সিয়েগফ্রিড, আমাদের প্রথম সন্তান ( ইতি দিওতিমা পর্ব ৭) – বল্লরী সেন
।। ষষ্ঠ অধ্যায় ।।
জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
২৪ এপ্রিল, ১৯০৫
আমার উচাটন দাবদাহের মতো ফুলকি উড়িয়ে নিয়ে চলল বেগানা পথে। মা নেই, বাপ নেই, আমি একা রাস্তা চলাফেরার মধ্যে দিয়ে জর্মান ভাষায় পটু হচ্ছি আর রুশ বন্ধুদের কাছে আমার বেশ নামডাক হচ্ছে। ওরা ওদের পুরুষ বন্ধুদের প্রেমপত্রের উত্তর দেবার সময়ে আমার শরণাপন্ন হয় আর আমাকে জর্মান চিঠিটাও দেখাতে বাধ্য হয়, বুঝি বেশ সংকুচিত হয়ে ওরা চিঠির উত্তর লেখাতে আসে।
না চাওয়া সত্ত্বেও ইয়ুং-এর মুখটা ভেসে আসে, যেমনটা তাকে কতবার কাছ থেকে দেখেছিলাম। সেই বরঘলস্লি হাসপাতালের সবচেয়ে উঁচুতলার এক কোণে মেট্রনের ঘরে যখন মাঝে মাঝেই রাত্রে থেকে যাচ্ছেন, অনেক রাত অব্দি আমাকে নিজের ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আর ধরে রাখছেন ভোর পর্যন্ত—বহু অছিলাতে। কখনও আমি জোর করে তাঁকে তাঁর স্ত্রীর কাছে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছি, বলেছি এম্মা অপেক্ষা করে আছে, আর দেরি না করে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু পাগলের মতো সে আমাকে আদরের মতো দলেছে, শুধিয়েছে খুঁড়ে খুঁড়ে কত গভীর এই ভালো লাগা, নাকি শুধুই আমি তার চিকিৎসার অনুবর্তী হয়ে আছি। গুলিয়ে গেছে সেই মুহূর্তে, কোন্টা এ্যানালিস্টের কাজ, কোন্টা ভালবাসায় দীর্ণ এক অসহায় মানুষের—যে হয়তো তার হারানো মাকে খুঁজছে এই আমার শরীরের গহ্বরে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯০৬
বিকেলের কাকের মতো গোধূলি স্নানের টান আমাকে ভর করে।
এক মাসে কতবার যে বাসা বদলেছি, ভয় হয়; মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। এখন আর খোসা সরিয়ে বেরোতে পারি না। স্তনভারের তলায় যে মেকি জীবন আমাকে টানে, রুদ্ধশ্বাসে আমি তাকে পরিহার করি। কেবল ইয়ুং-এর কোনও সংকল্প ব্যর্থ হতে দিইনি। যা যা সে চেয়েছে,
আমি নিজেকে রোধ করতে পারিনি।
মা, তুমিও কি চেয়েছিলে টাকার বিনিময়ে আমার শরীরটা প্যাকিং বাক্সের মধ্যে তার কাছে যাক? আর তুমি চিঠি লিখে ফ্রয়েডের কাছে সব জানিয়ে দেবে, যেন আমার অনিচ্ছায় সে বাধ্য করেছে আমাকে…
সে তো আমিই নিজে ফ্রয়েডকে সব বলব কোনোদিন , যখন বললে আর আমার কষ্ট চৌগুণ বাড়বে না
জুরিখ মেডিকাল স্কুল
হস্টেল, রুম ৫০৪
১৯০৬
মা তুমি আমার চিঠি না খুললেই পারতে।
ইয়ুং-এর সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা হয়নি, মা তুমি আমার নামের চিঠি না খুলতে। পড়াশুনার এখন খুব সমস্যা,
বাবার টাকায় বাধ্য হচ্ছি বই কিনতে। মনখারাপ করে কৃষ্ণসাগরের দিনগুলোর কথা ভাবলে, দাদি চলে যাওয়ার সেই খবর, ছ’বছরের পুচকি এমিলিয়ার মৃত্যু আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। আর ইয়ুংকে, তার স্মৃতিকে আমি আমার হাতে অন্যরকম করে নিচ্ছিলাম, যেভাবে স্মৃতিকে ঘুরিয়ে দেখলে আর ব্যথা বাজে না আমার। আর ঠিক তখনই, আমি আমার শরীরের মধ্যে পেয়ে গেছি আর একটা শরীর, ভ্রমরের মতো যে, আমাকে চারপাশে ঘিরে আছে দীর্ঘকাল। এম্মা ওঁর বিবাহিত স্ত্রী বটে, কিন্তু আমি না হয় ছোটো এক বন্ধু হয়েই থাকব, এ নিয়ে তুমি ভয় পেও না মা। প্লিজ বাবাকে পাঠিও না আবার। টাকার প্রয়োজন নেই আমার এখন, বেশ কিছু রুশ সিনিয়র আমাকে আগলে আগলে রাখে, এ মাসে জুতো কিনেছি আর নতুন এক বন্ধুকে কিছু রুবেল ধার দিতে হল। বাকি তো সরিয়ে রেখেছি। জানো মা, সেদিন বায়োলজির একটা ক্লাসে এত আশ্চর্য লাগল পড়া শুনতে, মা—নিকোলাই-এর ঔরসে তুমি আমায় পেয়েছিলে, নাকি…
এ চিঠি দেখেই নষ্ট করে ফেলো, যতবার এর লেখাগুলো তুমি পড়বে ততবার তোমার ঘেন্না হবে। আমি ওই ঘেন্নাকে কেন্নোর মতো গায়ে মুড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকব, যেমন ইয়ুং-এর কোলে তার শিশুকন্যাটি থাকবে, যেমন করে কোনোদিন আমাকে আমার বাবা স্নেহ করেননি। আমার দু’পায়ের বিভাজন সরিয়ে এপিথেলিয়াল কোষে চড়াও হয়ে নিকোলাইয়ের দণ্ড যেমন সপাং করে আমার এসপার-ওসপার ভেদ করেছে; মা বলে যখন প্রাণপণ চিৎকার করেছি যে ওই কালো জন্তুটাকে, মুখ ঢাকা, চিনতে পারিনি, ভয়ে আমার হাঁটু কাঁপছে, আওয়াজ হচ্ছে একটা অন্যরকম, অন্য একটা আওয়াজ, যেন আমার যন্ত্রণার পিরিচে কেউ গরম স্যুপ সর্ সর্ করে দাঁতে পান করছে অনেকক্ষণ ধরে
তারপর তুমি জানো সব। তবু আসোনি সেদিন।
তাই চিঠি লেখা আপাতত বন্ধ, তোমাকে আর বিশ্বাস করি না। স্পিয়েলরিন পরিবারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রইল না আর।