পোখরায় আমরা (সপ্তম পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য
সপ্তম পর্ব
ভাগ্য ভালো যে পাশে বসা এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক আমাকে আনাড়ি বুঝতে পেরে সিটবেল্টটা পরে নিতে বলেছিলেন, না হলে যে কী হত কে জানে! কারণ প্লেনটা রানওয়ে দিয়ে দৌড় শুরু করে কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন উচ্চতায় নিয়ে এল যে কিছুই আর কহতব্য নয়। একে তো প্লেনেও কোনো পাব্লিক এড্রেসের ব্যাপার নেই, যেরকম আমাদের এখানে বিমান সেবিকারা বিমান ওড়ার আগে বলে থাকেন। দুজন সেবিকা আছেন বটে বিমানে কিন্তু তারা ওঠার সময়েই হাতে দুখানা করে বয়েজ চকোলেট ধরিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব সেরেছেন। তারপর থেকে শুধু তাদের খিলখিল হাসির আওয়াজই পেয়েছি আমরা।
তারপর তো ওই আওয়াজে কানে ভোঁ ভোঁ শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই আর প্লেন মাটি ছাড়ার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গিয়েছে মাথা ঘোরা। আর সেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখলাম ধীরে ধীরে ছোটো হয়ে আসছে পোখরা শহর। আমরা ক্রমশ ঢুকে পড়ছি নীল আকাশ আর পেঁজা পেঁজা মেঘের তুলোর জগতে। তার মাঝেই কথা নেই বাত্তা নেই হঠাৎ প্লেনখানা কাত হয়ে গিয়েই সেকেন্ডের মধ্যেই আবার সোজা হয়ে গেল। যদি সিটবেল্টটি না বেঁধে থাকতাম তাহলেই হয়েছিল অবস্থা চিত্তির।
তবে সোজা হয়েই যা দেখলাম চারিদিকে সারা জীবন তা মনের মণিকোঠায় ধরে রাখবার মতো। চারিদিক জুড়ে শুধু পাহাড় আর পাহাড় আর আমরা তাদের শৃঙ্গ বরাবর চলেছি। মানে প্লেনটা আকাশে উঠে দুটো পাহাড়ের মাঝ দিয়ে কাত হয়ে এমন একটা জায়গায় ঢুকে পড়েছে যে চারিদিকে ৩৬০ ডিগ্রীতেই তখন শুধুই পাহাড় আর তাদের বরফ ঢাকা শৃঙ্গ। যে মচ্ছপুছারেকে নীচ থেকে মাথা উঁচু করে দেখে এসেছি জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি চলছি তার সমান্তরালে।
হঠাৎ তাপসের দিকে তাকিয়ে দেখি ও চোখ বড়ো বড়ো করে মাঝে মাঝে জানালার দিকে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই আমাকে হাতের ইশারায় যা বোঝাল তাতে হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে বাইরে চলে আসার উপক্রম। ওর পাশের জানালার কাঁচটা নাকি খুব ধীরে ধীরে চিড়চিড় করে ফেটে যাচ্ছে। আজীবন যা জেনে এসেছি বায়ুর চাপের ব্যাপারে তা মনে করতেই তখন চোখের সামনে চন্দ্রবিন্দু নেচে বেড়াচ্ছে। আর তার মাঝে ওই খিলখিল হাসির আওয়াজ। কোথায় সুন্দরীদের ওরকম হাসি দেখে শরীরে মনে পুলকে ভরে যাবে তা নয় মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ পেত্নীরা সামনে অট্টহাস্য করে যাচ্ছে। চোখ বুজে ফেললাম।
এতক্ষণ ধরে চারিদিকে শুধু ন্যাড়া পাহাড়, তাদের মাথায় বরফ আর অনেক অনেক নীচে সরু সুতোর মতো নদী দেখতে পাচ্ছিলাম চোখ খুললে। হঠাৎ প্লেনখানা পলকের মধ্যে আবার কাত হয়ে সোজা হয়ে গেল। আর অনেক দূরে নীচে ছোট্ট একটা রাস্তার মতো দেখা গেল। শুধু আমি নই, দেখলাম যে আমার মতো অনেকেই আরও যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল। কারণ ওটাই জুমসুম এয়ারপোর্ট। প্লেনটা ততক্ষণে তার দিক পরিবর্তন করে এয়ার স্ট্রিপের আরও কাছাকাছি নেমে এসেছে। নামার সময় তপনদা শুধু বিমানসেবিকাদের কাছে থেকে আরও দুখানা বয়েজ চকোলেট চেয়ে নিয়েছে। আর বিশেষ তেমন কিছু ঘটেনি। নেমে যা দেখলাম, আহা! তাকে ভাষায় বর্ণণা করা কঠিন।
একটা কালো পিচের মাঠ। তাকে ঘিরে চারিদিকে শুধু মাত্র হলদে পাহাড়। আর তাদের মাথার বরফের মধ্যে রোদ পড়ে যেন ধোঁয়া উঠছে সেখান থেকে। আর সেই হলুদ পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে কাঁটাঝোপ। হাওয়ার ঝাপটায় যেন মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছি আর সে হাওয়া এমন ঠান্ডা যে মনে হচ্ছে যেটুকু জায়গা পাচ্ছে সেখানেই যেন সূচ ফুটিয়ে দিচ্ছে।
বেশ কিছু বিদেশি নেমেছে প্লেন থেকে। দেখলাম তারা এয়ারপোর্টে বসেই ব্যাগ থেকে লোহার টুকরোটাকরা বের করে সেগুলোকে জোড়া দিয়ে আস্ত একখানা সাইকেল বের করে ফেলল। আর সেগুলো নিয়েই লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে পড়ল মুক্তিনাথের উদ্দেশ্যে। বুঝলাম একেই বলে মাউন্টেন সাইক্লিং। আর আমরা বেরোলাম হোটেল ঠিক করতে। তারপর যাব মুক্তিনাথ।