পোখরায় আমরা (ষষ্ঠ পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য
ষষ্ঠ পর্ব
তাপস যখন ডেকে তুলল আমাদের তখন ভোর পুরোপুরি হয়নি। বাইরে একে তো আলো ফোটেনি আর তার ওপরে যা বিদ্ঘুটে কুয়াশা তাতে দুহাত দূরের বললে ভুল হবে দু ইঞ্চি দূরের জিনিসও ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে হবে হোটেল থেকে তার কারণ সকাল ছটায় পোখরা থেকে আমাদের জুমসুমের ফ্লাইট।
এবারে এটা যে সময়ের ঘটনা সে সময় শুধু আমরা কেন আমাদের অনেক বড়োরাও প্লেনে চড়েনি। ব্যাপারটা এখনকার মতো নয় যে আমোদগেড়ে বাচ্চাও প্লেনের কথা উঠলে সে আলোচনায় অংশ নিয়ে নেয়। কী কী সম্ভাব্য হতে পারে তা নিয়ে আগের দিন বিস্তর আলোচনা হয়েছে রাতে শোবার পর। তাতে ঘুমোতে যেমন দেরি হয়েছে আবার উত্তেজনায় ঠিকঠাক ঘুম হয়নি বললেও ভুল হবে না। সকালে উঠে সেই জ্বলা চোখই কচলে হাত-মুখ ধুয়ে ডলতে ডলতে আমরা রাস্তায় এলাম সকলে ট্যাক্সির খোঁজে।
আর তাপস সেই অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটা শুরু করে দিল। এটাই ওর নিয়ম। রাস্তায় উঠে বেশ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে না নিলে ওর মেজাজটা ঠিক আসে না। কিন্তু আমরা তো পড়লাম মহা সমস্যায়। একে অন্ধকার, কুয়াশা তার ওপর ওরকম ভারী ব্যাগ কাঁধে। কিন্তু উপায় কী? আমরাও হাঁটা শুরু করলাম। আর খানিক পরেই বুঝতে পারলাম ওরকম ঠান্ডাতেও কুলকুল করে ঘামছি। যা হোক খানিক পরে একখানা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। এবং সে যাত্রায় বাঁচলাম। না হলে আমরাই মনে হয় বিশ্বে এমন লোক হতাম যারা কয়েক কিলোমিটার হেঁটে প্লেন ধরতে গিয়েছে।
বসে আছি পোখরা এয়ারপোর্টে। যেহেতু তার আগে কোনোদিন প্লেনে উঠিনি তাই এয়ারপোর্টেও ঢোকা হয়নি। কিন্তু যা গল্প পড়েছি বা ছবিতে দেখেছি তাতে এই জায়গাটিকে একদমই এয়ারপোর্ট বলে মনে হচ্ছে না। নিদেনপক্ষে একটা পাহাড়ি জায়গার বাসস্ট্যান্ড বলেই মনে হচ্ছে। বাইরে ঘন কুয়াশা। কাচের ওপারে পিচের একটা ছোটো মাঠ মতো। তাতে কয়েকটা ছোটো ছোটো প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো দেখতে অনেকটা ছোটোবেলায় শুকতারার কমিক্সে পড়া ডর্নিয়ার প্লেনের মতো দেখতে। কোনো পাব্লিক এড্রেস সিস্টেম এই এয়ারপোর্টে নেই। এনকোয়ারিতে খোঁজ নিতে আমাদের বলা হল কুয়াশার কারণে জুমসুমের প্লেন ছাড়তে দেরি হবে। এদিকে লোকজন দেখি বলাবলি করছে যে সকাল নটা দশটার মধ্যে প্লেন উড়তে না পারলে তা ক্যানসেল হয়ে যাবে কারণ জুমসুমে ওই সময়ের পর আর প্লেন নামতে পারে না। সেই হলুদ রাজ্যে না কি তারপর আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়।
বসে আছি, বসে আছি। মাঝে মাঝে রোদ উঠছে। কিছু লোক দৌড় দিচ্ছে কাচের জানালা খুলে প্লেনের দিকে। আমরাও দৌড়োচ্ছি ব্যাগপত্তর নিয়ে। খানিক এগোবার পর শোনা যাচ্ছে সেটা নাকি আমাদের প্লেন নয়। আবার কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারিদিক। হতাশ হয়ে ফিরে এসে বসছি। কে ডাকছে, কীভাবে ডাকছে—কিছুই বুঝতে পারছি না। সময় কাটছে। তপনদা মাঝেমধ্যে বলছে—চল তাপস, ফিরে যাই। তাপস কটমট করে তাকাচ্ছে। আসলে ব্যাপারটা কিছুই নয়। বিড়ি খেতে না পেরে তপনদা হতাশ হয়ে পড়ছে।
যাইহোক, এরকমই দৌড়তে দৌড়তে দেখলাম সত্যিই আমরা আমাদের প্লেনে উঠে পড়েছি। এবং কত কিছু ভেবেছিলাম যে এমন সিটে বসব যাতে ডানাতে ভিউ না আটকে যায়। কিন্তু যে কটা সিট খালি আছে তার প্রত্যেকটিই ডানার পাশে। সব লোক আগেই এসে বসে পড়েছে। আর অনিবার্যভাবে টিকিটে সিট নম্বর থাকলেও সেসব মানার কোন বালাই নেই।
কিন্তু একি? ছোট্ট প্লেনটার একদিক জুড়ে বাঁধাকপি, ডিম আর আরও কত শাকসবজিতে ভরতি। তারই একদিক দিয়ে জায়গা করে নিয়ে সবাইকে বসতে হচ্ছে। এটাই নিয়ম। এসব দেখতে দেখতেই কানে ভোঁ ভোঁ নিয়ে প্লেন ছুটতে শুরু করল আর আমরাও সত্যি সত্যিই বিদেশের মাটিতে আকাশে উঠে পড়লাম।