গাছ – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

শেয়ার করুন

একটা গাছ। অনেকদিনের গাছ। গাছটা সুন্দর কি অসুন্দর কেউ প্রশ্ন তোলে নি।

গাছের মনে গাছ দাঁড়িয়ে আছে। এর প্রয়োজন আছে কি নেই তা কেউ মাথা ঘামায় না।

যেমন মানুষ মাথার ওপর আকাশ দেখে মেঘ দেখে, পায়ের নিচে ধুলো দেখে ঘাস দেখে, তেমনি তারা চোখের সামনে একটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে দেখছে। সন্ধ্যায় দেখছে, দুপুরে দেখছে, সকালে দেখছে। কেবল চোখ দিয়ে হৃদয় দিয়ে অনুভূতি দিয়ে দেখা নয়, বোঝা নয়।

বা এমন করে একটা গাছকে বুঝতে হবে কেউ কোনদিন চিন্তাও করে না।

দিনের পর দিন যায়, ঋতুর পরে ঋতু কাটে, বছরের পর বছর যায় আসে—গাছের জায়গায় গাছ দাঁড়িয়ে।

বর্ষায় পাতাগুলি বড় হয়, পুষ্ট হয়, শরতে পাতাগুলি ভারি হয় মোটা হয়, সবুজ রং অতিরিক্ত সবুজ হয়ে কালোর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়, হেমন্তের মাঝামাঝি হঠাৎ সেই সবুজ-কালো গভীর রং ধূসর হয়ে ওঠে। তারপর শীতে হলদে ফ্যাকাসে নীরক্ত প্রসূতির পাণ্ডুর চেহারা ধরে পাতাগুলি ঝরে ঝরে পড়ে। গাছ বিরক্ত হয়।

তখনও গাছ গাছ থাকে।

গাছের চেহারা তখন শুধু কাঠের চেহারা হয়।

ছোট কাঠ বড় কাঠ চিলতে কাঠ সরাকাঠ পাতলা চিকন মানুষের আঙুলের মতো টুকরো-টুকরো অজস্র কাঠ—কাঠির একটা জবরজং কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

কিন্তু তা বলে কি মানুষ তখন তার ওপর রাগ করে? করে না। কারণ মেঘমেদুর আকাশের নিচে অরণ্যের চেহারা ধরে গাছ যখন দাঁড়িয়ে থাকে তখন মানুষ তাকে যে চোখে দেখে শীতের শুকনো আকাশের নিচ সরু মোটা কতগুলি কাঠ-কাঠির বোঝা মাথায় করে দাঁড়িয়ে থাকলেও মানুষ তাকে সেই চোখে দেখে। তাই বলছিলাম ওপর-ওপর দেখা। মন দিয়ে দেখা নয় বোঝা নয়। তাহলে ফাল্গুনে লালে সবুজ মেশানো নতুন পাতার সমারোহ দেখে মানুষ নাচত অথবা বৈশাখ পড়তে অজস্র মঞ্জরী মাথায় গাছ নিয়ে গাছটা আশ্চর্য গোলাপী আভায় আকাশ আলো করে তুলেছে দেখে আনন্দে চিৎকার করতো। তা কেউ করে না, এ পর্যন্ত করে নি।

দু-তিনটে বাড়ির মাঝখানে এক ফালি পড়ো জমির ওপর একটা গাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে তাদের একটু সুবিধা হয়, এই শুধু তারা জানে। এ-বাড়ির মানুষ জানে ও-বাড়ির মানুষ জানে, আশেপাশের আরো গোটা দু-তিন বাড়ির মানুষগুলিও একটু-আধটু সুবিধা আদায় করতে গাছের কাছে আসে বৈ-কি, যেমন সকাল হতে খবর-কাগজ হাতে করে দু-চারজন প্রৌঢ় বুড়ো গাছতলায় একত্র হয়ে রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি আলোচনা করে, যেমন দুপুরের দিকে এ বাড়ির বুড়ি ও-বাড়ির বুড়ি, এ বাড়ির বৌ ও-বাড়ির মেয়েকে গাছের নিচে সরু গালিচার মতন ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে রান্নার কথা সেলাইয়ের কথা ছেলে-হওয়ার কথা ছেলে না হওয়ার কথা বলে সময় কাটায়, আর বিকেল পড়তে ছুটে আসে ছেলে ছোকরার দল। গাছটাকে ঘিরে হৈ-হল্লা ছুটোছুটি, গাছে উঠে ডাল ভাঙা পাতা ছেঁড়া, বা কোনোদিন গাছের ডালে দোলনা বেঁধে দোল খাওয়া।

বা শীতের দুপুরে গাছের ছায়ায় মাথা রেখে শরীরটা রৌদ্রে ছড়িয়ে দিয়ে কারো-কারো গল্পের বই পড়া। আবার গ্রীষ্মের রাত্রে ঠিক এই গাছের তলায় শীতল পাটি বিছিয়ে হ্যারিকেন জ্বেলে পাড়ার পাঁচ-সাতজন গোল হয়ে বসে তাস খেলছে এই দৃশ্যও চোখে পড়ে।

যখন মানুষ থাকে না তখন গাছতলায় ছাগলটাকে গরুটাকে মাথা গুঁজে মনের আনন্দে ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে দেখা গেছে।

আর ওপরে নানাজাতের পাখির কিচিরমিচির কলরব, ডানা ঝাপটানো, ঠোঁটে ঠোঁট ঘসার শব্দ।

আর মাঝে মাঝে হাওয়ায় পাতা নড়ে, ডাল দুলে ওঠে।

বা এমনও এক-একটা সময় আসে যখন পাখি থাকে না, বাতাস নেই। গাছ স্থির স্তদ্ধ। পড়ো জমিতে নিবিড় ছায়াটুকু পেলে অনন্তকালের সাক্ষী হয়ে নিঃসঙ্গ গাছ যেন যুগ-যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বা মনে হয় কোনো দার্শনিক। নীরব থেকে অবিচল থেকে জগৎটাকে দেখছে। সংসারের উত্থান-পতন লক্ষ্য করছে। পাপের জয় পুণ্যের পরাজয় দেখে বিমূঢ় বিস্মিত হয়ে আছে।

চিন্তাশীল মানুষের মনের অবস্থা যেমন হয়। চিন্তাশীল মানুষ চুপ করে থাকে। সত্যি গাছটাকে সময় সময় এমন একটি মানুষ বলে কল্পনা করা যায়। তখন তার ধারে কাছে অন্য মানুষ পশুপাখি হাওয়ার চাপল্য কল্পনা করতে কষ্ট হয়।

হয়তো এমন করে কেউ গাছটাকে দেখছিল গাছটাকে নিয়ে ভাবছিল। এতদিন জানা যায় নি, এতদিন বোঝা যাচ্ছিল না। কে জানে হয়তো গাছটার সেই অন্তর্দৃষ্টি ছিল, গাছ বুঝতে পারছিল পুবদিকের একটা বাড়ির সবুজ জানালায় বসে একজন তাকে গভীরভাবে দেখছে লক্ষ্য করে। না, আগে হয়তো সে আর দশটি মানুষের মতো সাদা চোখে গাছের পাতা ঝরা দেখত, নতুন পাতা গজানো দেখত। এখন আর তার চোখ সাদা নেই। কাজল পরে গভীর কালো হয়েছে। এখন আর হাল্কা বেণী ঝুলিয়ে ফ্রক উড়িয়ে সে ছটফট করছে না যে, বাড়ির সামনে পড়ো জমিতে একটা গাছ আছে কি বাঁশের খুটি দাঁড়িয়ে আছে ওপর-ওপর দেখে শেষ করবে। এখন সে শান্ত গম্ভীর মাথায় দৃঢ়বদ্ধ সংযত কঠিন খোঁপার মতো তার মনও বুঝি সতর্ক সুসংবদ্ধ স্থির ও নিবিড় হয়ে উঠেছে। আর সেই নিবিড় মন সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে সারাক্ষণ সে গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। গাছটাকে নিয়ে ভাবছে। যেন ভাবতে ভাবতে একদিন তার দৃষ্টি কেমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। চোখের কালো পালকগুলি আর নড়ছে না, কালো মণি দুটি পাথরের মতো স্থির কঠিন হয়ে আছে। গাছ বুঝতে পারল একটা ভয়ঙ্কর ভাবনা তাকে পেয়ে বসেছে, ওই কালো পালক-ঘেরা চোখ দুটোর তাকানোর মধ্যে কেবল ভয় না, বিদ্বেষও যেন মিশে আছে। গাছ ভয় পেল, দেখল, কেবল দিনের আলোয় না রাত্রির গভীর অন্ধকারেও দুটি চোখ জানালায় জেগে আছে। নিরাকার অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি হয়ে রাত্রির গাঢ় তমসায় লুকিয়ে থেকেও যেন গাছ ওই দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। আতঙ্কের সঙ্গে পুঞ্জ ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছে একজন তার দিকে।

তারপর কথাটা জানাজানি হয়ে গেল। বুঝি সবুজ জানালার ওই মানুষটি সকলকে জানিয়ে দিল।

এই গাছ দুষ্ট। এই গাছ শয়তান। একে এখান থেকে সরিয়ে দাও।

পড়ো জমির আশেপাশের মানুষগুলি সজাগ হয়ে উঠল।

মানুষের মতো শয়তান হয়ে একটা গাছ মানুষের মধ্যে মিশে থাকতে পারে তারা এই প্রথম শুনল, জানল।

তাই তো, সকলে ভাবতে আরম্ভ করল, বুড়োর দল গাছের নিচে বসে পলিটিক্স আলোচনা করে, বুড়িরা যুবতীদের সঙ্গে বসে ছেলে হওয়া না হওয়ার গল্প করে, ছেলে-ছোকরার দল গাছের কাছে এসে খেলা করে; এমন গাছটা যদি ভালো না হয় যদি তার মধ্যে দুষ্ট বুদ্ধি লুকিয়ে থাকে তবে তো—

কেটে ফেলতে হবে, পুড়িয়ে দিতে হবে, মূলশুদ্ধ উপড়ে ফেললে সবচেয়ে ভালো হয়। সাদা ফুলের মালা জড়ানো স্ফীত শক্ত খোঁপা নেড়ে জানালার মানুষটি বলল, তা না হলে এই গাছ কখন কি বিপদ ঘটায় বলা যায় না।

সবাই শুনল, সবাই জানল।

শিশুরা খেলা করে। এই গাছের একটা বড় ডাল তাদের মাথায় ভেঙে পড়তে কতক্ষণ! বজ্রপাত হতে পারে এই গাছের মাথায়। আর নিচে তখন যে দাড়িয়ে বা বসে থাকবে, সঙ্গে সঙ্গে তার অবধারিত মৃত্যু। অর্থাৎ গাছই বজ্রকে ডেকে আনে। শয়তান কী না পারে। শুনে মানুষগুলির চোখ বড় হয়ে গেল।

কিন্তু সেই সবুজ জানালার মানুষটি চুপ করে থাকল না। গাছ সম্বন্ধে এতকাল যারা উদাসীন ছিল তারা আরও ভয়ঙ্কর কথা শুনল।

কেবল বজ্র কেন, শয়তান মধ্যরাত্রে যে কোনো একটি মানুষকে ডেকে নিজের কাছে আনতে পারে।

হুঁ, সকালে উঠে সবাই দেখবে সেই মানুষ ওই গাছের কোন না কোন একটা ডালে ঝুলছে।

গলায় দড়ি দেবার পথে গাছের ডাল যে একটি চমৎকার অবলম্বন, কথাটা নতুন করে সকলের মনে পড়ে গেল।

ওই গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে, কেটে ফেলতে হবে, সম্ভব হলে মূলশুদ্ধ।

হয়তো গাছের জানা ছিল না, পড়ো জমির পশ্চিম দিকের আর একটা বাড়ির লাল রঙের জানালায় বসে আর একজন তাকে গভীর ভাবে দেখছিল। সেদিকে দৃষ্টি পড়তে গাছ চমকে উঠল। এবং খুশি হল। লাল রঙের জনালার মানুষটির চোখ দুটি বড় সুন্দর। সেই চোখে ভয় আতঙ্ক ঘৃণা বিদ্বেষ কিছুই নেই। আছে স্নেহ প্রেম মমতা সহানুভূতি। দেখে গাছ বিস্মিত হল। কেননা কদিন আগেও মানুষটির দৃষ্টি অশান্ত ছিল, চলায় বলায় চাপল্য ছিল। হাফ প্যান্ট পরে সময়ে অসময়ে তার কাছে ছুটে এসেছে, ঢিল ছুঁড়েছে ডাল-পাতা লক্ষ্য করে, পাতার আড়ালে পাখির বাসা খুঁজে বার করে ভেঙে দিয়েছে, আর যখন তখন দোলনা বেঁধে দোল খেয়েছে। আজ সে মার্জিত ভদ্র স্নিগ্ধ সুন্দর। আদ্দির পাঞ্জাবির হাত দুটো কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে দুহাতের তেলোয় চিবুক রেখে জানালার ধারের টেবিলের কাছে বসে গাছের দিকে গাঢ় দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে। ভাবতে ভাবতে টেবিলের ফুলদানি থেকে একটা গোলাপ নাকের কাছে তুলে গন্ধ শোঁকে, যেন গাছটাকে যত দেখছে যত ভাবছে তত সে পরিতৃপ্ত হচ্ছে, আনন্দিত হচ্ছে। যেন গাছকে নিয়ে ভাবনার সঙ্গে গোলাপের গন্ধের একটা আশ্চর্য মিল রয়েছে। বুঝি গাছ তার কাছে গোলাপের মতো সুন্দর।

গাছ নিশ্চিন্ত হল, আশ্বস্ত হল। লাল জানালার মানুষটার মুখে সবাই অন্য কথা শুনল।

এই গাছ ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই গাছের নিচে সকালে বিকালে মানুষগুলি একত্র হয়। একটি মানুষকে আর একটি মানুষের মনের কাছে টেনে আনছে গাছটা। তার অর্থ আমাদের সামাজিক হতে শেখাচ্ছে। গাছটা আছে বলে ছেলেরা খেলাধূলা করতে পারে। মায়ের মতো শিশুদের স্নেহ ও আনন্দ বিতরণ করছে মাঠের ওই বনস্পতি।

সত্যি সে সুন্দর।

তার ছায়া সুন্দর, ডাল সুন্দর। তাই না নিরীহ সুন্দর পাখিগুলি তাকে আশ্রয় করে সারাক্ষণ কূজনগুঞ্জন করছে। প্রজাপতি ছুটে আসছে।

পাড়ার মানুষগুলি নতুন করে ভাবতে আরম্ভ করল।

পশ্চিমের লাল জানালার সুন্দর মানুষটি সেই খানেই চুপ করে থাকল না।

ইঁট, লোহা, সিমেন্টের মধ্যে বাস করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের চোখের সামনে একটি সবুজ গাছ আছে বলে প্রকৃতিকে আমরা মনে রাখতে পারছি। আমরা যে এখনো পুরোপুরি কৃত্রিম হয়ে যাই নি তা ওই গাছের কল্যাণে। এই গাছ থাকবে। এই গাছ আমাদের ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত জীবনে একটা কবিতার মতো।

তবে কি লাল জানালার মানুষটি কবি? গাছ ভাবল। রাত্রে জানালার ধারে টেবিলে বসে মানুষটি কাগজ-কলম নিয়ে কি যেন লেখে, যখন লেখে না চুপ করে বাইরে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মন্দ কথা শুনে মানুষ যেমন বিচলিত হয় তেমনি ভালো কথা শুনে তারা নিশ্চিন্ত হয়, খুশি হয়।

তাই একজন গাছটাকে মন্দ বলাতে মানুষগুলি যেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, আবার আর একজন গাছ তাদের অনেক উপকার করছে শুনে শান্ত হল।

তাই তারা গাছ নিয়ে আর মাথা ঘামাল না।

গাছের মনে গাছ দাঁড়িয়ে রইলো।

কিন্তু পুবের জানালার মানুষটি চুপ করে থাকলো না। গাছ শুনল, দাঁতে দাঁত ঘসে সে প্রতিজ্ঞা করছে, যদি আর কেউ তাকে সাহায্য না করে তো সে নিজেই কুড়ুল চালিয়ে গাছটাকে শেষ করে দেবে। এই গাছ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। শয়তানকে চোখের সামনে থেকে যেভাবে হোক দূর করবে।

গাছ শুনে দুঃখ পেল, আবার মনে মনে হাসল। যেন পুবের জানালার মানুষটিকে তার ডেকে বলতে ইচ্ছে হল, তোমার খোঁপায় ফুলের মালা শোভা পায়, তোমার চোখের কাজল, কপালের কুমকুমটি চমৎকার, তোমার হাতের আঙুলগুলি চাঁপার কলির মতো সুন্দর! সুন্দর ও নরম, এই হাতে কুড়ুল ধরতে পারবে কি?

যেন পশ্চিমের জানালার মানুষটির কানেও কথাটা গেল। তার সুন্দর আঙুলগুলি কঠিন হয়ে উঠল। গাছের বেশ জানা আছে ওই হাত, হাতের আঙুল দরকার হলে ইস্পাতের মতো দৃঢ় দৃপ্ত হতে জানে। আজ ওই দিয়ে সে কবিতা লিখছে বটে, গোলাপফুলকে আদর করছে—একদিন এ হাতে ঢিল ছুঁড়ে সে অনেক পাখির বাসা তছনছ করে দিয়েছে, গাছের ডাল ভেঙেছে, পাতা ছিঁড়েছে আর রুদ্রের মতো হাতের দুটো মুঠো কঠিন করে দোলনার দড়ি আঁকড়ে ধরে দানবশিশুর মতো দোল খেয়েছে। তাই বুঝি আজ বজ্রমুষ্টি শূন্যে তুলে সে প্রতিজ্ঞা করলো, এই গাছেকে যেমন করে হোক রক্ষা করবে। যদি কেউ এই গাছ নষ্ট করতে আসে তাকে ক্ষমা করবে না। জীবন থেকে কবিতাকে নির্বাসন দেওয়া চলে না। যদি কেউ গাছের গায়ে হাত তুলতে আসে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সে তাঁকে প্রতিহত করবে। গাছের গায়ে আঁচড়টি পড়তে দেবে না।

গাছ নতুন করে ভয় পেল। তাকে কেন্দ্র করে পুব ও পশ্চিমের জানালার দুটি মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধবে না তো!

সেদিন দুপুর গড়িয়ে গেল। দুটো বাচ্চা নিয়ে একটা ছাগল নিচের ছায়ায় ঘুরে ঘুরে ঘাস খেল। বিকেল পড়তে শিশুর দল হুটোপুটি করলো। অগুন্তি পাখির কিচির-মিচির করে উঠে তারপর এক সময় চুপ হয়ে গেল। রাত্রি নামল। নির্মেষ কালো আকাশ অসংখ্য তারা ফুটল। হাওয়া ছিল। গাছের পাতায় সর-সর শব্দ হচ্ছিল। রোজ যেমন হয়। পড়ো মাঠের চারপাশের বাড়িগুলিতে নানা রকম শব্দ হচ্ছিল, আলো জ্বলছিল। ক্রমে রাত যত বাড়তে লাগল এক একটি বাড়ি চুপ হয়ে যেতে লাগল, আলো নিভল। তারপর চারদিক নিঃসীম অন্ধকারে ছেয়ে গেল। অন্ধকার আর অমেয় স্তব্ধতা। মাথার ওপর কোটি-কোটি নক্ষত্র নিয়ে গাছ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এক সময় হাওয়াটাও মরে গেল। গাছের একটি পাতাও আর নড়ছিল না।

এমন সময়।

নিরন্ধ্র অন্ধকার দিনের আলোর মতো গাছ সব কিছু দেখতে পায়। গাছ দেখল পুবদিক থেকে সে আসছে। আঁচলটা শক্ত করে কোমরে বেঁধেছে। মালাটা খোঁপা থেকে খুলে ফেলে দিয়েছে। যেন যুদ্ধ করতে আসছে। এখন আর ফুলের মালা নয়। হাতে ধারালো কুঠার। গাছ শিউরে উঠল।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একদিকে মানুষের পায়ের শব্দ হল। গাছ সেদিকে চোখ ফেরাল। এবার গাছ নিশ্চিন্ত হলো। সে এসে গেছে। পশ্চিমের জানালার সেই মানুষ এসে গেছে। তার হাতে এখন কলম নেই। একটা লাঠি। গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি নেই। হাতকাটা গেঞ্জি। তার চোয়াল শক্ত। দৃষ্টি নির্মম। যেন এখনি সে বজ্রের হুংকার ছাড়বে।

গাছ কান পেতে রইল।

বিষণ্ণ স্তব্ধতা। অনিশ্চিত মুহূর্ত।

গাছের মাথায় একটা পাখির ছানা কিচমিচ শব্দ করে উঠল। যেন কোনদিক থেকে একটা নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ ভেসে এল। আকাশের এক প্রান্তের একটা তারার কাছে ছুটে গেল। একটু হাওয়া উঠল বৈ কি। নরম শাখাগুলি দুলতে লাগল।

যেন ভিতরে ভিতরে গাছ এমনটা আশা করেছিল। তাই খুব একটা অবাক হল না।

শাড়ি-জড়ানো মানুষটির অধরে হাসি ফুটেছে।

পশ্চিমের জানালার মানুষের শক্ত চোয়াল নরম হয়েছে। বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে না।

একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের মাঝখানের ব্যবধান এত কম যে গাঢ় অন্ধকারেও তারা পরস্পরের মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল। যেন একজন আর একজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনছিল।

‘হাতে কুড়ুল কেন?’

‘গাছটাকে কাটব।’

‘লাভ কি?’

‘গাছটা শয়তান।’

‘গাছটা দেবতা।’

‘শয়তানকে যে দেবতা মনে করে সে মূর্খ।’

‘দেবতাকে যে শয়তানের মতো দেখে সে পাপী। তার মনে পাপ তার হৃদয়ে হিংসা। তাই সাদাকে কালো দেখে—আলো থাকলেও তার চোখে সবকিছু অন্ধকার।’

‘তবে কি পৃথিবীতে অন্ধকার বলতে কিছু নেই? কালো বলতে কিছু নেই?’

‘নেই।’

‘এ কেমন করে সম্ভব।’ হাত থেকে কুড়ুলটা খসে পড়ল ওর। ভাবতে লাগল। গাছ খুশি হল। গাছ দেখল একজন কুড়ুল ফেলে দিল, আর একজন হাতের লাঠি ফেলে দিল। ‘এ কেমন করে হয়!’ ভাবতে ভাবতে পুবের জানালার মানুষটি মুখ তুলে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে তারার ঝিকিমিকি দেখতে লাগালো। তারপর এক সময় বিড়বিড় করে বললো, ‘সব আলো সব সুন্দর—কিছু কালো নেই, কোথাও অন্ধকার নেই।’

‘এমন কখনো হয়?’

‘নিজের ভিতরে যখন আলো জাগে।’

‘সেই আলো কী?’

‘প্রেম।’

মেয়েটির চোখের পাতা কেঁপে উঠল। গাঢ় নিশ্বাস ফেললো তার গলার স্বর করুণ হয়ে গেল।

‘আমার মধ্যে কি প্রেম জাগবে না?’

‘অভ্যাস করতে হবে, চর্চা করতে হবে।’ ছেলেটি সুন্দর করে হাসল। ‘ভালোবাসাতে শিখতে হবে।’

‘তুমি আমায় শিখিয়ে দাও।’

গাছ চোখ বুজলো। তার ঘুম পেয়েছে। গাছও ঘুমায়। কত রাত দুশ্চিন্তায় সে ঘুমোতে পারে নি। অথবা যেন ইচ্ছা করে সে আর নিচের দিকে তাকাল না। মানুষ যেমন গাছ সম্পর্কে উদাসীন থাকে, গাছকেও সময় সময় মানুষ সম্পর্কে উদাসীন থাকতে হয়, অভিজ্ঞ গাছকে তা বলে দিতে হল না।


অমৃত, নববর্ষ সংখ্যা, মে ১৯৭০

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২