রাত যখন নেমে আসে – নাতাশা গয়ারি অনুবাদ: তপন মহন্ত
[লেখক পরিচিতি: নাতাশা গয়ারির জন্ম গুয়াহাটিতে। তাঁর বাবার বদলিযোগ্য সরকারি চাকরির জন্য তাঁকে অসমের বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করতে হয়। দিল্লিতে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে তিনি বেঙ্গালুরুতে চলে আসেন। একটি আইটি কোম্পানিতে পূর্ণকালীন কাজ করার পাশাপাশি, তিনি তাঁর বন্ধুদের সাথে একটি যোগশিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনা করেন। বেঙ্গালুরু রাইটার্স ওয়ার্কশপের সদস্য।]
বাড়িটা নির্জন লাগছিল। রাজেশ উঠোন পেরিয়ে মাটির ঘরের বারান্দায় উঠে এসে তার পিঠের ব্যাগটি নামিয়ে রাখে। কাঠের বেঞ্চে বসে, সে তার পায়ের ধুলো ধূসরিত ক্যানভাসের জুতোর ফিতে খুলতে থাকে। বাইরের উষ্ণ বিকেলের নীরবতা ভাঙছিল একটি পথভোলা পাখির কান্না আর গ্রামটিকে ঘিরে থাকা বাঁশঝাড়ের মর্মর ধ্বনি। আগামী মাসগুলিতে একটি উত্তপ্ত গ্রীষ্মের আগমনির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল।
কলেজের ছোটোখাটো ছুটিতে রাজেশ সবসময় গুয়াহাটি থেকে গ্রামে ফেরার উত্তেজনার প্রবল অনুভূতি নিয়ে বাসে চাপে। চলার পথে বাসটি গ্রামবাসীদের তুলে তুলে অতিরিক্ত বোঝাই হয়ে, ধুলোবালির মেঘের ওপর উঁচু হয়ে দুলতে দুলতে এগোয় ধীর লয়ে। শীঘ্রই ভারী কিছু তার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অবস্থা আরও খারাপ হয় যখন সে গ্রামের অসমতল রাস্তায় পায়ে হেঁটে নারকেল ও সুপারি গাছের মাঝ দিয়ে তার বাড়ির বাঁশের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়। এবার সে মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বাড়ি এসেছে। সে রিমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে তার ঠাকুমা, মা-বাবা, ছোটোভাই—তার পরিবারের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
বিড়ালটি ছোট্ট ডাইনিং রুমের ঘুণে ধরা দরজার কাছে ‘ম্যাও’ করে। রাজেশের ছোটোভাই ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে বারান্দায় তারে ঝোলানো গামছায় মুখ মুছে নিঃশব্দে পাশের ঘরে ঢোকার আগে একপলক রাজেশের দিকে তাকায়। তার কপালের উপরের চুলের গোছাটা একটু খাড়া ছিল। জল, না জেল দিয়ে, রাজেশ ঠিক ধরতে পারে না।
“দুপুরের খাবার টেবিলে রাখা আছে।” ঠাকুমা বারান্দায় উবু হয়ে বসে দেয়ালের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। তাঁর পিঠের কুঁজটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল।
“মা কোথায়?” এটা ঠিক যেন প্রশ্ন করা নয়। ঠাকুমার কথার জবাবে কিছু বলা।
“তার ঘরে, আর কোথায়?”
একটি বাদামি মুরগি আশেপাশে চড়ছিল। মুরগির বাচ্চারা গোলাকারে মাকে ঘিরে ছিল। এই মরশুমে ছানাদের সংখ্যাটা বেশি। ঠাকুমা রোদে শুকানোর জন্য উঠোনে রাখা হালকা বাদামি ধানের স্তূপকে হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিতে নীচে নেমে গেলেন। রাজেশ তার গলায় একটা ছোট্ট দলা অনুভব করে। ঠাকুমা সম্ভবত একমাত্র কারণ, রিমার সাথে সম্পর্কের পরে, সে প্রথম বাড়িতে এসেছে!
সে কূঁয়োর ধারের বাঁশের ঘেরা দেওয়া স্নানের জায়গার বেড়ায় ঝোলানো একটি আয়তক্ষেত্রকার ছোটো ফাটা আয়নার দিকে তাকিয়ে শেভ করতে করতে রিমার কথা ভাবছিল। পরদিন তাকে নিকটবর্তী বাসস্টপ থেকে আনতে যাওয়ার আগে আজকের এক ঘণ্টার বাস যাত্রা তাদের আলাদা করে দিয়েছে। কূঁয়োর শীতল জলে স্নান সেরে শরীরের ধুলো পরিষ্কার করায় তার শরীর ও মনের প্রশান্তি ফিরে আসে।
রাজেশের দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতে বাইরের তাপমাত্রা নেমে যায় আর বাঁশের গেটের বাইরে সরু গ্রামের রাস্তার ধুলোও থিতু হয়। ঠাকুমা পাটের মাদুরের উপর ধানের স্তূপ জমা করেন। সম্প্রতি কাটা ফসলের গোলায় ধানগুলো ভরতে রাজেশ তাঁকে সাহায্য করে। সেখানে কাঠের পাটাতনের উপরে কবুতর বাসা করেছিল। এমন সময় ময়লা শার্ট ও সবুজ গামছা পরা একজন রোগা-পটকা লোক বাঁশের গেট দিয়ে টলতে টলতে ঢোকে।
“ওহ তুমি! কখন এসেছ?”
বাবার দিকে না তাকিয়ে রাজেশ বলে, “তিনটেয়”।
“ভালো ভালো।” তিনি হোঁচট খেয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। জুমাইয়ের (স্থানীয় মদ) তীব্র গন্ধ তাঁকে পিছু করে।
দ্রুত রাত নেমে আসে। রাজেশ বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ঠাকুমা বারান্দায় তার সাথে নীচু একটি কাঠের টুলে বসেছিলেন। দুজনেই নীরবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। বাইরে ঝিঁঝিপোকার একটানা কোরাস ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। দূরে জ্বলে উঠল কেরোসিন তেলের কুপি। অনেক গ্রামেই বিদ্যুৎ নেই। যেখানে আছে, সেখানেও দিনে কয়েক ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। আবছা আলো তার মায়ের ঘরের জানালায় খেলা করছিল। দূরবর্তী কণ্ঠগুলি ফিসফিসের মতো শোনাচ্ছিল। হঠাৎ এক ঝলক বাতাস রাজেশের শান্তির বিরল মুহূর্তটিকে বিষিয়ে দেয়। জুমাইয়ের তীব্র গন্ধে বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে। সে ভাবে রিমাকে বাসায় নিয়ে আসা উচিত হবে কিনা। ঠাকুমা হালকা সুতির শালে নিজেকে ভালো করে জড়িয়ে নেন।
প্রায় এক বছর আগে যখন তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, রাজেশ রিমাকে তার বাবার মদ্যপানের কথা বলেছিল। তারা দুজনেই এ ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কারণ বেশিরভাগ গ্রামবাসীর জুমাইয়ের প্রতি আসক্ত হওয়াটা তাদের সমাজে সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু যা সে রিমাকে বলতে পারেনি বা যা সে নিজেও কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি, তা ছিল তার মায়ের নেশার বিষয়টি। সে কখনও ভাবতে পারেনি যে তার মা নিয়মিতভাবে মদ্যপান শুরু করতে পারেন।
সেই রাতে, যখন সে তাঁকে রিমার কথা বলে, ঠাকুমা প্রথমবারের মতো হাসলেন।
“ঈশ্বর তার মঙ্গল করুক।” উনি রাজেশের প্রিয় ফুটন্ত লাফা শাকের কড়াই নাড়তে নাড়তে বলেন।
“আমি কি তাকে বাসায় নিয়ে আসব? সে একবেলার জন্য আসবে।”
“চিন্তা করো না। তোমার মা-বাবার অন্তরটা খারাপ না।”
“কিন্তু তাতে তো লাভ হবে না।”
ঠাকুরমা কোন উত্তর দিলেন না।
তার বাবাকে মদ্যপান বন্ধ করতে রাজি করানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে কোনো কথাই শুনতেন না। প্রতিবারই উনি তাঁর স্ত্রীর সাথে মদ খাওয়া নিয়ে ঝগড়া করেন। আসলে শিক্ষকের চাকুরির জন্য উনি গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। টাকাটা স্থানীয় কাঠের ঠিকাদারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছিলেন। ঋন শোধ করতে না পেরে উনি মদ্যপান শুরু করেছিলেন। কারণ চাকুরিটা অন্য কাউকে দেওয়া হয়েছিল এবং টাকাটাও আর ফেরত পাওয়া যায়নি। যখন তার ঠাকুরদা পাশের শহরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে স্ট্রোক করে মারা যান, তখন তাঁকে ধানক্ষেতের একটি গাছের নীচে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এখন তিনি সারাদিন মদে ডুবে থাকতেন। এমনকি সঙ্গী জুটলে সারারাতও মদ নিয়ে থাকতে পারেন। রাজেশের কাছে এটি একটি অলৌকিক ঘটনা যে তার বাবা এখনও বেঁচে আছেন! সে গ্রামের বেশ কয়েকজন যুবককে চেনে যারা অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলিওর, এমনকি মস্তিষ্কে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মারা গেছে। কিন্তু তার মায়ের বেলায় সে এমনটা আশা করেনি যে মা-ও তার বাবার পথ অনুসরণ করবেন। অথচ উনি তাঁর স্বামীর সাথে প্রাণপণে লড়াই করতেন যাতে তাঁকে মদ্যপান থেকে বিরত রাখা যায়। যখন প্রাথমিক মিষ্টি কথায় কাজ দিল না, তখন উনি সরাসরি তাঁর মদ্যপানের বিরোধিতা শুরু করেন। তাঁরা একে অপরকে গালিগালাজ করতেন যতক্ষণ না তাঁদের মধ্যে একজন কয়েকদিনের জন্য বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। একদিন, রাগের বশে, সে তাঁর স্বামীর বিছানার নীচে থাকা জুমাই ভর্তি একটি গামলার পুরোটা পান করলেন…
সে রাতে রাজেশকে তার বিছানা বানাতে সাহায্য করার সময় ঠাকুমা খুব হাসলেন। দীর্ঘদিন রাজেশ তাঁকে এত খুশি দেখেনি। ঘুম না আসা পর্যন্ত সে রিমার কথা ভাবতে থাকে।
পরদিন সকালে, সে দ্রুত স্নান সেরে একটি পরিষ্কার শার্ট ও একটি পুরোনো জিন্স পড়ে নেয়। তার বাবা আর ভাইকে কোথাও দেখা যায় না। বেডরুমে ঢুকে মাকে দেখার তার আর ইচ্ছে করছিল না। সকালের চা খাওয়ার সময়, ঠাকুমা তাকে জানিয়েছিলেন যে তার মা আগের রাতে ডিনার করেননি। তাঁর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সে থমথমে মুখে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবার চেয়ে তাঁর মায়ের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটেছে। বিগত দুই বছরে, উনি প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন।
সাইকেল চালিয়ে রাজেশ তাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরের বাস স্টপে যায়। বাসটি সকাল ১১টায় পৌঁছানোর কথা। তবে বেশিরভাগ সময়ে লেট করে। কিন্তু রাজেশ কোনো সুযোগ নিতে চায়নি। ১১টা ৪০ মিনিটে বাস আসে। রিমা বাস থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার পরনে উজ্জ্বল কমলা রঙের দখনা ও ব্লাউজে পিন আঁটা একটি হালকা-সবুজ চাদর তার কাঁধ জুড়ে নেমে এসে তার টলটলে মুখকে আলোকিত করেছে। রাজেশ সাইকেলে বসে তার পিছনের সিটে রিমার চড়ার জন্য অপেক্ষা করে। রিমা তার কোমর ধরে বসে। তারা ধুলোবালি, নুড়ি পাথরের অসমান রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যেতে যেতে নিজেরাই হাসাহাসি করছিল।
রাজেশের মা বারান্দার মেঝেতে বসেছিলেন। তিনি তাঁর ছেলেকে বাঁশের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখলেন। রিমা তার পেছেনে ছিল। রাজেশ মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের দিকে না তাকিয়ে রিমাকে তাঁর দিকে এগিয়ে দিল। রিমা মুচকি হেসে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। মেরুন সুতির শালে আবৃত ফ্যাকাশে রোগা মহিলা তাঁর কম্পিত হাত তুলে রিমার থুতনিতে স্পর্শ করতেই হাঁপিয়ে উঠে। তাঁর ক্লান্ত লাল চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এখন সবাইকে আরও ঝাপসা দেখাচ্ছে। “হে ঈশ্বর! তোমাকে রাজকন্যার মতো দেখাচ্ছে। এখন আমরা কি করব?”
“মেয়েটি কে?” রাজেশের বাবা তাঁর বিবর্ণ ঘরের বিছানায় উঠে বসলেন। এ ঘরে আলো খুব কমই ঢোকে।
“ওহ। এখানে এসো। এসে দেখ কে এখানে থাকে।”
কয়েক মিনিট পরে রাজেশের বাবাকে দেখা যায়। তাঁর বেসামাল পদক্ষেপ। শ্বাসে দুর্গন্ধ। রিমা তার দিকে এগিয়ে গেল, নীচু হয়ে তার পা স্পর্শ করল। উনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হঠাৎ তাঁর ফোলা ফোলা চোখ থেকে অঝোরে নেমে আসে অশ্রুধারা। উনি দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়েন মাটিতে। উনি কথা বলার চেষ্টা করেও পারলেন না। শুধু কাঁদলেন। তাঁর স্ত্রী পাশে বসেছিল। তাঁর দুর্বল হাতদুটো দিয়ে গায়ের শালটা ঠিক করে রিমার দিকে তাকিয়ে ছিল। রাজেশ নিথর চোখে স্থির দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে। রিমা ঠাকুমার পা ছোঁয়। ঠাকুমা তার গালে চুমু দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
বাড়িতে রাজেশ এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে অভ্যস্ত ছিল না। তার বাবা কান্নাকাটি বন্ধ করে করে তাঁর শার্টের ময়লা হাতা দিয়ে তাঁর মুখ মুছলেন। “আমরা এখন কী করব? আমরা ওর জন্য যথাসাধ্য সব করতে চাই।”
“ও আজ এখানে শুধু বেড়াতে এসেছে।” রাজেশ বাবার দিকে না তাকিয়েই বলে।
“না, তা হতে পারে না। কীভাবে আমরা ওকে যেতে দিতে পারি?” মা কেঁদে বলেন। তাঁর নিশ্বাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল।
“সে আমাদের পরিবারের একজন।”
“মা। চুপ কর। ও শুধু তোমার সাথে, বিশেষ করে ঠাকুমার সাথে দেখা করতে এসেছে। আজ এখানে থাকার জন্য আসেনি।”
এতে রাজেশের মা অঝোরে কাঁদলেন। বাবা মায়ের কাঁধে হাত রেখে নিজেও কাঁদছিলেন। তাঁদের মধ্যে আজ বিরল একাত্মতা দেখা গেল! মায়ের শ্বাস ভারী হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর মনে হচ্ছিল যে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
তাঁরা শান্ত হলে রিমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ওর হাতে ধরা একটি পিতলের থালায় পাঁচ কাপ চা। ঠাকুমা ওর পেছনে পেছনে একটি প্লেটে মেরি বিস্কুট নিয়ে আসেন।
সেদিন রাজেশের বাবা স্নান করে একটি পরিষ্কার শার্ট এবং একটি সাদা গামছা পরেন। তার মা স্যালাইনের ড্রিপ নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতে পেরেছেন। ঠাকুমা দুপুরের রান্না সারেন। রিমা তাঁকে সহায়তা করে। মুরগি এবং নিজেদের খেতের সবজির ঝোল রাঁধা হয় দুপুরের খাবারের জন্য। রাজেশের ভাই আগেরদিন বিকেল থেকে বাড়িতে ফিরে আসেনি। কেউ তার খোঁজও করেনি। কিছু গ্রামবাসী, বেশিরভাগই পাশের বাড়ির মহিলা তাদের সন্তানদের নিয়ে রিমাকে দেখতে আসে। রিমা যখন তাঁদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিচ্ছিল, তখন শিশুরা তার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল। রাজেশের মা-বাবা আগেই তাঁদের রুমে ঢুকে গিয়েছিল। আজকাল দুপুরে তাঁরা খুব সামান্যই খেতে পারেন।
রিমার উপস্থিতি পুরোনো বাড়ির অনেকদিনের গুমোট আবহাওয়াকে বদলে দিয়েছে। রাজেশের মনে ভেসে আসে দূর, অতীতের অস্পষ্ট ম্মৃতি… তখন তার মা সকালের নাস্তার জন্য পিঠা বানাতেন আর দুপুরের খাবারের জন্য গ্রামের পুকুরের মাছ ধরতেন। …তখন তার ভাই আর তাকে তার বাবা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে রেখে আসতেন… তখন জুমাইয়ের গন্ধে বাতাস ভারী হত না, আর তার বাবা ছিলেন সদাহাস্যোজ্জ্বল মরমী মানুষ…
দুপুরের খাবারের পর, রিমা একটি কাঁসার বাটায় পান-সুপারি নিয়ে আসে। সে দক্ষতার সাথে একটি কাটারি দিয়ে তাম্বুল টুকরো করে পানে চুন লাগায়। রাজেশের মা এবং বাবা স্নেহের সাথে তাম্বুলের টুকরো তুলে নিলেন। রাজেশের হৃদয় খুশিতে উথলে উঠে।
শীঘ্রই রিমার ফিরে যাওয়ার সময় হবে। রাজেশ তাকে সাইকেলে বসিয়ে বাস স্টপে নিয়ে গিয়ে তাকে বিদায় জানাবে। কয়েক মাস পরে তারা আবার দেখতে পাবে পরবর্তী কলেজ ছুটির সময়।
“ওকে যেতে দিও না প্লিজ।” রাজেশের মা যন্ত্রণায় কাঁদলেন এবং তাঁর কাঁপা হাতে মুখ লুকালেন। যখন রিমা তাঁর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে নীচু হয়, রাজেশের মা কেঁদে ফেলে বলেন, “ওকে যেতে দিও না, প্লিজ!” সে কম্পিত হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকেন।
“তুমি কীভাবে আমাদের সাথে এমনটা করতে পারো?” তার বাবা রিমার পিছন দিক থেকে এসে হাঁটু ভেঙে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়েন। রাজেশ তাঁকে সান্তনা দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে তিনি তার হাত ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেন।
রিমা মাথা নীচু করে। ঠাকুমা টুলের উপর বসে অসহায়ভাবে ওদের দেখেন।
“আমি এখন ওকে বিয়ে করতে পারব না মা। ওর এখনও হাইস্কুল শেষ হয়নি। আর আমি এখনও কিছু উপার্জন করি না। আমার কিছু নেই।” রাজেশ রাগে ও লজ্জায় কাঁপছিল।
“ও কথা বোলো না।” বাবা গর্জন করে, তাঁর নাকের জল মুছে বলেন, “ও কথা বোলো না। আমার যা কিছু আছে সব আমি তোমাকে দিয়েছি। তুমি এমনটা কীভাবে বলতে পারো?”
“না, তোমার কিছু নেই।” রাজেশ দূরে তাকিয়ে বলে।
একথা শুনে তার বাবা চিৎকার করে উঠলেন। পাশের বাড়ি থেকে দুজন মহিলা ঘটনাস্থলে এসেছেন। তাঁরা সান্ত্বনা দিতে রাজেশের মায়ের হাত ও কাঁধ ধরেন। গ্রামবাসীরা, যাঁরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন তাঁরা এগিয়ে আসেন। ঠাকুমা তার সুতির শালের কিনারা দিয়ে নিজের চোখের জল মুছলেন।
সূর্য অস্তমিত হতে শুরু করেছে। শেষ বাস শীঘ্রই আসবে। রাজেশ রিমাকে সাইকেলে চাপিয়ে অনেকটা দূরের বাস স্টপ পর্যন্ত যাবে। সে তাকে জোর করে ভিড় থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু মা কান্না থামাচ্ছেন না। বাবা বারবার অনুরোধ করে বলেন। “আমাদের ওকে দরকার। দয়া করে, তুমি কি আমাদের জন্য এটা করতে পারবে না? সে আমাদের পরিবারের একজন।”
রিমা আরচোখে তাকায় রাজেশের দিকে। একমাত্র সেই বুঝতে পারে তার অসহায়তা। পরিবারের চারপাশে গ্রামের মানুষের ভিড় জমে গেছে। কেউ একজন পুরোহিতের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু আপাতত সেটা বাধ্যতামূলক নয়। যদি রিমা বাড়িতে রাত কাটায় পরের দিন রীতি মেনে অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। আরেকজন বলেন। দিনের আলো ম্লান হতে শুরু করেছে। রাজেশের মনে হল যেন সে বাস স্টপ থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি বাসের হর্ন দূর থেকে শুনতে পাচ্ছে। যেন বাসটি একটি ধূলিকণার মেঘ উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। তার পিতামাতার অনুনয় বিনয় কান্নায় পরিণত হয়। প্রতিবেশীরা তাদের সান্ত্বনা দিতে থাকে। রিমা রাজেশের পিঠের দিকে তাকিয়ে রইল যখন সে চলে যাচ্ছিল, উঠোন পেরিয়ে, ঘুণে ধরা দরজার দিকে, তার প্রায়ান্ধকার ঘরে।