সাহির লুধিয়ানভির কবিতার অনুবাদ – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
‘শায়র এ ইনকিলাব’ সাহির লুধিয়ানভি। বিশ শতকের উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি।
প্রগতিশীল সাহিত্য সমিতির সদস্য থাকার সময়ে কমিউনিস্ট আদর্শ প্রচার করার জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের গ্রেপ্তারি এড়িয়ে ভারতে আসেন। তখন তাঁর প্রতিবেশী হন গুলজার ও কিষেনচন্দ (প্রথমজন খ্যাতনামা উর্দু কবি ও দ্বিতীয়জন উর্দু ঔপন্যাসিক)।
১৯৪৯ সাল থেকেই তিনি ফিল্মের জন্য গান লিখতে থাকেন। ১৯৬৩ সালে ‘তাজমহল’ ও ১৯৭৬ সালে ‘কভি কভি’ ফিল্মের জন্য ফিল্ম ফেয়ার পান।
প্রগতিশীল কবি হিসেবে তাঁর রচিত গান (গজল, নজম) এক অন্য মাত্রার বিষয় ছিল।
মহম্মদ ইকবালের ‘সারে জাহান সে আচ্ছা’-কে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন ‘তালিম হ্যায় অধুরী/ মিলতি নহিঁ মজদুরী/মালুম হ্যায় কিসিকো/ দর্দ-এ-নিহা হমারা/…’
ফিওদোর দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’-এর অবলম্বনে তৈরি ‘ফির সুবহ হোগী’ ফিল্মের আর একটি গানে সরাসরি পুঁজিবাদকে আক্রমণ করে লেখেন ‘বিতেঙ্গে কভি তো দিন আখি / ইস ভুখ কি অর বেকারী কে/ টুটেঙ্গে কভি তো বুৎ আখির/ দৌলত কি ইজরাদারী কে/ …জব এক অনোখী দুনিয়া কি/ বুনিয়াদ উঠাই জায়েগি/ ওহ সুবহ কভি তো আয়েগি…’
তাঁর ‘তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা’, ‘হমনে শুনা থা এক হ্যায় ভারত’, ‘হর তরহ কে জসবাত কা আয়লান হ্যায় আঁখে’’, ‘অভি না যাও ছোড় কর’, ‘তুম অপনা রঞ্জ ও গম’, ‘পর্বতো কে পেড়ো পর’ প্রভৃতি রচনা অনবদ্য।
১৯৬৮ সালে গালিবের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষ্যে তিনি সরাসরি লিখেছিলেন ‘যিন শহরও মে গুঁজি থি গালিব কি নবা-বরসো/ আজ উন সহরো মে উর্দু বেনাম ও নিশাঁ ঠহরি/ আজাদী এ কামিল কা আয়লান হুয়া জিস দিন/ মাতুব জবান ঠহরি/ গদ্দার জবান ঠহরি…’।
তিনি মহিলাদের ওপর অত্যাচার-এর বিষয়ে অজস্র লিখেছেন। যেমন ‘অওরত নে জনম দিয়া মর্দও কো/ মর্দও নে উসে বাজার দিয়া…’
প্যায়াসা ফিল্মে তিনি লিখেছিলেন ‘মদত চাহতি হ্যায় য়হ হবা কি বেটি/ যশোদা কি হম জিন্স / রাধা কি বেটি/পয়ম্বর কি উম্মদ / জুলেখা কি বেটি/ জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পর ওহ কহাঁ হ্যায়’ (মূল রচনায় শেষ লাইন ছিল ‘সনাখওয়ানে তকদিশ এ মশরিক কহাঁ হ্যায়)।
আজও কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ বিপ্লবের প্রতি প্রেমে পড়ে বলছেন ‘ওহ সুবহ কভি তো আয়েগি/ ইন কালি সদিও কে সর সে জব রাত কা আঁচল ঢলকে গা’ আবার কোনো মানবী তার প্রিয়তম কে বলছে ‘জহাঁ মে এইসা কোন হ্যায়/ কে জিসকো গম মিলা নহি’। হয়তো কেউ আবার প্রেয়সীর প্রেমে পড়ে ভাবছেন ‘কভি কভি মেরে দিল মে খয়াল আতা হ্যায়/ কে জিন্দেগী তেরে জুলফো কে পনাহো মে গুজরতি তো বহত আচ্ছি হোতি’।
তাঁরই তিনটি কবিতার অক্ষম অনুবাদের চেষ্টা করলাম।
ক্ষণিকের কবি
আমি ক্ষণিকের কবি, আমার কাহিনিও ক্ষণিকের
ক্ষণিকমাত্র আমার অস্তিত্ব, আমার তারুণ্যও ক্ষণিকের।
আমার আগেও বহু কবি এসে বিদায় নিয়েছেন,
কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গিয়েছেন, কেউ গীতরচনা করেছেন।
তাঁরাও ক্ষণিকের কাহিনি ছিলেন, আমিও কাহিনি ক্ষণিকের ,
কাল আমিও বিদায় নেব, যদিও আজ আমি তোমাদের।
এটাই আমার সৌভাগ্য, ক্ষণিকের জন্য কিছু বলতে পারা,
তোমাদের এই দয়াই যথেষ্ট, ক্ষণিকের জন্য কিছু শুনতে চাওয়া।
আগামীদিনে অনেকেই প্রস্ফুটিত কাব্যের সাজি নিয়ে আসবেন,
তাঁরা আমার থেকেও ভালো বলবেন,
তোমাদের থেকেও ভালো শ্রোতা পাবেন।
ধরণীর সব ফসলই আজ জন্মায় কাল কাটা হয়,
জীবন সেই বহুমূল্য যাপন, বিন্দু বিন্দু যা বণ্টিত হয়।
সাগরের ঢেউ আমি সাগরেই হারিয়ে যাব,
মাটির আত্মার স্বপ্ন আমি মাটিতেই আবার শয়ন নেব।
কাল যদি কেউ আমায় মনে করে, কেনই-বা করবে—
ব্যস্ততাময় এই জগৎ কেন নিজেদের সময় নষ্ট করবে।
চোখের জল
কখনও নিজের উপর, কখনও পরিস্থিতির জন্য চোখে জল চলে আসে
কথা উঠলে যেকোনো কথায় চোখে জল চলে আসে।
আমি তো ভেবেছিলাম আমি তাঁকে ভুলেই গেছি
কী যে হল আজ এ কোন্ কথায় চোখে জল চলে এল?
কেন বেঁচে আছি, কার জন্য বেঁচে আছি?
সবসময় এরকম প্রশ্ন এলেই চোখে জল চলে আসে।
হে বন্ধু, কেউ অপরের জন্য চোখের জল ফেলে না,
সবারই নিজের জন্য চোখে জল চলে আসে।
জীবন
জীবনকে এতটাই নিকট থেকে দেখেছি যে
সব চেহারাই আশ্চর্য বোধ হয়
হে বর্তমান, জেগে ওঠো, কোথায় নিদ্রিত তুমি?
বধ্যভূমি থেকে তিনি ডাকছেন তোমায়—
এই উরোগামী জীবন আর কতদিন বইব?
রোগী এখন চিকিৎসা দেখলেই ক্ষুব্ধ হয়—
সমস্ত দুঃখের জন্য প্রেমিকবৃন্দ অপেক্ষমান
প্রিয়ের গৃহপথই এখন বধ্যভূমির পথ
জীবন এমনভাবেই আমার সঙ্গ দেয়
যেন প্রিয় শত্রুকে সে সহ্য করছে….