সাবিনা স্পিয়েলরিনের সেই ডায়ারি: ( পর্ব ৩ ) – বল্লরী সেন

সাবিনা স্পিয়েলরিনের সেই ডায়ারি: ( পর্ব ৩ ) – বল্লরী সেন

শেয়ার করুন

চাবুক–দণ্ড

“…আমার বাবা, আমার বাবা আমাকে যেদিন চাবুক পেটা করলেন; হাঁটুর ওপর ফ্রক তুলে যেদিন হামি দিলেন, হামি দিলেন জানু আর বাজুর কনুইয়ে, নুয়ে পড়ে পায়ের পাতায় তাঁর ঈষৎ বাদামি চিবুক ধরে রাখলেন বহুক্ষণ… যতক্ষণ আমার সব শ্বাস যন্ত্রের মতো তাঁর গ্রীবার ধাক্কা খেতে খেতে যেন আর না ফেরে, সেইরকম এক মরণের তেষ্টায় তখন তিনি নিজেকে জল্লাদের মতো হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন বিষুবরেখার সীমান্তে। আর দিব্বি এরকম সহজ ধ্বংসাত্মক একটা গতিস্পন্দে আমাকে দুকাঁধে ধরে ঝাঁকিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, কী যে বললেন, যার মাথামুণ্ডু নেই। বললেন যেন তিনি পাগল হয়ে গেছেন, যেন শুনলাম বললেন, তাঁর মা তাঁকে ১২ বছর বয়সে ফেলে চলে যান, অথচ বাবার সঙ্গে কোনো বিরোধ হয়নি, কোনও ঝগড়াও না।

আমি ডায়ারি লিখি নিকোলাই জানেন। আমি নিকোলাই বলেই ডাকব, উনি আমার বাবা বলেই এত অপ্রত্যাশিত ব্যবহারের জন্য আমি নিজেকে দায়ী করি। ফ্রকের লেস সরালে দেখি বাবার চুমু কেমন সাপের দাঁতের মতো বসানো এই মাংসর ওপর। নিরুক্ত বিষ ঢেলে একটা ভয়াবহ সিরাপ আমার গেলাসে কে যেন ঢেলে রেখেছে, চোখ বুজলেই ওই রাত্রি আমার মনের ভেতরে পানশালার মতো হুল্লোড় করতে শুরু করে দেয়—আর সেই চাবুকের দাগের স্মৃতি সেই বিষণ্ণ ঢাকা বারান্দা, মেঘ সালংকারামুখর বর্ষায় ককেশাস পর্বতের শীতল তুষার বয়ে আনছে ঝড়; ডন নদীর জল জমতে শুরু করেছে আর বাবার দাঁতের মতোই ওর ধার। খুরপি কোপালে চাঁই বরফের ইঁট মনে হয়। আমাদের রস্তভ শহরের সর্বত্র স্লেজ চলছে, যানবাহন বেশ কম।”

—গাউনের পকেট থেকে এই চিরকুট এসে পড়ল ড. ব্লয়লারের হাতে, তিনি একটা সভা বসিয়ে ইয়ুং-এর পরামর্শ নিলেন। হইচই পড়ে গেল হাসপাতালের দিকে দিকে। আর নিকোলাই যাতে কোনোদিন মেয়েকে দেখতে না আসেন, তা বিধিসম্মত করতে ব্লয়লার চিঠি দিলেন দেশের বাড়িতে। শার্সি ভেদ করে যে বাষ্প তারার মতো আলো বয়ে আনত, সাবিনা তাকে দেখে মনে করত তার ছোটোবেলার ডন নদীর ধার, তরঙ্গায়িত প্রবাহের ফেনায় সে তার বিগত দিনগুলোর ওপর এক দোয়াত কালি উলটে দিল, কিন্তু নিজের হৃত দেহের সারাৎসার যে ক্যেভিয়ারের সুখাদ্যের মতো তার জন্মজিভে আটকে আছে!

দশম অধ্যায়

১৭.০২.১৯০৩

যে উপায়ে নিকোলাই তাঁর কৃষির মাটি তৈরি করে থাকেন, যে উপায়ে দুধ ধুনে ধুনে তার অন্তরের ক্ষীর বার করে আনেন, সেই একই উপায়ে তিনি আমার পাঁজরার মধ্যে শামুকের খোলার মতো ছুঁচোলো কিছু ফোটান্ আর ব্যথার বোধ হওয়ামাত্র এক শিরশিরানি খেলে যায়। যেন উলঙ্গ পিঠের কাঁকরে আইজ্যাক বা হাই স্কুলের সেই হিস্ট্রি স্যার সদ্য ঘুম ভাঙা অবস্থায় আমাকে কোলে শুইয়ে মজা মজা কাঁদাচ্ছে, আর কী যে পাচ্ছে, কী যে আনন্দ, কী যে দুঃখ, কী যে সুখানুভব। নিকোলাই তখন ধানের পেঁজা তুলোয় হুল ঠিকরে দিচ্ছেন আর লাল টকটকে তাঁর চোখ বৃষ্টির ছাটে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার শরীরের নীচে ধরা এক টুকরো বাগানকে, যেখানে টিউলিপের কুঁড়ির ভেতরে কার যেন হাতের অবিকল দাগ। মায়ের আর্ত চিৎকারে হতভম্ব নিকোলাই, আমার বাবা, যিনি পুশকিন ধরিয়েছিলেন আমাকে; তিনি দু হাতে মুখ ঢেকে দৌড়ে ঘর থেকে ছুট্টে বেরিয়ে গেলেন সে মুহুর্তে। মা-ও প্রথমে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেমন শব্দ করে ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার আওয়াজ করতে করতে ধাওয়া করলেন বাবার। আমার বেদম রাগ হচ্ছিল মায়ের ওপর, কেমন গা ঘিনঘিনে একটা। পা সমেত কোথায় আমার সর্বাঙ্গে উত্তাপ, ঘুম আর আনন্দ সুরার মতো আমাকে পিষে দিচ্ছে হামানদিস্তায়, কিন্তু আমি এই একক পরিধির ওপার ডিঙিয়ে উড়ে যাচ্ছি একা পারুল বোন। আমার চার ভাইবোনের বৃত্ত আমি কেটে পার হচ্ছি রস্তভ অন ডন নদীর শ্বেত চর্বি, যার বুনো বগলের দগ্ধ ঘাসে পুরনো মাসিকের ন্যাকরাখানি লেপ্টে আছে একটা পারটুন্সক্রাফটের দৈব মূর্ছনায়। আসলে আমি কাঁদছিলাম না। এটাই আমার অপরাধ। আমি দুঃখিত হব কেন, কেন মসৃণতাকে আমি নাকচ করব, কেন বাপের অলস দুপুরের সোহাগি তোষকে মুখ রেখে আমার দ্রবণ চিনতে কষ্ট হবে আমার? কেন ছিঁচকে পোড়া স্যাঁকা বেগুনের মরিচের মতো নরমকে সামাল দেবে না ওই ঝাঁজালো গোড়ালির চপ্পলদুটো। আমি ভাবি আর স্বপ্নে একদিন ঘাগরা ভিজিয়ে ফেললাম। সেইদিন দেখলাম ইভার রাগ কাকে বলে। ধুতে হবে বলে এত ক্রোধ তাঁর, না। আসলে এ এক অসবর্ণ অসূয়ার গল্প, মা আর মেয়ের চুলটি-মালুটি, তাই আবার প্রহার পেলাম। আর এ চাবুকের ঘা আমাকে জন্তুর মতো লোকসানে বুভুক্ষু করে তুলল অচিরে। ইভা-নিকোলাই হাইফেনেটেড গেরস্থালির তলায় পাপোষের কুকুরের মতো আমি ওদের জঙ্গমতার স্বাদ নিতে লাগলাম নিকোলাইয়ের টনিক মন্থনে, হেলনে, তোবড়ানো হাড়ের মজ্জায়। আর ইভা ক্ষণে ক্ষণে তার টেক্কা দেবার মন্ত্রে যা নয় তাই খরচা করতে লাগলেন। যেন নিজের জীবনের দাম্পত্যকে উনি এক এক চক্করে ফেলে ভেঙে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন এ ও তা কে। গায়ে পড়ে ঘ্যানঘেনে এই মহিলাটি দরকার না থাকলেও আইজ্যাকের মোজা কিনে আনেন, এমনই। অথচ কেবল দুর্ভাবনা করা তাঁর প্রধান কাজ।

২৬.০৪. ১৯০৩

উইঢিবির পেটের নীচে প্রাচীনায়তন কুলুঙ্গির মধ্যে বাবার চাবুকের কালশিটে ভাবলেই জিভ সেজে ওঠে, আহা কী যে মোহনীয় তানপুরার হ্লাদিনীধারা ছুটছে প্রপাতময় তাণ্ডবে। যতবার সপাং শব্দে ব্যথা চল্‌কে উঠছে, ততটাই টানটান স্বমেহনের রশি আমার কুণ্ডলিনীর মরমে কষ্টের মহাজনি কারবারে মেতে উঠেছে। আরও মার খাবো, নিকোলাই… যত মার মারলে নিজেকে শেষ অবধি হতরিক্ত হয়ে ঘেন্না করা যায়, ঠিক ততটা মার আরও দরকার ।

— নিকোলাই! তুমি কি তোমার মাকে এমনই ঘৃণা করো? তাই বলতে যে, আমি নাকি তোমার মায়ের মুখ কেটে বসানো। তাই মায়ের কোনো ছবি নেই রস্তভ-এ। কোনো ফলক নেই। এমনকি, কোনও গল্প পর্যন্ত বলেনি কেউ, যা তোমার ছেলেবেলার কথা বলবে আমাদের। ভয় আসতে লাগল, প্রেতগ্রস্ত হলাম। প্রতি রাতে আমার ওপর কেউ ভর করে। সূর্যাস্তের পর প্রতি রাতে…

(ক্রমশ)

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২