‘আই আর ডি পি’, তপন বন্দ্যোপাধ্যায় – অরিন্দম রায়

‘আই আর ডি পি’, তপন বন্দ্যোপাধ্যায় – অরিন্দম রায়

শেয়ার করুন

বর্তমান সময়ে ‘আদিবাসী চর্চা’র খরস্রোত বইছে সাহিত্য, রাজনীতি বা ভোট-বাজারে ও রুচির মান দর্শনে। আদিবাসী-সংস্কৃতির পণ্যায়ন বা পাতি বাংলায় ‘মার্কেটিং পলিসি’ আমরা হাটে-বাজারে দেখতে পাই। তা সে ঘুপচি গলিতে সুভাষ নিয়ে বক্তৃতা হোক্‌, মাননীয়/ মাননীয়াগণের জনসভা হোক্‌, এ্যারিসটোকেটেড পরিবারে ঘর সাজাবার আসবাব হোক্‌ বা শান্তিনিকেতনে কোমড় ধরে একটু ‘Cool-dance’ আর সেলফি হোক্‌- আদিবাসী-ব্রান্ড আজ ‘সর্বঘটের কাঁঠালি কলা’-য় পর্যবসিত হয়েছে। বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবী, রাষ্ট্র-চিন্তকদের এহেন হার্দিক প্রয়াসের নেপথ্যে যে ভণ্ডামি চলে তার মুখোশোন্মোচন ঘটে আলোচ্য গল্পে। কারণ, আদিবাসী ব্রান্ড হয়ে উঠলে আপত্তির তো কিছু নেই, কিন্তু তাদের সার্বিক উন্নয়ন, সমাজ-সংস্কৃতির মূল্যায়নে অপমানকর প্রবৃত্তি, অবহেলা, তাচ্ছিল্যের যে মনোভাব দেখা যায় তা বড় বেদনার।


I.R.D.P অর্থাৎ Integrated Rural Development Program। ভারত সরকার কর্তৃক ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকল্পটি চালু করার প্রস্তাবনা গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৮০ থেকে প্রকল্পটি আরম্ভ হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, দরিদ্র মানুষের জীবিকার সুযোগ করে দেওয়া। তারসঙ্গে তারা যাতে তাদের কর্মদক্ষতার মানোন্নয়ন করতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া। যেকোনো প্রকল্প বা প্রস্তাবনার প্রধান সমস্যা হলো, তার রূপায়ণ প্রক্রিয়ায়। তেমনই, I.R.D.P প্রকল্পটি ঠাণ্ডা ঘরে প্রোজেক্টারের রঙিন আলোয় যতটা ‘ফলপ্রসূ’, ‘দুর্দান্ত’ বলে মনে হয়েছিল বঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক টাঁড় প্রান্তরে সে প্রকল্পই বুমেরাং হয়ে ওঠে। পেট ভরা ভাত আর বুক ভরা অক্সিজেনের যোগান দিতে গিয়ে I.R.D.P-প্রকল্প তাদের টুঁটি চেপে ধরে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের দুর্বল রূপরেখা, স্থানীয় নেতাদের অশিক্ষা-স্বার্থসর্বস্বতা একসময় গরিবগুর্বো আদিবাসীদের প্রাণ আর চামড়াটুকু ছাড়া সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলে।

ছাতিমপুর গ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় আদিবাসীদের বসবাস। ফসল ফলে না, শুকনো, পাথুরে জমি। প্রহ্লাদ হেমব্রমের মতো বাকিদেরও দুরবস্থা। যাদের বার্ষিক আয় ৩,৫০০ টাকার থেকে কম তারা I.R.D.P–র প্রকল্পাধীন হয়। প্রহ্লাদ হেমব্রম, কালাচাঁদ টুডু ও রামনাথ বেসরা এই তিনটি পরিবারকে এ বছর অগ্রে স্কিম দেওয়া হয়। কারণ, তাদের বার্ষিক আয় ২,৪০০ টাকার কম! অর্থাৎ কিনা, সরকারি ভাষায় তারা হলো গিয়ে ‘পুওরেস্ট অব দি পুওরস’। বেঁচে থাকার লড়ায়ে অস্ত্রহীন পদাতিক প্রহ্লাদ যখন নিজের I.R.D.P স্কিম পাওয়ার ব্যাপারে শোনে, সে কিন্তু উৎফুল্ল না হয়ে স্পষ্টত ঘাবড়ে যায়। কারণ, যে পঞ্চায়েত মেম্বার অবনী দাস কোনোদিন তার দিকে ফিরেও তাকায়নি পর্যন্ত, সে হঠাৎ কিনা তার বাড়ি এসে তারই ‘উপকারের’ কথা বলে গেল! যেচে পড়ে, ঘরে বয়ে ‘উপকার’? যাই হোক্‌ এ ঘটনার সপ্তাহখানেক পর, হৈ হৈ-রৈ রৈ করে গ্রামে একদিন সভার আয়োজন করা হলো পঞ্চায়েত থেকে। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জটিলেশ্বরবাবুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সভায় নিয়ে এল অবনী।
“একবার আমার এলাকায় চলুন, আবার সামনে ইলেকশন-টিলেকশন আসছে, এখন মাঝেমধ্যে না গেলে- ”১
না গেলে যে কী?- সেটা আর বুঝিয়ে বলতে হয়নি ভোটবাজারে পোড় খাওয়া জটিলেশ্বরবাবুকে। নির্ধারিত দিনে তিনি সভায় আসেন এবং ইংরেজি-বাংলায় তাঁর বক্তব্য রাখেন স্কিমের উপকারিতা সম্বন্ধে। কিন্তু যাদের এ ভাষণ সেই ‘নরাধম’, ‘বোঙা’ প্রহ্লাদরা কিছু বোঝে না! না বুঝলেও (কারণ ‘সেটা বড় কথা নয়’) এরপর একদিন I.R.D.P ফর্মে প্রহ্লাদদের টিপছাপ নিয়ে যায় অবনী। তারপর স্বাভাবিকভেবে নানান প্রক্রিয়ার মাধম্যে, সাংবাদিকদের সম্মুখে ঘটা করে প্রহ্লাদদের হাতে নতুন ডেঁচকি, হাতা এসব জিনিস তুলে দেওয়া হয় একদিন। গেঁড়ো হল অন্যখানে! একটি অঞ্চলে একই জীবিকার জন্য ব্যাঙ্ক লোন দিতে নারাজ। কিন্তু তাতে কী? বিচক্ষণ অবনী বুদ্ধি খাটিয়ে X-কে চানাচুর ভাজার স্কিম, Y-কে পিগারি, Z-কে গোটারি লিখে ফর্ম ফিলাপ করে দিয়েছে। ব্যাস এই বিচিত্রতা, বিভিন্নতা এখে ব্যাঙ্ক লোন দেয়। এদিকে গণতান্ত্রিক দেশে এমন অযাচিত উপকারের বিনিময়ে পার্টির নামে ‘প্রাপ্য’ টাকা চেয়ে নেয় অবনী প্রহ্লাদদের কাছ থেকে।
“স্কিম স্যাংশন হলে পার্টি ফান্ডে কিছু চাঁদা দিও কিন্তু…”২
গল্পের নায়ক প্রহ্লাদ হেমব্রমের বরাতে জুটেছে চানাচুর ভাজার স্কিম। তাই তার হাতে নতুন ডেঁচকি, হাতা।
ব্যাঙ্ক কিন্তু প্রথমেই টাকা দিতে নারাজ। কারণ, এর আগে I.R.D.P স্কিমে যাদের লোন দেওয়া হয়েছিল তারা যথাযথ ব্যয় না করে, ‘ভালো-মন্দ’ খেয়ে, রেডিও, সাইকেল, টর্চ এসব ‘ফালতু’ জিনিস কিনে খরচ করে ফেলেছে। ফলে ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের সংখ্যা বাড়ছে। I.R.D.P স্কিম অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতা মোট ৬,০০০ টাকা পাবে। তার মধ্যে ৩,০০০ টাকা দেবে সরকার। আর বাকি ৩,০০০ টাকা ব্যাঙ্ক দেবে লোন হিসাবে। যা মাসে মাসে সুদ সমেত শোধ করতে হবে ঋণ গ্রহীতাকে। এদিকে অশিক্ষিত, বোকার দলেরা ‘লুন’ কী জিনিস জানে না! আর অবনীরা তাদের ‘কাট-মানি’ পায়। এই সরকারি স্কিম যেন অবনীর মতো নিচুতলার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে ‘স্কিম-জীবিকা’র মতো।
আমাদের প্রহ্লাদের কপালে জুটেছে চানাচুর ভাজার স্কিম। বাস্তবিক প্রহ্লাদের চৌদ্দ পুরুষ কোনোদিন ব্যাঙ্ক লোন নেয় নি। চানাচুর ভাজা তো কোন দূর অস্ত! তাই প্রহ্লাদ কী করবে ভেবে তল পায় না। অবনী কিন্তু আশ্বাস দেয়, কয়েকদিনের মধ্যে চানাচুর ভাজার ট্রেনিং দেওয়া হবে তাকে। এদিকে মাস পেরিয়ে যায়… গরিবের ঘরে লক্ষ্মী বড় সচলা। লোনের টাকায় অনাহারী প্রহ্লাদ আর তার বউ কুস্‌মি পেট পুরে ভাত, মুরগীর ডিম, মাংস এসব খায়। পরনের কাপড় ছিল না, কাপড় কেনে। এভাবেই দিন যায়। লোনের টাকা শেষ হয়। আর তারপরই হঠাৎ একদিন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার স্বয়ং এসে হাজির হন প্রহ্লাদের ঘরে। ম্যানেজারের কাছে সব শুনে তো প্রহ্লাদের মাথা ঘুরে যায়-
“ব্যাঙ্কের লোন সুদে-আসলে বেড়ে ক্রমশ নাকি পাহাড় প্রমাণ হয়েছে”৩
প্রহ্লাদের ঘটি-বাটি-চাটি সব ক্রোক করতে উদ্যত হয় ব্যাঙ্ক। এ ঘটনার সময় অবনীর দেখা পাওয়া যায় না। সব হারাবার পর হঠাৎ একদিন রাস্তায় অবনীকে আবিষ্কার করে ‘পঞ্চাৎ, পঞ্চাৎ’ বলে হাঁক দেয় নরকঙ্কাল প্রহ্লাদ। অবনী সভয়ে শোনে প্রহ্লাদ তাকে ডাকছে ‘বাঞ্চোৎ, বাঞ্চোৎ’… প্রহ্লাদ বলে-
“মুরা ত ভিখিরি ছিলাম, আরু ভিখিরি হয়ি যাতিছি যে”৪

এ প্রশ্নের উত্তরে অবনী বলে-
“তোমাদের কোনও ভাবনা নেই। পঞ্চায়েত সমিতির মিটিঙে সিদ্ধান্ত হয়েছে তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আর একটা সাবসিডিয়ারি স্কিম করা হচ্ছে। প্রত্যেকে আরো দু হাজার টাকা করে লোন…”৫
ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সুখেন গুপ্ত এহেন প্রস্তাব শুনে চমকে যান। পঞ্চায়েত-রাজনীতির এই নোংরা বৃতান্ত শুনে তিনি আফশোস করে বলেন-
“তাদের আরও লোন দিতে হবে! গরিব লোকগুলো একবার লোন নিয়ে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে, সেকেন্ড লোন নিলে তো চুল পর্যন্ত…”৬
সরকারের সেবামূলক স্কিম বুমেরাং হয়ে প্রহ্লাদের গলায় বঁড়শির মতো বিঁধে যায়। ফায়দা হয় অবনীদের। উপযাচক হয়ে আদিবাসীদের জীবনে, সংসারে ঢুকে তাদেরই অস্তিত্ব তছনছ করবার ভিলেন- দিকু রাষ্ট্র, পঞ্চায়েতকে প্রহ্লাদরা তাই ‘বাঞ্চোৎ’ ছাড়া আর কী বলতে পারে? কীই বা বলা উচিত? তারই সঙ্গে সমাজকে বুঝতে হবে বাবুয়ানি, শৌখিনতা কিংবা রুচির পরিচয় দর্শাবার নিমিত্তে আদিবাসী-শিল্প বা আচার বা পোশাক বা নাচ বা নারীশরীর কখনোই ক্রয়লভ্য পণ্য নয়; বোঝা উচিত বলে মনে করি।

তথ্যসূত্র
১. আই আর ডি পি, গল্প সমগ্র (১ম খণ্ড), তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা, ২০০২, কলকাতা, পৃ:- ৩৭৮।
২. ঐ, পৃ- ৩৮২।
৩. ঐ, পৃ- ৩৮৬।
৪. ঐ, পৃ- ৩৮৬।
৫. ঐ, পৃ- ৩৮৬।
৬. ঐ, পৃ: ৩৮৪।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২