জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১২ )

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১২ )

শেয়ার করুন

পর্ব–বারো

অধ্যায়–২

মায়ের সঙ্গে বাড়ি বিক্রি করতে যাওয়ার দিন আমার সেই সব ঘটনার কথা মনে পড়ছিল যা ছোটোবেলায় আমাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু কোন্ ঘটনাটা যে আগে ঘটেছে আর কোন্‌টা পরে, তা ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। আর আমার জীবনে তাদের সত্যিই কোনো ভূমিকা আছে কিনা সে সম্বন্ধেও নিশ্চিত ছিলাম না। এমনকি তখন আমি এও বুঝতে পারিনি যে কলা কোম্পানির মেকি বাড়বাড়ন্তের সময় আমার বাবা-মা’র বিয়ে আসলে সেই ঘটনাপ্রবাহেরই একটি অংশ ছিল যা পরবর্তীকালে আরাকাতাকার অবক্ষয়ের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতবে। যেদিন থেকে আমার জ্ঞান হয়েছে সেদিন থেকেই শুনে এসেছি, বারংবার শুনেছি–প্রথমে চুপিচুপি, তারপরে উচ্চৈস্বরে, সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে–সেই এক ভবিষ্যৎ বাণী, ‘কোম্পানি নাকি চলে যাবে বলছে’। কিন্তু লোকেরা হয় সেটা অবিশ্বাস করত, নয়তো তার পরিণতির কথা ভাবার সাহস তাদের ছিল না।

সেই ঘটনাটা আমার মা যেভাবে বর্ণনা করতেন তাতে সংখ্যাটা ছিল খুব কম। অথচ বিপরীতে আমার কল্পনায় তার ব্যাপ্তি এত বিরাট ছিল যে আমি বস্তুত হতাশাই বোধ করতাম। অনেক পরে যখন প্রত্যক্ষদর্শী ও যারা সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং খবরের কাগজের আর্কাইভ ও সরকারি নথি খুঁজে দেখেছি, তখন বুঝতে পেরেছিলাম যে আসলে কোনো পক্ষই সত্য কথা বলেনি। সরকার অনুগামীরা বলেন কেউ মারা যায়নি। আর যাঁরা তাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে তাঁরা গলার স্বর না কাঁপিয়ে জোরের সঙ্গে বলেন মৃত্যুর সংখ্যা একশোর কিছু বেশি। এমনকি তাঁরা দেখেছেন যে প্লাজার উপর রক্তাক্ত অবস্থায় মৃতদেহগুলো পড়ে ছিল। তারপর একটা মালগাড়ি করে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে পচা কলার মতো সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ফলত আমার সত্য এই দুই চূড়ান্ত অবস্থানের সম্ভাবনাহীনতার মধ্যে চিরতরে হারিয়ে যায়। কিন্তু ঘটনাটা এমনই নাছোড়বান্দার মতো আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে যে শেষ পর্যন্ত একটি উপন্যাসে এই গণহত্যার কথা লিখি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সহ। তার সঙ্গে ছিল এক ভয়াবহতার আবহ, ঠিক যে ভয়ের সঙ্গে ঘটনাটি আমার কল্পনায় দীর্ঘদিন জাগরুক ছিল। এভাবেই আমার বর্ণনায় মৃতের সংখ্যা পৌঁছে যায় তিন হাজারে–ঘটনাটির অভিঘাতের গুরুত্ব বজায় রাখতে। তবে শেষ পর্যন্ত জীবনের বাস্তব আমার সঙ্গে সুবিচার করল: কিছুদিন আগে, এই গণহত্যার এক বর্ষপূর্তি উদযাপনে সেই সময়ের সেনেটের স্পিকার এক মিনিটের নীরবতা পালন করতে বলেন রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিহত ওই তিন হাজার অজ্ঞাতনামা মৃতের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

কলা কোম্পানির এই গণহত্যা[১] ছিল পূর্বে সংঘটিত বহু হত্যার এক চূড়ান্ত পরিণতি। এক্ষেত্রে শুধু সংযোজন করা হয় যে নেতারা কম্যুনিস্ট এবং সম্ভবত তাই ছিলেন তাঁরা। সবথেকে বিখ্যাত ও নির্যাতিত হওয়া নেতা এদুয়ার্দো মায়েচার সঙ্গে বাররানকিয়ার মোদেলো জেলে ঘটনাচক্রে আমার দেখা হয়। এটা সেই সময়ের কথা যখন আমি মায়ের সঙ্গে বাড়ি বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। এদুয়ার্দো মায়েচাকে নিকোলাস মার্কেসের নাতি হিসাবে নিজের পরিচয় দিতেই তাঁর সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তিনিই আমাকে বলেন যে আমার দাদু মোটেই নিরপেক্ষ ছিলেন না, বরং ১৯২৮ সালের ধর্মঘটের একজন মধ্যস্থতাকারী ছিলেন এবং তিনি দাদুকে সৎ মানুষ হিসাবেই গণ্য করেন। তিনি আমার কাছে যেভাবে গণহত্যার ব্যাখ্যা করেছিলেন তাতে ঘটনাটি সম্পর্কে আমি আগে যা জেনেছি, বুঝেছি তা সম্পূর্ণতা পায় এবং সে ঘটনার সামাজিক অভিঘাত সম্বন্ধেও অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ ধারণা আমার মধ্যে গড়ে ওঠে। সকলের স্মৃতির মধ্যে যে একটি মাত্র বিষয় নিয়ে অসামঞ্জস্য ছিল তা হল মৃতের সংখ্যা। তবে সে যাই হোক, আমাদের ইতিহাস সম্বন্ধে এটাই তো আর একমাত্র অজানা রহস্য নয়!

ঘটনাটি সম্বন্ধে এত রকমের ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য পাওয়াই আমার স্মৃতি-বিচ্যুতির প্রধান কারণ। সেই ভুল স্মৃতির মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী ছিল তা আমার নিজেকে নিয়েই। মনে পড়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির দরজায়, মাথায় প্রুশিয়ার হেলমেট আর হাতে ছোটো খেলনা বন্দুক। আমি দেখছি একদল ঘর্মাক্ত কাচাকো বাদাম গাছের তলা দিয়ে মার্চ করে যাচ্ছে। তাদের প্যারেডের মধ্যে ইউনিফর্ম পরা কম্যান্ডিং অফিসারদের একজন আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমাকে সম্ভাষণ করে বলল:

—‘বিদায়, ক্যাপ্টেন গাবিতো[২]।’

স্মৃতিটা খুবই স্পষ্ট, কিন্তু তা সত্যি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেই ইউনিফর্ম, হেলমেট ও খেলনা বন্দুক সবই ছিল, শুধু ধর্মঘটের বছর দুয়েক পরে ছিল, যখন কাতাকায় আর কোনো সেনাবাহিনী ছিল না। এই ধরনের অনেকগুলো ঘটনার ফলে বাড়িতে আমার বদনাম হয়ে গেল যে আমার গর্ভাবস্থার স্মৃতি মনে আছে আর আমি এমন সব স্বপ্ন দেখি যা ভবিষ্যতে ফলে যায়।

এইরকম পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে আমি নিজের পরিবারের আবহ সম্বন্ধে সচেতন হতে শুরু করি। তাই সেই বাড়ির কথা মনে করলে আমার স্মৃতিতে শুধু জেগে ওঠে এক বিরাট বড়ো বাড়ির নিঃসঙ্গতার মধ্যে বিধৃত কিছু দুঃখ, স্মৃতিবিধুরতা আর অনিশ্চয়তা। অনেক বছর ধরে আমার মনে হত জীবনের ওই পর্বটা আমার কাছে যেন প্রতি রাত্রের দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হয়েছে। কেন-না সেই সাধু-সন্তদের মূর্তি দেওয়া ঘরে যে ভয় আমি পেতাম সেই একই ভয় নিয়ে প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙত। কিশোরবেলায় স্কুল-হস্টেলে আন্দেসের শীতার্ত ঘরে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতাম। এই অনুতাপহীন বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছনোর পর তবেই আমি বুঝতে পেরেছি যে কাতাকার বাড়িতে দাদু-দিদিমার একমাত্র কষ্ট ছিল সারাক্ষণ স্মৃতিকাতরতায় ডুবে থাকা এবং তাঁরা যত বেশি তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করতেন তত বেশিই তাতে নিমগ্ন হয়ে যেতেন।

আরও সহজ করে বললে বলতে হয় যে দাদু-দিদিমা কাতাকায় থাকতেন ঠিকই কিন্তু মনে মনে বাস করতেন পাদিয়া প্রদেশে। তখনও পর্যন্ত আমরা জায়গাটাকে শুধু ‘প্রদেশ’ বলতাম, আর বেশি কিছু বলার দরকার পড়ত না, যেন সেটা ছাড়া অন্য কোনো প্রদেশের অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল না। হয়তো সচেতনভাবে ভেবে করেননি, কিন্তু কাতাকায় যে বাড়ি তাঁরা তৈরি করেছিলেন তা ছিল বাররানকাসের বাড়ির অবিকল প্রতিরূপ। বাররানকাসের সেই বাড়ির যে কোনো জানলা দিয়ে তাকালেই দেখা যেত রাস্তার ওপারের এক সমাধিক্ষেত্র, যেখানে মেদার্দো পাচেকো চিরশয্যায় শায়িত ছিল। যদিও কাতাকায় তাঁদেরকে সবাই ভালোবাসত এবং বেশ ভালোই ছিলেন সেখানে, কিন্তু তাঁদের জীবন উৎসর্গীকৃত ছিল সেই মৃত্তিকার সেবায় যেখানে তাঁরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা নিজেদেরকে ঘিরে রেখেছিলেন শুধুমাত্র নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস ও বদ্ধমূল ধারণার সীমারেখায়, তার বাইরে যা কিছু ভিন্ন, যা কিছু অন্যরকম, তাদের জন্য তাঁদের দরজা ছিল পুরোপুরি বন্ধ।

সেই প্রদেশ থেকে যারা এসেছিল তারাই সবার আগে দাদু-দিদিমার কাছের বন্ধু হয়ে উঠতেন। গত শতাব্দীতে তাঁদের পূর্বপুরুষরা স্পেন থেকে ভেনেসুয়েলা হয়ে যে ভাষা বয়ে এনেছিলেন সেই ভাষাতেই তাঁরা বাড়িতে কথা বলতেন। তবে তার সঙ্গে একটু একটু করে মিশে গিয়েছিল ক্যারিবিয়ার আঞ্চলিক ভাষা, দাসদাসীদের আফ্রিকার ভাষা ও গুয়াহিরো[৩] ভাষার কিছু টুকরো-টাকরা। অনেক সময়েই দিদিমা আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এই সব ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে পরিচারিকাদের সঙ্গে থাকার ফলে ওই সব কথা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারতাম। এখনও অনেক কথা আমার মনে আছে: atunkeshi–আমার ঘুম পেয়েছে, jamusaitshi taya–আমার খিদে পেয়েছে, ipuwots–গর্ভবতী মহিলা, aríjuna–বিদেশি – এই শব্দটি দিদিমা ব্যবহার করতেন স্পেনীয় ও সাদা চামড়ার মানুষদের বোঝাতে, এক কথায় শত্রু। অন্যদিকে গুয়াহিরোরা একধরনের অপভ্রংশ স্প্যানিশ ব্যবহার করত, ঠিক যেমনভাবে চোন কথা বলত। তবে মাঝে মাঝে তার মধ্যে থাকত শুদ্ধ স্প্যানিশের ঝলক আর কিছু অকথ্য শব্দ। দিদিমা চোনকে ওই সব কথা বলতে বারণ করতেন কেন-না সব সময়েই তার ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যেত।

সেই দিনটা অসম্পূর্ণ থেকে যেত যেদিন বাররানকাসে কার বাচ্চা হয়েছে বা ফোনসেকায় ষাঁড়ের লড়াইয়ে কতজন ষাঁড় মারা গেছে কিংবা মানাউরেতে কার বিয়ে হল কি রিওয়াচায় কে মারা গেল অথবা সান হুয়ান দেল সেসারে যে জেনারেল সোকাররাস খুব অসুস্থ ছিলেন তিনি কেমন আছেন, এইসব খবরগুলো কাতাকার বাড়িতে এসে না পৌঁছত। কলা কোম্পানির পাইকারি বাজারে সস্তায় বিক্রি হত টিস্যু কাগজে মোড়া ক্যালিফোর্নিয়ার আপেল, বরফে রাখা লাল স্ন্যাপার মাছ, গালিসিয়ার হ্যাম, গ্রীসের অলিভ। কিন্তু বাড়িতে একমাত্র সেই সব জিনিসই খাওয়া হত যা স্মৃতিবিধুরতার রসে জারিত: রিওয়াচার গুড়ি কচুর ঝোল, জলখাবারের জন্য ফোনসেকার ভুট্টার কেক, লা গুয়াহিরার[৪] নুন খেয়ে বড়ো হওয়া ছাগল বা দিবুইয়া থেকে আনা জ্যান্ত কচ্ছপ ও গলদা চিংড়ি।

একইভাবে ট্রেনে করে প্রতিদিন যেসব অতিথি আসত, তারা হয় ওই প্রদেশের লোক বা সেখানকার কেউ তাদের পাঠিয়েছে। একই ধরনের পদবী হত তাদের: রিয়াস্কো, নোগেরা, ওবাইয়ে আর প্রায়শই তাদের যোগ থাকত দুই পবিত্র সম্প্রদায় কোতেস ও ইগুয়ারানদের সঙ্গে। তারা কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে আসত এবং আসার কথা আগে থেকে বলা না থাকলেও এটা অবধারিত ছিল যে তারা দুপুরে খেয়ে তবে যাবে। দিদিমা রান্নাঘরে ঢুকে প্রথম যে কথাটা নিয়ম করে বলতেন তা আমি আজও ভুলতে পারি না: ‘সব কিছু রান্না করতে হবে, যারা আসছে তাদের কার কোন্‌টা ভালো লাগবে তা জানা নেই।’

একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক বাস্তবের মধ্যে আধৃত ছিল তাঁদের এই পালিয়ে যাওয়ার অনন্ত ইচ্ছা। কলোম্বিয়ার ক্যারিবিয়ায় সান্তা মার্তার সিয়েররা নেবাদা পাহাড় ও পেরিহা পাহাড়ের মধ্যবর্তী উর্বর গিরিখাতের মধ্যে অবস্থিত সেই প্রদেশের ছিল একটি স্বতন্ত্র ও নিজস্ব জগৎ এবং প্রাচীন ও দৃঢ়প্রোথিত সাংস্কৃতিক আবহ। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে এই প্রদেশের সংযোগ ছিল অনেক বেশি সহজ। কেন-না হামাইকা ও কুরাস্কোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকায় এখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে অনেক বেশি০ মিল ছিল আন্তিয়াস দ্বীপপুঞ্জের। আবার ভেনেসুয়েলার সীমান্তের উন্মুক্ত প্রবেশদ্বার যেহেতু শ্রেণী বা রং কোনো কিছুই বাছ-বিচার করত না তাই তাদের জীবনযাপনের সঙ্গেও এদের জীবনযাত্রাকে প্রায় আলাদা করা যেত না। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে, যেখানে তখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, সেখান থেকেও ক্ষমতার মরচে পড়া উপরিতল–আইন, কর, সেনাবাহিনী বা খারাপ খবর আড়াই হাজার মিটার উচ্চতায় উদ্ভূত হয়ে মাগদালেনা নদী দিয়ে কাঠের আগুনের বাষ্পীয় পোতে করে আট দিনের যাত্রার পর এই প্রদেশে এসে প্রায় পৌঁছতই না বলা যায়।

ফলত এই আত্মগত প্রকৃতি জন্ম দিয়েছিল এক স্বতন্ত্র বদ্ধ সংস্কৃতির যা দাদু-দিদিমা কাতাকায় প্রয়োগ করেছিলেন। আমাদের বাড়িটা যেন একটা গৃহ নয়, গোটা একটা গ্রাম। খাবার টেবিলে সবসময়ই অনেকজন খেতে বসত। তবে আমার তিন বছর বয়স হবার পর থেকে সবার আগে যে বিশেষ দুজন খেতে বসত তারা হলাম দাদু ও আমি: দাদু টেবিলের মাথায় আর আমি ঠিক তাঁর ডান দিকের কোণে। বাকি চেয়ারগুলোয় প্রথমে বসত ছেলেরা, পরে মেয়েরা, তবে কখনোই একসঙ্গে নয়। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হত ২০ জুলাই, স্বাধীনতা দিবসের উৎসবের দিন। যতক্ষণ না সবার খাওয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত চলত মধ্যাহ্নভোজনের পালা। রাত্রে আর খাবার টেবিল সাজানো হত না। রান্নাঘরেই সবাইকে বড়ো কাপের দুধ-কফি দেওয়া হত, তার সঙ্গে থাকত দিদিমার তৈরি অতুলনীয় পেস্ট্রি। খাওয়া হয়ে গেলে যে যেখানে পারত হ্যামক টাঙিয়ে শুয়ে পড়ত, এক একজন এক এক উচ্চতায়, এমনকি উঠোনের গাছে গাছে পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ত।

সেই সময়ে আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা ঘটেছিল সেই দিন যেদিন একদল লোক একই রকম জামা ও কাঁটা দেওয়া হাঁটু পর্যন্ত জুতো পরে আমাদের বাড়িতে এলেন। তাঁদের সবার কপালে ছাইয়ের ক্রশ আঁকা। তাঁরা সবাই কর্নেলের ঔরসজাত পুত্র–হাজার দিনের যুদ্ধের সময় প্রদেশ দিয়ে যাওয়ার কালে তিনি এঁদের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের শহর থেকে এখানে এসেছেন দাদুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে, তবে মাসখানেকেরও বেশি সময় পরে। বাড়িতে আসার আগে তাঁরা অ্যাশ বুধবারের[৫] প্রার্থনায় গিয়েছিলেন। সেখানে ফাদার আঙ্গারিতা তাঁদের কপালে যে ছাইয়ের ক্রশ এঁকে দিয়েছিলেন তাকে মনে হয়েছিল এক অলৌকিক চিহ্ন এবং সেই রহস্য আমাকে বহু বছর পর্যন্ত তাড়া করে বেরিয়েছিল, এমনকি ওই পবিত্র সপ্তাহের প্রথা সম্বন্ধে জ্ঞান হওয়ার পরেও।

এই সন্তানদের বেশিরভাগেরই জন্ম হয়েছিল দাদুর বিয়ের পরে। মিনা যেদিন থেকে এঁদের জন্মের কথা জানতে পেরেছেন, একটা ছোট্ট খাতায় তাঁদের নাম ও পদবী লিখে রাখতেন। তবে শেষ পর্যন্ত এক বিরল প্রশ্রয়ের সঙ্গে তাঁদের সবার নাম তিনি পারিবারিক তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেন, আর তা করেছিলেন স্বেচ্ছায়, খোলা মনে। তবে সেদিনের সেই কোলাহলমুখর আগমনের আগে পর্যন্ত না মিনা, না অন্য কেউ, কারুর পক্ষেই এই সন্তানদের আলাদা করে চেনা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই দিন তাঁদের প্রত্যেকের অদ্ভুত সব চরিত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। তাঁরা গম্ভীর প্রকৃতির ও পরিশ্রমী। পারিবারিক মানুষ ও শান্তিপ্রিয়। তাই বলে প্রচুর মদ খেয়ে নিজের মাথা উড়িয়ে দিতে যে তাঁরা ভয় পায় এমনটা নয়। সেই দিন তাঁরা খাবারের থালা ভাঙলেন, একটা বাছুরকে চাদরের মধ্যে তুলে নাচাবেন বলে সেটার পেছনে এমন ছুটলেন যে গোলাপের ঝোপ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, কয়েকটা মুরগিকে গুলি করে মারলেন স্টু খাবেন বলে এবং গায়ে তেল মাখানো একটা শুয়োরের দড়ি খুলে দিলেন আর সেটা গিয়ে ধাক্কা মারল বারান্দায় বসে সেলাই করছিল যে মেয়েরা তাদের গায়ে। এতগুলো অঘটন ঘটলেও কেউ কিছু মনে করল না, কারণ তাঁরা সঙ্গে করে আনন্দের ঢেউ নিয়ে এসেছিলেন।

মাঝে মাঝেই আমার সঙ্গে দেখা হত এলবিরা মাসির[৬] যমজ ভাই এস্তেবান কাররিয়োর সঙ্গে। তিনি বিভিন্ন হাতের কাজ করতে পারতেন এবং যেখানেই যেতেন তাঁর সঙ্গে থাকত যন্ত্রপাতির একটা বাক্স। যে বাড়িতে যেতেন সেখানে কিছু ভেঙে গেলে ওই যন্ত্রপাতি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সারিয়ে দিতেন। আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের যে সমস্ত ফাঁক-ফোকর ভর্তি করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল তিনি তাদের সম্পূর্ণতা দিয়েছিলেন তাঁর সুন্দর রসবোধ ও ক্ষুরধার স্মৃতিশক্তি দিয়ে। কিশোরবেলায় মামা নিকোলাস গোমেসের[৭] সঙ্গেও প্রায়ই দেখা করতে যেতাম। তাঁর রং ছিল একেবারে সাদা (ব্লঁদ), তাতে মেচেতার লাল লাল ছোপ। ফুন্দাশিয়োন[৮] শহরের পুরোনো জেলখানায় তাঁর একটা দোকান ছিল আর সেটা নিয়ে খুব গর্ববোধ করতেন। আমার বখে যাওয়ার সব খবরই তিনি রাখতেন আর তাই যখনই তাঁর কাছ থেকে চলে আসতাম এক ব্যাগ ভর্তি করে প্রচুর জিনিস আমার সঙ্গে দিয়ে দিতেন। আরেক মামা রাফায়েল আরিয়াস[৯] সব সময়েই অন্য কোথাও যাওয়ার পথে আমাদের বাড়িতে ঢুকতেন খুব ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে। একটা খচ্চরের পিঠে চেপে আসতেন, পরনে থাকত ঘোড়ায় চড়ার পোশাক। বড়োজোর রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি খাওয়ার মতো সময় তাঁর হাতে থাকত। আর সব মামাদের আমি দেখা পেয়েছিলাম প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায়। তখন আমি সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি এক স্মৃতিকাতর যাত্রার পথ ধরে আমার প্রথম উপন্যাসটি লিখব বলে আর মনে পড়ছে মামাদের কপালে আঁকা সেই ছাইয়ের ক্রশ–আমাদের পরিবারের এক অভ্রান্ত চিহ্ন।

দাদু-দিদিমার মৃত্যুর অনেক বছর পরে যখন বাড়িটাকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখন একদিন আমি রাতের ট্রেনে ফুন্দাশিয়োন গিয়েছিলাম। স্টেশনে তখন একটা মাত্র খাবার দোকান খোলা ছিল। সেখানেই বসলাম। সামান্যই খাবার পড়েছিল দোকানে। কিন্তু দোকানদার মহিলাটি আমার জন্য এক থালা সুন্দর খাবার তৈরি করে দিলেন। তিনি খুব বকবক করছিলেন আর বেশ উপকারীও ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হল তাঁর এই সমস্ত সৎ গুণের অন্তরালে কোথায় যেন আমাদের সম্প্রদায়ের এক দৃঢ় চরিত্রের নারীকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। অনেক বছর পরে জানতে পারি আমার সেই ধারণা সত্যি: সেই সুন্দরী দোকানি সারা নোরিয়েগা[১০] আসলে আমার অচেনা মাসিদেরই একজন।

টীকা

১। গণহত্যা: ইতিহাসের পাতায় ‘Banana Massacre’ নামে পরিচিত। ১৯২৮ সালের ৫ ডিসেম্বরের রাতে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। কলোম্বিয়ার সিয়েনাগা নামক অঞ্চলে আমেরিকার কলা উৎপাদক কোম্পানি ‘ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি’-র শ্রমিকরা উন্নত কাজের পরিবেশের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেন ১২ নভেম্বর। কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে কোনোরকম চুক্তি করতে অস্বীকার করে এবং জোর করে ধর্মঘট তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তৎকালীন রক্ষণশীল সরকার ঘটনাস্থলে মিলিটারি পাঠায় এবং মিলিটারি সেই নিরস্ত্র ধর্মঘটীদের বিচ্ছিন্ন করতে নির্বিচারে গুলি চালায় যার ফলে অনেক শ্রমিক মারা যান। মৃতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে মতদ্বৈধতা আছে। আনুমানিক ৪৭ থেকে ৩৮০০ জন শ্রমিক মারা যান। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসে এই গণহত্যার বিবরণ দিয়েছেন।

২। গাবিতো: গাব্রিয়েলকে ভালোবেসে ছোটো করে ‘গাবো’ বা ‘গাবিতো’ বলা হয়।

৩। গুয়াহিরো: ওয়াইউ বা গুয়াহিরো ভাষা আরাওয়াকান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। ভেনেসুয়েলার উত্তরপশ্চিম ও কলোম্বিয়ার উত্তরপূর্ব অংশের ওয়াইউ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০৫,০০০ আদিবাসী মানুষ এই ভাষায় কথা বলে।

৪। লা গুয়াহিরা: ক্যারিবীয়ান সমুদ্রের উপকূলে কলোম্বিয়ার একটি রাজ্য।

৫। অ্যাশ বুধবার: খ্রিস্টানদের একটি পবিত্র দিন। এই দিন প্রার্থনা ও উপবাস করা হয়।

৬। এলবিরা মাসি: গার্সিয়া মার্কেসের মাতামহ কর্নেল মার্কেসের বিবাহ বহির্ভূত কন্যা। ২০ বছর বয়সে তিনি আরাকাতাকায় আসেন। কর্নেলের স্ত্রী ত্রাঙ্কিলিনা ইগুয়ারান তাঁকে সস্নেহে নিজের মেয়ের মতো দেখাশোনা করেন এবং এলবিরাও তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে সেবা করেছেন।

৭। নিকোলাস গোমেস: কর্নেল মার্কেসের আরেক বিবাহ বহির্ভূত পুত্র।

৮। ফুন্দাশিয়োন: কলোম্বিয়ার মাগদালেনা রাজ্যের একটি শহর।

৯। রাফায়েল আরিয়াস: কর্নেল মার্কেসের আরেক বিবাহ বহির্ভূত পুত্র।

১০। সারা নোরিয়েগা: কর্নেল মার্কেসের বিবাহ বহির্ভূত কন্যা। তাঁর মায়ের নাম পাচা নোরিয়েগা। সারার নাতনি এলিদা নোরিয়েগার কাছে কর্নেলের তৈরি একটি সোনার মাছ ছিল।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২