্পী ক্রান্তদর্শী হয়ে ওঠেন?

শাগালের পথ, ‘হোয়াইট ক্রুশিফিকেশন’ দেখার পর মনে হয় ক্রান্তদর্শী হয়ে ওঠার পথ। যে পথ ধরে তিনি আবিষ্কার করছেন আসন্ন-আউসভিৎজ ও গ্যাস-চেম্বারের বাস্তবতা।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

2 Comments

  1. চমৎকার একটি লেখা পড়লাম। খুবই ভালো লাগছে। অসাধারণ!

  2. অসাধারণ! এমন লেখার কাছে মাথা নত হয়ে যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২