এনিউমা এলিশের শেষ পৃষ্ঠা – বল্লরী সেন
জিয়াভরলি নদী, দেবীসূক্ত॥
দ্বাদশ অধ্যায়
ইতালীয় লেখক ও দার্শনিক জর্জো আগাম্বেন যখন সেই স্বর্গীয় উদ্যানের কথা লিখছেন, আমার ইজেলে পুব পাহাড়ের রোদ ফিরোজা হয়ে সৌরমণ্ডলের ফ্রেম ছিঁড়ে টুপ্ টাপ্ নামছে তেরচা হয়ে বৃষ্ণিবংশের চত্বরে, আমি শ্রুতিতে পাচ্ছি শ্রদ্ধা কামায়নীকে—ধারণ করছি রাত্রিসূক্ত। কুন্তীর হাতে কাটা মাংসের মতো সযত্ন টুকরো হয়ে হয়ে আমি বায়ু, অর্থ, শ্লেষ, রোমাঞ্চ, স্তম্ভ থেকে সোজা দ্বাপরের শেষ সুদর্শন হিসেবে প্রাচীন মৃৎপাত্রে লিপিবদ্ধ হলাম। ত্রিভুজের কেন্দ্র থেকে মাধ্যাকর্ষের মণিতে আমার রজঃস্বলা পরিধির আয়ুস্পন্দে ছলাৎ ছলাৎ রব উঠছে; তারামণ্ডলের গা থেকে হঠাৎ খসে পড়ল আমার স্নায়ু, বল্গাহারা হলাম। আর কোনো রাশ রইল না পায়ের, গোড়ালির আদি অনাদি ঢেউ লেগে দুধে আলতায় শির ভিজিয়ে নিচ্ছে চন্দ্রাপীড়—আমি না দেখলেও। কারণ বের দেওয়া অভিমন্যুর ব্যূহের শেষ পৃষ্ঠায় যে দানবীয় হত্যাদৃশ্যটি লেখা হচ্ছিল, তার খয়ের কালির দোয়াত প্রায় শূন্য, মেঘডাবরে অরণ্য নিঃশেষিত, যুধিষ্ঠির সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভাঙছেন আর ক্রমশ অন্ধত্ব তাঁকে পেয়ে বসছে। যা দেখেন, তাও তাঁর বিশ্বাসের অযোগ্য, তিনি নিজের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে যমালয়ের দোর ধরে লুটিয়ে পড়ে নির্বীজ করতে চাইছেন গোটা পাণ্ডববর্গকে। আর এর জন্য তিনি নিজেকেই দায়ি করছেন সবচেয়ে বেশি। সিন্ধুশকুনের ডানার ওমে মোড়া অক্ষরচিবুকের তলায় এক খুদে লাল তিলের লালিমা যখন পুবের আকাশকে ছাপিয়ে উঠত রক্তপট্টবস্ত্রের কটিরেখা, যজ্ঞের আহূত স্বাহার আমেজে আমার দারুণ ঘুম নেমে আসত, আমি বিলীয়মান রক্তলাভায় আমার শীতার্ত কুণ্ডে ঢেলে দিই লোহিতাশ্বের খুরের থেকে ছিটকানো বিদ্যুৎ। ধুলোর ভেতর অভ্রের কন্জুস টানে আমি আনীত হলাম নৈমিষারণ্যে। আমার মীনমুখর দিনগুলি এভাবেই পুরুষের অতিপ্রশ্নদোষে অভিশপ্ত। মাজা ধরে মুণ্ড আর ধর পৃথক করে প্রতি পুত্রের পাতে, জিভের আগায় আমি লুপ্ত ‘হ’-এর মতো জ্যান্ত আজও। আর এ সবের পরেও আপনাদের পানের ডিবেয় আমার চতুর ও নারকীয় পাপের প্রগল্ভ উনান লকলক করছে, জননান্তর সৌহৃদানি তার শেষ এখনও রচনা করেনি কেউ। মরালসন্ধ্যা নেমে এল চড়কডাঙায়, আপামর বিতানলতারা কুঁকড়ে আছে শীতের ঝাপটায়, কারও একগুছি চুলে লাগছে উচ্ছের বাসন্তীফুল, কেউ আবার লেবুর মতো ফুটফুটে—কর্ণকাপাস মোহমাকড়ি। কাঁসার গাড়ুর গায়ের হিম ঠাণ্ডা নিজের কলেবরে মেখে নিচ্ছে গোধূলির অমরকানন। চারদিকের ঘ্রাণঘন বৃক্ষপুরীর মধ্যে একলা সাঁঝ নেমে আসছে, পায়ের আঙোট জুড়ে আকাশের তারার হীরে। প্রত্নমন, শুষ্কমন, চিরাগমন পার হচ্ছি দিকচক্রবালে। আকাশের রং এখন প্রসব পরবর্তী জরায়ুর মতো। তার কোমরে, নাভিতে, জানুতে কে যেন লাল গুঁড়ো টিপ ছড়িয়ে দিয়েছে। আদিম নিকোনো দাওয়া, তার এক পাশে জলের কুঁজো আর কাঁসার ঘটি চাপা। গাভীর গায়ের গন্ধ, উনুন ধরছে কোণে—চাঁদ নেই। ফুলকি থেকে একপ্রকার ত্রাস তালপাখা খেতে খেতে চাটাইয়ের ওপর আসছে, সেঁকা বেগুনের চামড়ায় পুড়ছে দুটো হাতের পাতা বিছিয়ে ধরছে কে একজন। জোনাকির ঝাঁক বসেছে ঘুমের পদ্মফুলে, গোটা শ্রমণে এখন আরতির সময়। তূণীর আল্গা করে অন্ধকারেরা গাছের পাতার ফাঁকে কেমন চুরি করে ঢুকে ডার্করুম খেলছে।আমি আশ্রমিক নই, তবু সন্ধ্যার ছেই বুঝি আমারও অঙ্গস্পর্শ করে, দুর্বার এক সাঁঝের গোধূম ডেকে নিয়ে আসে জিয়াভরলি নদীর মোচড়ানো আলোয়ানে, মঠের বাঁ হাত ধরে যেখানে টিউকল, শ্মশান, রক্তজবার গাছ—ওইখানের পুরনো কুঠির একটা তিনকামরার বাগদিঘর আমার। চণ্ডালের ধারে আসে না কেউ। আর সত্যি তো, একদিন ডোমের বংশের কেউ আমায় বিইয়েছিল, জন্মের সময়ে নাড়ী জড়িয়ে গেল, মাকে যাতনায় ছটফট করতে শুনেছি। আমি মাঝ রাস্তায় তখন লবঙ্গবনের ধর আর মুণ্ড বেছে ডাঁই করছি আর কাঠামো রুইছি। অহল্যাপাহাড়ের পয়মন্ত ভেড়াচরি লাল ফিতে বাঁধা কন্যার আহারপাত্রে সুগন্ধি খিদের মধ্যে ক্রমে ঘুমে জর্জরিত আমি; সর্বনাশের স্বপ্ন দেখব বলে লালিত হচ্ছি। আমি সেই কুট্টিনী, নফরলালিতা, যার কূটচক্রে তুমি-আমি, সে-তারা—সবাই মদপ্লাবী লেহনের তীব্র আকর্ষে উদ্যানবাটি থেকে ফিরে আসছি কীচকের জঠরে। সেই শেষ অবিবেচক, বিধর্মী, যবন, যে নিজেরই পরিবারে একটি লাট্টুর মধ্যে উল্কাজীবাণু ভরে ছুঁড়ে দিয়েছে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে, অলস কোনো এক সমুদ্রশৃঙ্গার মুহূর্তে, লাস্যে, দ্যুতিতে—বীজগর্ভ ভ্রূণের আয়ু নাশ করার হাপিত্যেশ ক্রোধে, নিজের জিহ্বার সপত্নী লেলিহান যোনিজিভের বিস্মৃতির গহ্বরে ।