শীত ও আগুনের মিথোজীবিতা – দীপাঞ্জনা মণ্ডল

শীত ও আগুনের মিথোজীবিতা – দীপাঞ্জনা মণ্ডল

শেয়ার করুন


সিগারেটের শেষটুকু ধোঁয়াশূন্য না করে কখনোই ফেলতে পারি না। পায়ে পিষতে এক চিলতে অস্বস্তি হয়, ফলে আশপাশে ছাইদান না পেলে উচ্চ গলনাঙ্কের কিছু মানে লোহা বা টিনের কিছু অথবা জমে থাকা কাদাজল খুঁজি। বর্ষায় তেমন ঝামেলা নেই, তবে শীতকালে এরকম সমাধান সহজে না পেলে হাতে ধরে রাখি ফিল্টার, অপেক্ষায় কখন নিঃশেষ হবে শেষ ফুলকিটুকু। তখন এই আগুনের শেষ না রাখার একটা যুক্তির জোর পাই, বাতাস শুকনো, সহজে আগুন ছড়াবে ঝরা পাতা থেকে পলিথিন আর কাগজের রদ্দি।

সমস্যায় পড়লে হাত পাতার একটা অভ্যেস হয়েছিল। যে কোনও সমস্যায়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক—অনায়াসে চাইতাম, শূন্য হাতে ফিরিনি কখনও। অসীম ধৈর্য, মমত্ব, স্নেহ, সম্মান দিয়ে, আর হ্যাঁ, দরদামহীন সময় দিয়ে।
ক্রমশ আমরা আমাদের ছেলেবেলার না বোঝা চলচ্চিত্রগুলোর চলতা-ফিরতা চরিত্র হয়ে উঠছিলাম। ওই হঠাৎ সাময়িক সময় কাটানো সঙ্গীর জীবনবীক্ষায় নিজেকে উলটে-পালটে নেওয়া বা স্কুলবেলার সম্ভাবনা আর প্রত্যাশাপূরণের থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে মাঝবয়েসে ক্লাসমেটদের খুঁজে পাওয়া—স্বপ্নভঙ্গ আর তার থেকে অন্য স্বপ্নের কাছে হাত পাততে শেখা। দেখা যাচ্ছিল জীবন একেবারেই জীবনের মতো অদ্বিতীয়। তবু অভিজ্ঞতা শ্রুতি বা স্মৃতিবন্দি। পরোক্ষ উত্তরাধিকারে আর প্রত্যক্ষ অর্জনে। ­

পাতা ঝরার মানে আমার শিশুবেলার মার্চ-এপ্রিল; মফস্বলের বিরাট বাড়ি একটা বছর ছয়-সাতের পুঁচকে-কে হা হা গিলতে আসে, লু ধুলো আনে, হুতাশও। পুরো বাড়িতে হাওয়া দাপায়। আমি ভয়ে ভয়ে রাস্তার দিকের বারান্দায় সেঁটে যাই, রাস্তা দিয়ে নির্জন দুপুরেও দু-চারটে মানুষ হাঁটে, রিক্সা চলে, কুকুর-ছাগল-গরু-মুরগি-হাঁস। ভয় একটু কমে।

রাস্তার ওপরে ঝরঝর ঝপাস করে বুক কাঁপিয়ে সহসা নারকেল পাতা পড়ে। চোখে না দেখা অব্দি নারকেল পাতাটা, মনে হয় একটা বিরাট রূপকথার রাক্ষস ছুটে আসছে যেন। এলোমেলো হেঁটে যাওয়া ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা কেউ না কেউ ময়লা গামছায় মুখ মুছে পাতাটা উলটে-পালটে দেখে, আলতো করে গোড়ার দিকটা ধরে অলস এগোয়। ভয়ানক রাক্ষস উনুনে খাক হতে আর মুড়ো ঝাঁটার উত্তরদায়িত্ব নিতে রাক্ষসটিকে অভিশপ্ত দেখে আমি হাঁফ ফেলি। গলা শুকোলেও জল খাই না। টয়লেট বাড়ির পেছনে, তারপরে বিরাট উঠোন, সেখানেও রূপকথার নানা ভয় ঘাপটি মেরে থাকে হয়তো। ফোল্ডিং খাটের আধখানা না পাততে পেরে সেটাকে আরামকেদারা বলে ভেবে বাকি আধখানায় মাথা আর পিঠ রাখি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সে সময়, যখন দিনে দুশ নম্বরের পরীক্ষা চলত সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি। আমি লু আর ঝরে পড়া পাতার শব্দে সিঁটিয়ে থাকতাম একেকটা গোটা দিন একেবারে একা।

একা থাকার বাধ্যতা একা থাকার অভ্যেস দিয়েছিল। নিরন্তর একা, প্রতি মুহূর্তে সবুজ থেকে হলুদ হয়ে ঝরে পড়ার মতো অমোঘ। শিমুল গাছের ওপর মউচাক ভাঙতে এসে অসংখ্য ডিম আর লার্ভা ঝরে পড়তে দেখে অসহায় চিৎকারে অপরাধবোধে ঠেলে দিয়েছিলাম সবাইকে। শেষমেশ মধু নিয়ে চাক ফেলে পালিয়েছিল মশালওয়ালারা। কালবৈশাখীতে সেটা ঝরে পড়েছিল। টেপরেকর্ডারে বেজেছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা’। শূন্যগর্ভ চাকটা ঠিক সেই পরিত্যক্ত গাঁয়ের ভাঙা কুটীরের সারি।

অসহায় অথচ পূর্ণত অধিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের অবস্থানে সারা শরীর আর মাথা দাউদাউ জ্বলত। সময় কাটছে, বয়স বাড়ছে। নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে শালিকের ঘর। দীর্ঘ দুপুরঘড়ির কাঁটায় ওদের দিনযাপনের ব্যস্ততা জড়িয়ে যায়, নীচে দু-চারটে কুটো পড়লে লকলকিয়ে ওপরে ওঠে বিরক্তি আর শাপশাপান্ত। রোদ পড়লে নারকেল পাতার তৈরি জাফরি বারান্দা থেকে শীতলপাটি তুলে ঠান্ডা আঁধারে গা ধুতে নামে।

রোজ ঘাম জমে, নোনতা ধুলোর স্তর। রোজ ক্লেদ বিমুক্ত রাখার লড়াই করতে করতে নারকেল গাছের মাথায় স্নেহস্পর্শ নামে, কুচবরণ কন্যা মেঘবরণ কেশ আর আনন্দাশ্রু নিয়ে জড়িয়ে রাখে। মলিন সবুজ উজ্জ্বল হয়। পাতা কুড়িয়ে যাদের রান্না হয়, তারা খুব করুণমুখে ঘুঁটে বা কয়লার দাম হিসেব করে, কেরোসিন খোঁজে।

অথচ এতদিনে অভ্যেস হয়ে আছে আগুনের শেষ রাখতে নেই। জল আগুনকে জব্দ করে, বাড়বাগ্নির গল্প ইন্দ্রজাল হয়ে রসায়নে সুব্যাখ্যাত হয়। অথচ যারা জানে তারা জানত ভেজা কাঠ আর পাতায় শুধু ধোঁয়া হয়, পাক হয় না।

একা থাকার ভয় থেকে বাঁচতে আমরা আকাশে উঁকি দিয়েছিলাম, সেখানে আর সেখান থেকে যে বিরাটত্বকে পাওয়া যায় তা যে সমষ্টি কেবল বিভ্রম তার মোহ থেকে মুক্ত করে। সমস্ত মূলধারার সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উত্তরাধিকারকে নস্যাৎ করার সময়েই চূড়ান্ত বেনিয়ম ঘটিয়ে এক নিরুপায় অনবধানের সুযোগে চতুরতার সঙ্গে কেটে দেওয়া হল নারকেল গাছের মাথা। একা একা মরে গেল সে। অথচ হাতেকলমে দেখা যাচ্ছে তার অস্তিত্ব। কত অজানা পাত্রে জমিয়ে গিয়েছে সুপেয় পানীয় আর আড়াল করেছে কঠোর কাঠিন্য দিয়ে।

অতএব সমস্ত মায়া ছবি হয়ে যায়। যে আগুনের শেষ রাখতে নেই তাকেই শীতার্ততা বিশেষ অতিথির মর্যাদা দেয়। এদিকে অনেক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে উত্তরাধিকারীদের জন্য, আগুন পোয়াতে দেখলে রে রে করে, অক্সিজেন কমে যাচ্ছে এই তীব্র পরিবেশ সচেতনতায়। কিন্তু ঠিক কতটা ক্ষুদ্র স্বার্থে সচেতন সে কৃষ্ণগহ্বরের দিকে ফিরেও তাকানোর দায়িত্ব নেয় না। যেহেতু নেবে না দায়িত্ব, কেবল কিছু প্রকল্প দেবে, তাই শীত যেন হাড়ে দুব্বো না গজাতে পারে তা নিশ্চিত করতে শুকনো পাতা আর ডালপালা-কুটো যত্নে রাখা দরকার, দরকার ইন্ধনের সময়ে-অসময়ে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২