কাঞ্চনজঙ্ঘাতে গুইয়ের গান – প্রবীর মিত্র
সিউদো সিউদো মা সিন্দুরলে তিমরো মন
পিঞ্জরালে ঢাকেছ
মন খোলি হাস লা লা–
ওপরের লাইনগুলো পড়ে কিছু বুঝলেন? না আমিও প্রথমে কিছু বুঝিনি। এটি ইন্দ্রবাহাদুর থাপা রচিত একটি নেপালি লোকসঙ্গীত, যার কিছুটা বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় “প্রাণ খুলে হেসে নাও, পিঞ্জরে তোমার মনটাকে কেন বন্দী করে রেখেছ।” ১৯৬২ সালের একটি সিনেমায় এই গানের গায়ক একজন নেপালি শিশুশিল্পী, নাম গুইয়ে। ভালো নাম শেরিং শেরপা।
১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির জন্য লেখা প্রথম গল্প, ‘বাগানবাড়ি’-র শুটিং-এর কাজে হাত দেন। প্রথমে গল্পের পটভূমি ছিল কলকাতার একটি বাগানবাড়ি ঘিরে, কিন্তু পরে তিনি স্থির করেন সেটা কলকাতার বদলে হবে তাঁর প্রিয় শহর দার্জিলিংয়ে। এর আগে অবশ্য তিনি বহুবার দার্জিলিং গিয়েছিলেন তাই মনে মনে তিনি গল্পের খোলনলচে পালটে ফেললেন এবং গল্পের নাম ‘বাগানবাড়ি’ পালটে দিলেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। নিজের হাতে তৈরি করলেন দার্জিলিং-এর বিভিন্ন লোকেশনের ম্যাপ যেখানে তিনি এই ছবির শুটিং করবেন এবং ছবিটি হবে রঙিন, যেটা হবে সত্যজিৎ-এর প্রথম রঙিিন ছবি। ২১শে নভেম্বর ১৯৬১-তে সত্যজিৎ রায়ের পুরো টিম দার্জিলিং রওনা হয়ে গেল। ছবি বিশ্বাস, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, অনুভা দে, সুব্রত সেনশর্মা, এন বিশ্বনাথন, হরিধন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রথিতযশা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন এই টিমে। এছাড়াও সত্যজিৎ অলকানন্দা রায় ও অরুণ মুখোপাধ্যায়ের মতো নবাগতদেরও এই ছবিতে অভিনয় করিয়েছিলেন। বিজয়া রায়ের স্মৃতিচারণায় জানা যায়, টানা ২৮ দিন নানা প্রতিকূলতার মধ্যে শুটিং হয়েছিল এই ছবির। কখন মেঘ, কুয়াশা বা বৃষ্টি, আবার কখন ঝলমলে রোদ, প্রকৃতির এই আলো-আধাঁরকে গল্পে বেশ কাজে লাগিয়েছিলেন সত্যজিৎ। শুটিং-এর সময় বারবার আলো কমে যাচ্ছিল ও কুয়াশায় চারিদিক ঢেকে যাচ্ছিল, যারাই সিনেমাটি দেখেছেন, তাঁরাই জানেন এই কুয়াশাকে গল্পে কী অপূর্বভাবে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ! তিনি গল্পের চিত্রনাট্যটাও প্রকৃতির সমস্ত অবস্থার উপযোগী দৃশ্যের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাছাড়া তখন দার্জিলিং সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। ফাঁকা ফাঁকা, প্রচুর গাছপালা, বাড়িঘর তেমন নেই, তাই দৃষ্টি চলে যায় অনেকখানি। জলাপাহাড়, চিলড্রেন প্লে গ্রাউণ্ড যেখানে সুব্রত ও অনুভার একটা লং শট নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ম্যালকে অসাধারণ ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন সত্যজিৎ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ঠিক সেই সময়, বোম্বাই থেকে একটি শুটিং টিম এসেছিল একটি হিন্দি ছবির গানের শুটিং-এর জন্য। শাম্মি কাপুর অভিনীত ‘প্রফেসর’ ছবির একটি গানের শুটিং হবার কথা সেই সময়, কিন্তু ঘন কুয়াশার জন্য তাঁদের শুটিং আপাতত বন্ধ। কাপুর পরিবারের সঙ্গে সত্যজিৎ-এর সম্পর্ক চিরকাল মধুর, তাই শুটিং চলাকালীন ব্ল্যাঙ্ক কলার ফিল্ম ক্যানের একবার শর্টেজ হওয়াতে শাম্মি কাপুর নিজে এগিয়ে আসেন সত্যজিৎ-কে সাহায্য করতে। নিজেদের স্টক থেকে শাম্মি কাপুর বেশ কিছু ব্ল্যাঙ্ক কলার ফিল্মের ক্যান দিয়ে দেন সত্যজিৎ-কে যাতে তিনি বিনাবাধায় ছবির পরবর্তী অংশটুকু শুট করতে পারেন। সত্যজিৎ পরে একটি সাক্ষাৎকারে শাম্মি কাপুরের প্রতি তাঁর এই কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন।
একদিন শুটিং-এর ফাঁকে সত্যজিৎ তার সহকারীর সঙ্গে দার্জিলিং-এর রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিলেন। এমন সময় চোখে পড়ল, ৭-৮ বছরের একটি নেপালি ছেলে। হাতে লাট্টু ও লেত্তি। ছেলেটির পরনে ছেঁড়া নোংরা জামা ও ঢলঢলে ইজের। একমনে লেত্তি দিয়ে সে হাতের লাট্টুটাকে ঘোরাচ্ছে। তার ছোট্ট হাতের মাঝখানে কাঠের লাট্টুটা বনবন করে ঘুরছে, ছেলেটি এক দৃষ্টে লাট্টুটার দিকে তাকিয়ে আছে। আর বলা বাহুল্য, সত্যজিৎ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ছেলেটার মনোযোগী মুখের দিকে। সত্যজিৎ আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন ছেলেটির দিকে এবং কথাবার্তা শুরু করলেন, যেভাবে তিনি অন্যান্য শিশুদের সাথে কথাবার্তা বলেন, একজন প্রাপ্তবয়স্কদের মতো। “আমরা একটা সিনেমার শুটিং করছি ম্যালে। তুমি কি একবার বিকেলে আসবে, তোমাকে খুব দরকার।” ছেলেটি কী বুঝল কে জানে, শুধু কিছু না বলে একবার মাথা নাড়ল। সেদিন বিকেলের শুটিং-এর কাজ শুরু হল। কিন্তু সত্যজিৎ-এর চোখ ভিড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগল সকালের দেখা সেই সরল মুখটিকে। তবে কি গুইয়ে আসবে না! চিন্তায় পড়লেন সত্যজিৎ। তখন পাহাড়ি সান্যালের সাথে ছবি বিশ্বাসের একটা ভাইটাল টেক হচ্ছে। ছবিবাবু বেশ রাশভারী লোক, কিন্তু শটের এক জায়গায় বার বার ভুল হচ্ছে কিন্তু উনি সেটা মানতে একেবারেই রাজি নন। সত্যজিৎ বেশ কয়েকবার অভিনয় করে দেখিয়ে দিলেন ছবিবাবুকে। ফাইনাল টেক নেবার সময় হঠাৎ সত্যজিৎ-এর নজর গেল ভিড়ের দিকে। সকালের দেখা সেই নিষ্পাপ মুখ এককোণে দাঁড়িয়ে আছে আর পাহাড়ি ফুলের ডাঁটা চিবোচ্ছে। সত্যজিৎ এগিয়ে এলেন গুইয়ের দিকে। গাল টিপে একটু আদর করে গল্প জুড়ে দিলেন। এগিয়ে দিলেন মিষ্টি ও বিস্কুটের প্লেট। ওদিকে রাশভারী অভিনেতা ছবিবাবু বেশ বিরক্ত, যদিও মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু পাহাড়ি স্যান্যাল বেশ মজার মানুষ। তিনি সবকিছু ভুলে গুইয়ের কাছে এগিয়ে গেলেন। ইউনিটের সবাই অবাক হয়ে দেখল একজন দীর্ঘদেহী মানুষ একটি ছোট্ট নেপালি বাচ্চার সাথে গল্পে মশগুল।
‘তুমি গান গাইতে পারো বাবা?’ দীর্ঘদেহীর জবাবে গুইয়ে বলল, ‘পারি কিন্তু বাংলা গান নয়, নেপালি একটা গান আমার জানা আছে।’ ‘বেশ তো, সেই গানই চলবে। আমার সাথে এসো, এখানে বড্ড ভিড়, তোমার গান ভালো ভাবে শুনতে পারব না’, এই বলে সত্যজিৎ সেই ছেলেটিকে নিয়ে গেলেন একটি ঘরে। ছেলেটি ঘরে ঢুকেই অবাক, সেখানে নানাধরনের যন্ত্রপাতি ও বড়ো বড়ো বাক্স। সত্যজিৎ এবার গাইতে বললেন ছোট্ট গুইয়ে-কে। মনপ্রাণ ঢেলে গুইয়ে গাইল তার নেপালি গান। গান শেষ হবার পর গুইয়ে অবাক হয়ে দেখল সেই দীর্ঘদেহী মানুষটি একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইতিমধ্যে সত্যজিৎ আর একটি কাজ করে ফেলেছেন, গান গাওয়ার সময় পুরো গানটা তিনি রেকর্ড করে নিয়েছেন তাঁর ছোট্ট টেপ রেকর্ডারে। গরিব ঘরের ছেলে ছোট্ট গুইয়ে কোনোদিন টেপ রেকর্ডার দেখেনি, সে যখন নিজের গাওয়া গান সেই ছোট্ট যন্ত্রটির ভেতর থেকে শুনল তার চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। ততক্ষণে সত্যজিৎ ভেবে নিয়েছেন তার গল্পে গুইয়ের অবস্থান।
সেদিন থেকে গুইয়ে সত্যজিতের টিমের একজন হয়ে গেল। পাহাড়ের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত বিভিন্ন লোকেশনে ও বেশ কয়েকটি শটে গুইয়েকে অন্যান্য অভিনেতাদের সাথে নিপুণভাবে ফ্রেমে জুড়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। গুইয়েকে তেমন কিছু সংলাপ দিলেন না, শুধু তার মুখের অভিব্যক্তি ধরলেন ক্যামেরায়। শুটিং চলাকালীন ছোট্ট গুইয়ের ভিতরে একটি কথা একেবারে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ, ‘মনে রেখ বাবা, এক ছবি হাজার কথার সামিল’। শুধু তাই নয়, তার রেকর্ড করা নেপালি লোকগানটি দুর্দান্ত ব্যবহার করলেন ছবির একেবারে শেষ দৃশ্যে। গুইয়ে এবং তার গান একটা ফ্রিকোয়েন্সি বা প্রকৃতির কাছাকাছি এক আত্মউপলব্ধির অবকাশ বা মানসিক মুক্তির আনন্দের হাতছানি। এই ছবিতে ব্যবহৃত করুণা বন্দোপাধ্যায়ের লিপে রবি ঠাকুরের অপর একটি গান যেটি অমিয়া ঠাকুর গেয়েছিলেন, ‘এ পরবাসে রবে কে হায়!’, এই গানের ফ্রিকোয়েন্সিটাও যেন গুইয়ের সেই গানকে ছুঁতে চায়। খেয়াল করে দেখুন, দুটি গানেই সত্যজিৎ কোনো যন্ত্রসঙ্গীত কিন্তু ব্যবহার করেননি। ছবির শেষ দৃশ্যটা একবার চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন, ব্যানার্জির (এন বিশ্বনাথন) হাত থেকে চকলেটের প্যাকেটটা নিয়ে গুইয়ে নির্জন ম্যালের একটা রেলিং-এ বসে চকলেটটা খেতে খেতে শুরু করে তার সেই গান ‘সিউদো সিউদো মা সিন্দুরলে তিমরো মন, পিঞ্জরালে ঢাকেছ, মন খোলি হাস লা লা–’ এরপর ফ্রেমে দেখা যায় রায়বাহাদুর বেশী দাম্ভিক ছবি বিশ্বাসকে যিনি পাগলের মতো নিজের প্রিয়জনের নাম ধরে ডাকছেন কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আজ তিনি যেন বড্ড একা এই পৃথিবীতে। গুইয়ের গানের সুরের সাথে সাথে একসময় মেঘ কেটে যায়, আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এরপর গুইয়ে বড়ো হয়। ইচ্ছে থাকলেও পরবর্তী জীবনে আর অভিনয়ের কোনো সুযোগ আসেনি তার কাছে। তাই তার কাছে আজও ছোটোবেলার সেই স্মৃতি টাটকা। সেই দীর্ঘদেহী মানুষটি শুটিং শেষে গুইয়ের বাপের কাছে এসেছিলেন গুইয়ে-কে কলকাতায় নিয়ে নিজের কাছে রাখার জন্য, কিন্তু গুইয়ের একগুঁয়ে বাপ তাতে রাজি হয়নি। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ-এর প্রস্তাব। তখন সত্যজিৎ নিয়ে আসেন সেই ছেঁড়া জামা ও ইজের আর সেই মাপে কলকাতা থেকে গুইয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন কিছু নতুন জামা ও স্যুট।
আগামী ২রা মে ভোটের চূড়ান্ত গণনার পাশাপাশি সেই দীর্ঘদেহী মানুষটির ১০০ বছর পূর্তি উৎসব হবে হয়তো। যদি করোনা আজও তাঁর কোনো ক্ষতি না করে থাকে তাহলে আমি নিশ্চিত গুইয়ে বা শেরিং শেরপা আগামীকাল সবকিছু ফেলে মোবাইলে বা কম্পিউটারে আবার ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটি দেখে তাঁর ফেলে আসা ছোটোবেলার স্মৃতির সাগরে ডুব দেবেন। ছবির প্রতিটি ফ্রেম তাঁর মুখস্থ। ব্যানার্জি-মণীষার পিছু নেওয়া, ব্যানার্জির কাছে পয়সা চাওয়া, পাহাড়ি পথে মালবাহী খচ্চরের গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুং টাং আওয়াজ এবং শেষে এক বেচারা বুড়ো লোকের (ছবি বিশ্বাস) কাউকে খুঁজে না পাওয়া, সেটা দেখতে দেখতে তাঁর চকলেট খাওয়া, যেটা ওই সিনেমার এক সাহেব (এন বিশ্বনাথন) লোক তাকে দিয়েছিল খেতে, এসব দেখে তাঁর যেন বড্ড মনে পড়বে ব্যারিটোন ভয়েসের সেই দীর্ঘদেহী মানুষটিকে আর চোখের কোণে চিকচিক করে উঠবে কয়েকফোঁটা জল।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা :
১। আনন্দবাজার
২। বিষয় চলচ্চিত্র–সত্যজিৎ রায়
৩। পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা–বিশেষ সত্যজিৎ রায় সংখ্যা
৪। আমাদের কথা–বিজয়া রায়
৫। পাঁচালি থেকে অস্কার–অনিরুদ্ধ ধর
৬। এই লেখায় ব্যবহৃত সমস্ত ছবি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও মূল সিনেমা থেকে কিছু স্টিল শট নেওয়া হয়েছে।