শুভ্রাশ্রী মাইতি-র পাঁচটি কবিতা
সঞ্জীবনী
এই তো জল ছলছল আয়নাবিলাসী দীঘি আমার,
কবেকার যেন; আঁজলার পর আঁজলা ভরে কী এত
স্মৃতিভার তুলছ তুমি বলো… শ্যাওলাঝাঁজির গন্ধমাখা!
হাতের পাতায় একে একে উঠে আসছে
আমাদের নরম নীল চিঠি, পাখিগানের সুপ্রভাত,
ঘামফুলের নির্জন দুপুর, অলিভ পাতার
চকচকে সবুজ আদরচুম্বন আর বহু পুরাতনী
ভালোবাসার স্নেহ তিরতির ঢলঢলে মুখ কোনো
দ্যাখো, ভালো করে দ্যাখো, সাগর সেঁচা অমৃতের
থেকে কি কিছু কম মনে হয় এদের, বলো ?
এরাও তো তোমাকে মৃত সঞ্জীবনী নিরাময়
দিতে চেয়েছে রাতদিন, সেই কবে থেকে যেন…
শালুক নামের পুকুরটি
এই যে যাচ্ছি… হেঁটে যাচ্ছি…
এ ধুলোবালি শহরের মুমূর্ষু বুক চিরে
হেঁটে যাচ্ছি… দূর… বহুদূর…
সাদা খইয়ের মতো উড়ছে রোদজ্বলা ছোটো ছোটো দুঃখবিষাদ
রুখুসুখু বাতাসে ধুলোধোঁয়ার মেঘলা কালো ঘর, তেলকালি জীবনের
পাশে ঠাসাঠাসি, ঘেঁষাঘেঁষি কবেকার আলোআঁধারি মায়াবসত যেন…
গলানো পিচরাস্তা ছাড়িয়ে আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলে
বিষে বিষে বিবর্ণ হয়ে যাবে বেলাশেষের বৈতরণী;
বন্ধ চোখের পাতায় পবিত্র পারাপার আঁকবে তুলসীচন্দন
কী জানি কোন্ অজানা বেদনে টনটন করে উঠবে
শোকেতাপে পোড়া দেবদারু গাছের সান্ধ্য বুক…
আর এসবের মাঝে একবুক শুশ্রূষা নিয়ে
চোখের জল ফেলতে ফেলতে হেঁটে যাবে আমার
ছায়াভরা নরম শালুকপুকুরটি আমারই পিছু পিছু
কোন্ সে নিরাময় মৃত্তিকা মায়ায়, অনন্ত, অফুরন্ত যেন…
জাতিস্মর
এইসব ছুটে যাওয়া ঘরবাড়ি, গাছপালা
বড়ো চেনা মনে হয় সব… এই তো সরপড়া পানাবতী পুকুর
এঁটো বাসন মেজে নেয় ঘোমটা পরা বধূ মমতার খুদকুঁড়ো হাতে
চই-চই ছানাপোনার সংসার পিছু পিছু চলে গেছে তার
জলছাপ পথখানি ধরে দূর সে দিগন্তের দিকে…
এই তো পেনসিলে আঁকা ধানকাটা মাঠ টান টান
পড়ে আছে এখানে আঁতুড়ের স্যাঁতানো মায়ের মতো
হেমন্তের খড়কুটো ছুঁইয়ে গেছে তাকে, কোন্ সে গ্রামদেবী
পুরাতনী স্নেহমাখা ধানদুব্বো আশীর্বাদীর মতো
মনে হয়, এইখানে খেলে গেছি যেন কতদিন
মুড়ি-বাতাসায় নিয়েছি মেখে মাখন মাখন আলো
এ ধুলোভরা পথঘাট, এ টলটলে শিশিরের বুকে
কোথা যেন ফেলে গেছি আমি, কবেকার ঘাসফুল-ফড়িং জীবন…
চিরন্তন
আজকাল পাখিরা ভয় করে না আমায় মোটেও
ছাদে এসে দাঁড়ালে উড়তে থাকে মাথার চারপাশে দল বেঁধে
দুষ্টু মেঘছানাদের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে নরম চোখে ডাকে—
ঘু…র…র…ঘু, ঘু…র…র…ঘু, ঘু…র…র…ঘু…
আমি আনন্দী রোদের চাল, গম ছড়িয়ে দিই মাদুরে
ডানার ঝটপট শব্দে ভালোবাসা নিয়ে উড়ে আসে ওরা,
কবে থেকে যেন… কেউ মাথায়, কেউ কাঁধে, কাঁধ টপকে
হেঁটে হেঁটে নেমে আসে প্রসারিত হাতের চবুতরায় নির্ভয়ে
খুঁটে খুঁটে গ্রহণ করে নাম লেখা আদুরে শস্যদানা যত
পালক খসে পড়ে একটি, দুটি… নরম স্বপ্নের মতো
ছুঁয়ে ফেলে এ মেঘলা মুখ, বুক… অভিমানী…
আমি জানি, ওরা তোমার খোঁজ পেয়ে গেছে এ মনে ঠিক
ভালোবাসলে বুকের খাঁচাও বড়ো হয়ে যায় খুব—
একথা পাখিরাও কি জেনে গেছে তবে নিশ্চিত!
সূর্যমুখী আলোর কবি
(কবি সুব্রত রুদ্রকে স্মরণ করে)
একটা সহজ, গভীর পথ ধানখেতের বুক চিরে
চলে গেছে জোছনাধোওয়া দিগন্ত-চাঁদের দিকে, অনশ্বর
কোনো অকারণ যানজট নেই এখানে, কোনো অবাঞ্ছিত কোলাহল,
পেঁয়াজ খোসার মতো দৃশ্যদূষণ, কত জনমের যেন…
এখানে পুকুরের জল আধঘুমন্ত কবিতার মতো স্থির।
নদীর চরে বুড়োবুড়ি কাশের বৈঠক। ধপধপে ধুতি পাঞ্জাবি পরা
সকালের আকাশ। পুতুল পুতুল মেঘলা মানুষ। খড়কুটো মায়াবসত।
জলফড়িঙের চোখে চেয়ে আছে সব তার দিকে যেন কবে থেকে…
এই পথ দিয়েই হেঁটে আসবে সে; কাঁটাবাবলার বন
পেরিয়ে আমাদের প্রিয়তম গানগুলি নিয়ে; সহজ মমতায়
ঝুঁকে পড়ে তুলে নেবে কবেকার ফেলে যাওয়া বাঁশি,
পাখিদের হরবোলা আর অফুরন্ত কোনো ভালোবাসা, পৃথিবীর
জনমদুখী কার্তিক মাসের পড়ন্ত কোনো বিকেলে
আমাদের গাঢ়তম ছায়ার উঠোনে বসে একমনে
লিখে যাবে পাকুড়পাতার ওপর নতুন কোনো পদ্য, স্বগতোক্তির ঢঙে
স্নান সেরে, অন্ধকারের দ্বিধা ধুয়ে মুছে, একবার
পড়ে দ্যাখো, পড়ে দ্যাখো, ভালো করে সেসব
এতদিনের দেখাশোনার বাইরেও কোনো আশ্চর্য আলোর সত্য
সূর্যমুখী ফুলের মতো অনন্ত হয়ে ফুটে উঠতে পারে তোমার ঝাপসা চোখে…