পিলখানা ব্লাইন্ড স্কুল – শিবসাগর দেবনাথ
দু’বিন্দু ঘুমের মাঝে বসে আছে অবাধ শরীর। মাধ্যম―আমি তাকে চিনি, সাঁকোর অভিলাষে জেগে থাকে সেলাইমেশিনে। এরূপ বিন্যাসের একপারে আমি, তুলোবীজ। ওপারে ন্যস্ত আলো প্রতিভ শাড়ির। আমাকে যেতে হবে তাঁতকল দিয়ে। সেতুদেহে খুঁজে পাব তাহার স্থপতি?
টুকরো টুকরো কাচ
১
আমাদের পার্থিবতা জল ও হাওয়ার। তার পরে মন ও শরীর ফসলেরই দান। ধ্রুব এই শস্যখেত, পৃথিবীর রক্তপাত কত না দেখেছে! তবু চুপ করে থাকে। তার হয়ে হাল ধরে কলোনির জাইদুল মিঞা―অস্পষ্ট গলায় প্রতিটি ‘ধান’ উচ্চারণে তার মুখ আলো হয়ে যায়। সেইসব উলগুলানের পরে তবু বল খেলা আছে, আছে খেতান্তে হারিয়ে যাওয়া রোদ। অদূরেই পাতার স্তূপ, তিনমাস শীতকাল পড়ে আছে। কে যেন খোঁপা ভেবে আগুনের ফুল গেঁথে দেয়? তাকে ঘিরে ঘন হয় সাঁঝ, মানুষের হাত ও সর্বজনীন হিমের নিষেক। দুধেল ধান মুখে উড়ে যায় পাখি―যেহেতু যাওয়াই নিয়ম―ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী
মানুষেরা চিরকালই পাখিদের ওড়াউড়ি ভালোবেসে ক্রমশ বিজ্ঞানে, মহান আকাশে পাড়ি দিয়ে থাকে। একদিন তারও সীমা জেনে
জিভে জাগে রিপু, হিংসা আজও তীরের ফলায়
২
নিষ্ঠুরতা, তুমি মহামারী দিনে পরিযায়ী শ্রমিকের পেট। যেদিকে পা চলে যায়, সেদিকেই পথ। অনিশ্চয় ব্যতীত কিছু নেই ওই হাতে। বিকেলের মজে ওঠা রোদে মেঘেদের ট্রেন, আমাদের রুজি-রুটি উবে যায় আমাদের ফেলে। ভাবি ওই হাতে শেষ ঝুঁকি নেব। তা কি খুব বৃথা কাজ হবে?
৩
ভোরের বাতাস। মানুষের কথা শুরুর আগে একটি মোরগ আজান ধরেছে। অতঃপর অ্যালার্ম বেল ও কলঘরের শব্দে ঢেকে দেব তাকে। রোদ রোজের কুটুম, তড়িঘড়ি এসে বলে―“দেরি হয়ে গেল?” বছর দুইয়ের বিল্টুকে কথা শেখাতে বসি, ওর এলোমেলো ইশারা পেরিয়ে। সুর ন্যাংটো, আদিম, নিবিড়। জামা হাতে গীতিকার প্রতিশোধকামী, তাকে ঢেকে দিতে চায়। একদিন ঘুমঘোর, মানুষের কথা থেমে যাবে: চারিদিকে গাছ আর গাছ। আঙুরের জিজীবিষা শৃগালের তরে। সমবেত অশ্রুত রাগ তোলা হবে রাতের সরোদে…
৪
দুর্মূল্যতা গাঁথা থাকে পাথরে পাথরে। শিলমোহর, পুরাতন লিপি, তোমাদের ভালো লাগে ছবি―ছবিতে শিকার। ভিমবেটকার ত্বকে আঁজলানো জলের মতন আমিও দেখেছি অসি, তার রেণু ফেলে পিতা হয় জনৈক নিষাদ―ধরো রাত্রি মহোৎসব, বনদেবীর কৃপা হলে ভরে যাবে খেতের জরায়ু―বলি চাই, চাই পরাক্রমী পল। একদিন সেই আদেশের জোরে, উঠেছিল চাঁদ বর্শাফলকে। সময় শিরীষের পাতা, সবকিছু মুছে দিতে জানে। পারে না নিজেকে মোছাতে, গাছেদের মনে থাকা মৃগয়ার নথি
৫
যতদূর চোখ যায়, পৃথিবী দৃশ্যত রঙের কুবের। রৌদ্রাভ গাছ আরও জ্বলে ওঠে, বয়ঃসন্ধির গুণে। আকাশ গ্যাসের আগুনের মতো নীল, আশ্চর্য! তবু জীবনের সে প্রথম পাসপোর্ট ছবি, সাদাকালো ছিল। আশ্চর্য, তুমি ছিলে―সেদিনের স্টুডিওয়, আলো আর আওয়াজে। স্মৃতি রুগ্ন বালক―গঙ্গাজুলির খাটে কী ভীষণ সাদামাটা হলে, সমিধবরণ!
দোলের দুপুর। এক আবাত্তি মিছিল ঠোঙা ও গায়ে করে রং নিয়ে যায়। থমথমে মেঘ থেকে এইমাত্র বৃষ্টি গড়াল। দৌড় আপাতত বৃথা। কে কবে ভিজে যাওয়া রুখতে পেরেছে? যাবতীয় ধুয়ে নগ্ন হচ্ছে দিন, যেন পতনের আগে আদম আর ইভ। আরও আরও মেঘ এসে রেখে যায় নিজের ধূসর। মহাশূন্য, উহাকে কুড়াও! তুমি শিশুবৎ আলো। তোমাকে বিলোব কালো, স্লেটের আধান। চক-হাতে তাকে তুমি যা খুশি সাজাও
৬
মরে গেলে মাটিছাড়া হব, ঘর হবে আকাশের দেশে― সাকিন তারাদের দেখে একথা ভাবতে বসেছি। শস্য পাহারা দিই। সারারাত যে কীভাবে গড়াল, আমারই চোখের শিয়রে, জলের মতন। ভোরের অধর তুমি আধফোটা ফুলের কুসুম―একটা দু’টো পাখি, দখিনা বাতাস―জাগো! আমি ফিরি বাসার নিকটে
৭
একটি পাখির বুকে বিঁধে আছে ব্যাধের নিশানা। শিশুমন তাই দেখে বিচলিত হয়। বড়ো হয়ে জানে প্রকৃতির রীতিনীতি খাদ্য-খাদকে―যেকথা কৈশোরে বুদ্ধ জেনেছে।
নিজ লেজ ছুঁতে চেয়ে ধাবিত বেড়াল, ফিরে আসে নিজের কাছেই। আত্মা নরম পাখি, অবয়ব তাহার কোটর। বোশেখের ঝড়ে, দুইয়ের মিথুনে চৈতন্য জাগুক।
ঘাসমাঠ ডিঙিয়ে এসেছি নদীর জিহ্বায়। আমার বলার কিছু নেই। ছিল দিন, রাতের লাগোয়া দিন, বাঙ্কারে শুয়ে শুয়ে বৃষ্টি গুনেছি। আমার বলার কিছু নেই। স্রোত, তুমি কিছু বলো
সমস্ত আকাশ পড়ে আছে জলের বাথানে। বটরের বিষ্ঠা ছিল বলে জানা হল স্রোতের ভাঙন ক্ষমতা, কীরকম খুলে দেয় গোপনীয় জট। বহুদূর বিকেলবেলায় মৃদুমন্দ জেগে ওঠে চর। সে বিশ্বাসে তোমাতে সঁপেছি: তৃতীয়বিশ্ব দিন, অহরহ পথশিশু, মাতৃভাষাকে…
আরশি
কে যেন আঁকতে বসেছে। কৃপণ ওই হাতে শিশুর সারল্য প্রোথিত: সাঁওতাল পরগণা চিরে বেজে ওঠে স্রোতের বিধান, চণ্ডীমঙ্গল গ্রাম―ঝুমচাষ, পুড়ে যাবে অধরা শ্যামল, ক্ষুধাশীর্ণ ব্যাধের ঘরণী। এইসব ছবি দৃশ্যত গোপন, পিলখানা ব্লাইন্ডস্কুলের বই। আমাদের শিক্ষণীয় হোক দু’টাকার পিঠে গাঁথা ব্রেইলের লিপি
উৎসর্গ: মা, তোমাকে
কৃতজ্ঞতা: শাশ্বতী সরকার