|

ছাপ – ফুবোকু কোজাকাই অনুবাদ: ড. পূরবী গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

মূল জাপানি থেকে বাংলায় অনুবাদ: ড. পূরবী গঙ্গোপাধ্যায়

[ফুবোকু কোজাকাই ১৯১৭ সালে তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে ইউরোপ এবং আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলে তাকে অধ্যাপক করা হয় এবং পরের বছর ডক্টরেট প্রদান করা হয়। কিন্তু ১৯২২ সালে, তার স্বাস্থ্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ফুবোকু বিভিন্ন রকমের উপন্যাস লিখলেও তিনি প্রধানত রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাসের-ই স্রষ্টা ছিলেন।]

[মূল কাহিনিতে এক মহিলার অদ্ভুত মানসিকতার ছাপ রয়েছে।]

অপরাধ-বিজ্ঞানের সভা, যেটা মাসে একবার করে বসে সমমনস্ক কিছু বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে, সেই সভায় আজকের ‘হট টপিক’ ছিল “মহিলাদের প্রতিশোধ”। কিন্তু সেদিন দুপুর থেকেই এত ঝড়, ঝঞ্ঝা, বরফ পড়া চলছিল যে, উপস্থিতির হার ছিল খুবই কম। মাত্র পাঁচজন আসতে পেরেছিল। এই পাঁচজন সত্যি-সত্যিই অপরাধ-বিজ্ঞানের পোকা। সবসময়ে অপরাধ-বিজ্ঞানের চর্চাতেই তারা আনন্দ পেত। যদিও প্রত্যেকেই অন্যান্য বিভিন্ন পেশায় যুক্ত।

রুমহিটারের চারপাশে চেয়ার টেনে বসে, হুইস্কি খেতে খেতে, সিগারেট টানতে টানতে তারা বকবক করে

চলছিল। বাইরের বরফ পড়ার শব্দ ক্রমশই বেড়ে চলেছিল। হাত-পা-মুখ সব ঠান্ডা হয়ে আসছিল।

দু-হাতের তালু দিয়ে গাল দুটোকে ধরে মাঝে মাঝে হাত ও গাল গরম করে নিচ্ছিল।

আমি, কেউ কিছু বলার আগেই বলে উঠলাম “ইতালীয় অপরাধ-বিজ্ঞানী লোম্ব্রোশিউ-র গল্পে এক মহিলার উল্লেখ আছে যে তার স্বামীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রতি রাত্রে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যেত তার যৌবন বিক্রি করতে যাতে তার সিফিলিসের মতো কিছু যৌনরোগ এসে তার স্বামীকেও বিধ্বস্ত করে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা আর কি। কিন্তু আমার মনে হয় এ ধরনের সিদ্ধান্ত খুবই অশিক্ষিত মনের পরিচয়। কোনো সুশিক্ষিত মহিলা এরকমটা কখনোই করবে না।”

উপস্থিত এক সদস্য ধরা যাক তিনি মি.ওয়াই, পেশায় বিচারক বলে উঠলেন–“আমার অভিজ্ঞতা বলে একজন উচ্চশিক্ষিত মহিলাও এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ মহিলাদের স্বভাব বোঝা খুবই মুশকিল। তাঁরা আপাত শান্ত ও মানিয়ে নেবার স্বভাবের হলেও প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে হলে, নানা ভাবে, নানা ঘুর পথেও প্রতিশোধ নিতে পারে। একবার কোনও কারণে মহিলাদের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জাগলে তারা সমস্ত ভদ্রতার মুখোশ খুলে বেড়িয়ে আসতে দেরি করে না। এমনকি নিজের ক্ষতি করেও অন্যের ক্ষতি করতে রাজি থাকে। এটা মধ্য-শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত মহিলাদের মধ্যেও লক্ষ করা যায়।” 

সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত এক গাইনোকোলজিস্ট (স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ) ধরা যাক তিনি ড.ডাব্লু বলে উঠলেন আমি মি.ওয়াই এর সাথে সহমত। মহিলাদের ‘অবসেশনের’ মতো সাংঘাতিক জিনিস কিছুই নেই। আমাদের রূপকথার যেসব গল্পে রয়েছে যে, মহিলারা কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জিঘাংসা জাগলে নিজেকে সাপ বা রক্ষসীতে পরিণত করে অপেক্ষা করে থাকে সেই মানুষটিকে মারার জন্য, তা মনে হয় শুধুই লেখকদের কল্পনার ফল নয়। মহিলাদের এই জিঘাংসা নেবার স্বভাব থেকেই সেই সব চিন্তা অনুপ্রাণিত।

ঠিক সেই সময়ে নাট্যকার হয়তো তার নাম মি. এস্, যিনি এতক্ষণ রুম-হিটারের পাশে ড. ডাব্লুর উলটোদিকে বসেছিলেন, বলে উঠলেন—“আমি বলি কি, ড. ডাব্লু তাঁর পেশাগত কারণে বহু মহিলাকে দেখেছেন এবং অনেক মহিলার মানসিক দিক বোঝার সুযোগও পেয়েছেন। তাই আপনারা কি বলেন? আজ ড. ডাব্লুকে তাঁর কোনও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে বললে কেমন হয়? সবাই একসাথে একমত হয়ে গেলেন। ড. ডাব্লু প্রথমে একটু আমতা আমতা করে চিন্তা করে বললেন—

“অবশ্যই মি. এস্ যেমন বললেন, পেশাগত কারণে আমি অনেক মহিলাকে কাছ থেকে দেখেছি। কেউ কেউ তাঁদের অনেক মানসিক যন্ত্রণার কথাও আমাকে বলেছেন। কিছু ভয়াবহ ঘটনা ও মানসিকতার মহিলাকেও আমি দেখেছি, তাদের কথা শুনেছি। কেবল একটা ভয়াবহ ঘটনা আমি কোনোদিনই ভুলব না। যদিও ডাক্তার হিসাবে আমার রোগীদের কোনো গোপন কথা বলা নীতি-বিরুদ্ধ, কিন্তু এই ঘটনার প্রধাণ নায়িকা এখন মৃত। তাই মনে হয় নামটা গোপন রেখে যদি ঘটনাটা বলি কারো বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না। এটা এক মহিলার প্রতিশোধের কথা। তাই আজ সন্ধ্যার জন্য উপযুক্তই হবে।”

“আমাদের পেশায় সব থেকে সংকটজনক সময় হল যখন একজন প্রসূতি শারীরিকভাবে বিপদের মধ্যে থাকে। তখন মাকে বাঁচাব না বাচ্চাকে বাঁচাব সেটা নিয়ে খুব দ্বন্দ্বে পড়ে যাই আমরা। যেমন ধরুন, একজন মহিলার টিবি বা যক্ষা রয়েছে। কিন্তু তিনি সন্তান-সম্ভবা। তখন কী করব? মহিলার জন্য বাচ্চার জন্ম দেওয়া খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তখন সাধারণত আমরা এ্যাবর্‌শনের পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই প্রসূতি এ ব্যাপারে বিরুদ্ধে যান। বিশেষত যে সব দম্পতি বহুদিন যাবৎ নিঃসন্তান। হবু মা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েও নবাগত শিশুকে জন্ম দেবার জন্য অনুরোধ করেন। বাচ্চার জন্মের সাথে সাথে তাঁর মৃত্যুতে যে বাচ্চাটিকে খুবই দুঃখে কাটাতে হতে পারে সেটা জেনেও মায়েরা তাঁর অনাগত সন্তানকেই পৃথিবীর আলো দেখাতে চান। এটা একটা অদ্ভুত প্রাকৃতিক, নাড়ীর টান।

এখানে আমাদের এক বিশাল সমস্যা তৈরি হয়। তখন আমরা প্রসূতির অনুরোধেই কেবল মাত্র তাঁর সুস্থতা ও নিরোগ ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রার্থনা করে শিশুর জন্মের প্রতীক্ষায় থাকি।

যে ঘটনা আমি বলতে চাইছি সেটাও এই ডিলেমা বা দ্বন্দ্ব নিয়েই। একদিন এক বিদেশ সচিব ডেকে পাঠালেন তাঁর স্ত্রীকে পরীক্ষা করার জন্য। ওই বিদেশ সচিব ও তাঁর স্ত্রীকে আমি এক সময়ে খুব ভালো করে চিনতাম। ভদ্রমহিলা একজন সুন্দরী সোসাইটি লেডি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এবং তাঁর যে খুব সুনাম ছিল তা নয় এবং নানা রকম গুজব ছিল তাঁর সম্বন্ধে। অত্যন্ত বদমেজাজি এক সুন্দরী। তাঁর স্বামীরও যে খুব সুনাম ছিল তা নয়। তবে উনি খুব উচ্চপদস্থ এক ব্যক্তি। তাই তাঁর সব অপব্যবহারই লোকে ক্ষমা করে দিত।

আমার যখন ডাক এল অনুমান করলাম যে, নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা অন্তঃসত্ত্বা।

ওঁদের বাড়িতে পৌঁছে, সেই ময়ূরীর মতো পেখম তুলে ঘুরে বেড়ানো মহিলাকে দেখার বদলে দেখলাম শীর্ণ, রুগ্ন এক মহিলাকে, যিনি একজন নার্সকে সাথে নিয়ে একটি বিছানায় শুয়ে আছে। তাঁর সুন্দর ফোলাফোলা গাল দুটো তুবড়ে গিয়েছে। হাত দুটো হাড্ডিসার। একদম আলাদা এক মানুষ। পরীক্ষা করে যেটা বুঝলাম যে, মহিলা ন-মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু একই সঙ্গে মহিলা লাংসের যক্ষাতে আক্রান্ত।

পরীক্ষায় আরও বুঝলাম ভ্রূণের অবস্থা একদমই ঠিক আছে। কিন্তু মায়ের ওই যক্ষাটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলল। তার ওপর মহিলার হার্টের অবস্থাও খুবই খারাপ। হয়তো খুব শিগ্‌গিরি প্রসব করাতে না পারলে বাচ্চাটারও পৃথিবীর আলো দেখা হবে না।

আমি যখন সময়ের আগেই প্রসবের ব্যবস্থা করার এবং তার প্রয়োজনের কথা বললাম তখন উনি মোটেই অবাক হলেন না। বললেন উনি জানতেন যে ওনার অন্তঃসত্ত্বা হবার তিন মাসের সময় থেকেই উনি যক্ষায় আক্রান্ত। “প্রথম থেকে যে ডাক্তার দেখছিলেন তিনি গর্ভপাতের পরামর্শ দিয়েছিলেন আমার শরীরের কথা ভেবে। কিন্তু অবস্থাক্রমে আমি এখনও জীবিত। আমি কেবল মনের জোরে বেঁচে আছি ডক্টর, বাচ্চাটাকে জন্ম দেব বলে। তারপর আমি মারা যাব। কিন্তু গত কদিন ধরে আমার বুকে একটা অসম্ভব চাপ আর ব্যথা হচ্ছে। শরীরটাও খুবই দুর্বল লাগছে। তাই আমি আপনার মতো একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারকে ডাকতে বলেছিলাম। ডাক্তারবাবু, আমার বাচ্চা কেমন আছে? ও সুস্থ ভাবে পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে তো?”

আমার পক্ষে তখন অন্য কোনো উত্তর দেওবা সম্ভব ছিল না। তাই বললাম –‘আপনার বাচ্চা একদম সুস্থ’। যদিও জানতাম যে মায়ের অবস্থা খুবই সংকটজনক।

মহিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেসে উঠলেন। ওনার ওই রুগ্ন শুষ্ক মুখের হাসিটা দেখে মনে হল কোনো রাক্ষসী হাসল বোধহয়।

ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণের জন্য পাশ ফিরে শুলেন আর একদম চুপ করে রইলেন। তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গাল ও বালিশের সাদা ঢাকা ভিজিয়ে দিল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ওনাকে কাঁদার সময় দিলাম। মহিলা একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে নার্সকে পাশের ঘরে অপেক্ষা করতে বললেন। নার্স চলে যেতেই উনি ওনার শীর্ণকায় ডানহাত দিয়ে আমার বাঁ-হাতটা চেপে ধরলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী হতে চলেছে। উনি বলে উঠলেন –“ডাক্তার আমি আর পারছি না। আর পারছি না।”

আমি একটু অবাক হলাম যে, উনি ওনার শারীরিক যন্ত্রণাতে কষ্ট পাচ্ছেন নাকি অন্য কিছু ?

মহিলা ওনার রুমালটা হাতে নিলেন। চোখদুটো মুছে খুব কষ্ট করে একটা জোরে নিশ্বাস নিলেন। তারপর আমার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরলেন।

বললেন—“ডক্টর, দয়া করে আপনি আমার বাচ্চাটাকে পৃথিবীর আলো দেখান। তারপর আমি মারা গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ওকে মারবেন না।”

বলেই উনি অসম্ভব কাশতে শুরু করলেন। আমি ডান হাত দিয়ে আমার নিজের মুখেও চাপা দিলাম।

তখন বিষণ্ণ বাগানে শরতের মাঝ-দুপুরের স্তব্ধতা। একটা কেমন মন কেমন করা পরিবেশ তৈরি করল।

এরপর মহিলা কাশির দমক সামলে যা বললেন আমি হতবাক হয়ে গেলাম।

ওনার বয়ানেই বলি: “আমি জানি আপনি আমার কথার ধরনে অবাক হচ্ছেন। কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই বাচ্চাটাকে জন্ম দিয়েই এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে চাই। কেন জানেন? আজ আমি আপনাকে বলছি আমার অনাগত সন্তানকে এই পৃথিবীতে আনতে চাওয়ার একমাত্র কারণ আমার স্বামী। তাই আপনার সাহায্য চাই। সেইজন্য আমি আজ সব কথা আপনার কাছে বলব। মৃত্যুর আগে কাউকে সব বলাটাও দরকার। ডাক্তার আমাদের বিবাহিত জীবন একদমই সুখের ছিল না। বিয়ের পরের কিছুদিন অবশ্যই আমারা খুব সুন্দর কাটিয়েছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে বিভেদ এল। আমার স্বামী অতিরিক্ত মাত্রায় বেহিসাবি মানুষ ছিলেন। আমিও খানিকটা উড়নচণ্ডী ছিলাম। কিন্তু আমার স্বামীর স্বভাব সহ্যের সীমার বাইরে ছিল।

এরপর আমার স্বামীর তার পছন্দসই একজন মহিলার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং সে ওই মহিলার বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। আমি একটুও বিরক্ত হইনি। বরঞ্চ যেন স্বস্তির নিশ্বাসই ফেলেছিলাম। হঠাৎ করেই দেখি আমার স্বামী আবার বাড়িতে ফিরে এল আর আমার সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে চাইত। আমার তখন এক অদ্ভুত প্রতিহিংসা স্পৃহা জাগল। ভাবলাম এই সুযোগ। ওকে জব্দ করতে হবে। এরমধ্যে অভাবনীয় ভাবেই আমি সন্তানসম্ভবা হই। বিয়ের পাঁচ বছর পরে প্রথম সন্তান সম্ভাবনা। স্বভাবতই আমার খুশীই হবার কথা। কিন্তু আমি একদমই আনন্দিত হলাম না। যখনই ভাবতাম এটা তো ওই পাজি বাজে লোকটার সন্তান, আমার মাথাটা গরম হয়ে যেত। ভাবতাম এটাও তো আমার এক শত্রুই জন্মাবে। তখন আমি গর্ভপাতের কথাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এটা ওটা করতে করতে দেরি হয়ে গেল আর আমার যক্ষা ধরা পড়ল। সেই সময়ে আমি যে ডাক্তরের চিকিৎসাধীন ছিলাম উনিও আমাকে গর্ভপাতের পরামর্শই দিয়েছিলেন। বাচ্চাটার অসুস্থ জন্মাবার সম্ভাবনা ও আমার মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই ডাক্তার এই পরামর্শ দিয়েছিলেন তা আমি বুঝেছিলাম। তাই গর্ভপাতের সিদ্ধান্তই নিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মনে হল–যদি বাচ্চাটা জন্মায় তা হলে তার অসুস্থ হবার একটা সম্ভাবনা আছে। এছাড়াও বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবার পরেও যদি আমি বেঁচে থাকি তো আমিও চিররুগ্ন থাকব।”

মহিলা খানিকক্ষণ চুপ করে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিলেন। আমার ভয় হল এরপরে মহিলা কী বলবেন, আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন কিনা?

মহিলা আবারও বলা শুরু করলেন—“ডক্টর, আমি যে বাচ্চাটাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাইছি তার কারণ কিন্তু আমার মাতৃত্বের অনুভূতি নয়। তার কারণ, যদি বাচ্চাটা অসুস্থ জন্মায় তাহলে, আমি বেঁচে থাকি বা না থাকি, সেটা আমার স্বামীর সারা জীবনের জন্য একটা যন্ত্রণার কারণ হবে। প্রসঙ্গত, যেদিন থেকে আমি শয্যাশায়ী সেদিন থেকেই আমার ছোঁয়াচে অসুখের দোহাই দিয়ে বাড়ির বাইরের এই আউট্ হাউসে থাকতে দিয়েছে আর মনে মনে আমার মৃত্যুর দিন গুণছে। সেইজন্যই আমার আরও মনে হচ্ছে এই নিষ্ঠুর মানুষটাকে কত রকম ভাবে কষ্ট দেওয়া যায়। কিন্তু একজন শয্যাশায়ী অসুস্থ মানুষ কীভাবে অন্যের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে? তাই ভাবলাম বাচ্চাটা যদি এই প্রতিশোধ নিতে পারে। একটা সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে।”

মহিলার চোখদুটো তখন ঠিক যেন একটা শিকারি বেড়ালের মতো জ্বলজ্বল করছিল। আমার সারা শরীরে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি ওনার চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিলাম।

“ডক্টর”—মহিলা খুব জোরে ডেকে উঠলেন। তারপর তার অতি দুর্বল সরু ডানহাতটা কোনো রকমে তুলে তাঁর কপালের সোজাসুজি দেওয়ালে আঙুল তুলে একটা বাঁধানো ছবি দেখালেন। আমি এতক্ষণ লক্ষ করিনি ওই বাঁধানো ফ্রেমে উকিইয়ো-এ পেইন্টিং স্টাইলের একটা নীল রাক্ষসের আইজুরি পেইন্টিং এর ছবি লাগানো আছে। রাক্ষসের নীল মুখ এক অসম্ভব রকম ভয়াবহ পরিবেশের সূচনা করেছে।

“ডক্টর”—মহিলা আবার বলা শুরু করলেন।

“এই রাক্ষসের ছবিটা আসলে আমার বাপের বাড়িতে ছিল। এবং আপনি যেমন দেখছেন ঠিকই এটা হোকুসাই -এর আঁকা ও সই করা। এটা আমি আমার বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে পেয়েছিলাম এক অদ্ভুত সংস্কারের বশে। ওটা আমার বৈবাহিক জীবনের রক্ষা-কবচ হিসাবে থাকবে এটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু এটাকে আমি এখন ঠিক উলটোভাবে কাজে লাগাব।” একজন অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো বলে উঠলেন–“আমি একটা বইতে পড়েছিলাম যে, গ্রীসের এক রানী যখন সন্তান-সম্ভবা ছিলেন তখন একজন কুৎসিত দর্শন কালো মানুষের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ফলস্বরূপ তিনি একটি কালো-কুচ্ছিত সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। ডাক্তার আমিও এই উপায়ই কাজে লাগাতে চাই প্রতিশোধ নেবার জন্য। আমি তাই দিন-রাত ওই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি, যাতে আমারও ওই রকম রাক্ষসটার মতো ভয়ংকর দেখতে কোনো বাচ্চা জন্ম নেয়। যদি সত্যিই আমার মনোবাসনা মতো এক কুৎসিত সন্তানের জন্ম হয়, তাহলেই আমি আমার স্বামীর ওপর যোগ্য প্রতিশোধ নিতে পারব। সারা জীবন ধরে ওই অমানুষিক চেহারার আত্মজকে দেখে যেতে হবে। তার রাক্ষুসে স্বভাব সহ্য করতে হবে। কিন্তু বাচ্চাটা যদি মারা যায় তাহলে কিছুই হবে না। আমারও স্বামীকে জব্দ করা হবে না। ডাক্তার আমাকে সাহায্য করুন, ওকে জন্মাতে দিন।” মহিলা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতেই দু-হাত জড়ো করে আমাকে আবারও বাচ্চাটাকে বাঁচানোর আকুতি জানালেন।

আমি কী বলব, কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কারণ বাচ্চাটা জন্মালেও সে যে রাক্ষসের মতো চেহারা বা স্বভাব নিয়ে জন্মাবে তা তো আর নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাই হোক, এই সময় এই রকম হিস্টিরিক এক প্রসূতিকে এসব বোঝাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনও তো হতে পারে যে, মহিলা তাঁর নিজের উড়নচণ্ডী জীবনের জন্যেও অনুতপ্ত বলে এইসব অপ্রকৃতস্থ চিন্তা-ভাবনা করছেন। মানুষের আবেগ তো আর অঙ্ক মেপে হয় না। তাই আমি আর সব চিন্তা ছেড়ে প্রসূতি যাতে সুস্থভাবে প্রসব করাতে পারে তার ব্যবস্থা করে মহিলাকে যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।

পরদিন সকালে মহিলার থেকে ফোন পেলাম। তাঁর প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। আমি যেন তক্ষুনি ওদের বাড়ি যাই। একটু অবাক হলাম। এত তাড়াতাড়ি তো হবার কথা নয়। হয়তো বা প্রসূতির শারীরিক অবস্থার জন্য এমনটা হল। ওনার বাড়িতে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় মহিলার স্বামী আমাকে সম্ভাষণ করলেন।

—“ডক্টর আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি তো বুঝেছেন যে, আমার স্ত্রী কী রকম হিস্টিরিক হয়ে উঠেছেন। আমাকে বা যে ডক্টর প্রথম থেকে ওনাকে দেখেছিলেন কাউকেই ওর কাছাকাছি ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। ওনার ইচ্ছে অনুযায়ী আপনার সাহায্য আমরা চেয়েছি। দয়া করে ওকে একটু কষ্ট থেকে রেহাই দিন।” ভদ্রলোক কিন্তু এত মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তাঁর সচিব সুলভ আভিজাত্য থেকে সরেননি।

আমি কোনো রকমে ওনাকে প্রতি-সম্ভাষণ করে দৌড়ে গেলাম ওই আউট-হাউসের দিকে, যেখানে গতকাল মহিলাকে দেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে যাবার সময়টুকুর মধ্যেই ভাবলাম এত ভদ্র, পরিশীলিত একজন মানুষ কী করে তাঁর স্ত্রীর কাছে এত ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠতে পারেন?

আউট-হাউসে গিয়ে দেখি নার্স আরও একজন ধাত্রীকে সাথে নিয়ে প্রসবের সমস্ত ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন করেছেন। প্রসূতি আমাকে দেখে বেশ খুশি হলেন বলে মনে হল। আমার, ঘরে ঢুকেই সেই ছবিটার দিকে চোখ চলে গেল। ভাবলাম কী জানি হয়ত বা আজকে সত্যিই কোনো অতি-প্রাকৃত ব্যাপার প্রত্যক্ষ করব। ওই রকম হিংস্র দানবাকৃতি এক মানব সন্তানের জন্ম হবে হয়তো আমার হাতেই যেমন ওই সন্তানের মা চাইছেন।

কিন্তু লক্ষ করলাম প্রসূতির ঠোঁট একটু বেগুনি। তাড়াতাড়ি একটা ইন্‌জেকশন দিলাম। পাল্‌সের গতি খুব ধীর। ভয় হল বাচ্চাটিকে পৃথিবীতে আনার আগেই না মহিলা চলে যান। কিন্তু অদম্য মনের জোরের জন্যই হোক বা মিরাকেলই হোক প্রসবের সময় এসে গেল।

মহিলার সারা কপালে সাদা সাদা ঘামের বিন্দুতে ভরে গেল। উনি দাঁত চেপে প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে চলছিলেন। কিন্তু চোখে-মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। মানুষের জেদ সফল হলে যে আনন্দ দেখা যায় তা প্রকাশ পেল। বাচ্চাটা ধীরে ধীরে পৃথিবীর আলো দেখার প্রস্তুতি নিল। অবশেষে আমি সেই আর্তনাদ শুনতে পেলাম যেন একটা বাঁশের থালার সাথে রূপোর থালার ঘষার আওয়াজ। আমার চোখ স্বাভাবিক ভাবেই শিশুটির দিকে চলে গেল। একটি ফুটফুটে কন্যা-সন্তান। কোনো রকম অস্বভাবিকতা তার চেহারায় দেখা গেল না। তার গায়ের রং বা মুখের চেহারা কোনোটাই দানবচিত নয়, যেমনটা তার মা চেয়েছিলেন। এবং সেটাই স্বাভাবিক ছিল। যদিও ন-মাসে সে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হল, কিন্তু তুলনামূলকভাবে সে যথেষ্ট সুস্থ ও সজীব। মার দেহ থেকে বেরিয়েই বেশ অনায়াসে হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করে চলেছিল।

আমি খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাব, তখনই একটা “উহ”–একটা ক্ষীণ কাতরানির আওয়াজে মহিলার দিকে তাকিয়ে দেখি ওনার চোখ অনিয়ন্ত্রিত ঘোরাফেরা করছে। ঠোঁটদুটো নিষ্প্রভ হবে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ইন্‌জেকশন দিলাম। কিন্তু আমার সব চেষ্টাকে হারিয়ে মহিলা না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন। আমি অবশ্য এই মৃত্যুতে খুব একটা হতাশ হলাম না। প্রথমত এই মৃত্যুটা খানিকটা জানাই ছিল। আরও মনে হল যে, এ একরকম ভালোই হল মহিলা তাঁর সন্তানকে দেখার আগেই চলে গেলেন। ওনার আশানুযায়ী সন্তানের চেহারা হয়নি দেখে হয়তো খুবই হতাশ হতেন। কিন্তু আমার মনে হয় মহিলা সংজ্ঞাহীন হবার আগে হয়তো বাচ্চার কান্নার আওয়াজটা শুনেছিলেন। আর ওই আওয়াজটা শুনে যখন বুঝলেন তাঁর ঈপ্সিত সন্তান পৃথিবীতে এসেছে তখনই একটা স্বস্তির বোধই মনে হয় ওনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিল।

নার্স এবং ধাত্রী দুজনেই মহিলার মৃত্যুতে খুবই দুঃখিত হলেন। তাঁরা মায়ের দুই পায়ের মাঝে শুয়ে থাকা শিশুটির নাড়ী কাটার দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন। আমি ওদের গরম জলের পাত্র তৈরি করতে বলে একজনকে পাঠালাম ওদের বাড়িতে সচিবকে সুসংবাদ, দুঃসংবাদ দুটোই দেবার জন্য। তারপর আমি নিয়ম অনুযায়ী শিশুটির চোখকে কোনো রকম সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ‘সিলভার নাইট্রেটের’ ড্রপ দেবার জন্য চোখটা একটু ফাঁক করলাম।

এ সময় আমি বোধহয় একটা অস্ফুট চিৎকার করে চমকে সরে আসি।

সবাই শুনুন, যে মেয়েটির জন্ম হয়েছিল তার চোখ সত্যিই অস্বাভাবিক রকমের নীল ছিল।

আমি অজান্তেই হোকুসাইয়ের ছবির দিকে তাকালাম।

সেই নীলের ছাপ কি সত্যিই শিশুর চোখের রঙকে প্রভাবিত করেছিল?

যা হোক, ঠিক সেই মুহূর্তে, আমার এটিকে একটি অতিপ্রাকৃত কারণ ভাবার চেয়ে অন্য আরও সাধারণ, আরও বাস্তবসম্মত কারণ ভাবতে সংকোচ হয়েছিল।

মহিলা কি পারলেন তাঁর স্বামীর ওপর প্রতিশোধ নিতে, যেভাবে উনি চেয়েছিলেন? হোকুসাই-এর ছবির প্রতিফলন না অন্য কিছু? বুঝলাম না। এভাবে ভাবতে ভাবতে যখন মৃতার মুখের দিকে তাকালাম, তখন মনে হলো তার ঠোঁটের চারপাশে ধূর্ত হাসির ছায়া আছে, সম্ভবত তার দুষ্ট মানসিকতার ছাপ মৃত্যুর পরেও রয়ে গিয়েছে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *