ভোজ কয় যাহারে (চতুর্দশ পর্ব) : টমেটো – সত্যম ভট্টাচার্য

ভোজ কয় যাহারে (চতুর্দশ পর্ব) : টমেটো – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

এমন অনেক জিনিস আছে যা আমাদের জীবনে সরাসরি লাগে না, কিন্তু যদি দরকার পড়ে সেজন্য সাথে বা সঙ্গে রাখতে হয়। যেমন ধরা যাক, ঘুরতে যাবার সময় আমরা ওষুধ, ক্রিম বা ব্যান্ডএইড সাথে রাখি। কেন? দরকার পড়লে সেসব যাতে লাগতে পারে। বেশিরভাগ সময়ই সেসবের দরকার পড়ে না। আর দরকার যাতে না পড়ে তাই সবাই চায়। তাই সেসব ঘুরে যেভাবে বাইরে গিয়েছিল সেভাবেই আবার বাড়ি ফিরে আসে। অর্থাৎ এসব জিনিস যেমন ইনএভিটেবল নয় আবার সাথে না রাখলেও মনটা যেন কেমন খচ খচ করে, যদি কিছু হয়, তখন যদি দরকার মতো এইসব জিনিসকে হাতের সামনে না পাওয়া যায়।

মনে প্রশ্ন জাগে, টমেটোও কি এমনই একটি সবজি? কারণ বেসিক্যালি আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত ট্র্যাডিশনাল বাঙালি খাবারদাবারে বেসিক টমেটোর তরকারি বলে তো তেমন কিছু হয় না। হ্যাঁ, যেটা হয় বা আছে বহু বহু বছর ধরে তা হল টমেটোর চাটনি। পাতলা হোক বা গাঢ়, বেশি মিষ্টি হোক বা শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ঝাল ঝাল–যেভাবেই হোক না কেন একটা জম্পেশ খাওয়াদাওয়ার পর শেষ পাতে একটা চাটনি হলে বেশ জমে যায়। হ্যাঁ, সময়ে সময়ে কখনও জলপাই, কখনও কুল আবার কখনও চালতা আমাদের রসনা নিবৃত্তি করে বটে তবে শেষ পাতে ওই ভালোটুকু লাগানোর জন্য এখন প্রায় সারাবছরই হাজির থাকে টমেটো। যা আগে পাওয়া যেত শুধু শীত পড়লে।

এইবার প্রশ্ন হচ্ছে বাজারে অনেক লোককে দেখি প্রতিদিনই বেশ ভালো পরিমাণে টমেটো নিচ্ছে। এইবার জানতে ইচ্ছে করে এই টমেটো দিয়ে কি সারাবছরই তারা চাটনি খায়? কিন্তু চক্ষুলজ্জার কারণে জিজ্ঞেসও করা যায় না। না কি অন্য কোনো কারণে তাদের খেতেই হয়। কারণ সবজির দাম তো সারাবছর একই থাকে না। কখনও যেমন দশ টাকায় এককিলো টমেটো দেয় দোকানদার আবার কখনও সেই টমেটোরই কেজি গিয়ে দাঁড়ায় হয়তো দুশোটাকা।

এবারে যতদূর জেনেছি কোনো কোনো রোগের কারণে ডাক্তারবাবুরা টমেটো খেতে না করেন, তাহলে বিষয়টি কি এমনও যেখানে ডাক্তারবাবুরা দৈনিক টমেটো খেতে বলেন? আবার এমনও হতে পারে যে আমাদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তনের জন্য আমরা এমন কিছু জিনিস আজকাল খাই, হয়তো প্রতিদিনই খাই, তাতে টমেটোর দরকার পড়ে। যেমন আজকাল মানুষ প্রায় রোজই স্যালাড খায় যা কিন্তু আগে আমাদের রোজের মেনুতে থাকত না। এবারে স্যালাড খেতে হলে তো তাতে টমেটোর দরকার পড়বেই।

আবার এই যে বললাম দৈনিক টমেটো কিনতে দেখি, তা কিন্তু দেখি অনেক আমাদের মফস্বল শহরে বাস করেন এমন মারোয়াড়ি লোককেও। তারা কি স্যালাড খান? কারণ যতদূর জানি তারা তো নিরামিষাশী হন। আবার অনেকে তা নাও হতে পারেন। আবার অনেকে পেঁয়াজ বাদ দিয়েও স্যালাড খেতে পারেন। তারা কি তাহলে দৈনিক চাটনি খান, না কি তাদের সবজি তরকারিতে টমেটো দেবার রেওয়াজ আছে? এইসব প্রশ্ন অহরহ মাথার ভেতর ঘোরে, জানতে ইচ্ছে করে।

তবে আমাদের বাড়িতে বহুদিন থেকেই টমেটোর দরকার পড়ে আসছে, এক তো চাটনির জন্য আর এক মাটনে দেবার জন্য। এই মাটনে টমেটো দেবার ব্যাপারটা বাড়িতে মাংস হলেও চালু ছিল। এখন যেমন আমরা ম্যারিনেট কথাটা জানি আগে তো এসব জানতাম না। তখন খাসি বা পাঠার মাংসে একটু রং ধরানোর জন্য, যারা লঙ্কার গুড়ো দেন না তাদের টমেটোর দরকার পড়ত।

আর এখন তো আমাদের মেনুতে ঝোলের বদলে চলে এসেছে গ্রেভি। তাকে থকথকে বানানোর জন্য ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজের সাথে টমেটোর উপস্থিতি বাধ্যাতামূলক। আরেক জিনিস হয়েছে এখন। মানুষজন রুটি দিয়ে গবগবিয়ে খাচ্ছে। তাতে যে ওত বড়ো বড়ো করে টমেটো দেওয়া যেতে পারে আর সেসব খাওয়াও যেতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, তার নাম চিলি চিকেন।

যাই হোক, একবার আলিপুরদুয়ারের দমনপুরে আছি কবিসঙ্গে। রাতে মোচ্ছব হয়েছে একপ্রস্থ। এবারে সকালে বেরুব। কুক মহিলা রুটি বানিয়েছেন আর তার হাসবেন্ড কেয়ারটেকার ভদ্রলোক গিয়েছেন বাজারে। তিনি ফিরে আসলে সবজি হবে আমাদের রুটির জন্য। এদিকে আমাদের দেরি হচ্ছে। তখন তিনি সেই কাঠের উনুনে কয়েকখানা টমেটো ঢুকিয়ে দিলেন। খানিক পড়ে তাদের বের করে ওপরের পাতলা খোসাখানা ফেলে দিয়ে নুন, লঙ্কা আর তেল দিয়ে মেখে আমাদের দিয়েছিলেন রুটির সাথে। সত্যি বলতে আমাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল ওটা খাবার জন্য। একা টমেটোর ওরকম ব্যবহার অদ্যাবধি আর পাইনি।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২