স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (৬ষ্ঠ পর্ব)
‘স্তব্ধ রেখার পাশে’
ষষ্ঠ পর্ব
How should one paint true weeping after nature? —as it was when someone was dissolving in tears innermost—like weeping of the woman I saw in the hospital for venereal diseases—with the sickly naked baby in her arms. She who had now come to learn that her child was doomed to die from birth…
(The Private Journals of Edvard Munch- edited and translated by J. Gill Holland)
‘কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র! তুই তোর জরার হাত কঠিন বাঁধন দিস। অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র স’রে যাবে। শীতল স’রে যাবে মৃত্যু সরে যাবে। তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে। অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকবো, অন্ধকার হবো।
আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।’ (জরাসন্ধ/ শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘জরাসন্ধ’ কবিতাটির সামনে যখন’ই আসি, দু-তিনবার কবিতাটি পড়বার পর চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে, বর্ষার প্রান্তর পেরিয়ে শুয়ে থাকা এক নয়ানজুলির ছবি। সে নয়ানজুলিটিকে দেখতে চোখ বন্ধ করতে হয় না; চোখ খোলা অবস্থায় আমি দেখতে পাই তাকে।
ধক করে নাকের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে স্নায়ুতে মিশে যেতে থাকে পচা ধানের গন্ধ। সেখানে শুয়ে রয়েছে অন্ধকারের হৃদপিণ্ড; ধুকপুক করছে। অনঙ্গ অন্ধকার থেকে নেমে এসে অনঙ্গ অন্ধকার দিয়ে তৈরি এক মিনি ব্ল্যাকহোল কেঁপে চলেছে।
কিন্তু এ কি শুধু এক অন্ধকার অস্তিত্বের অন্ধকার-যাত্রাপথের ধারাবিবরণ! শক্তি লিখেছিলেন, ‘তোর জরায় ভর ক’রে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি।’ এখানে এসে দীর্ঘক্ষণ থেমে থাকি প্রতিবার, আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি তিনি লিখছেন, ‘তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস।’
মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে দুটি বাস্তবতা, একবার শক্তি লিখছেন ধাত্রী’র জরায় ভর করে অন্ধকারের অস্তিত্ব পাবার কথা, আরেকবার তিনি লিখছেন সে জরার হাতে কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ার কথা।
একই সঙ্গে ঘটে চলেছে দুটি প্রক্রিয়া, জন্মের মূলে যে জরা’র ভূমিকা সে জরা’ই আবার কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ করছে।
মাতৃ ও ধাত্রীভূমিকার এই দ্বৈত সত্তা শক্তি’র কবিতায় এসেছিল। জন্ম যে ‘অন্ধকার’ উপহার দিয়ে গেল তার থেকে মুক্তি নেই যেন, যেন এ এক পারাপারহীন সমুদ্রের ভেতর ভেসে বেড়ানো।
এডভাড মাঞ্চ এক জায়গায় তাঁর সাইকোনিউরোসিসে আক্রান্ত বাবার কথা লিখতে গিয়ে লিখছেন, ‘Form him I inherited the seeds of madness. The angels of fear, sorrow and death stood by my side since the day I was born.’
শৈশব-অবস্থা থেকেই বাবার বিষাদ, অদ্ভুত বিপণ্ণতা থেকে শুরু করে বহু কিছু প্রবেশ করেছিল মাঞ্চ-এর জীবনে। বাবা ক্রিশ্চিয়ান মাঞ্চ-এর জগতের সঙ্গে এডভাড-এর জগতের ভালোবাসা ও ‘ঘৃণা’র সম্পর্ক, সম্পর্কের বিচিত্র রসায়ন বারবার ছায়া ফেলেছিল তাঁর শিল্পে। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, কিন্তু আঠারো-শো তেষট্টি সালের বারোই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করা মাঞ্চ-কে সব থেকে বেশি তাড়িত করেছিল সম্ভবত আঠারো-শো আটষট্টি সালে টিউবারকোলোসিসে মায়ের মৃত্যু।
সারা জীবনে মাঞ্চ-এর নারী সম্পর্কে ‘অদ্ভুত’ কিছু ধারণা ও আচরণ, বারবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া, প্রবল ঘূর্ণি’র মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ও ঘুরে দাঁড়ানো- সবকিছুর মধ্যে হয়তো রয়েছে শৈশবে মায়ের মৃত্যু দেখা।
মাত্র তিরিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধি’তে আক্রান্ত হয়ে লরা’র মৃত্যু মাঞ্চ-এর মধ্যে বুনে দিয়েছিল উদ্বেগ, হতাশা, ‘বিভৎস’ সুন্দরের প্রতি অমোঘ টান ও স্নায়বিক ভঙ্গুরতা। এর হাত থেকে তিনি মুক্তি পাননি কোনও দিন।
মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে মাঞ্চ-কে তাড়া করে গিয়েছিল তাঁর বোনের মৃত্যু’ও। সোফি নামে সে বোন চলে গিয়েছিল সেই দুরারোগ্য টিউবারকোলোসিসে’ই, মাত্র ষোল বছর বয়সে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব মাঞ্চ-এর ছবিতে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে রোগাক্রান্ত শিশু’রা, তাদের মৃত্যুশয্যার সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় নারী-পুরুষ। এই বিপুল বিশ্বের অনন্ত সৌন্দর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে শিশু’র মৃত্যু দেখতে বাধ্য হওয়ার মধ্যে যেন লুকিয়ে রয়েছে নিয়তির খেলা।
মাঞ্চ-এর প্রথম দিকের উল্লেখ্য একটি ছবির কাছে এসে জীবনের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা মৃত্যুর হাহাকার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। শৈশবে মাতৃহারা হওয়া ও কৈশোরে প্রিয় দিদি’কে হারানোর কষ্ট যেন মাঞ্চ-কে বুঝিয়ে দিয়েছিল জীবনে যা কিছু সে আঁকড়ে ধরতে চাইবে, যা কিছুর মধ্যে নিজের আশ্রয় খুঁজবে তাই একদিন তাঁর হাত ছেড়ে অবেলায় বিদায় নেবে। এই স্কন্ধকাটা ভয় মাঞ্চ-কে আজীবন তাড়া করে গেছে। তাঁর ব্যক্তি-জীবনের বহু ঘটনার পিছনে রয়ে গেছে এই উদ্বেগ ও হাহাকার।
১৮৮৫ সালে মাঞ্চ-এর সৃষ্টি ‘দ্য সিক চাইল্ড’ ছবিটিতে সেই হাহাকারেই প্রকাশ।
(দ্য সিক চাইল্ড- ১৮৮৫)
মৃত্যুশয্যার শুয়ে রয়েছে সোফি, টিবি-তে আক্রান্ত কিশোরী। ক্যানভাসের ডানদিকে স্তম্ভের মতো নেমে এসেছে ভারী পর্দা। বাম দিকে সোফি’র পাশে জলের পাত্র, যেন মৃত্যুর কাছে অপেক্ষা করছে জীবনের ইশারা। ব্রাশ স্ট্রোকগুলি এতটাই ভারী যে তা শিল্পীর ক্ষতবিক্ষত, উদ্ভ্রান্ত মনোজগতের ইশারা বহন করছে। স্ট্রোকগুলি শেষ হয়েছে ভার্টিকালি। সোফির মুখ এসে পড়েছে আলোর আভা, এ আলো কি প্রেত-আলো? সোফির বাম হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন যিনি তিনি সম্ভবত তাঁর কাকিমা কারেন।
ছবিটির দিকে আরেকবার তাকানো যাক, এবার আবিষ্কার করা যাবে সোফির মাথার উপর অর্ধচক্রাকারে রয়েছে গবাক্ষের ইশারা অথবা আয়না অথবা বিছানার প্রান্ত। মৃত্যুর চন্দ্রাতপের মতো স্থির হয়ে রয়েছে সেটি, কালো। বৃত্তের অর্ধেক আমাদের দৃষ্টিগোচর, বাকি অর্ধেকের সন্ধান আমাদের জানা নেই। বাকি অর্ধেক সম্ভবত মৃত্যুর প্রকাশ।
এ ছবিটির সব থেকে আশ্চর্য অংশ হল সোফি’র দৃষ্টি।সোফি তার কাকিমার দিকে তাকিয়ে নেই, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে কালো পর্দার দিকে। তা হলে কি সোফি তার নিকট-মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিল?
তুষার চৌধুরী’র একটি লেখায় পড়েছিলাম,
‘মেয়েটি পরীর মতো বেপরোয়া শুয়ে ছিল ঘাসের আড়ালে
অবাধে গজানো লতা জড়িয়েছে ওকে, ওর দেহে কাঁটাফুল
ফুটেছে, ফুলের ক্রুশে বেঁধা সেই মেয়ে
ফণিমনসার ঝাড়ে পোকা ডাকে
চড়ুই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল
মস্ত শাদা প্যাঁচা,
চক্ষু মুদে বসে আস্তানায়, কুঠি ভূতুড়ে নির্জন
কালো মিনিবেড়ালের চড়ুইশিকার আজ দেখেছে মেয়েটি’ (অপূর্ণ)
-সোফি’র শুয়ে থাকার মধ্যে বেপরোয়া ভঙ্গি নেই সঙ্গত কারণেই, কিন্তু মৃত্যুর প্রহর গোনার সময়েও তার মুখ থেকে জীবনের আভা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ভূতুড়ে নির্জন কুঠি’তে শুধু এক মানুষের হাত ছুঁয়ে রয়েছে তার হাত।
একজন্মে দেখাশোনা হল, এক-জন্মের দেখাশোনা শেষ হল। কোটি কোটি তারাদের মাঝখানে একটি সবুজ গ্রহে আমাদের দেখাশোনার প্রহর ফুরিয়ে আসছে।
‘দ্য সিক চাইল্ড’ সৃষ্টির পর্বটি মাঞ্চের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আরও একটি কারণে। ১৮৮৬ সম্ভবত মাঞ্চের জীবনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বছর। সৃষ্টি ও শিল্প আসলে স্বাধীনতার অনুশীলন, ক্রমশ স্বাধীন থেকে অধীকতর স্বাধীন জগতের দিকে চলে যাওয়াই একজন শিল্পীর প্রধানতম লক্ষ্য।
পাবলো পিকাসোর সঙ্গে তাঁর বাবার সম্পর্ক, মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অ্যটাচমেন্ট থিয়োরি দিয়ে ব্যাখ্যা করে শিল্পীর শৈশবের দিনগুলি তাঁকে পরবর্তী সময়ে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল তার সন্ধান করতে চেয়েছেন বহু বিজ্ঞানী ও শিল্প-সমালোচক। মাঞ্চের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে।
মাঞ্চ তাঁর প্রাক-যৌবন পর্যন্ত সরাসরি বাবার বিরোধীতা করতে পারেননি ঠিক কথা, কিন্তু ১৮৮৬-তে লেখক হান্স ইয়াগার-এর নেতৃত্বে একদল শিল্পী-সাহিত্যিক তৎকালীন ক্রিশ্চিনিয়ার রক্ষণশীলতা, বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থা ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ‘ক্রিশ্চিনিয়া’স বোহেমিয়া’ নামে এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
বিস্ময়করভাবে লক্ষ করার, মাঞ্চের বাবা যা যা অপছন্দ করতেন (নাস্তিকতা, উন্মুক্ত প্রেম, মদ্যপান ও অ্যনার্কি) সে সবকিছুতেই তীব্র আস্থা জ্ঞাপন করে ‘ক্রিশ্চিনিয়া’স বোহেমিয়া’র সক্রিয় সদস্য হয়েছিলেন মাঞ্চ। এর ঘটনার পর থেকে বাবার সঙ্গে মাঞ্চের সম্পর্ক আর কোনও দিন স্বাভাবিক হয়নি।
মাঞ্চের শিল্প যে ক্রমশ ব্যক্তিগত অ্যনার্কির দিকে ঝুঁকে যাবে, তা যেন কিছুটা স্পষ্ট হয়ে এসেছিল ১৮৯৩-এ সৃষ্ট ‘দ্য স্টর্ম’ চিত্রটিতে।
(দ্য স্টর্ম- ১৮৯৩)
প্রত্ন-ঝড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারটি মানুষ, মধ্যবর্তী মানুষটি শাদা পোশাকে আবৃত। দূরে আরও তিনজন, ক্যানভাসের ডিপে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাতিজ্বলা বাড়ি। বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি ঝড়ের দাপটে নুয়ে পড়েছে।
সব থেকে আশ্চর্যের, চারজন মানুষই তীব্র আতঙ্কে কান চেপে ধরেছে। পাথুরে প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন মানুষের ভেতর প্রবেশ করছে ঝড়ের গর্জন।
কিন্তু এ ঝড় সম্পূর্ণ প্রতীকী, ব্যক্তি-মানুষের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঝঞ্ঝা মানুষ তীব্রভাবে চাইছে তার প্রকাশকে গোপন রাখতে, কিন্তু পারছে না। ব্যক্তি-মানুষের আর্তনাদ যে একদিন ‘দ্য স্ক্রিম’ ছবিটিতে পরিস্ফূট হয়ে উঠবে, তার ইঙ্গিত যেন রয়ে গেল এ ছবিটিতে।
২
‘ডিসটর্শান’-এর সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক রহস্যময়, মাঝে মাঝে মনে হয় মাতৃসূত্রের মধ্যে নিহিত থাকবে একটি ধ্রুবক, যা তাবৎ ডিসটর্শানের সঙ্গে সামঞ্জস্যতাকে মিলিয়ে দেবে। গোল্ডেন রেশিওর খুব কাছাকাছি অবস্থান করে শিল্পের ডিসটর্শান। এ পথ ধরেই আমাদের কাছে সত্যের থেকেও বেশি সত্য হয়ে ওঠে শম্ভু রক্ষিতের ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’।
এ কাব্যগ্রন্থের ৩৪-তম কবিতাটিতে তিনি লিখছেন, ‘সৌরজগতের মহাকর্ষ ভেদ করে অন্য নক্ষত্রের রাজ্যে সমৃদ্ধ সন্দেহ বাস্তবতা / নাড়ি ক্ষুদ্র ও দ্রুত হয়, কোন খুঁত নেই- বিস্তারিত খবর মেঘবাহী বায়ু / ধনসম্পদের; নিভৃত মানুষের রাজ্য প্রদক্ষিণ সুর রাত্রির ঢেউয়ে ভুল করে।’
কবিতাটির শেষ হয়েছিল এভাবে, ‘যেমন প্লাবন ও রহস্যের মর্মোদ্ধার প্রকৃতির বীজ হয় / নিঃশব্দ নিসর্গ হাওয়ায়; অখিল মহাশূন্য আজ নিরুদ্ধেশ হবে।’
এ তুমুল ব্যক্তিগত অ্যনার্কি’র জগৎ যেন ক্রমশ চলে যাচ্ছে এক ব্ল্যাকহোলের দিকে, যেখানে গিয়ে আমাদের সমস্ত ‘তথাকথিত’ ‘অর্থ সন্ধান করা’ প্রবণতাকে বিসর্জন দিতে হয়।
কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন ও সন্ধান থেকেই যায়… যে অর্থ আমাদের কাছে অধরা অথবা রহস্যময় নীলাভ তারার মতো জ্বলে রয়েছে তার ভেতর কি কোনও মহত্তর ‘অর্থ’ লুকিয়ে নেই? এ কাব্যগ্রন্থেই তো শম্ভু রক্ষিত লিখেছিলেন, ‘যেন অতিক্ষুদ্র মুষিকের মত উপকূলে লোকগুলি কৌশলে অব্যক্ত পাতার / দেহে প্রচ্ছন্ন পাপড়িতে আবিষ্কৃত হয়। মরুভূমির গর্ভে চলে যায় যেন / যেন বায়ুযন্ত্র থেকে তারা ভেসে আসে। যেন বিরাট কোন ঘটনা / মুহূর্তকাল পরেই ঘটবে বা মুহূর্তকাল আগে ঘটে গেছে।’ (৭২-তম কবিতা)
(দ্য স্ক্রিম- ১৮৯৩)
‘দ্য স্ক্রিম’ ছবিটি ও মাঞ্চ সারা পৃথিবীতে সমার্থক হয়ে গেছে। ক্যানভাসটিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।
একদম উপরের দিকের অংশে রয়েছে ঢেউ খেলে যাওয়া মহাজাগতিক আলোর স্রোত। কমলা ও হলুদ রঙের স্রোতের মাঝখানে উঁকি মারছে এক-চিলতে সবুজ। ক্যানভাসের নীচের অংশটিকে ত্রিভুজের অতিভুজ বরাবর ভাগ করলে দেখা যাবে ডান-দিকে জল ও ঢেউয়ের ঘূর্ণি। একটি ব্রিজের ওপর তীব্র আর্তনাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে একটি প্রাণ।
বাম-দিকে দুটি মানুষ এ দৃশ্যের অবাক দর্শক।
ক্যানভাসের উপরের দিকে স্ট্রোকগুলি হরাইজন্টাল, মাঝ বরাবর স্ট্রোকগুলি রূপান্তরিত হয়েছে ভার্টিকালে।
যে মানুষটি দু’হাত দিয়ে কান চেপে ধরে রয়েছে তার চোখে মণি নেই, তার দেহ’ও তরঙ্গের আকৃতি ধারণ করেছে। তার ঠোঁট খোলা, সেও চিৎকার করে উঠতে গিয়ে যেন থমকে গিয়েছে। এ মানুষ কি সারা-পৃথিবী জুড়ে জীবনানন্দ-কথিত শূকরের প্রসব বেদনার মতো চিৎকার আর চিৎকারের বিভৎসতা থেকে রক্ষা করতে চাইছে নিজের সত্তা?
শিল্প যে নির্জনতা দাবি করে তা কি অনবরত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার কাছে?
আধুনিকতার সব থেকে বড় অসুখ, উদ্বেগের স্রোত আছড়ে পড়ছে তার সমস্ত সত্তা জুড়ে। এবার ছবিটির উপরের অংশে তাকিয়ে থমকে যেতে হবে। কারণ একদম বাম-দিকে এসে একটি স্রোত হঠাৎ চোখের আকৃতি ধারণ করে আবার মিলিয়ে গেছে। যেন সমস্ত চরাচর চেয়ে চেয়ে দেখছে ব্যক্তি-মানুষের হাহাকার ও উদ্বেগ। ছবিটির মধ্যে আরেকটি বিষয় রয়েছে, রয়েছে কুণ্ডলীকৃত মোটা দাগের সমাহার। একটি মানুষের সমস্ত অস্তিত্বের উপর চেপে বসছে বাহ্যিক গূঢ় কারণসমূহ। এখান থেকে, এ নরক থেকে পালানোর কোনও পথ আর খোলা নেই।
সারা জীবন পতঙ্গের মতো নারীদের দিকে ছুটে গেছিলেন মাঞ্চ, আবার নারী’ও তাঁর দিকে ছুটে এসেছিল একইভাবে। যৌনতা নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নে তিনি নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে তাঁর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মিলি থালো’র, যিনি তাঁরই এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়র স্ত্রী ছিলেন। সে প্রেম নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না মাঞ্চের মনে, কিন্তু তাঁকে সারাজীবন অভিশাপের মতো তাড়া করে বেড়িয়েছিল টুলা লারসেনের ‘প্রেম’। বেশ কয়েকজন সমালোচকের মতে, সে প্রেম দুঃস্বপ্নের মতো নেমে এসেছিল তাঁর জীবনে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সে কারণে। সে প্রসঙ্গে কিছুটা পরে আসা যাবে, আপাতত ১৮৯৫ ও ১৮৯৬ সালে তাঁর আঁকা দুটি ছবির কাছে ফিরে যাওয়া যাক। ছবি দুটির নাম ‘ইয়ং গার্ল উইথ থ্রি হেডস’ এবং ‘সেপারেশন’।
‘ইয়ং গার্ল উইথ থ্রি হেডস’ ছবিটি দেখতে দেখতে যে কোনও দর্শকের এক মুহূর্তের জন্য ফ্রয়েডিয় যৌনচেতনা ও ইদ-ইগো-সুপারইগোর কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য।
(ইয়ং গার্ল উইথ থ্রি মেল হেডস-১৮৯৫)
ছবিটিতে যে কিশোরী’কে দেখা যাচ্ছে সে এক ভঙ্গুর, প্রত্ন, নারী-শরীরের অধিকারী। ক্যানভাসে মাঞ্চ ব্যবহার করেছেন গাঢ় বাদামী, সবুজ, লালাভ রঙ। কিশোরীটির বসে থাকার মধ্যে আড়ষ্টতা রয়েছে, সে হয়তো তার পিউবার্টি’র আগমন সম্পর্কে সচেতন ও দিশাহারা। ক্যানভাসে জটিল বিন্যাস, তিন-পুরুষের মুখ ক্যানভাস ফুঁড়ে বেরিয়েছে।
মেয়েটি কারও দিকে তাকিয়ে নেই, এবং তিনজন পুরুষের মধ্যে বাম-দিক থেকে দু’জন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নেই। একমাত্র মুণ্ডিতমস্তক, বয়স্ক পুরুষটি চেয়ে রয়েছে মেয়েটির দিকে।
পুরুষের এই দৃষ্টির সামনে মেয়েটি আতঙ্কিত, তার পা-দুটি জড় হয়ে রয়েছে, রয়েছে উরু’র উপরে হাত। মেয়েটি তার যৌনতার প্রকাশকে আড়াল করে রাখতে চাইছে পুরুষদের থেকে।
কিন্তু ছবিটির রহস্যময়তার এখানেই শেষ নয়, একদম বাম-দিকের পুরুষটির চোখ খোলা, কিন্তু সে মেয়েটির সম্পর্কে উদগ্রীব নয়। অধরোষ্ঠ পুরু এবং তার কামুক সত্তাকে সে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে অদ্ভুতভাবে। তার পাশের পুরুষটির চোখ বন্ধ, সে তৃপ্ত- এমনই মনে হচ্ছে। একদম ডানদিকের পুরুষটির বিকৃত মুখ, একমাত্র সেই চেয়ে রয়েছে মেয়েটির দিকে।
এ বিকৃত মুখ কি বিকৃত যৌনতার প্রকাশ? অপ্রাপ্তবয়স্ক’র সঙ্গে যৌন-আকাঙ্ক্ষার অবদমন কি অবদমন থাকছে না এক্ষেত্রে?
জীবনের প্রথমদিকেই মৃত্যু, অসুস্থতা, অসমবয়সী প্রেম ইত্যাদি নিয়ে মাঞ্চের জটিল মনোজগতের প্রকাশ এ ছবি।
ক্যানভাসটির দিকে তাকালে দেখা যাবে, বর্ডার-লাইনের কাছে ডিম্বাকৃতি কয়েকটি গোলকের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। এই ডিম্বাকৃতি বস্তুগুলি কি নারীর ঊর্বরা-শক্তিকে চিহ্নিত করছে? এগুলি কি ডিম্বানুকে মনে করিয়ে দিচ্ছে? সিটে বসে থাকা কিশোরী তার পিউবার্টির স্তর পেরিয়ে ক্রমশ নারী হয়ে উঠছে- এ যেন তারই প্রকাশ।
‘সেপারেশন’ ছবিটি মাঞ্চ সৃষ্টি করেন ১৮৯৬ সালে। ছবিটিতে ক্যানভাসের বামদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন পুরুষ, হতাশা আর বিষাদ তাকে আক্রান্ত করেছে। পুরুষটির পরনের কালো পোশাকের সঙ্গে নারী’র পোশাকের হালকা-হলুদ রঙ কন্ট্রাস্ট তৈরি হয়েছে। লক্ষ্ করার, পুরুষটি তার বুক চেপে রয়েছে যে হাত দিয়ে সে হাত রক্তাক্ত। তার পায়ের কাছে যে গাছের আভাস তাও যেন রক্তগাছ।
পুরুষটিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে এক নারী, তার চুল হাওয়ায় উড়ছে, তার পোশাক ছড়িয়ে রয়েছে দিগন্ত পর্যন্ত।
নারীটির চলে যাওয়া সম্পর্কে সচেতন পুরুষটি, এতটাই সচেতন যে সে ফিরেও তাকাচ্ছে না নারীটির দিকে। নারীটির ছেড়ে যাওয়া ভঙ্গির মধ্যে ঋজুতা আমাদের চোখ এড়াবে না।
এই বিষাদ মাঞ্চের অনিবার্য লক্ষণ। ক্যানভাসটিকে দু-ভাগে ভাগ করলে দেখা যাবে, পুরুষটি যে দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে দিকে সবুজ ও বৃক্ষের আভাস বেশি। জীবনের সমস্ত কিছুর মধ্যে দাঁড়িয়েও নারীটির এই চলে যাওয়াটিকে মেনে নিতে পারছে না পুরুষটি। অপরদিকে নারীটির চলে যাচ্ছে ধূসর থেকে ধূসরতর জগতের দিকে। ক্যানভাসে দুটি ফিগার সৃষ্টি করার সময় মাঞ্চ এখানেও রেখে দিয়েছেন ডিসটর্শান।
(সেপারেশন- ১৮৯৬)
যে প্রেম মাঞ্চ-কে অভিশাপের মতো তাড়া করে ফিরেছিল সে প্রেমের ছায়া পড়েছিল তাঁর ছবিতেও। ১৮৯৮ সালে লাল-চুলের সুন্দরী টুলা লারসেনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল মাঞ্চ-এর। শিল্পীর মনোজগতের মধ্যে যে কী বিচিত্র সব ধারণা কাজ করে যায় তা মাঞ্চ-এর টুলার সম্পর্কে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত থেকে কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব।
মাঞ্চ টুলার সম্পর্কে ভাবিত ছিলেন এবং একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নিজের শিল্পের প্রদীপটিকে রক্ষা করতে হলে টুলার সঙ্গে যৌনসম্পর্কে জড়িয়ে পড়া চলবে না।
লারসেনের সঙ্গে যৌনমিলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাঁর শিল্প। এ অদ্ভুত ধারণার পিছনে যেমন আমাদের বোধগম্য কোনও কারণ নেই ঠিক তেমনই আমাদের বোধগম্যতার বাইরে থেকে যাবে কেন লারসেন শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াতেন। অনিচ্ছুক মাঞ্চ-কে জোর করে ইচ্ছুক করানোই তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। এমনকি পরিচিতদের কাছে মাঞ্চের নামে কুৎসা রটাতে তিনি পিছপা হতেন না।
১৮৯৮ সালে ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ মন নিয়ে মাঞ্চ সৃষ্টি করতে শুরু করেন ‘রেড ভার্জিজিয়া ক্রিপার’।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি বাড়ির মধ্যে আমাদের দৃষ্টি অনিবার্যভাবে আকর্ষণ করবে রক্ত-রঙা বাড়িটি।
চারপাশে কাঠের সীমানা, বাঁকা রাস্তা দিকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে একটি মুখ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটি মুখ।
(রেড ভার্জিনিয়া ক্রিপার-১৮৯৮-১৯০০)
বাড়িটির গঢ় লাল রঙ লারসেনের লাল-চুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, বাড়িটির ভিতর ঘটে যাচ্ছে ভয়ংকর কিছু। এক শিল্প সমালোচক একে চিহ্নিত করেছেন ‘নেমলেস হরর’ হিসাবে।
মাঞ্চের তুলির স্ট্রোক বেশিরভাগ সময়েই বোল্ড, মোটা। এখানেও তাই। মাঞ্চের বিস্ফোরিত দু-চোখে বাসা বেঁধে রয়েছে বিপণ্ণতা ও মৃত্যুভয়। তার পিছন দিকে যে পথের ইশারা তা এক আগুনপথ। এ আগুনপথ দিয়ে হেঁটে যেত যেতে মৃত্যুর কাছাকাছি এসে পৌঁছে গেছেন মাঞ্চ।
লারসেনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে ওঠে, ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাঁকে এতটাই তাড়া করতে থাকে যে তাঁকে স্যানেটোরিয়ামে ভর্তি করতে হয় ১৮৯৯-এ।
৩
‘মাঝে মাঝে স্পষ্ট করে বলা দরকারঈশ্বর আছেন
মগডালে-বসে-থাকা পাপিয়াকে আর
পর্যবসিত বস্তুপৃথিবীকে স্নান করাচ্ছেন।
মাঝে মাঝে স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন
তুমি যে আমার সাধনার ধন,
তুমি চলে গেছ বলে আমাকে গাহন করাবার
কেউ নেই, যত্রতত্র সেরে নিই মধ্যাহ্নভোজন’।
-অলোকরঞ্জনের ‘গাছ’ কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে পড়ছিল মাঞ্চের ‘গলগথা’ (১৯০০) নামক অয়েল-পেইন্টিঙের কথা।
এক সময়ে মাঞ্চের তীব্র বিশ্বাস জন্মেছিল, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। তিনি যে নিটশের প্রতিকৃতি অঙ্কন করবেন তা স্বাভাবিক।
কিন্তু স্যানেটোরিয়ামে বেশ কয়েকমাস অতিবাহিত করবার সময় কি মাঞ্চের মনে ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন ধারণার জন্ম নিয়েছিল!
যদিও যিশু ঈশ্বর নন, ঈশ্বর-পুত্র তবু গলগথা ছবিটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রুশে বিদ্ধ যিশু, ব্যাকগ্রাউন্ডে আকাশ চিরে চলে গেছে রক্তমেঘ। এ মেঘ যিশুর রক্তপাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যিশুর পায়ের কাছে বেশ কিছু অস্পষ্ট মূর্তি। তারা সবাই প্রণত; ক্যানভাসের একদম সামনে সাতটি মানুষের মুখ।
সাত সংখ্যাটি ‘সিন’-ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
কিন্তু সব থেকে আশ্চর্যের, ক্রুশবিদ্ধ ‘যিশু’ কি আসলে মাঞ্চ নিজেই?
প্রতিটি আধুনিক মানুষই কি ক্রুশবিদ্ধ যিশু? নিজের ক্রশকাঠ বধ্যভূমির দিকে বয়ে নিয়ে যাওয়াই কি নিয়তি?
অলোকরঞ্জনের কবিতাটি নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে। আমাদের সব থেকে বেশি দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে ওই ‘স্পষ্ট করে বলা দরকার’ শব্দগুলিতে।
(গলগথা- ১৯০০)
তিনি যে একই সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘তুমি নেই বলে আমাকে গাহন করাবার/ কেউ নেই’ সে বিষয়টিকে আমরা যেন যথাযথ গুরুত্ব দিলাম না।
রিডেমশনের সম্ভাবনাহীন এ পৃথিবীতে ডেভিল-সত্যতাই মানুষের সব থেকে বড় আশ্রয়, হয়তো।
১৯০৩-এ মাঞ্চ সৃষ্টি করেছিলেন ‘সেলফ পোর্ট্রেট ইন হেল’।
(সেলফ পোর্ট্রেট ইন হেল- ১৯০৩)
নরকের অগ্নি দাউদাউ করে জ্বলছে, বামদিকে তার রঙ কালো আর ডানদিকে বাদামি। মাঞ্চ বঙ্কিমদৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছেন চারপাশের পৃথিবী অথবা নরক।
প্রায় এই সময়েই তিনি সৃষ্টি করেন আরেকটি বিখ্যাত ছবি, ‘অন দ্য অপারেটিং টেবিল’। চিকিৎসক ও নার্সের মুখের আদলে চোখ ও ঠোঁটের চিহ্ন নেই। যেন কতগুলি অনুভূতিশূন্য মানুষ অথবা অভ্যাসের দাস অপারেশন করে চলেছে।
(অন দ্য অপারেটিং টেবিল- ১৯০২-০৩)
বিছানায় রক্তের ছোপ, এ রক্ত ক্ষরিত হয়েছে মাঞ্চের ক্ষতবিক্ষত হৃদয় থেকে। এ রক্ত শরীরের থেকেও বেশি মনের। ব্রাশের নিখুঁত টানের বদলে মোটা-দাগের ছোপের মধ্যে যে আকস্মিকতা থাকে সেটিকেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মাঞ্চ।
আর দুটি ছবির উল্লেখ করে এ লেখার সমাপ্তি ঘটবে। একটি তাঁর অল্প বয়সে চিত্রিত, ছবিটির নাম ‘মাই ব্রাদার স্টাডিং অ্যনাটমি’ (১৮৮৩)। ধাতব নীল-রঙের দেওয়াল ঘরটিকে রহস্যময় রূপ দিয়েছে।
(মাই ব্রাদার স্টাডিং অ্যানাটমি- ১৮৮৩)
টেবিলের উপর ছড়ানো খুলি, একজন তরুণ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সেগুলি। বামদিকের খুলিটি অবিকল চেয়ে রয়েছে পড়ুয়ার দিকে। মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরেনা কখনও, কিন্তু জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে গোপন সম্পর্ক রয়ে যায়। জীবন ঝুঁকে পড়ে চেয়ে থাকে মৃত্যুর দিকে, মৃত্যুও অবাক চোখে চেয়ে থাকে জীবনের দিকে।
এ ছবিটির কাছে অন্তত পনেরো-বার ফিরে এসেছিলাম। কোনও দিন চোখে পড়েনি, হঠাৎ একদিন লক্ষ করা গেল টেবিলের সামনের দিকে পড়ে থাকা খুলিটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে রাজমুকুটের আদল অথবা শিরোস্ত্রাণ।
সারা জীবনে বহুবার রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে ভর্তি হতে হয়েছে তাঁকে। শৈশবে মায়ের মৃত্যু ও বাবার অদ্ভুত সব আচরণ চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল তাঁর জীবনে। জীবনে সুস্থির নারীর খোঁজে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন, আবার একই সঙ্গে কিছু সংস্কারের ফলে নারীর থেকে কিছু কিছু সময়ে দূরে থেকেছেন।
এডভাড মাঞ্চ-কে কি তাড়া করে বেড়িয়েছিল অতিপ্রাকৃত শব্দ-দানব? নিটশে লিখেছিলেন, ‘Flee my friend, into thy solitude! I see thee deafened with the noise of great men, and stung all over with the stings of the little ones.
Admirably do forest and rock know how to be sokent with thee. Remember again the tree which thou lovest, the broad-branched one-silently and attentively in o’erhangeth the sea.
Where solitude endeth, there beginneth the market-place; and where the market-place beginnneth, there beginneth also the noise of the great actors. And the buzzing of the poison-flies.’
এই মার্কেট-প্লেস থেকেই কি পালাতে চেয়েছিলেন মাঞ্চ? তাঁকে নিয়তিতাড়িত খাঁচাবন্দি এক সত্তা বলে মনে হয়। বারবার ভুল মানুষের অরণ্যে গিয়ে, ভুল নারী ও পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়েছিলেন। সত্যিই কি তিনি পড়েছিলেন? না কি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘনিয়ে তুলেছিলেন এ বিপণ্নতা? এ প্রশ্নের মধ্যে বহু সময় ঘুরপাক খেতে থাকে মাঞ্চ-এর জগৎ।
যে ছবিটি দিয়ে এ লেখা শেষ হবার কথা সেটির নাম, ‘স্প্রিংটাইম ল্যান্ডস্কেপ উইথ রেড হাউস’ (১৯৩৫)।
(স্প্রিংটাইম ল্যান্ডস্কেপ উইথ রেড হাউস-১৯৩৫)
ছবিটির মধ্যে আনন্দ-লহরী রয়েছে। অনুচ্চ-টিলার উপর একটি লালবাড়ি। সরু জলধারা বয়ে চলেছে, দু’দিকের ঢালু পাড়। এই জলধারা ও ঢালু পাড় নারী শরীরের ইশারা ফুটিয়ে তুলেছে। যেন নগ্ন নারী শুয়ে রয়েছে চরাচরে, যৌনতার অপেক্ষায়। অথবা প্রকৃতিই তো সে নারী।
লাল রঙের প্রভাব কোনও দিন কাটিয়ে উঠতে পারেননি মাঞ্চ। লারসেনের লাল-চুল তাঁর অবচেতনে খেলা করে গেছে।
বেলুনাকৃতি একটি গাছ এবং তার ডানদিকে পরপর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি গাছ।
যেন চন্দ্রাতপের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা।
আকাশে ভাসমান মেঘ। আপাতভাবে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
কিন্তু হায়, কে যেন, কী যেন নিয়তি এক ভয়ংকরভাবে রুদ্ধ করে রেখেছে আকাশের দিকে গাছগুলির বিস্তারের স্বাধীনতা!
এক অদৃশ্য চাদর চেপে ধরে রয়েছে তাদের।
সমস্ত মুক্তির পরেও ওটুকুই বাধা, ওটুকুকে কোনও দিন অতিক্রম করা যাবে না, যায় না। অদৃশ্য ভীষণ লোহার থেকেও ভারী কারাগারের মধ্যে মাথা খুঁড়ে মরে মানুষ। এখান থেকেই শিল্পের হাহাকার ও বিস্তার শুরু। মনে পড়ে গৌতম বসু লিখেছিলেন,
‘দুটি চোখই হারিয়ে ফেলেছি
এইমাত্র হারালাম আদিসপ্তগ্রাম;
দিনশেষে, এসেছি প্রাণের কিনারায়,
এবার আমি নিজেরই পায়ের কাছে
আছড়ে পড়েছি, ভক্ষণ করেছি মাটি।
ভাবি, এত এত গ্রন্থি, বিনা রক্তপাতে
যদি ছিন্ন করা যেত, উর্ধ্বলোকে তবে
প্রত্যহ, কেন ওই ভীষণ আয়োজন?’ (গোধূলি)
সবকটি ছবি বহু আলোচিত হলেও ছবিগুলির সাথে আপনার হৃদয়ের সৎ সংযোগ লেখার মধ্যে পরিস্ফুট, তাই আলাদা। এখানেই আমাদের তৃপ্তি আপনার লেখার সার্থকতা। এবারের বাংলা কবিতাগুলি চয়ন খুব মনঃপুত হয়নি। অন্তহীন শুভেচ্ছা।