“গণতন্ত্রের উৎসব”-এ প্রান্তিক মানুষের রক্তে হোলিখেলা – সৌম্য শাহীন
ভাঙড়ে আবার রাষ্ট্রীয় মদতে গণহত্যা!! রাজ্য সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়ে খুন করল অসংখ্য মানুষকে।
গত মাসের সাত তারিখে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই মনোনয়ন দাখিল করাকে কেন্দ্র করে তুমুল অশান্ত হয়ে ওঠে দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙড়। গত একমাস ধরেই কার্যত ভাঙড়ে রক্তের হোলিখেলা চলছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপির বাইরে এই একটিমাত্র বিধানসভা আসনেই জয়লাভ করে সংযুক্ত মোর্চা। আইএসএফের নওশাদ সিদ্দিকী ২৬ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী রেজাউল করিমকে। তারপর থেকেই বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে, বিভিন্ন গণ আন্দোলনের মঞ্চে এই তরুণ নেতার বক্তব্য নজর কেড়েছে রাজনৈতিক পর্যবক্ষকদের। ফলে শাসকদলের রোষানলে পড়তে হয় তাকে এবং সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ভাবে ৪২ দিনের জন্য আরও ১৮ জন সহযোদ্ধার সঙ্গে জেলবন্দি হয়ে থাকেন নওশাদ। অতঃপর আদালতের সিদ্ধান্তে জামিন পেয়ে ভাঙড়ে ফেরা মাত্র বিপুল জনউন্মাদনা তৈরি হয় তাকে নিয়ে। এবং পঞ্চায়েত ভোটের আগে নতুন করে আশায় বুক বাঁধে আইএসএফ-বাম কর্মীরা। দিকে দিকে শুরু হয় তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ।
বিগত বিধানসভায় এনআরসি আতঙ্কের পরিবেশে দক্ষিণবঙ্গের মুসলিমরা একচেটিয়াভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিতে বাধ্য হন। তারপর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত পণবন্দির মতো ব্যবহার করতে শুরু করেন মুসলিম সমাজকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খানের কথা। যোগীরাজ্যের কায়দায় পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বাড়িতে ঢুকে এনকাউন্টার করে খুন করে তরতাজা এই তরুণকে। তদন্ত তথা বিচারের নামে প্রহসন হয়। এমনকি আনিসের পিতা সালেম খানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন বিচারক রাজশেখর মান্থা এবং তাঁকে হলফনামা দিয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। বস্তুত, আনিসকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলার মুসলিম সমাজকে সবক শেখালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী রাজনীতিকে, বিশেষত যদি সেটা মুসলিম সমাজের মধ্য থেকে উঠে আসে, তাহলে তাকে নির্মমভাবে দমন করা হবে। এরই উলটো পিঠে তার সুরে সুর মেলানো নো ভোট টু বিজেপি নামক কাঁঠালের আমসত্ত্ব তত্ত্বের অন্যতম প্রচারক তথা সংগঠক “বীরভূমের চাষার ব্যাটাকে” রাজ্যসভার জন্য মনোনীত করে বুঝিয়ে দিলেন যে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে সন্তুষ্ট রাখতে কলাটা–মুলোটা দরাজ হাতে বিলোতে কোনো আপত্তি নেই তার।
তৃণমূলের শাসনকালে অর্থনৈতিকভাবে এমনিতেই গ্রামবাংলা ধুঁকছে। কর্মসংস্থান নেই, স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা ধারাবাহিক দুর্নীতির ফলে ভেঙে পড়েছে, আট হাজারের বেশি স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার, ছাত্রদের হাতে মিড ডে মিল টুকু না দিতে হয়, তার জন্য কারণে-অকারণে লম্বা ছুটি দেওয়া হচ্ছে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে। এই অবস্থায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর যুবকদের একমাত্র আয়ের রাস্তা হল শাসক দলের ফুট সোলজার হিসেবে কাজ করা। পাথর-বালি-কনস্ট্রাকশন সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত হওয়া বা পঞ্চায়েতের হাতে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা খাতে আসা টাকা থেকে প্রাপ্ত কাটমানির সামান্য ভগ্নাংশ–এগুলোই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। নেতাদের মধ্যে টাকার ভাগ নিয়ে বিরোধ ঘনীভূত হলে এদের হাতে দুটোই বিকল্প—হয় বিপক্ষকে মারো অথবা তার হাতে মরো। এবং বিপক্ষ বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৃণমূল কংগ্রেসেরই অপর কোনো গোষ্ঠী। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ গতবছরে বীরভূমের বগটুই গ্রামে ভাদু শেখ বনাম সোনা শেখ নামক শাসকদলের দুই স্থানীয় নেতার মধ্যে রেষারেষির ফলে অসংখ্য প্রাণের অকালে ঝরে যাওয়া। মহাভারতের জতুগৃহ পর্বে যেমন পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীর প্রাণ বাঁচাতে বলি দেওয়া হয়েছিল এক নিষাদ মা ও তাঁর পাঁচ সন্তানকে, তেমনই বগটুইতে ভাদু হত্যার প্রতিশোধ নিতে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল শিশু নারী বৃদ্ধ সহ দশজন নিরপরাধ মানুষকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির এই ট্র্যাডিশনকে বজায় রেখেই এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে সরকারি হিসেব মতো যে প্রায় পঞ্চাশজন মানুষ খুন হয়েছেন, তার অধিকাংশই দরিদ্র মুসলমান। এরাই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক, আবার হিংসার রাজনীতির অগ্রণী সৈনিকও, নিছকই দাবাখেলার বোড়ে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু রাজনীতির একটা বৃহত্তর দিক রয়েছে, যা জাতীয় রাজনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভয়াবহ রাজনৈতিক হিংসার মাধ্যমে ২০১৮র বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েতের মডেল বাংলার মানুষ মেনে নেন নি, পরের বছরেই লোকসভা নির্বাচনে একথা স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ৩৪টা আসন থেকে ২০১৯এ এক ঝটকায় তৃণমূলের আসনসংখ্যা নেমে আসে ২২এ, অপরদিকে বিজেপি ২ থেকে ১৮এ পৌঁছে যায়। কিন্তু মাত্র দু বছরের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ায় তৃণমূল কংগ্রেস, ২১৩টি আসন এবং প্রায় ৪৮% ভোট নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বিজেপি লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারলেও বাম – কংগ্রেসের ভোট ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। অধিকাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে দক্ষিণবঙ্গে একচেটিয়া ভাবে মুসলিম সমাজের ভোট জোড়া ফুলে যাওয়ার ফলেই সে যাত্রায় তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী বৈতরণী সাফল্যের সাথে পার করতে সক্ষম হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভালোই বোঝেন যে মুসলিম সমাজের এই আনুগত্য হারালে বাংলার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারানোর সমূহ সম্ভাবনা। গত দু বছরে আইএসএফের উল্কাসদৃশ উত্থান এবং বামফ্রন্টের সঙ্গে মসৃণ জোটের ফলে সেই মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশই আজ তাঁর হাতছাড়া। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব দেখতে মগ্ন মমতা তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে টার্গেট করেন নওশাদ ও তাঁর অনুগামীদের। আইএসএফের গড় ভাঙ্গড়কে বিশেষভাবে নিশানা করা হয়। কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের প্রধান ভোটব্যাঙ্ক, অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে ভোটে ধ্বস নামলে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বিরোধী জোটের নেতৃত্ব পাওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে হবে তাকে। ফলে ‘উন্নয়নের দিনমজুরদের’ হাতে নগদ টাকা এবং অজস্র অস্ত্রের যোগান দেওয়া শুরু হয়। তৃণমূলী দুষ্কৃতিদের সঙ্গে সংঘর্ষে নির্বাচনের আগেই ভাঙড়ে মৃত্যু হয় অন্তত তিনজনের। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের ফলে পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে দাঁড়ায় যে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস ভাঙড়ে এসে এলাকা পরিদর্শন করেন।
এই ধরনের সন্ত্রাসের বাতাবরণেই গত ৮ই জুলাই ভাঙড়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন তুমুল গণ প্রতিরোধের ফলে বেশিরভাগ জায়গাতেই তৃণমূলের মস্তানবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
এরপর শুরু হয় ফলাফলের জন্য গণমানুষের প্রতীক্ষা।
১১ই জুলাই সকাল থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কার্যত তৃণমূলের মুছে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত জয়ের খবর আসে—রাত আটটার সময়ে আইএসএফের জেলা পরিষদ প্রার্থী জাহানারা বেগম ৫৪০০ ভোটে জয়যুক্ত হন। সকাল থেকে গণনা কেন্দ্রে কড়া নজর রেখেছিলেন আইএসএফ-বাম কর্মীরা। জয়ের আনন্দে কয়েক মুহূর্তের জন্য তারা উৎসবে মেতে ওঠেন। সেই সুযোগে আরাবুল ইসলামের নেতৃত্বে তৃণমূলী গুণ্ডাবাহিনী গণনাকেন্দ্রের দখল নেয়। শুরু হয় ব্যালট বাক্সে ভানুমতীর খেল। রাত দশটা নাগাদ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক তৃণমূল প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করেন।
প্রতিবাদে বিক্ষোভে নামে গ্রামবাসীরা। রাষ্ট্রের ট্রিগার হ্যাপি পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে চারজন আইএসএফ কর্মীর মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়েছে। আরও কতজন গুলিবিদ্ধ এবং গুরুতর আহত তার সবটুকু এখনও স্পষ্ট নয়।
সরকারি মতে মৃতের সংখ্যা যদিও চার, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কম করে সাত-আটজন আইএসএফ-বাম কর্মী মারা গেছেন বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। ভগবানপুর অঞ্চলের এক বিরোধী কর্মীর বক্তব্য যে বহু মৃতদেহ গায়েব করে দিয়েছে আরাবুলের গুন্ডা বাহিনী এবং এই কাজে তাদের সক্রিয়ভবে সাহায্য করেছে রাজ্য পুলিশ। তার এই দাবি সমর্থন করেন এলাকার আরও বহু বাসিন্দা। প্রসঙ্গত, গত ১৫ই জুন এই তরুণ পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচনের জন্য প্রার্থীপদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার পথে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাকে খুন করার চেষ্টা করে এবং তার সমস্ত নথিপত্র ছিঁড়ে দেয়। অথচ কাশিপুর থানার পুলিশ তার এফআইআর নিতে অস্বীকার করে, উলটে রাত্রিবেলায় পুলিশ তার বাড়িতে এসে খানাতল্লাসির নামে মহিলা ও শিশুদের হুমকি দেয়।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় সিপিআইএমের অন্যতম নেতা এবং রাজ্য কমিটির সদস্য তুষার ঘোষের বক্তব্য, রাজ্যজুড়ে সন্ত্রাসের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তাতে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত হয়ে গেছিল। মনে রাখা দরকার, ৮ই জুন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে পরের দিন থেকেই নমিনেশন চালু করে দেয় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। মাত্র ছয়দিন দেওয়া হয় মনোনয়নপত্র জমা করার জন্য। এই নজিরবিহীন সিদ্ধান্তে একটা বিষয় স্পষ্ট—ঠিক কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কায়দায় রাজ্য সরকারও সমস্ত স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলিকে পার্টির অনুগত ভৃত্যে পরিণত করেছে। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ সহ বিরোধী কণ্ঠস্বরগুলোকে গলা টিপে হত্যা করে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-বিজেপির বাইনারিকে প্রতিষ্ঠিত করাই হল শাসকগোষ্ঠীর মূল এজেন্ডা। ‘আরএসএসের দুর্গা’ সেই কাজটাই নিপুণভাবে করে চলেছেন। এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা দিকে দিকে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। আগামীকাল বিকেল চারটের সময় লেনিন মূর্তির পাদদেশ মৌলালি পর্যন্ত বামফ্রন্টের ডাকে তৃণমূল সরকারের স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে এক বিরাট সমাবেশ ও পদযাত্রার ডাক দেওয়া হয়েছে। বাম নেতৃত্বের আশা, সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল মানুষ এই মিছিলে যোগ দিয়ে শাসকশ্রেণীর বিপক্ষে তাদের প্রতিবাদকে তুলে ধরবেন।
এই ফ্যাসিস্টিক সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইটা
অসম্ভব দুরূহ, কিন্তু সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত ফ্রন্টেই আন্দোলন জারি রাখতেই হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রগতিশীল অংশকে খোঁজার অপচেষ্টার বদলে দিকে দিকে শ্রমজীবী ঐক্য গড়ে তোলাই একমাত্র রাজনৈতিক পথ।