স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (৫ম পর্ব)

শেয়ার করুন

পঞ্চম পর্ব

‘কখনও এমন হয়, তোমার দুহাতে কোনও কাজই থাকে না;

ঘুম ভেঙে মুখ ভার, মনে হয় শুরু হলো এখনই সকাল;

দুহাত এত কী ভারিঃ রোদটুকু-ধরা মাঠে তেঁতুলের ডাল

পাখি গেলে নড়ে ওঠে; কাঠবেড়ালিও ছাড়ে গুঁড়ির ঠিকানা।

শিশুদের খেলা ছাড়া কাজ নেই, আছে আজ তোমার কুঁড়েমি।

বিকেলের শেষ আলো মেঘের ওপারে হেম শেলায়ের মতো;

মাঠ রোদ গাছ পাখি এই এক গোল ফ্রেমে ধরা পড়ো তুমি;

ও বুঝি তোমার মেয়েঃ শান্ত, একটু নুয়ে, কর্মশিক্ষারত।’

(সীবন / বীতশোক ভট্টাচার্য)

পাখি যাচ্ছে, পাখি উড়ে এসে বসে আবার উড়ে যাচ্ছে আর দুলে উঠছে তেঁতুলের ডাল। শেষ-বিকেলের মাঠের ওপর এসে পড়ছে সন্ধ্যার মায়া… অন্ধকারের ইশারা, আর সেখানে জেগে রয়েছে একটি মেয়ের ছবি। কিশোরী, একটু ঝুঁকে সূচিকর্মে রত। ‘কর্মশিক্ষারত’ শব্দটির কাছে এসে থমকে যাই, বারবার ফিরে আসি, আবার কবিতাটির প্রথম শব্দ কয়েকটির কাছে ফিরে যাই… ‘কখনও এমন হয়’। সব সময় হয় না, যখন পৃথিবী খুব শান্ত হয়ে আসে, যখন নির্জনতার মধ্যে বসে থাকে মানুষ, যখন প্রকৃতির ভেতর থেকে একটি ‘মেয়ে’ উঠে এসে বসে দিগন্তে তখনই এমন ঘটনা ঘটে।

মেয়েটি শান্ত, একটু নুয়ে এবং ‘কর্মশিক্ষারত’। হঠাৎ মনে হয় এ মেয়ে কি মানস-গৌরী? এ ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত অণু-পরামাণুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্পন্দন’কে ধারণ করে রয়েছে, আজ বিকেলের শেষ-আলোয় সে এসে বসেছে দিগন্তের কাছে।

কবি তাকে আবিষ্কার করছেন কিশোরী হিসাবে। যে প্রশ্নটি কবি করেছেন (‘ও বুঝি তোমার মেয়ে’) তা আসলে এক পবিত্র ‘প্রতারণা’। শব্দটিকে মনে মনে বদলে ‘আমার’ করে দিই এবং পড়তে থাকি এক কল্পিত টেক্সট- ‘ ও বুঝি আমার মেয়েঃ’। মাঠ রোদ গাছ পাখি ধরে চলেছে যে মেয়ে একই ফ্রেমে, যে মেয়ে সূচিকর্মে-রত তাকে ‘আমার’ মেয়ে হিসাবেই গণ্য করেছিলেন বীতশোক। নিজেকে স্থাপন করেছিলেন কল্পিত ‘তোমার’ অবস্থানে, ম্যাক্রো থেকে মাইক্রো-স্তরে নেমে এসেছিল সে ‘মেয়ে’।সমস্ত কর্মের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে নিজের মেয়ে ভেবে শিহরিত হয়ে উঠেছিলেন বীতশোক।

বীতশোকের এই কবিতাটির সঙ্গে ক্লদ মনে’র ‘ওম্যান রিডিং’ ছবিটির সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য দুই’ই অনেক। দিগন্তে ‘কর্মশিক্ষা’য়-রত মেয়েটিকে বীতশোক আবিষ্কার করেছিলেন আত্মজা হিসাবে; এ ছবিটির ইতিহাস যাঁরা জানেন তাঁর নিশ্চয় জানবেন যে এ-ছবির মেয়েটি ক্যামি ডনসিঁও; ১৮৬৫ সালে মনে’র সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। তিনি এক অখ্যাত, গরীব শিল্পীর প্রেমিকা। ১৮৪০ সালের ১৪ নভেম্বর প্যারিসে জন্মগ্রহণ করা এই শিল্পী’র পরিবার তাঁর পাঁচ-বছর বয়সে নরম্যান্ডি’তে চলে যাচ্ছে ভাগ্যসন্ধানে।

সতেরো বছর বয়সে মাতৃহারা হয়ে উনিশ বছর বয়সে তিনি আবার চলে গিয়েছিলেন প্যারিসে, ছবির টানে; এক বন্ধুর পরামর্শে।

কিন্তু তার আগে তিনি শৈশব ও কৈশরের বেশ কিছুটা কাটিয়ে ফেলছেন ল্য হ্যাভ(র) নামে একটি জায়গায়। নরম্যান্ডির বন্দর এলাকা; শ্যেন নদী গিয়ে মিশেছে ইংলিশ চ্যানেলের সঙ্গে। মোহনার কাছে জল ও জাহাজের অবাক খেলা; ক্রমশ জল ও জলের ভেতর খেলা করতে থাকা জল-রঙ আলো প্রবেশ করতে শুরু করেছে তাঁর স্নায়ুতে। আকাশে মেঘের বিস্ময়কর কারুকাজ দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা শিল্পী শুষে নিচ্ছেন সমস্ত রঙের সন্ত্রাস।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে মেয়েটিকে (ক্যামি ডনসিঁও) তার সঙ্গে দেখা হবার সাত-বছর পর সৃষ্টি হচ্ছে এ ছবি। তবে তার আগে ঘটে গিয়েছে আরও কিছু ঘটনা; ক্ষতবিক্ষত হতে হতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রঙের জাদুকরদের একজন শেষ করে দিতে চেয়েছেন তাঁর জীবন। আত্মহত্যার তীর থেকে ফিরে এসেছেন। আবার সৃষ্টি করেছেন; ছবিটির কাছে আরেকবার ফিরে আসা যাক।

A Woman Reading 1872

(ওম্যান রিডিং- ১৮৭২)

ক্যানভাসের ওপর গাঢ় তেলরঙের খেলা; ইম্প্রেশনিস্ট ঘরানার জাদুকর তাঁর প্রেমিকা’কে এনে বসিয়েছেন বাগানের মৃদু রোদ্দুরে। ব্রাশের স্ট্রোকগুলি ঘুরে চলেছে ক্লকওয়াইজ… ঘড়ির কাঁটা বরাবর। ক্যানভাসের ডান-দিক থেকে শুরু হয়ে সেগুলি শেষ হচ্ছে বাম-দিকে। অন্তত ছবির উপরের দিকে বাম-দিক বরাবর এ প্রবণতা বেশি; ফলে ক্যামি’র মাথার উপর তৈরি হচ্ছে সবুজের চাঁদোয়া। গাছগুলিকে, পাতাগুলিকে আলাদা করে চেনানোর কোনও ইচ্ছা নেই মনে’র। বীতশোক যেমন ‘এক ফ্রেম ধরা’ পড়বার কথা লিখেছিলেন এখানেও মনে এক ফ্রেম ধরতে চাইছেন পৃথিবীর সমস্ত সবুজ। ক্যানভাসের বাম-দিক থেকে ডান-দিকে পা-ছড়িয়ে বই পড়ে চলেছে এক নারী, পরনে ইউরোপিয়ান পোশাক। তার পা ও নিতম্বের কাছে ফুটে থাকা ফুলগুলি রূপান্তরিত হয়ে চলেছে শাদা-প্রজাপতি’তে। তার মাটি থেকে উঠে ঘুরে ঘুরে ছড়িয়ে পড়ছে নারীটির পোশাকে, শরীরে।

আসলে তারা পাতার আড়াল থেকে চুঁইয়ে পড়া রোদ্দুর; প্রবেশ করবার কথা ছিল না, অথচ যেন প্রবেশ করে ফেলেছে এ দৃশ্যের মধ্যে। সে সূর্যের আভা পেয়ে হেসে উঠেছে কয়েকটি বুনো-ঝোপ, মেয়েটির হ্যাট ও বুকের কাছে খেলা করছে অপার্থিব আভা।

ছবিটি যতবার দেখেছি মনে হয়েছে যেন এক অজানা নক্ষত্রমণ্ডল অথবা আকাশগঙ্গা ছড়িয়ে রয়েছে বাগানে।

মনে’র পরের ছবিটির কাছে বসার সময় শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল স্রোত নেমে যায়, মনে পড়ে এ বাংলার একজন কবি লিখেছিলেন,

‘যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক

চেয়েছিলো- হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি’।

– ‘দ্য লাঞ্চেন’ ছবিটির সঙ্গেও তেমনই হাঙরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খাবার বিষয় জড়িত হয়ে রয়েছে। ছবিটি মনে সৃষ্টি করেন ১৮৬৮ সালে; ঠিক তার আগের বছর, ১৮৬৭-তে (অবশ্য মতান্তরে সময়টিকে ১৮৬৮-র মে মাস বলেও গণ্য করেন কেউ কেউ) জন্মগ্রহণ করেছে তাঁর ও ক্যামির প্রথম সন্তান জ্যঁ। মনে তখন রয়েছেন ল্য হ্যাভ(র)-এ; প্রবল অর্থকষ্টে তিনি সদ্যজাত সন্তানের কাছে যেতে পারছেন না। পৃথিবীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পধারার একটির রূপকার মনে মনোকষ্ট, গ্লানি’তে ঝাঁপ দিয়েছিলেন শ্যেন নদীতে। বেঁচে গিয়েছিলেন ভাগ্যক্রমে। কিন্তু এর সঙ্গে ছবিটির সংযোগ কোথায়?

ঘটনাটির গভীর গভীরতর সংযোগ রয়েছে ছবিটির সঙ্গে, কারণ ১৮৬৮-সালে এ ছবিটি আঁকার সময়ে মনে’র অর্থনৈতিক অবস্থা রাতারাতি ভাল হয়ে যায়নি।

(দ্য লাঞ্চেন-১৮৬৮)

-অথচ ছবিটিতে খাদ্য-পানীয়ের প্রাচুর্য লক্ষ করার মতো। ক্যামি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয়েছেন সন্তানের দিকে, জানালার পর্দা ভেদ করে অপার্থিব আলো এসে পড়েছে টেবিলে। রঙের জাদুকর ধরে রাখছেন সে আলো। দেওয়াল ও দণ্ডায়মান দুই রমনীর পোশাকের রঙ গাঢ় বাদামি ও কালো। ছবিটির মাঝখানে সফেদ টেবিল-ক্লথের উপর থরে থরে সাজানো খাদ্য, যেন পৃথিবীতে খাদ্যের অভাব ছিল না, যেন পৃথিবীতে খাদ্যের অভাব থাকবে না কোনওদিন। ছবিটি দেখতে দেখতে আবিষ্কার করা যাবে, মা এবং ছেলে, কারও দৃষ্টি’ই খাবারের দিকে নিবদ্ধ নেই। থরে থরে সাজানো খাবারের সামনে বসে শিশুটির দৃষ্টি উদাসীনভাবে চলে যাচ্ছে টেবিল পেরিয়ে।

জীবনীগ্রন্থগুলিতে জানা যাচ্ছে মনে তখন তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছেন; তা হলে সে সময়ে এমন একটি ছবির সৃষ্টি করলেন কেন তিনি? এ ছবি কি ‘যা হতে পারত, অথচ যা হল না’ তার প্রকাশ? মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, এ ছবি মনে’র স্বপ্নে সম্ভব হয়ে ওটা ছবি।

কিন্তু মানুষ কি তার স্বপ্নের ভেতরেও স্বপ্নভঙ্গের ইশারা বয়ে নিয়ে বেড়ায়? মনে’র মতো একজন শিল্পী কি তাঁর ছবির মধ্যে রেখে যাবেন না সে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও হাহাকার? আপাতভাবে এই ছবিটির মধ্যে ছড়ানো প্রকাশ্য আলোর উৎসবের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হতে বাধ্য, ছবিটির মধ্যে কোথাও কোনও স্বপ্নভঙ্গের ‘অন্ধকার’ নেই। কিন্তু সে ধারণাও খণ্ডিত, কারণ ক্যানভাসের বাম-কোণে রাখা চেয়ারের নিচে তাকালে কবন্ধ ভয় গলা টিপে ধরতে বাধ্য।

চেয়ারের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটি পুতুল, হাত’পা-হীন একটি পুতুল। এ পুতুল মনে’র স্বপ্নভঙ্গের বেদনার দিকে ইঙ্গিত করে। শুধু তাই নয়, টেবিলে তিনটি প্লেট সাজানো রয়েছে, তৃতীয় প্লেটের সামনের চেয়ারে যেন এক্ষুনি এসে বসবে কেউ। সে ব্যক্তি কি মনে? মনে কি নিজেকে ছবিতে অনুপস্থিত রাখছেন এ কারণেই যে দৃশ্যটির পূর্ণতাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সব থেকে বড় অন্তরায় তিনি নিজেই? ছবিটির দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অতি-অবশ্যই নজরে পড়বে, টেবিলের ওপরে টানটান করে পাতা টেবিল-ক্লথ এবং টেবিল থেকে ঝুলে থাকা টেবিল-ক্লথ- তারা এক হয়েও যেন পৃথক। উপরের অংশ অনেক বেশি শুভ্র, ভাঁজহীন। অপরদিকে ঝুলে থাকা অংশ ভাঁজে ভর্তি ও কিছুটা মলিন। দৃষ্টিপথের বাইরে মনে কি এভাবেই তাঁর দারিদ্র লুকিয়ে রাখার ইশারা রেখে গেলেন ছবিটিতে?

জীবন ঠিক কতটা টালামাটাল ছিল ক্লদ মনে’র? তাঁর ছবি যে তাৎক্ষণিক সফলতা পাবে না তা সমালোচকদের আগেই যেন বুঝতে পেরে গেছিলেন তিনি স্বয়ং। ১৮৭৪ সাল আসতে তখন বেশ কিছুটা দেরি, ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের প্রথম প্রদর্শণী’তে মনে’র ছবি দেখে লুই লেরয় নামে সমালোচক যে লিখবেন, ‘ছবির বদলে কে যেন ক্যানভাসে কাদা ছিটিয়ে চলেছেন’, তাও তখন বেশ কিছুটা দূরের বিষয়। প্রবলভাবে পথ খুঁজে চলেছিলেন মনে; খুঁজে চলেছিলেন একটি দৃশ্যে চারপাশ থেকে আলো পড়া এবং সে কারণে দৃশ্যটির রূপ খুব সূক্ষভাবে বদলে বদলে যাওয়ার গূঢ় পদ্ধতি ও কারণ। বুঝতে চাইছিলেন প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা রঙের সন্ত্রাস।

মনে’র ছবির দিকে তাকালে বোঝা যায় ‘জলের’ প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ কখনও ফিকে হয়নি। জীবনে জল ও জলের ভেতর থেকে উঠে আসা জল-রঙ আলো’ই সব থেকে বেশি এঁকেছেন মনে। যেমন ‘দ্য মাউথ অফ দ্য শ্যেন অ্যট অনফ্লা’ ছবিটির কথা মনে পড়তে বাধ্য এ সময়ে। অনফ্লা’র কাছাকাছি শ্যেন এসে মিশেছে ইংলিশ-চ্যানেলে।

(দ্য মাউথ অফ দ্য শ্যেন অ্যট অনফ্লা, ১৮৬৫)

-আকাশে ফুঁসে ওঠা মেঘের দল, ক্যানভাসের নিচের দিকে শ্যেনের উথালপাতাল জলে ভেসে বেড়াচ্ছে নৌকা, ডিঙি। নিচের বামদিকের নৌকাটি ডুবে যেতে যেতে টাল সামলে নিচ্ছে, একটি ডিঙি আড়াআড়ি পার হয়ে যাছে নদী। দিগন্তের কাছে নৌকার সার, সব নৌকাগুলির পাল ধূসর। শুধু একটি নৌকার পাল শাদা। উপরের বামদিকে একটি লাইটহাউস। আকাশে কয়েকটি পাখির উড়ে যাওয়া। রিয়েলিস্টিক ভঙ্গিতে আঁকা এ ছবিটিতে এর বেশি কিছুই নেই, কিন্তু যা রয়েছে তা হল অসম্ভব গতিশীল, ঘূর্ণনমাখা মুহূর্তের চিত্রণ।

কী আশ্চর্য শিল্পীর জীবন! শ্যেনের কাছে বারবার ফিরে এসেছিলেন মনে, ছবির জন্য। আবার এই শ্যেনের বুকেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন, শ্যেন তাঁকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল।

১৮৬৯-এ সৃষ্ট ‘দ্য ম্যাগপি’ ছবিটির কাছে যাবার আগে ঊনবিংশ শতাব্দী’র মধ্যভাগ থেকে একটি ছোট্ট আবিষ্কার শিল্পীদের হাতে যে স্বাধীনতা তুলে দিয়েছিল এবং সে কারণে শিল্পকলায় কী সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল তার দিকে একবার তাকানো যাক। এর আগে পর্যন্ত শিল্পীদের গুঁড়ো-পাওডারের আকারে প্রাপ্ত পিগমেন্ট গুলে রঙ প্রস্তুত করতে হত। সময়সাপেক্ষ ও বহন করার ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ অসুবিধাজনক। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মেটাল-টিউবে ‘রেডি-মিক্সড’ রঙ বিক্রি হতে শুরু করে। মনে’র জীবনীকার Susie Hodge থেকে শুরু করে বহু শিল্প-সমালোচক মনে করেন এই ‘রেডি-মিক্সড’ রঙের টিউব শিল্পীদের তাদের স্টুডিও থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তাঁরা রঙ নিয়ে যখন যেখানে খুশি চলে যেতে পারতেন, প্রকৃতির মাঝখানে বসে সরাসরি প্রকৃতি থেকে ক্যানভাসে ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।

১৮৭০-এ বেশ কিছুদিনের জন্য লন্ডন চলে যাবেন মনে; দেশে ঘনিয়ে ওঠা যুদ্ধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে এ ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না। তার আগে ১৮৬৯-এ তাঁর হাতে সৃষ্টি হবে ‘দ্য ম্যাগপি’।

জনমানবহীণ প্রান্তরে একটি কাঠের বেড়া পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে সকাল, ঢুকে পড়ছে রোদ। ক্যানভাসের মাঝ-বরাবর বরফ ও পাথরের স্পর্শরেখা, ক্যানভাসটি প্রায় দুটি অংশে বিভাজিত হয়ে গেছে।

(দ্য ম্যাগপি- ১৮৬৯)

উপরের অংশটি তুলনামূলকভাবে বেশি ‘ভারী’, সেখানেই গাছের সার ও বরফ-ঢাকা পথের ইশারা। শুধু ধূসর ও রজত-শুভ্র রঙের ভেতর মনে সীমাবদ্ধ থাকলেন না; তিনি ছবিটিতে খুব হালকা আকাশী, স্বর্ণাভ-হলুদ রঙ ব্যবহার করলেন। ম্যাগ পি-কে রাখলেন গেটের উপর। ম্যাগ পি’টি কি এবার গান গেয়ে উঠবে? এ বরফের মতো দীর্ঘ একাকিত্ব ও শূন্যতার ভেতর কি বেজে উঠবে তার গান?

It is poetry through the harmony of true colors. Monet adores real nature. (Cammille Pissarro)

‘একদিন আমাদের কবিতা আরও অস্পষ্টতার দিকে চলে যাবে।

ছাদের কার্নিশ থেকে কাক উড়ে এস বলবেঃ

তুমি ভিক্ষুক, তুমি দ্যাখ আশ্বিনের সবুজ ধানের খেত।

একদিন ঘুম থেকে উঠে তুমি দেখতে পাবে, সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে গেছে

অস্পষ্ট হয়ে গেছে খিদিরপুর, বাড়ি-ফেরার পথ, চার্চ, দেবদারু গাছ

একদিন দেখতে পাবে তোমার চারপাশে অস্পষ্ট কোলাহল,

তুমি আর এগোতে পারছ না’। (একদিন / কালীকৃষ্ণ গুহ)

যুদ্ধের প্রকোপ এড়াতে প্যারিস থেকে লন্ডনে চলে যান মনে ১৮৭০ সালে। নতুন জগৎ, নতুন বন্ধুদের সান্নিধ্যে মনে’র ছবিতে এল নতুন বাঁক। আরও ‘অস্পষ্টতার’ দিকে চলে গেল সে সব ছবি।

কিন্তু এখানেও লক্ষ করার, জলের ‘মায়া’ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারছেন না মনে। একের পর এক ছবি এঁকেছেন, তার মধ্যে অতি-বিখ্যাত ‘দ্য টেমস বিলো ওয়েস্টমিন্সটার’ (১৮৭১)।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে আগুনের গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দ্য হাউস অফ পার্লামেন্টের নব-নির্মিত ভবন। বিগ বেন; এবং ১৮৬২ সালে খুলে দেওয়া ওয়েস্টমিন্সটার ব্রিজ। ছবিটির ডিপ-স্পেস ক্রমশ কুয়াশায় ঢেকে আসছে, ডান-দিকে কয়েকজন শ্রমিক ভেঙে চলেছে একটি জেটি। সম্ভবত ভিক্টোরিয়া এমব্যাঙ্কেমেন্ট তৈরির কাজ চলছে। ছবিটিতে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা ছড়িয়ে রয়েছে। হলুদ বিষণ্ণতার মধ্যে জেটি ভেঙে চলেছে কয়েকজন শ্রমিক।

এভাবেই কি পুরাতন কিছু সংস্কার ভেঙে নতুন ‘ইম্প্রেশনিস্ট’ ঘরানার সূচনা করতে চেয়েছিলেন মনে?

(দ্য টেমস বিলো ওয়েস্টমিন্সটার- ১৮৭১)

অবশ্য বেশিদিন লন্ডনে থিতু থাকতে পারেননি মনে, আবার তিনি ফিরে আসেন প্যারিসে। তীব্র অর্থ-সংকটের কারণে পরিবার নিয়ে চলে যান ছোট শহরে। প্যারিসের সাঁলো-তে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তাঁর ছবি। তিনি ও তাঁর কিছু বন্ধু মিলে প্রথম ইম্প্রেশনিস্ট একজিবিশন করলেন ১৮৭৪ সালে, সমালোচনার তীর ধেয়ে এল তাঁদের দিকে। প্রথাগত ছবির বদলে তাঁর তখন সৃষ্টি করে চলেছেন বিচিত্র ধারার ছবি। বাস্তবের মধ্যে যে লুকিয়ে থাকতে পারে এত এত রহস্য ও বিমূর্ত রূপ তা তাদের ছবিতে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এ পর্বের সব থেকে বিখ্যাত ছবি অবশ্যই ‘ইম্প্রেশন, সানরাইজ’ (১৮৭২)

(ইম্প্রেশন, সানরাইজ- ১৮৭২)

এখানেও মনে জলের কাছে ফিরে এসেছেন, দূরে বন্দর-শহরের রেখা। বাণিজ্য ও শিল্পায়নের চিহ্ন। যে জল, নৌকা, শহর আর সূর্য এঁকেছেন তা ঠিক রিয়ালিস্টিক নয়, বাস্তবতার মধ্যে ফুটে থাকা আরেকটি দেখার পদ্ধতি। ছবিটিতে ছোট ছোট, শক্তিশালী ব্রাশ-স্ট্রোক, মনে একেই ঘোষণা করলেন ‘ইম্প্রেশন’ বলে।

মনে’র মতো এত বেশি ছবির সিরিজ খুব কম ইউরোপিয়ান শিল্পীর আছে। মনে’র আগে হাতে-গোনা গুটিকয়েক শিল্পী সিরিজ এঁকেছেন। মনে একই দৃশ্যের উপর এসে পড়া আলো’কে বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে চেয়েছিলেন, দেখতে চেয়েছিলেন বিভিন্ন কোণ থেকে ফুটে ওঠা একই দৃশ্যের বিভিন্ন রূপ।

(হেস্ট্যাকস এট দ্য এন্ড অফ সামার- ১৮৮১)

যেমন এ মুহূর্তে আমরা যে ছবিটির কাছে বসে সে ছবিটির নাম ‘হেস্ট্যাকস এট দ্য এন্ড অফ সামার’। গিভার্নি’তে থাকার সময় মনে হেস্ট্যাকস সিরিজের বেশ কিছু ছবি আঁকেন। বিভিন্ন ঋতু’তে বদলে বদলে গেছে শস্যস্তুপের রূপ। এ ছবিটিতেও ছোট ছোট ব্রাশ-স্ট্রোকস। সবুজ ও নীলের বিভিন্ন শেডস ব্যবহার করেছেন শিল্পী। দিগন্তে ছুটে যাওয়া অনুচ্চ টিলা ক্যানভাস’কে আড়াআড়ি দুটি ভাগে ভাগ করেছে। ওই টিলার প্রান্ত পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টি ছুটে গিয়ে তাকে অতিক্রম করে চলে যেতে চায়, পারে না। আমাদের সামনে জেগে থাকে দুটি শস্যস্তুপ, স্তনের মতো দুটি স্তুপ। বাস্তবের সরাসরি উপস্থাপন নয়, পরিবর্তে বাস্তবের প্রতিচ্ছবি ফুটে রয়েছে ছবিটিতে।

যে অস্পষ্টতার কথা লিখেছিলেন কালীকৃষ্ণ গুহ তা কি শুধুই ‘অস্পষ্টতা’? না কি সে অস্পষ্টতা স্পষ্টতার অধিক কিছু?

মনে’র রুয়ান ক্যাথিড্রাল ইন ফুল সানলাইট ছবিটি দেখলে এ প্রশ্ন আরও আরও গভীর হয়ে উঠবে।

(রুয়ান ক্যাথিড্রাল ইন ফুল সানলাইট- ১৮৯৪)

সূর্যের আলো গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল ক্যাথিড্রাল, তার খিলানের মধ্যে প্রবেশ করেছে আলো। মনে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যাথিড্রালটিকে ‘অস্পষ্ট’ করে দিয়েছেন, কোনও ব্রাশ-স্ট্রোক’ই দীর্ঘ নয়। কিন্তু আশ্চর্য, ক্যাথিড্রালটি যত অস্পষ্ট হয়েছে সূর্যের আলোয় তার দেওয়ালগুলির কেঁপে ওঠা যেন তত তীব্র হয়েছে। ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হয়, দেওয়ালগুলি ধকধক করে কাঁপছে।

ঠিক এভাবেই কি একদিন কেঁপে উঠেছিলেন জীবনানন্দ? তাঁর ‘অবনী পালিতের মৃত্যু’ কবিতায় আমরা পাচ্ছি,

‘অনেক পুরুষ, নারী, কুকুর, ও রৌদ্রের জয়জয়কারে

মানে বা মোনে-র মতো শিল্পীকে মরে গেছে দেখে খুন-খুন হয়ে হাসে

পাললিক মৃত্তিকার চিত্রকর মরে যায় দেখে…’

– একজন শিল্পীর একটি বা দুটি কাজ অতি-বিখ্যাত হয়ে যাওয়া এক ধরণের আভিশাপ সে শিল্পীর ক্ষেত্রে। মনে’র কথা মনে হলেই সেই বিখ্যাত ‘ওয়াটার লিলিজ’ সিরিজের কথা মনে পড়ে আধিকাংশ মানুষের। এই বাইরে যে তাঁর শয়ে শয়ে আশ্চর্য সৃষ্টি রয়ে গেল সেদিকে আমাদের নজর পড়ল কম।

(ওয়াটার লিলিজ- ১৯০৩)

মনে’র ওয়াটার লিলিজ বিখ্যাত হবার পিছনে বহু কারণ আছে, তবে সব থেকে প্রধান কারণ অবশ্যই, রঙের মেলোডি বলতে যা বোঝায় ওয়াটার লিলিজ সিরিজের ছবিগুলি তাই-ই। গিভার্নি’তে গিয়ে তিনি একটু মানসিক স্থিতি পেয়েছিলেন, ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছিল তাঁর ছবি।

ওয়াটার লিলিজ সিরিজের যে ছবিটি এখানে দেখা যাচ্ছে সেটিতেও এসে পড়েছে নীল আকাশের ছায়া, শুধু জলের শান্ত শরীর জুড়ে ফুটে রয়েছে লিলি। খুব ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, উইলো’র ছায়া পড়েছে জলে। রঙের ভাইব্রেশন ছড়িয়ে পড়ছে অতি-শান্ত জলে। শুধু ভালবেসে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দীর্ঘ সময় মনে অতিবাহিত করেছিলেন গিভার্নি’তে। সৃষ্টি হয়েছিল একের পর এক ছবি, এ সিরিজের।

মনে’র ওয়াটার লিলি-তে কিছুই হয়ে ওঠার বাসনা নেই যেন, যেন জলের অতল থেকে উঠে আসা শান্ত এক মায়া খেলা করে বেড়াচ্ছে লিলি’র দল।

কিন্তু এই শান্ত আবহাওয়ার মধ্যে হঠাৎ মণীন্দ্র গুপ্ত’র ‘ডিম’ কবিতাটি মনে পড়ল কেন আজ? কেন মনে পড়ল সেই আট’টি লাইন,

‘ডিম পড়ে আছে বনে, কাঁটাঝোপে-

করুণতা ঘিরে আছে তাকে।

ডিমের খোলায় জেব্রা ক্রসিংয়ের দাগ-

ঘোড়ার ডিমের মতো এ কি কোনো স্তন্যপায়ীদের ডিম?

পৃথিবী যেন বা এখনো অতীত যুগে আছে।

আনন্দ না, বিষাদ না,

রহস্য ডিমের মূর্তি ধরে ঘুমন্ত শিশুর মতো শুয়ে আছে

কাঁটাঝোপে ধুলোয় বিকেলে’।

-মনে তাঁর ‘দ্য এগস’ ছবিতে ডিমগুলিকে রেখেছিলেন একটি টেবিলে।

(দ্য এগস- ১৯০৭)

টেবিলে একটি ঝুড়ি, একটি বাটি ও একটি জগ আকৃতির পাত্র রাখা। জগ’টির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেটি রূপান্তরিত হতে শুরু করবে অচেনা এক প্রাণীর আদলে। টেবিলের উপর যে মোলায়েম বস্ত্র তা যেন কোনও নারীর এলিয়ে থাকা শরীর। ঝুড়ির ভেতর, টেবিলে ফেলে রাখা কাপড়ের ওপর পড়ে রয়েছে কতগুলি ডিম। রহস্যজনক কতগুলি ডিম… আরও ভাল করে দেখলে বোঝা যাবে ব্রাশ-স্ট্রোকসগুলি চক্রাকারে শেষ হয়েছে। ঠিক যেন ঘূর্ণি’র মধ্যে পড়ে রয়েছে কতগুলি ডিম।

ক্রমশ ডিমের করুণতা গ্রাস করতে থাকে, বহু দশক পেরিয়ে মনে’র বিপণ্ন বিস্ময়ের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে মণীন্দ্র গুপ্ত’র বিপণ্ণ বিস্ময়।

মনে পড়ে শিল্পের এই বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে, প্রকৃতির এই বিস্ময়ের দিকে তাকিয়েই মণীন্দ্র গুপ্ত একদিন লিখেছিলেন, ‘যেন জাদুঘরে রয়েছে ইস্কুল- ম্লান স্তব্ধ অতীতের করিডোর’।

শেয়ার করুন

Similar Posts

2 Comments

  1. চমৎকার। চিত্রকরদের ছবি ধরে ধরে এরকম আলোচনা খুব একটা দেখিনা। আগে যাদের লেখা দেখেছি বেশির ভাগই নির্দিষ্ট ছবির প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে তার নিজস্ব অনন্য ভাবনা লিখেছেন, সেদিক থেকে এই লেখাগুলি আলাদা, ছবিকেন্দ্রিক। খুব ভালো লাগছে বাংলা কবিতার অকৃপণ এবং যথাযথ ব্যবহার। ওম্যান রিডিং ছবিটি নিয়ে আমার একটু ভিন্ন বক্তব্য আছে, যদিও উল্লেখ করার মত কিছু নয়। মনের প্রচুর সিরিজ আছে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিচিত্র আলোর খেলায় বিচিত্র ঋতুর খেলায় নিসর্গ। একই রাস্তার বাঁক সকালের নরম আলোয় আবার বিকেলের পড়ন্ত আলোয়। সেই সব সিরিজ ধরে দীর্ঘ আলোচনা আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্থীন শুভেচ্ছা জানবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *