ছটি কবিতা – গৌতম চৌধুরী ও দেবদাস আচার্য

ছটি কবিতা – গৌতম চৌধুরী ও দেবদাস আচার্য

শেয়ার করুন

দেবদাস আচার্যর কবিতা

প্রাণ-গঙ্গা

এত প্রাণ
চারিদিকে বিন্দু বিন্দু সহস্র প্রাণ
চিনি বা না চিনি
দেখি
ঝরে পড়ছে যুগ যুগ ধরে ক্রমাগত
যেন বৃষ্টি ঝরে অবিরত

প্রাণের ভিতরে আমি আত্মহারা
প্রাণ প্রবাহে ডুবে
স্নান করি

অনন্ত

অসংখ্য বিদ্যুৎ কণিকার
ছুটন্ত ভাসমান ঢেউ
প্রণম্য প্রভু
মৃত্যু
মৃত্যু পরম শক্তিমান ও অমর
তোমার পুচ্ছের গতিময় তারকাগুলির
ঢেউ
জীবনকে ধারণ ও বহন করে করে
নিত্য ধাবমান।

গৌতম চৌধুরীর কবিতা

নিঃসঙ্গ কাফেলা

১.

অমোঘ একটা সত্য যদি হঠাৎ এসে হাজির হয়, কেমন দেখতে হতে পারে তার চেহারা! সে কি ধুধু মাঠের মাঝখানে বাজেপোড়া এক তালগাছ? না, কাঁপতে কাঁপতে অলিন্দে এসে-বসা সেই পাখি, যে ঝড়ে পথ হারিয়েছে? সে কি হৃৎপিণ্ড ভেদ ক’রে ছুটে যাওয়া আততায়ীর একটি মাত্র গুলি? না, শূন্য থেকে ভেসে-আসা কিছু পঙ্‌ক্তি, যা কাগজে লিখে ফেলতেই তুমুল স্রোতে ভেসে গেল অদৃশ্যের দিকে? সে কি জ্বরতপ্ত কপালের ওপর একটি শান্ত করতল? না, কুয়াশায় ঢেকে-যাওয়া সেই বাতিঘর, সারেং কিছুতেই যার হদিশ পেল না? হয়তো এই সব সম্ভাবনাই সত্যি। বা, রয়েছে আরও না-বলা সব সম্ভাবনা। কিংবা এসব কিছুই নয়, সে আসলে শুধুই এক পথের বিস্তার। কেবলই চলার হাতছানি।

২.

বৃক্ষশীর্ষ থেকে শেষ আলোরশ্মিটুকুও মুছে গেছে। শুকনো মুখে শূন্য হাতে ফিরে এসেছে ভিক্ষু। তাহলে নিজেকেই উৎসর্গ ক’রে দিতে হবে আজ, ভাবে সে। গিয়ে দাঁড়াতে হবে খোলা চত্বরে। ক্ষুধার্তদের তো ফেরানো যাবে না। তারা এসে একটু একটু ক’রে কেটে নিয়ে যাবে শরীরের একেকটা অংশ। মাটি অল্প সময়েই লাল হয়ে উঠবে। রেকাবিতে ঠং ঠং ক’রে এসে পড়বে নানা মাত্রার মুদ্রা। কিন্তু আজ আত্মবিক্রয়ের কোনও ফুরসত নেই। এখন শুধু নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের রক্তধারার ওপর। যতক্ষণ চেতনা থাকে। চোখের সামনে থেকে যতক্ষণ না-মিলিয়ে যায় বাকি কাফেলার আঁকাবাঁকা রেখা।

৩.

একটু সামান্য বৃষ্টিতেই কেমন রঙিন হয়ে ওঠে এই পথ। পায়ের নীচে রুক্ষ কাঁকরের আঘাতও আর স্পর্শ করে না তেমন। কতটা যে চলা হল, আর আরও কতটা যে যেতে হবে, তা নিয়ে চুলচেরা হিসেবে আর মন লাগে না। কিন্তু এমন মায়াবী বৃষ্টি তো রোজ হবে না। আকাশও এমন রঙিন হয়ে উঠবে না। তখন কি মানুষের মুখে ফিরে আসবে শাপশাপান্তের ভাষা? কে তাদের মনে করিয়ে দেবে, কেউ তাদের ডাকেনি এই পথে। সকলেই স্বয়মাগত। সবারই হয়তো একটা ক’রে আলাদা আলাদা কাহিনি ছিল। কিন্তু সেসব উপাখ্যান কাঠিমের পাকে গুটিয়ে অশথ ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছে তারা। তারপর, নেমে এসেছে এখানে। সেদিন কি তারা জানত, কোথায় যাবে, কোথায় যেতে চায়? কিচ্ছু না, স্রেফ একটা না-জানা উলসানি আকুল ক’রে রেখেছিল সেদিন। মুক্তি, ভেবেছিল তারা। আজ বুঝি মনে হয়, বড়ো কঠিন এই শব্দের ভার। খেলা থেকে বিদায় নেবে কেউ কেউ। কেউ কেউ তাকিয়ে থাকবে আকাশের দিকে, কবে আবার রঙিন হয়ে উঠবে তা।

৪.

প্রতিটি দ্বিধাহীন পদক্ষেপের আড়ালে রয়ে গেছে শত শত অনিচ্ছা। পরাভবের গাঢ় দাগ আঁকা আছে প্রতিটি অনুপলে। শক্ত ক’রে আঁটা ওই মুঠি, যাকে মনে হচ্ছে একটা বিরাট আত্মপ্রত্যয়ের ইশারা, তা আসলে ধরে থাকতে চাইছে একটি অদৃশ্য করতল। সেই করতল যেন নক্ষত্রখচিত এক টুকরো রাত্রি-আকাশ। বা, বিশাল অশ্রুবিন্দুর মতো একটি স্বচ্ছ নীল হ্রদ। বা হয়তো জ্যোৎস্নায় নেয়ে-চলা এক মাতাল অরণ্য। ভিতর থেকে গর্জন ভেসে আসে দু-একটি পশুর। আসলে সবটাই একটা বিনির্মাণ। আকাশ, সরোবর, জঙ্গল–কারওই কোনও অস্তিত্ব নেই। শুধু এক অদৃশ্য করতল পথিকের মুঠির ভেতর ধকধক করে। ভেঙে পড়ার হাত থেকে বাঁচায়। একটা জলজ্যান্ত শিশুই তাহলে বলা যায় এই পথিক মহোদয়কে। শক্ত ক’রে ধরে আছে সেই করতল, পাছে হারিয়ে যায়। আসলেই যা নেই, তবু না-থেকেও যা উত্তাপ দিয়ে যায়, কল্পনায়।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২