ভোঃ – দীপাঞ্জনা মণ্ডল

শেয়ার করুন

হে পাঠক, স্বাগত আপনাকে। অদ্য এই গদ্যকার আপনাকে আপনার পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে কিছু আলোকপ্রদান করিবে। শিরোনাম দেখিয়া হে সুশীল, এই অধম স্থির জানে, আপনার অভিজ্ঞান শকুন্তলমের কথা স্মৃতিপথে অবধারিত আসিয়া পড়িয়াছে। আপনি যেন পুনরায় শুনিতে পাইতেছেন সেই দূরাগত সাবধান বাণী, যা আশ্রমবাসীদের প্রতি উচ্চারিত হইয়াছিল, অর্থ ও অস্ত্রে ক্ষমতাবান মৃগয়াগত দুষ্মন্তের আগমন সম্পর্কে বিধিবদ্ধ সতর্কবচন হিসেবে। এক্ষণে আপনাকে আমার জানাইয়া রাখা প্রয়োজন আপনি ওই সূত্রে এই গল্পের পাঠ করিবেন না। আবার করিতেও পারেন। করুন অথবা নাই করুন সে সম্বন্ধে আপনি নিজ যুক্তিজাল স্বয়ং সজ্জিত করিবেন।

আপনি জানেন আপনাদের সমাজে এক একজন করে কুকুরজীবনসঙ্গী থাকার প্রচলন হইয়াছে। এইরূপ থাকাথাকি পূর্বে ছিল না। বা বলা ভালো এই রূপে ছিল না আমার বর্তমানে। আমি আপনার সময়ের কথা তবে কী রূপে জানিলাম! ওই যেমন করিয়া রাম না হইতেই রামায়ণ হইয়াছিল সেই রূপে। আশা করি রামায়ণের কথা আপনাদের সময় অবধি পৌঁছাইয়াছে। মনুষ্যসকল কুকুরে সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন। সৃষ্টিশীল চিন্তক মনুষ্যেরা যে সকল কাজে কালক্ষেপ করিতে বিমুখ সেই সকল কাজই সম্প্রতি কুকুরদিগের দ্বারা সম্পাদন করানো হইয়া থাকে। যেমন গণতান্ত্রিক মতদান, যেমন বাড়িতে অভ্যাগত আসিলে আপ্যায়ন, যেমন নিকটে ভ্যাগাবন্ড জাতীয় কেহ আসিলে লোকজন জুটাইয়া দুয়ো দেওয়া ও দাঁতখিঁচান, যেমন মধ্যমানের বিক্রয় উপযোগী মানস ও ঔরসজাত সন্তানসৃজন ইত্যকার ছোটবড় নানান কাজ ইহারাই করিয়া থাকে।

রাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে কুকুরের লালন-পালন করিয়া থাকে ও সংবিধান নামক রাজনীতিগ্রন্থে তাদের ভাদ্রমাসকালীন সমস্ত কার্যাবলীর নিখুঁত নিয়মাবলী সংকলিত রাখে, কারণ ইহার সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়া সরাসরি সম্পর্কিত। উৎপাদন ও বিক্রয়ের লভ্যাংশে রাষ্ট্র সর্বদাই সজাগ দৃষ্টি রাখিয়া চলে আপনার সময়েই ইহা আর নতুন কথা কী। এতদ্ব্যতীত পুচ্ছ ও লোমের দীর্ঘতা ও বিন্যাস, দেহাকৃতি, বাসস্থান ইত্যাদির বিচারহেতু কুকুরদের কতিপয় ধর্মগ্রন্থ বিদ্যমান। মোটামুটি এই সকল নির্ণায়ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আপনারা সঙ্গে একটি কুকুরসঙ্গী রাখেন। আপনাদের শৈশবাবস্থা কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট। দেখা যায় পরিবারের মধ্যে একজন মানুষ ও অন্যরা কুকুর – ইহাই স্থিতাবস্থা। বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে ইহাদেরই কেউ কেউ কুকুর হয় আর কেউ কেউ কুকুর পোষ্যরূপে রাখিয়া থাকে। কিন্তু এই রূপান্তরের সঠিক প্রক্রিয়া আজ অবধি কেউ সরকারিভাবে প্রকাশ করিতে পারে নাই। এ সম্বন্ধে কোনরূপ চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশকেরা জনসমক্ষে আসার অনতিবিলম্বে বারংবার রহস্যজনক ভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। কুকুরেরা মিলিত ক্রন্দনে বাতাস ভারি করিয়াছে এবং অবিলম্বে সম্মুখস্থ মাংসের টুকরা ক্রন্দনসহকর্মীর অধিকার হইতে কাড়িতে মনোনিবেশ করিয়াছে।

কুকুর হওয়া ও কুকুরের প্রভু হওয়া সম্বন্ধে আপনিও একদা প্রবল বিস্ময়ের সম্মুখীন হইয়াছিলেন। সে প্রসঙ্গ আনিবার প্রলোভন সংবরণ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। ভাবিয়া দেখুন আপনার উপর নির্ভরশীল কুকুরের বেয়াদপির শাস্তি দিতে তাকে একদিন না খাইতে দিয়া তাহারই সম্মুখে আপনি যখন বিরিয়ানি ভক্ষণে নিয়োজিত হন, তাহার কিরূপ অবস্থা হয়। অথবা ভাদ্রমাসে তাহাকে শিকলে বাঁধিয়া রাখিয়া আপনি যখন আগত সঙ্গীর সঙ্গে প্রেমালাপ করেন তখনই বা সে কিরূপ ক্ষুব্ধ হইয়া উঠে! এক্ষণে যে সম্পর্কে সরকারি কোনও নথিই আদতে তথ্য কিছু জানায়না সে সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা আলোচনা করিবার সুযোগ আমি ছাড়িব কেন। আমি শুধু ক্ষুধার্থ নই, আমি বিক্ষুব্ধ। আমাদের সময়ে এমতাবস্থায় এত নতুন নতুন রাজনৈতিক দল পাড়ায় পাড়ায় তাদের নাম ও চিহ্ন নথিভুক্ত করাইয়াছে যে শেষ অবধি এ ক্ষেত্রেও নাম ও চিহ্ন অনুমোদনে সেন্সরবোর্ডের টিকালো নাসিকা আমদানি করিতে হইয়াছে। নচেৎ নাম ও চিহ্নে অপভাষার আগমন ঠেকানো অসম্ভব হইয়া উঠিতেছিল। দেখুন আমি আমার সময়ের গোপন কথা আপনার সঙ্গে শেয়ার করিলাম, ন্যায়ত আপনার সময়ের আপনিকেন্দ্রিক গোপন কথা আলোচনা করিবার অধিকার অতএব আমার হইল। আপনার বয়ঃসন্ধি থেকেই আপনি কুকুরত্ব ত্যাগে যত্নবান হন। একা হইলেই গলার বকলস ছিঁড়িয়া দু পায়ে দাঁড়ানো অভ্যাস করিতে থাকেন। মনুষ্যের সমস্ত আদবকায়দা আপনি অসীম যত্নে আয়ত্ব করেন। বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া যখন আপনি গৃহত্যাগ করেন আপনার শ্রবণগোচর হয় যে আপনাকে লইয়া আপনার গৃহকর্তা আবেগপূর্ণ বাক্যসকল দৃষ্টান্তপ্রতিষ্ঠার্থে কহিতেছে।

আপনারা সঙ্গে একটি কুকুর না থাকিলে বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া আপনি মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। প্রথমেই কুকুরদের বৈধ বাজার হইতে আপনাকে সঙ্গী পছন্দ করিতে হয়। আপনি পছন্দ করিলেন, দাম দিলেন, কুকুর আপনার হইল, এত সহজ নহে। এরূপ দাসপ্রথা পূর্বে থাকিলেও আপনার সময়ে আর নাই। আপনাকেও কুকুরের পছন্দ হইতে হইবে। সে আপনাকে প্রভুত্বে বরণ করিতে আগ্রহী হইলে তবেই আপনি তাহার বৈধ ক্রেতা হইতে পারেন। রাস্তার কিছু কুকুরকে এখনও এই বাজারে আনা যায়নি। তাহাদের মূল্য দিতে হয় না, তবে তারা আপনাকে পছন্দ করিলে আপনি তাদের খাদ্য ও বাসস্থান দিতে বাধ্য থাকেন। এই আপনার কুকুর সঙ্গী পাবার প্রাথমিক কিছু নিয়ম। কুকুরের অধিকার স্বীকৃত করিতে আপনারা নিয়মিত আলাপ আলোচনা, সভা, মিছিল করিতেছেন। কুকুরেরা তাহাদের নানা অধিকার পাইতেছে। আপনাদের এই পোষ্যদের পাশে থাকাকে আমি এই দূরের সময় থেকে দুই হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করি।

আপনাদের যত্নে কুকুরদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাইতেছে। আপনারা দাবি জানাইতে বলিলে উহারা প্রায়োপবেশনে বসে অথবা শ্বদন্ত শানায়। আপনাদিগের অনেকের কুকুর ঐক্যমত্যে পৌঁছিয়া ঐহিক প্রাপ্তির জন্য কাহাকেও অনুসরণ করিলে তাহাকে দাদা ও পারত্রিক প্রাপ্তির জন্য কাহাকেও অনুসরণ করিলে তাহাকে বাবা-সম্পর্কে স্থান দেয়। দাদাদের ও বাবাদের মধ্যে নানান জটিল সম্পর্কের জাল অবিরত সংযুক্ত ও বিযুক্ত হইতে থাকে। এই সংযোজন ও বিয়োজন প্রক্রিয়া কুকুরদের সম্মুখে ঘটিলেও বৃহৎ সম্পর্ক জালটির সমগ্রতা, অস্তিত্ব ও ব্যাপ্তি সম্বন্ধে তাহাদের কোনও ধারণাই নাই।

তা আপনি প্রথম একক প্রভু হইয়া কুকুর কিনিতে গিয়া যেন পূর্বজন্মের পরিচিত একটিকে সামনেই পাইলেন। অন্যমনে তাহাকেই লইয়া আসিলেন। বেশি বাছিয়া কাজ কী! এই আপনার সেই তরুণ বয়সের ভাবনা। সঙ্গী হইলেই হইল। কিছুদিন তাহার সঙ্গে থাকিয়া আপনি ভাবিলেন আপনি কুকুরদের ঈশ্বর। তাহাদের প্রভু হইতেই আপনার জন্ম। কিন্তু ভুল ভাঙিল যখন দেখিলেন ওইটি ছাড়া অন্য কোনও কুকুরই আপনাকে তেমন পাত্তা দেয়না। ব্যাপার কি? আপনি অকারণ ক্রোধে একদিন উহাকে যথেচ্ছ ঠেঙাইলেন, কেন তার এত আনুগত্য! সে অনেক সহ্য করিয়া অবশেষে দাঁত খিঁচাইয়া গোঁ গোঁ করিতেই আপনি দেখিলেন তাহার মুখের বাম পার্শ্বের শ্বদন্ত ভাঙা। ও হরি বল! আপনি করিয়াছেন কী! চিনিতে না পারিয়া আপনার সহোদরটিকেই যে সঙ্গে আনিয়াছেন। বাল্যে আপনার মনুষ্য হইবার সাধনা সে আড়াল হইতে দেখিতেছিল বলিয়া আপনি ডান হাতে ঘুঁষি মারিয়া তাহার দাঁত ভাঙিয়া দেন। সে কোন নালিশ করে নাই। আপনার অন্ধ ভক্ত ছিল। এ তো সেই! সে কুকুরত্বে থাকায় গন্ধ দ্বারা আপনাকে চিনিয়াছে সহজেই, কিন্তু আপনি আপনার নতুন মানব সংস্কারের চর্চায় কুকুরের সমস্ত গুণই ভুলিয়াছেন। সে স্বতঃই আপনার অনুগত। আপনি তাহাকে বশ করেন নাই। বিরক্তিতে আপনি তাহাকে বিদেশে পাচার করিয়া দিলেন।

এক্ষণে আপনি কিঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ হইয়া পাঠ বন্ধ করিবেন ভাবিতেছেন, কারণ আপনার দৈনন্দিনের থোড় বড়ি খাড়া আমি ক্লান্তিকর ভাবে আপনাকেই বলিয়া যাইতেছি। ক্ষমা প্রার্থনা করি মহাশয়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা যে অবস্থার মধ্যে স্বতঃই থাকি তাহার স্বরূপ সম্বন্ধে ধারণা করিবার আলাদা করিয়া প্রয়োজন হয় না। আপনি যদ্যপি অত্যন্ত সচেতন তবুও এক্ষেত্রে ধরিয়া নিন আমি আপনার অবস্থানের সঙ্গে ক্রমে ক্রমে অভ্যস্থ হইয়া উঠিবার নিমিত্ত এই সকল কথার চর্বিতচর্বণ করিতেছি। যাহা আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নয় তাহা কৃত্রিমভাবেও যদি আত্মস্থ করিবার প্রযত্ন না করি তবে সৎ রচনা আপনার হাতে তুলিয়া দিব কি প্রকারে! সুতরাং মহাশয়, কিছু ধৈর্য রক্ষা করুন।

কুকুরদের বংশমর্যাদা আপনাদের সময়ের নতুন আমদানি নহে। ও বস্তু আমাদের সময়েরও পূর্ব হইতে বিদ্যমান। আপনারা বিজ্ঞাপনে ‘কুকুর চাই’ শিরোনামের নিচে তাহার প্রার্থিত গুণাবলী লিপিবদ্ধ করিয়া দেন। উহাদের জ্ঞাতি-গোত্র, গাত্রবর্ণ, স্বভাব প্রভৃতি যত বৈশিষ্ট্যে সম্ভব আপনারা উহার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াইয়া তুলিতে চাহেন। এত প্রকার সাবধানতা অবলম্বন করেও আপনারা যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া কুকুরের প্রভু হইয়া উঠেন, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিতে পারেন না। একে তো বাজার ঠকাইবার নিমিত্তই উঁচাইয়া আছে। তদুপরি আপনার সম্পদ ব্যয়পূর্বক আপনি যাহাকে খরিদ করিয়া আনিলেন ও তাহার জাগতিক সুখের সমস্ত ব্যবস্থা করিতে ত্রুটি করিলেন না, সে যে বাহিরের কারোর প্রতি আকৃষ্ট হইয়া আপনার নাকের ডগায় পুচ্ছ নাচাইয়া চলিয়া যাইবে না এমন আশা করা বালুচরে গৃহনির্মাণের তুল্য। আপনার বৃদ্ধ প্রতিবেশীর প্রবীণ কুকুরটির মৃত্যুর পরে যে নবীনা আসিল সে কি আপনাকে তাহার সঙ্গদানে গৌরবান্বিত করেনি? আপনি তাহাকে গৃহে আনিবেন না নিশ্চিত বুঝিয়া এবং সেই সময়েই আপনার গৃহাগত এক বন্ধুকে আশ্রয় করিতে পারিয়া সে অবিলম্বে ঠিকানা বদলের নিষ্ঠুরতা করে নাই! এই পরানুগত হইবার জন্য কুকুরদের বেশি বাহিরে যাবার প্রয়োজন নাই, প্রাতঃকৃত্যাদির সময় টুকুই যথেষ্ট। কিংবা আপনি হয়তো বাজারে তাহারই আহার্যের ব্যবস্থা করিতেছেন, আপনার পার্শ্ববর্তী অশালীন গায়ে পড়া ব্যক্তি উহার কপালে হাত বুলাইতেছে, আইনত আপনি এই স্পর্শে আপত্তি জানাইতে পারেন না মনে মনে জ্বলিয়া যাইলেও, কিয়দ্দিন পরে নোটিস পাইলেন আপনার পোষ্য আপনার সহিত থাকিতে চাহে না, আদালতে এতদিনের সমস্ত দেনাপাওনা তৌল করিতে গিয়া জানিলেন সেই কপাল ছোঁয়া নচ্ছারটির সঙ্গেই আপনার কুকুরটি বসবাস করিবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাকে ত্যাগ দিয়াছে। ইহারা কুকুর সমাজের কলঙ্ক। কিন্তু কলঙ্কের আধিক্য কিছু কম নহে।

এই বিচ্ছেদকালে আপনার স্মৃতিপথে উদয় হইবে কতো দীর্ঘ সাধনার পরে আপনি তাহাকে পাইয়াছিলেন। প্রথমাবধি কোনও বিচার না করে শুধু কুকুর বলিয়াই আপনি তাহাদের ঘনিষ্ঠ হইতে রাস্তার কুকুরদের লেড়ো বিস্কুট খাওয়াইতেন। ক্রমশ আপনি কুকুর চরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হইলেন। উহারা রাতে কেন হাও হাও করিয়া কাঁদে, অথবা কখন স্বজাতীয়দের ডাকিয়া আপনাকে তাড়া করিতে পারে, বা কখন ভয়ে কেঁউ কেঁউ করিয়া পুচ্ছ লুকাইয়া পলাইয়া যায় সমস্তই আপনি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশ্রেণীর কঠিন পাঠক্রমের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিখিয়াছেন। আপনার তুল্য কুকুর ভুলাইতে পারে আপনার আশপাশে এমন কজন আছে! তারপরে বলিলে অত্যুক্তি হইবে না কুকুরদের প্রতি আপনার ভদ্রতাও অসামান্য। তাহাদের অনুমতি ভিন্ন আপনি অযথা তাদের ঘাড়-পেট টিপিয়া, গাল-গলায় হাত বুলাইয়া ভালোবাসা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। কুকুরটির সামনে কখনও সুখাদ্য, কখনও সু-শয্যা কখনও মনোমত ক্রীড়া জাতীয় কোনও না কোনও প্রলোভনের সামগ্রী উপস্থিত করিয়া তার আপনাকে সমস্ত রকমের ভালোবাসা প্রকাশের স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করিয়া তারপরেই আপনি তাহাকে কোলে টানিয়া লন। আপনার এই সমস্ত চর্চা আপনাকে কুকুরজাতির প্রতি যথার্থ সংবেদনশীল প্রমাণিত করে।

আপনার চর্চার প্রসঙ্গে আপনার মনে আসে পূর্বে একাধিক কুকুর আপনার মহত্ত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আপনি তাদের সংস্পর্শ ত্যাগ করিয়াছেন। আপনার সহমর্মীতা দ্বারা তাড়িত হইয়া তাহারাই না বলিয়া গিয়াছে আপনি আসলে তাহাদের ভালোর নিমিত্ত ওই তীব্র বিরহানল বরণ করিয়াছেন! দিনে দিনে কুকুর পোষ মানানো সম্পর্কে আপনার দক্ষতা প্রশ্নাতীত রকমে ভালো হইয়াছে। আপনার কুকুর বাগাইতে না পারা বন্ধু ও বন্ধুনীরা এ নিয়ে আপনার প্রতি যে প্রবল ঈর্ষা অনুভব করে তাহা জানিয়াও আপনি উদার হৃদয়ে তাদের কুকুরচরিত্রের পাঠ দিয়াছেন। আপনি আপনার দক্ষতায় বিশ্বাসী, আর এ জগতে দক্ষতা থাকিলে কুকুরের অভাব!

আপনি স্বভাবতই কুকুরজাতির কাছে এত গ্রহণযোগ্য যে বাজারে আপনি ঢুকিলেই তাহারা আপনার মনোযোগ আকর্ষণে ব্যাপৃত হয়। সেবারও অনুরূপ হল্লা শুরু হইয়াছিল আপনি উপস্থিত হইতে। আপনার তখন কিছু একা থাকিবার শখ চাগিয়াছে। কারণ চাহিলেই একটি পোষ্য জোটানো আপনার বাঁয়ে হাতকা খেল। এই মালটি (মাফ করিবেন আপনার এই  চূড়ান্ত প্রতারণার পরিস্থিতিতে আমি কিছু শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করিয়া ফেলিয়াছি, আপনিও ইহাকে এই মুহূর্তে আদরণীয় কুকুর নামে ভাবিতেছেন না। আমি আপনার ভাবনার অনুসারী হইলাম মাত্র।) কিছু কৃৎকৌশলে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন আপনার চোখে উহার কৌশল অনভিজ্ঞ কুকুরের সারল্য ঠেকিয়াছিল। কারণ জটিল উপস্থাপনের যোগ্য হয়ে উঠবার মতো বংশকৌলীন্য অথবা চর্চিত দক্ষতা কোনটাই যে উহার নাই তা আপনি তৎক্ষণাৎ বুঝিয়াছিলেন। আপনি কাজের ঝোঁকে দীর্ঘদিন আর ওদিকে যাননি এবং যেদিন গেলেন সেদিন বহুদূর থেকে দৌড়িয়া আসিয়া আপনাকে চমকাইয়া দিয়া দেখিয়া এ আবার ভিড়ে মিশিয়া যায়। কিন্তু আপনি তাহার দৃষ্টি আর ভুলিতে পারেন না।

ঘরে ফিরিয়া আপনি বাস্তব বুঝিতে পারেন, উহার মানের কুকুর আপনার যোগ্য নহে। আপনি বিবেচনা করিয়া বাজারে যাওয়া বন্ধ করেন। কিন্তু কুকুরের সংস্পর্শ ছাড়া থাকা আপনার পক্ষে অসম্ভব হওয়াই আপনি তরুণ বয়সের মতো রাস্তার কুকুরদের সঙ্গলাভে মাঝে মধ্যে লেড়ো কিনিতে শুরু করেন। অনতিবিলম্বে একটি সাধারণ নেড়ি আপনার অত্যন্ত অনুগত হইয়া পড়ে। আপনি উহাদের লেড়োর সঙ্গে কিছু ভ্রান্তিও বিলাইয়াছিলেন। তাহার মধ্যে একটি আপনার কুকুর প্রেমের প্রথম স্মৃতির প্রতি আপনি আজও অনুগত। সেই স্মৃতির অভাববোধ আপনার মধ্যে বর্তমান। ব্যাস, নেড়িটি আপনার কথার মানে করিল আপনি আজও আবার রাস্তার নেড়িদের কাছেই ফিরিতে চান। শুধু সেই স্মৃতির মতো অপাপবিদ্ধা কুমারী এক আনুগত্যের প্রত্যাশা আপনার, যা পেলে আপনিও পুনরায় হবেন অনুগত, তৎক্ষণাৎ।

আপনিও বুঝিলেন না আপনি নেড়িদের আনুগত্য চাইছেন বাজারের সেই দৃষ্টির কাছ থেকে। না কি বুঝিলেন কিন্তু আপনার মোহনচর্চা পদ্ধতি আপনাকে তা প্রকাশ করিতে দিল না? এই অস্থিরতার মধ্যে আপনার বন্ধু এক, জানালেন আপনি বাজারে না গেলে সেই কুকুরটি আর বাঁচিবে কি না সন্দেহ। আপনি দয়াল। সুতরাং যাইলেন। ওই কুকুরটিকে ভাড়া লইয়া আসিয়া আপনার গৃহ দেখাইলেন। সে তাহার আগমনের কোনও প্রস্তুতি না দেখিয়া সামান্য ক্ষুব্ধ হইল না কি! আপনি লক্ষ করিয়াও গ্রাহ্য করিলেন না, উহাকে ভাড়া আনিয়াছেন সঙ্গ দিতেছেন ইহাই না কত!

আপনি উহাকে কিনিলেন না। অথচ উহার প্রকাশ বিভঙ্গে মুগ্ধ হইয়া নিয়মিত বাজার হইতে ভাড়া লইয়া গৃহে আনিতে লাগিলেন। কয়েকদিন অতিরিক্ত সময় উহাকে রাখিয়া জরিমানাও গুনিলেন। কিন্তু আপনি নিজেকে গুটাইবার পূর্বেই রক্ষকের হাতে বাঁধা হইয়া পরদিন সে আপনার দুয়ারে উপস্থিত হইল। আপনি উহাকে এড়াইতে পারিলেন না। অথচ চাহিলেই উহাকে ত্যাগ দিতে পারেন এই আত্মবিশ্বাসে আপনি সাবধান হইলেন না। উহাকে রাতে বাজারে পৌঁছাইয়া আপনি নেড়ির সঙ্গেও মোলাকাত করিলেন। সে কিছু কৃশ হইয়াছে। কিন্তু কোমল দৃষ্টিতে আপনাকে বিচলিত করিল না। শান্তভাবে আপনার আগমনে পুচ্ছ নাড়িল মাত্র। আপনি উহার অপূর্ব প্রকাশের পাশে ইহার শীতলতা বসাইয়া তুলনা করিয়া মনে মনে কিছু উহার দিকে ঝুঁকিতে থাকিলেন।

ইহার মধ্যে বাজারে গিয়া একদিন তাহার মুখে শুনিলেন আজ পূর্বেই সে অন্য একজনের সঙ্গে ভাড়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে, পরদিন শুনিলেন তাহার শরীর খারাপ। অন্যের সঙ্গে তাহার ভাড়া যাবার সিদ্ধান্তে আপনার ক্রোধানল জাগ্রত হইলেও আপনি যেহেতু তাহাকে খরিদ করেন নাই, তাই সে ওরূপ যাইতেই পারে আপনি জানিতেন। বেশি কথা কি, যতদিন অবধি সে আপনাকে দেখিয়াই পুচ্ছ নাড়িত আপনিই তাহাকে শিখাইয়াছেন এরূপ পরাধীনতার কোনও অর্থই নাই, সে চাহিলেই অন্য কাহারও ভজনা করিতে পারে। আপনাদের দেওয়া-নেওয়া তো রহিলই। কী ক্ষতি অন্য কেহ তাহার মাথায় হাত বুলাইলে। আপনি জানেন, সে ও বোঝে তার আসল সঙ্গী কে! কী দরকার বাহিরের বাঁধনের, এক গৃহতলে থাকিবার?

বেশিদিন যাইল না, আপনি বাজারে গিয়া শুনিলেন আপনার প্রার্থিত মালটি আর আপনার আয়ত্ত্বে নাই, সে অন্য প্রভু নির্বাচন করিয়াছে, সেই প্রভুও উহাকে খরিদ করিবার জন্য প্রস্তুত। উহার বাসস্থান সজ্জিত হইতে যতটুকু বিলম্ব, তার পরেই সে নতুন ঠিকানায় স্থানান্তরিত হইবে। আপনি দুর্দান্ত ক্ষোভে মাথার চুল ছিঁড়িলেন। কাহাকে বলিবেন মনে মনে আপনি আপনার গৃহসজ্জা বদলাইয়াছেন। উহার মনের মতো করিয়া উহাকে রাখিবার সমস্ত মানসিক প্রস্তুতি আপনার সম্পন্ন হইয়াছে। এখন এ কী বিষম বজ্রপাত! আপনি, আপনি যার দৃষ্টি পাইতে কুকুরেরা আকুল, তিনি উহার পায়ে ধরিয়া সাধিলেন, ও মুখ ফিরিয়া ছিল, ফিরিয়াই রহিল। তাহার দোষ নাই। তাহার আপনাকে ভালো লাগিয়াছিল। এবং সে আপনার সঙ্গ কামনা করিয়াছিল। চাহিয়াছিল আপনিও অনুরূপে তাহাকে চাহেন। কিন্তু আপনি কেবল উহাকে দয়া করিলেন। সে ভালোবাসা আদায় করিতে চাহে, দয়া নহে। সুতরাং সে চলিল।

হতাশা ক্ষোভ প্রতারণা সমস্ত মিলিয়া আপনি কোথায় চলিয়াছিলেন আপনার জ্ঞান ছিল না, পায়ে একটা কিছু জড়াইতে আপনি বিপুল ক্রোধে লাথি মারিলেন। কেঁউ কেঁউ কান্না উঠিল। আপনি বেখেয়ালেই ওই রাস্তায় আসিয়াছেন, আপনার অনুগত নেড়িটি আপনার সঙ্গে চলিতে আসিয়াছিল, লাথির ধাক্কায় ছিটকাইয়া পড়িয়া হতভাগ্য শিরদাঁড়া ভাঙিয়া ফেলিয়াছে। আপনি চমকাইলেন। আপনার চর্চা ভয়ংকর আঘাত পাইল। আপনার চোখে জল আসিল। কিন্তু হায় নেড়ির ভাঙা শিরদাঁড়া আপনার অকপট দুঃখে জোড়া লাগিল না। এই জোড়া না লাগার বাস্তবতা, আপনি অপেক্ষা করুন মহাশয়, দিনে দিনে আপনাকে আরও বিরক্ত করিয়া তুলিবে, কারণ ইহা সত্য আপনি সজ্ঞানে নেড়ির অপকার চান নাই, তদুপরি তাহার ক্ষতিতে আপনি যথার্থই দুঃখী। অথচ তাহাতে নেড়ির কোনও উন্নতি নাই। জগতের এ ঘোর অবিচার। আপনি কি করিবেন। উপরন্তু নেড়ি লোকমুখে আপনার আত্মহারা ক্রোধের কারণ শুনিল, আপনার তাহাকে লাথি মারিবার আগে পরের অসংলগ্ন কথাদের জুড়িয়া সে কারণের অস্তিত্ব বুঝিল। ভবিষ্যতে সে সযত্নে পিছনের পা টানিয়া চলিয়া আপনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখিতেই পছন্দ করিবে, এবং যেহেতু আপনি সত্যই দুঃখ পাইয়াছেন তাহার ক্ষতিতে তাই তাহার অভব্য আচরণে আপনি প্রতিক্রিয়া না দেখাইয়া তাহাকে অবজ্ঞা করিবেন। কুকুরদের সামগ্রিক উন্নতি ও তাহাদের দৃষ্টির সীমা প্রসারে আপনি জীবন দিবেন। তাহাদের সামনে প্রকারান্তরে নিজের যাপনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করিবেন। কঠিন যুক্তিক্রম বিন্যাসে যে আপনাকে ছাড়িয়া গিয়াছে সেও আপনার প্রতি অন্যায় করিয়াছে এবং আপনি যাহার পঙ্গুত্বের জন্য দায়ি তাহার আপনাকে পূর্ববৎ আপন করিতে না পারাও আপনার প্রতি অন্যায় বলিয়া আপনি স্থির করিবেন।

আপনাদের সমাজ এই রূপ কুকুর-মানুষ সম্পর্কে বিন্যস্ত হবে। আপনার মতো চিন্তক প্রগতিশীলেরা কুকুরদের স্বাধীনতা ও অধিকার লইয়া লড়াই করবেন। আপনার বন্ধু উহাদের গাত্রবর্ণ বা গোত্র বিচারের পদ্ধতি নির্মূল করিতে পথে নামিবে, আপনি তাহার সঙ্গী হইবেন। রাষ্ট্র এরই মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মত গ্রহণ করবার সময় আসিয়া যাওয়ায় কুকুরদের খাদ্যাভ্যাস ও ডাকের বৈচিত্র্য সম্বন্ধে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করিবে। আলাদা আলাদা দাদা ও বাবার অনুসরণকারী কুকুরদের আলাদা ডাক ও খাদ্যাভ্যাসের বিন্যাস থাকিবে। আপনি কুকুরদের জন্য লড়াই করিবেন। কুকুরেরা বাবা ও দাদার নামে নির্ধারিত খাবারের মেনু মুখস্থ করিয়া তারপরে খাদ্যসংগ্রহের নিমিত্ত মনোনিবেশ করিবে। তাহাদের আর আপনাদের দ্বারা আলোকিত হইবার সময় হইবে না। আপনারা ভোঃ ভোঃ শব্দে তাদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী করে তুলবার যতই প্রয়াস পাইবেন, ততই আপনাদের ডাক উহাদের কানে উহাদের ভাষার বিকৃত উচ্চারণ হিসেবে উহাদের বিরক্তি উৎপাদন করিবে।

       হে সচেতন আপনাকে কেন এসব বলিলাম! কেন আপনার মূল্যবান সময় বরবাদ করিতে আসিলাম! আপনি কি বুঝিতে পারিতেছেন না নিজের বিপদ? আমি জানি একপ্রকার বুঝিতেছেন। আপনি বুঝিয়াছেন আপনার অভ্যন্তরস্থ কুকুর জাগিতেছে, আপনার এতদিনের মানুষ হইবার অভ্যাস জলাঞ্জলি হইল। যে মুহূর্তে আপনি কাঁদিয়া প্রার্থী হইলেন সেই কুকুরের আপত্তি অনুভব করিয়াও, আপনি পুনরায় পুচ্ছধারী হইলেন। বুঝিয়াও আপনি মানিতে চাহেন না, তাই এই গল্পের উপরে আপনার এত ক্রোধ। আপনি কুকুরদের দাবি লইয়া সরব হইবেন, কিন্তু কুকুর হওয়া স্বীকার করিবেন না। আপনি কুকুরদের অধিকার পাওয়াইতেছেন না কি তাহাদের দয়া করিতে আসিয়াছেন তা নিয়ে এইবার একবার সংশয়াপন্ন হইবেন না কি! আমি জানি না, আপনি জানিতে চাহিলে জানুন। প্রকারান্তরে এ সব আপনার অতীতেও হইয়াছে। আমার অতীতেও। আপনাকে সতর্ক করা আমার কর্তব্য বলিয়া বোধ হইল। তাই জানাইলাম। আপনার পছন্দ না হয় আপনি কেঁচে গণ্ডূষ করিতেই পারেন। পছন্দ হইলে আমার বার্তা অনুধাবনে নতুন চর্চার চেষ্টা পাইতে পারেন। ভোঃ

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২