পারুলীর উড্ডয়ন – আনোয়ারা সৈয়দ হক
আকাশ থেকে বৃষ্টির ফলা কোত্থেকে যে শরীরে এত শান দিয়ে এসে লাফিয়ে পড়ল পারুলীর টিনের চালে, আল্লা মাবুদ সে-ই জানে।
প্রসব যন্ত্রণায় কাটা মুরগির মতো দাপাতে দাপাতে পারুলী একবার চিৎকার করে বলল, ‘আল্লাহ’; কিছুক্ষণ পরে আবার বললো, ‘ইয়া রসুল’; তারপর চুপ।
এমন যে হবে তা কক্ষণো ধারণা করা যায়নি। সকাল থেকে সামান্য মেঘ মেঘ খেলা চলছিল বটে আকাশে, পরে সব ঠিকঠাক। সমুদ্রের নোনা বাতাস মাঝে মাঝে গায়ে লেগে বিজবিজ করছিল, তা এমন তো সব সময় হয়।
ভোরে উঠে শরফু আজ আকাশের দিকে বার কয়েক তাকিয়ে কী ভেবে ঘরে ঢুকে বলল, ‘তুই থাক, আমি আসতিছি।’
শুনে প্রাণ ধক করে উঠল পারুলীর। আবার কি সেই পুরোনো খেলা শুরু হল শরফু হারামীর?
‘কনে যাও?’ পারুলী শরীরের এই অবস্থায় যতদূর সম্ভব উদ্ধত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে চেষ্টা করল। পারুলী মনে মনে জানে এই ভঙ্গিটা এখনও পর্যন্ত শরফু ভয় পায়।
অতি বাধ্য পুরুষের মতো পারুলীর শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে স্বর নিচু করে শরফু বলল, ‘এই তো গঞ্জের থে’ আসতিছি। তোর জন্যে ওষুধ আনতি যাই। বিনু কোবরেজ আজ যাতি বলেছে।’
পারুলী বহুদিন আগেই বিশ্বাস হারিয়েছে শরফুর ওপর, তবু হাজার হোক সে নিজে মানুষ তো, মেয়েমানুষ তো বটে, কেন জানি স্বামীর এই কথাটা বিশ্বাস করতে মন চায় তার। সাবধান হয়ে সে বলে, ‘যাতিছো যাও, মনে রাখবা আমার কিন্তু এখুন তখুন অবস্থা। পেট লেবে এয়েছে নিচে, দেরি করবা না।’
এ কথার উত্তর শরফু তড়িঘড়ি করে ‘না না রে পারু, যাব আর আসব’ বলে সাত সকালেই গঞ্জের দিকে হাওয়া।
আর আল্লার কি খেয়াল, শরফু বাড়ি ছাড়ল, তক্ষুণি চিনচিন করে উঠল তলপেট, যেন আবার মাসিক শুরু হবে এমনি একটা ভাব।
ভীষণ ভয় হল পারুলীর। এই নির্জন ভিটার ওপরে টিনের একচালায় একাকী সে শরফুকে নিয়ে বাস করে। এতদিন শরফুর এক বোন সঙ্গে থাকত, ইদানীং বিয়ে হয়ে ভিন গাঁয়ে তার বাস। পৃথিবীতে পারুলীর এমন কেউ নেই যে তার এই দুরবস্থায় সামনে এসে দাঁড়ায়। ব্যথা ওঠার মুহূর্তের মধ্যে পারুলীর চোখের সামনে দুনিয়াটা দুলে উঠল। অচেনা হয়ে এল চেনা সব কিছু। ‘নানি গো নানি’ বলে এক হাঁক ছেড়ে পারুলী বাড়ির পশ্চিম দিকে হাঁটা ধরল। ঐ দিকে পঞ্চি দাইয়ের হোগলার ছাউনি দেয়া একচালার আস্তানা। একশো বছর বয়স হবে পঞ্চির। এ গাঁয়ে এমন কোন জোয়ান বা বুড়ো নেই যাকে পঞ্চি তার মায়ের পেট থেকে টেনে বের করেনি। বাইরে থেকে আসা মানুষগুলোর কথা অবশ্য আলাদা।
নিঃসঙ্গ পঞ্চি দাই কি মনে করে এগিয়ে আসছিল পারুলীদের বাড়ির দিকেই; পারুলীকে খোলা চুলে হুতাশে দৌড়াতে দেখে ভীষণ রেগে খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠল, ‘অরে বজ্জাত বেটি, ভরপুরো পেট নিয়ে জঙ্গলে ঘুরিস, বদনজর লাগলি পরে খালাস করবেনে কিডা?’
‘নানা গো, ব্যথা’, বলে পারুলী একেবারে হামলে পড়ল বুড়ির সামনে।
পারুলীর বাক্য উচ্চারণে মুহূর্তে পঞ্চি মরা মুখের চামড়ার খাঁজে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। বাচ্চা খালাসের কথা ভাবলে কেন যে এখনো এত উৎসাহ লাগে বুড়ির। যেন এ গাঁয়ে নতুন প্রাণের স্পন্দন আনতে হাজার বছরের জন্যে সে ইজারা নিয়েছে গ্রাম। পঞ্চি বুড়ির খালাস করা শিশুগুলো অর্ধেক মেয়ে বলা যায়। আর মেয়ে শিশু জন্মালে পঞ্চি দাই মহা খুশি। কারণ এগুলো বেঁচে থাকলে বড় হয়ে আবার তার হাতেই খালাস হবে। বাচ্চা হবার সময়ে এ গাঁয়ের মেয়েরা যেখানেই থাকুক না কেন গাঁয়ে ফিরে আসবেই। পঞ্চির ওপরে তাদের বড় ভরসা।
আগুনে পানি পড়ার মতো পঞ্চি দাই স্বর নরম করে পারুলীর হাত ধরে বলল, ‘ঘরে চল লাতিন, পরীক্ষা করে দেখি।’
বাড়ি ফিরে ছেঁড়া মাদুরে চিৎ হয়ে শোয় পারুলী। বড়ো ভয়ে ভয়ে শোয়। কি জানি কি বলে পঞ্চি দাই। পঞ্চি দাইয়ের হাতের আঙুলগুলো এই বয়সেও কত নরম, যেন ননী জড়ানো আঙুলে। তবু কত যে ব্যথা লাগে পারুলীর। সে কাঁদে। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সত্যিকার ব্যথায়। ভেতরে পরীক্ষা করে দেখে গম্ভীর হয়ে গেল পঞ্চি দাই, যেন অসন্তুষ্ট। গুইসাপের মতো চামড়ার ভাঁজে লুকোনা ঘোলাটে চোখ দুটো পারুলীর মুখের ওপরে ফেলে সে বলল, ‘মুখের জোড় খোলেনি লাতিন, দেরি আছে।’
‘কত দেরি নানি?’ পারুলী নিঃশ্বাস ফেলে বলে।
‘অ-নে-ক। এ ব্যথা থাকবে না গো, এ ভুয়ো ব্যথা।’
শুনে পারুলীর মনে হল খুশিতে সে লাফ দিয়ে বসে। কিন্তু এই অবস্থায় সেটা কোনক্রমে সম্ভব না বলে চুপ করে রইল। পঞ্চি দাই লাঠি ভর দিয়ে দাওয়া থেকে নেমে উঠোনে কাত করে রাখা কোলার পানিতে হাত ধুয়ে বসতে না বসতে, ওমা, সত্যি সরে গেল ব্যথা।
যেন বেঁচে গেল পারুলী। সে এক গাল হেসে বলে উঠল, ‘শরফু গঞ্জের থে ওষুধ আনতি গেছে নানি, ও ফিরলি পরে ব্যথা আবার হবেনে।’
‘প্রসব ব্যথা তুমার হাতে ধরা নাকি, লাতিন?’ বলে পঞ্চি দাইও হাসল। পঞ্চি দাই কখনো হাসলে পারুলীর মনে হয় যেন পাথরের চাঙড় কেউ ভেতর থেকে ভেঙে ঝুর ঝুর করে বাইরে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গালে একটাও দাঁত নেই পঞ্চির। দাঁত যে কোনদিন ছিল সে নিশানাও নেই মুখের ভেতরে, তবু পঞ্চি দাই-এর হাসিটা স্বর্গীয় দেখায় পারুলীর কাছে। সে মাওরা মেয়ের মতো করুণ স্বরে বলে, ‘নানি, ডর করে আমার, তুমি আমারে ছেইরে যাবা না এ সুময়।’
পঞ্চি দাই এ কথা শোনার পর মাথা নেড়ে ‘আচ্চা’ বলে উঠে দাঁড়ায়। লাঠিতে ভর দিয়ে, কি ভেবে, পারুলীর দিকে ফিরে বলে, ‘ক বচ্ছর পর আবার তুমার গর্ভ হল, লাতিন?’
পারুলী আঁচল মুখে দিয়ে বলল, ‘তিন বচ্ছর পর, তাও অনেক চিষ্টা করার পরে নানি। কানা ফকির থে তিনডে তাবিজ লেবার পর। পরথমডা তো…’
‘জানিরে লাতিন’, বলে হাত উঠিয়ে পারুলীকে থামিয়ে বিষণ্ণ মাথা নাড়ল পঞ্চি দাই।
প্রথম বাচ্চাটা মৃত প্রসব করেছিল পারুলী, সেই তিন বছর আগে। বাচ্চা প্রসবের দু’দিন আগে শরফু লাথি মেরেছিল পেটে। এক পেট তাড়ি খেয়ে গঞ্জের হাট থেকে সে ফিরেছিল সেদিন। সঙ্গে ছিল ঝিমকালো লুচ্চাটা, যার নাম ধলু মেন্ধী। বাড়ি ফিরেই শরফুর হুকুম হল, ‘ভাত খাতি দে, পারু।’
‘রান্না হইনি আজ।’
‘ক্যান, রান্না হইনি ক্যান?’
‘ক্ষুদকুঁড়োও নেই ঘরে। সেই বিহানে তুমি বলে গিইলে চাল আনতি যাতিছো, আসিলে এখুন।’
এই কথা শুনে ক্ষেপে আগুন হয়েছিল শরফু হারামী। আর মিটমিট করে হাসছিল লুচ্চা মেন্ধী। আল্লার কসম, পারুলী জানে, কোনদিন সুযোগ পেলে লুচ্চা মেন্ধী যদি পারুলীর বুকে হাত না রেখেছে তো সে কান কেটে ফেলবে। কিন্তু মূর্খ শরফু তা বুঝলে তো! ভাত রান্না হয়নি শুনে শরফু চিৎকার করে বলেছিল, ‘মেঘনা মাগী, তোরে আমি খুন করব আজ। আমি সেদিন পাঁচ কিলো চাল আনিছি ঘরে, কয়দিন ভাত দিছিস আমারে? সব তোর নাদা পেটে ভারিছিস?’
এই একটা দোষ পারুলীর। অযথা দোষারোপ সে সহ্য করতে পারে না। যেভাবে হোক তার প্রতিবাদ করা চাই। তবু অতটা হয়তো রাগত না সে, কিন্তু লুচ্চা মেন্দীর মিটি মিটি হাসি হঠাৎ মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তার। এমনিতে পারুলী মনে মনে শরফুকে গালি দিলেই যথেষ্ট। ভাত দেবার ভাতার না, কিল মারার গোঁসাই। তাছাড়া দিনরাত মদতাড়ি খেয়ে খেয়ে এই বয়সেই চেহারায় বুড়োটে ভাব নিয়ে এসেছে শরফু। আর মুখ খারাপ কি! নেশা করলে মুখের কোন আগল থাকে না শরফুর। হয়তো পারুলীর বাপের বাড়ির অবস্থা ভালো হলে সে শরফুর ঘরও করত না। কিন্তু বাপ-মা মরা পারুলীর, ভাইয়ের সংসারে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে মানুষ হওয়া পারুলীর এর চেয়ে ভালো বর কি জুটত কোনদিন? তবু রাগ বলে কথা। পারুলীর স্নায়ুর ভেতরে রাগের একটা অবদিমত স্রোত সর্বক্ষণ খেলা করত তখন। সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিল, ‘পাঁচ কিলো চাল আনিলে কবে? কোন্ ভাদ্দর মাসে? আজ আশ্বিনের কদ্দিন? আমি নাদাপেটি? হাঃ, পেট ভরে ভাত দিইলে কোনদিন যে নাদাপেটি হব?’
ব্যস্, দুম করে এরপর লাথি পড়ল পারুলীর ভরাগর্ভ পেটে। নাড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল বাচ্চাটার। দুদিন বাদে পেট থেকে বেরোল মৃত সন্তান। পারুলীর মনই অবশ্য বলছিল এরকম হবে। তবু আশায় বুক বেঁধেছিল। পঞ্চি দাই আশ্বাস দিয়েছিল অনেক। মেয়েরা এরকম দু চারটে লাথি গর্ভবর্তী অবস্থায় খেয়েই থাকে, ক’জনের বাচ্চা মারা যায়? মেয়ে মানসির জান, বিলাইয়ের জানরে লাতিন, বাচ্চার কিচ্ছু হবে নান’, বলেছিল পঞ্চি দাই। কিন্তু প্রসব হল মৃত সন্তান। কি ফর্সা হয়েছিল গো ছেলেটা। একটু নীল হয়ে গিয়েছিল সত্যি, যেন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে, তবু কী যে সুন্দর চেহারা! ঠোঁট দুটো লাল টুকটুকে ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল, কিন্তু অনেকক্ষণ পেটের ভেতরে স্তব্ধ হয়ে থাকার জন্যে কেমন ফোলা ফোলা হয়ে উঠেছিল। হাত-পাগুলো কেমন লম্বা লম্বা সলসলা। পঞ্চি দাই খালাসের পরে আফসোসে মাথা কাঁপিয়ে বলেছিল, ‘আহারে লাতিন, কপাল খারাপ তোর, পুত্র সন্তান গো, বাপের লাথির ধাক্কা সামলাতি পারিনি, কন্যে হলে বেঁইচে যেত।’
তাই হয়তো হবে। পৃথিবীতে মেয়েদের হয়তো অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি করে পাঠায় আল্লাহ। যেন পুরুষের শত অত্যাচারেও তারা মরে না।
মৃত সন্তানটি প্রসবের পর বহুদিন থম মেরে ছিল পারুলী। শরফুর মুখের দিকে তাকাতই না। এলোচুলে, শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে আপন মনে হেঁটে বেড়াত সে এ বাড়ি ও বাড়ি, এ পাড়া ও পাড়া। সকলে তখন বলত, পারুলীকে পেঁচোয় ভয় পেত সকলে। পাড়ার বউ-ঝিরা তার চোখে চোখ পড়তে তুরতুর করে ভয়ে দৌড় মারত এদিকে সেদিকে।
কিন্তু পারুলীর হিসেবে সে বড় সুখের ছিল দিনগুলো। যেন কোন চিন্তা-ভাবনা নেই, দায়-দায়িত্ব নেই। আপন মনে গুনগুন করে গান গাইতে কতদূর যে চলে যেত পারুলী তার হিসেব নেই। সেই কত দূরে ভেড়িবাঁধ তৈরি হচ্ছে, ততদূর চলে যেত সে। বসে বসে মেয়ে শ্রমিকদের কাজকর্ম দেখত। ইচ্ছে হত ওদের মতো সেও ইট ভাঙতে বসে যায়। হয়তো একদিন যাবে সে, সত্যিই যাবে। শরফু হারামীর ঘর করার চেয়ে ভেড়িবাঁধের জন্যে ইট ভাঙতে বসাও বড় আনন্দের কাজ বলে মনে হত তার। নিজের ভাত খাবার চালের পয়সা সে নিজেই যোগাড় করবে তখন, চাই কি শরফুর ভাতের যোগাড়ও সেই করে দেবে। তখন আর ঝটপট পা ওঠাতে সাহস করবে না হারামী শরফু। আর সাহস করলে উল্টে পা ওঠাবে পারুলীও। বেশ হবে তখন। ভেবে বড়ো ভালো লাগত পারুলীর।
কিন্তু যা হয়, ঐ ভাবনা পর্যন্তই শেষ। শরীরে এক ফোঁটা শক্তি ছিল না তখন। চুপচাপ বসে বসে সে মেয়ে শ্রমিকদের কাজ দেখত আর ভাবত। দুপুরবেলা মেয়ে শ্রমিকগুলো ঠান্ডা পানির ভেতরে আটা গুলিয়ে যখন দুপুরের আহার করত, পারুলীকেও তার ভাগ দিত তারা। পারুলী কোনরকম লজ্জা না দেখিয়ে তা খেত, তখন শরফু এসে ধরে নিয়ে যেত তাকে। আঁচল ঠিকঠাক করে, শাড়ি গুছিয়ে গাছিয়ে ফিরিয়ে আনত বাড়িতে। খুব তখন দুঃখিত ছিল শরফু ক’দিন। তারপর খবর পেয়ে লুচ্চা মেন্দী এল একদিন বাড়িতে, মুখ কালো করে বসে রইল হাতনেয়, যেন বাচ্চাটা সে-ই পেটে ধরেছিল, তার সাথে চলে গেল শরফু। ফিরল তিনদিন পর। আপাদমস্তক তাড়ি খেয়ে, জুয়া খেলে, মুখে খিস্তি তুলে বাড়ি ফিরল সে।
অতীতের ভেতরে যেন মগ্ন হয়ে পড়েছিল পারুলী। ‘যাই গো লাতিন’ পঞ্চি দাই-এর কথায় হুঁশ ফিরল তার। দেখল পঞ্চি দাই লাঠি ভর দিয়ে আপন মনে হাঁটছে। যেন বাড়ি ফেরার আগে পা দুটো চালু করে নিচ্ছে। পারুলীর অন্যমনস্কতা ভাঙতে মুখ ফিরিয়ে পারুলীর দিকে তাকিয়ে সে বললো, ‘শরফু গঞ্জের থে ফিরে আলি পরে আমারে নিয়ে আসতি বলবা। নাহয় রাতটা এখেনেই থেকে যাবোনানে আজ।’
পঞ্চি দাই চলে গেলে মনটা খালি হয়ে গেল পারুলীর। তার বাড়ির চারপাশে শুধু সবুজ আর ধূসর মেশানো জঙ্গল। একদিকে বাঁশবাগান, কলাবাগান, ছাতিম গাছ; অন্যদিকে আল্লা মাবুদ জানে কত বছরের পুরোনো আশশ্যাওড়া ও কনকানটের ঝোপ। এর কোনটাই পারুলীদের নয়। পারুলীর শ্বশুর একখানি জমি রেখে মারা যাবার পর সেটাও বেচে খেয়েছে শরফু। অবশ্য বেচার সময় কড়কড়ে টাকাগুলো হাতে পেয়ে বলেছিল গঞ্জে দোকান দেবে, তা আর হয়নি। মেন্ধী লুচ্চা যতদিন শরফুর সঙ্গ না ছাড়বে, শরফুর কিচ্ছু হবে না জীবনে, পারুলী জানে। এক এক জন মানুষের জীবনে কালনেমি বলে বন্ধু জোটে এক একটা। ধ্বংস করে সব কিছু। শরফু হারামীর জীবনে মেন্ধী লুচ্চা সেইরকমএক কালনেমি।
তবু পারুলীর কত যে পথ শরফু হারামীর বাচ্চা ধরে পেটে। হাজার হোক, স্বামী তো বটে। আর স্বামী যেই হোক, বাচ্চা দরকার পারুলীর। শরফু যদি আজ গঞ্জে গিয়ে মুখে রক্ত উঠে মরে যায়, বাচ্চা কি হবে না পারুলীর? হ্যাঁ, হবে। শরফু বেঁচে না থাকলেও বাচ্চা হবে। শরফুর বাচ্চা যদি পেটে না ধরত, অন্য কারো বাচ্চা পেটে ধরত পারুলী। ধরতই। কারণ পারুলী মা হতে চায়। জননী হবার জন্যে ভেতর থেকে বড়ো তাড়া আছে পারুলীর। যদি না সে তিন বছর আগে মৃত সন্তানের মুখ চোখে দেখত, তাহলে হয়তো বাচ্চার জন্যে এত টান ধরত না মনে। একবার মৃত সন্তানের ভুবনভোলা তুলতুলে মুখ চোখের সামনে দেখে আর তো তাকে ভুলতে পারেনি পারুলী।
আহা, এ যেন সাপের মাথার মণি দর্শন গো। মানুষ আলাভোলা হয়ে যায়, দিবারাত্রি এক হয়ে ওঠে, চৈতন্যের চোরা কুঠুরির সুড়ঙ্গ বেয়ে তরতর করে নামে নোনা পানির স্রোত, যাকে অশ্রু বলা যায়। কত যে মনে মনে কেঁদেছে পারুলী তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানটির জন্যে। তাইতো আবার বাচ্চা দরকার পারুলীর। বাচ্চা চাই। তার বুকের সুডৌল স্তন দুটো ফুলে উঠেছে অস্বাভাবিকভাবে, শিগ্গিরি সাদা দুধে ভরে যাবে এ কুম্ভ। চুক চুক শব্দ করে চোরাচোখে মায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে এই শুভ্র তরল অমৃত পান করবে তার সন্তান, নাড়িছেঁড়া ধন তার। গতবার মৃত বাচ্চা প্রসবের পর স্তন টিপে টিপে সেই তরল অমৃত মাটিতে ফেলেছে পারুলী। কোন কোনদিন আপন মনে বুক বেয়ে দুধ পড়েছে কোলে, তখন যেন মৃত সন্তানের কান্নাও ভেসে আসত পারুলীর কানে, আহারে, বাজান আমার, আমারে ফেলায়ে কনে গেলিরে তুই, পারুলী মনে মনে বলত। বাইরে থম মেরে থাকা পারুলীর বুকের ভেতরে তখন অবিশ্রাম বিলাপ, কে তার খোঁজ রেখেছে? তাই বাচ্চা চাই পারুলীর। ছোট্ট একটা বাচ্চা। শরফু হারামীর বংশরক্ষার জন্যে না, তার নিজের বুকের জমে থাকা দুধ খাবার জন্যে বাচ্চা চায় সে একটা। শরফু হারামীর বংশ নিপাত যাক, পারুলীর বাচ্চা কোল আলো করে বেঁচে থাকুক। তার নিজের অস্তিত্বের বহমানতা অনুভব করার জন্যেই বাচ্চা দরকার পারুলীর।
এদিকে অন্ধকার হয়ে এল বটে চারদিক, আজন্ম বিশ্বাসঘাতক শরফু নামক স্বামীটির দেখাও নেই। সেই কোন্ সকালে গঞ্জে গেছে পারুলীর জন্যে ওষুধ আনতে। ব্যথায় খিচে উঠছে এখন পারুলীর শরীর, অথচ সে একা। আর কোত্থেকে যে ঝাঁপিয়ে নেমেছে বৃষ্টি, শান দেয়া বৃষ্টির ফলা লাফিয়ে নামছে ফুটো টিনের চালে, পাগলের মতো তাথৈ তাথৈ করে শব্দ করছে, ফেটে পড়ছে অট্টহাসিতে, ঝম ঝম, গম গম, সোঁ সোঁ করছে চারদিকে। অনেক কষ্টে কুপি জ্বালিয়েছিল একটা পারুলী, কখন তা নিভে গেছে। পারুলী এখন এই অন্ধকারে নিশ্বাসও যেন টানতে পারছে না ভালো করে। নানি, নানি বলে ডেকে কতবার যে চেঁচিয়ে গলা ভেঙেছে সে। আল্লাগো, রসুলগো বলে চেঁচিয়েছে। তার সব ডাক প্রকৃতির এই তান্ডবলীলার ভেতরে কোথায় হারিয়ে গেল পারুলী বলতেও পারবে না।
এখন রাত কত, তাও পারুলী জানে না। একবার যেন তার মনে হল একশো বছরের বুড়ি পঞ্চি দাই ঘরে ঢুকল লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে। কিন্তু এ পঞ্চি দাইকে তো সে চেনেও না। সাড়ে চার ফুটের ওপরে নয় পঞ্চি দাইয়ের শরীর, কিন্তু এ পঞ্চি দাই যেন ছ’ফুট বেশি লম্বা, এর মুখের চামড়া টান টান, গালের ভেতরে এক রাশি সাদা ঝকঝকে দাঁত, অন্ধকারে ছুরির ফলার মতো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। এর হাতেও লাঠি আছে একটা, তবে সেটা লাঠি না বলে লগা বলাই উচিত।
যেন অনেকক্ষণ ধরে, বলা যায় অনাদিকাল, একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলো পারুলীর। সে দু হাতে ভর দিয়ে উঠে বসল মেঝেয়। পিপাসায় গলার ভেতরটা শুকিয়ে খড়কাঠি হয়ে আছে। ‘মাগো’ বলে উঠল পারুলী, কিন্তু যে মাকে জ্ঞান হওয়া অবধি চোখে দেখেনি, তার নাম মনে করে সান্ত্বনা এল না মনে। এদিকে ঐ তো তার দু পায়ের ফাঁকে পড়ে আছে মাংসপিন্ড একটা। ঘরের ভেতরে বৃষ্টির পানির যে বান ডেকেছে, সেই বানে যেন ফুলসমেত ভেসে যাবে সেটা। কড়কড়াৎ করে বাজ পড়ল কোথাও। বিদ্যুতের আলোয় জিনিসটা দেখল পারুলী, তারপর অন্ধকারে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। কোত্থেকে যে শরীরে এত কাঁপন এল তার, থর থর করতে করতে দাঁতে দাঁতে নেড়েচেড়ে দেখল সে অনেকক্ষণ। একেবারে স্পন্দনহীন, স্তব্ধ। মেয়ে, এবার মেয়ে। আহারে মেয়ে। আহারে, পারুলীর মেয়ে।
চোখ দিয়ে যেন নুহ নবীর বান ডেকেছে। তপ্ত পানির বান। পুড়ে যাচ্ছে পারুলীর চোখ। তার আত্মবিশ্বাসী অভিমানী মনে কে যেন কষে এক লাথি বসিয়েছে। অপয়া সে, অপয়া। জননী হবার অযোগ্য। হায়রে, পারুলী জননী হবার অযোগ্য।
পা ঘষে দেশলাই খুঁজে কুপি জ্বলায় পারুলী। ফুলটা এখনো লেপ্টে আছে সদ্য ভূমিষ্ট শিশুটির শরীরে। ফুল কাটবে কি দিয়ে পারুলী, তার হাতের কাছে তো কিছু নেই। ‘মণি, মণিরে’ বলে শুকনো গলায় পারুলী বার কয়েক বাচ্চাটিকে ডাকল, তারপর যেন অসীম মমতাভরে ফুলসুদ্ধই কোলে তুলে নিল তাকে। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে গেল, আর সাথে সাথে ঘুরে গেল মাথা। তখন ভীষণ শব্দ করে বাজ পড়ল আবার।
সবদিক কত যে সুনসান এখন। অমল ধবল জোছনায় ভরে যাচ্ছে উঠোন, বাঁশঝাড়, কলাবাগান। সুঁই খুঁটে তোলা যাবে মাটি থেকে এমন অবস্থা। বাচ্চাটা কোলে করে ঘর ছেড়ে দাওয়ায় এল পারুলী। দাওয়া থেকে উঠোনে। প্রচন্ড ক্ষুধার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে তার পেট। আশ্চর্য, মৃতসন্তান কোলে নিয়েও ক্ষিদে পায় মায়ের।
একহাতে কলাপাতা ছিঁড়ে পারুলী উঠোনের মাঝখানে পাতল। তার ওপরে রাখল সে শিশুটি, যেন বৃষ্টিস্নাত শীতল জড়পিন্ড একটা। তবু একটা পারুলী নামে এক আত্মভিমানী নারীর সন্তান। হোক মৃত, তবু। আর কেউ এর দাবিদার নয়, এমন কি শরফুও।
বাতাসে ঠান্ডা পরিস্কার ভাব। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। উঠোনে মৃত সন্তান। সবকিছু কেমন গোছানো ছিমছাম। বুক টান করে শ্বাস নিল পারুলী। মুখ উঁচু করে আকাশ দেখল। চরাচর ব্যাপী যেন মাতৃদুগ্ধের বন্যা ঢেলে দিয়েছে চাঁদ এই নিশুতি মধ্যরাতের আসরে। থরথর করে উঠল পারুলীর শরীর। দুঃখের ভেতরে, রক্তের ভেতরে, অস্তিত্বের ভেতরে যে পুঞ্জিভূত বেদনা, যে ক্ষোভ ও বঞ্চনা তা যেন পালকের মতো হালকা করে দিল তার শরীর। পারুলী-ই, পারুলী-রে, বলে কে যেন দূর থেকে ডাকতে লাগল তাকে। উই, হুঁই হুঁই, হুঁই রে, বলে ডাক ছেড়ে পারুলী বাতাসে ছড়িয়ে দিল দুটো হাত। পারুলী এখন উলঙ্গ ও নিঃসঙ্গ, সেই সাথে কি স্বচ্ছন্দ নির্ভার তার অবয়ব ও মন, যেন পাখির পালকে আচ্ছন্ন হয়েছে সর্বাঙ্গ, হালকা হয়েছে, এত হালকা যে ইচ্ছে করলেই সে এখন উড়তে পারে। এই, হুস হুস হুস। হুস হুস হুস, হুঁই। হুঁই-ই-ই-ই। মুক্তির আনন্দে পারুলী বিস্তারিত দুটো হাতে মৃত সন্তানের চারপাশে ঘুরপাক খায়।
ঘুরতে ঘুরতে ছেলেবেলোর স্মৃতি মনে আসে। সেই বাজপাখিটা। তালগাছের নীচে আহত হয়ে পড়ে থাকা পাখিটা সেদিন তার চারপাশে জড়ো হওয়া ধূর্ত, নিষ্ঠুর, মজা দেখা, ষন্ডা কতকগুলো মানুষের ভয়ে এভাবেই আহত ডানা মেলে প্রচণ্ড শক্তিতে উড়ে যেতে চেয়েছিল আকাশে, তার নিরাপদ আশ্রয়ে। পেটের কাছে লুকিয়ে রেখেছিল সে ছোট্ট একটি শাবক, যা ছিল তার নিজেরই। দু’পায়ে আঁকড়ে ধরে শাবকটিকে গুটিয়ে নিয়েছিল সে ভেতরে। মজা দেখা মানুষগুলো ঢিল মেরে তার নিহত হবার প্রক্রিয়ায় ব্যাপৃত থাকলেও সে তার ডানা নিয়েই উড়ে যাবার অলৌকিক প্রার্থনায় কেমন ধূসর চোখে একাগ্র হয়ে তাকিয়ে ছিল, না মানুষের দিকে নয়, আকাশেরও দিকে। অথর্ব ডানায় বাতাস কেটে কীভাবে সে শব্দ করার চেষ্টা করছিল, হুস, হুস, হুস।
পারুলীও কি ঐ পাখিটার মতন এখন? হুস হুস হুস, হুঁই-ই-ই। আর আশ্চর্য কি দেখ, পারুলীর হাত দুটো কেমন শক্তপোক্ত ডানায় রূপান্তরিত হচ্ছে। কত দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। এই তো পারুলী উড়তে পারছে এখন, একটু একটু উড়তে পারছে। এবার সম্পূর্ণ উড়তে পারছে। ইস্ একেবারে পাখির মতো গো। ঐ, ঐ, ঐতো দেখা যায় কলাবাগানের প্রান্ত, পঞ্চি দাইয়ের হোগলার ছাউনি দেয়া একচালাটা, ঐ তো ওখানে নসিমনদের গরুর খাটাল, কলু শেখের পাট পচানো ডোবা, উই যে দূরে রহিম মোল্লার ধানক্ষেত, আরব আলির মাইল ভুট্টা চাষের সীমানা, ডিপ্ টিউবওয়েল-এর বাঁধানো ঘর, ভেড়িবাঁধ, যৌবন উপচে পড়া নদী। হুঁই, হুঁই, হুঁই। আরো উপরে উঠেছে এবার পারুলী। ঐ দূরে দেখা যায় গঞ্জ। ঐ যে নসু ব্যাপারীর চামড়ার গুদাম, রহমত মাঝির গুড়ের আড়ত, চেয়ারম্যানের গোলা বাড়ি, বেলচাপিয়ার মাঠ, মাঠের ধারে পাঠশালা। হুঁই, কত উপরে উঠেছে এখন পারুলী। সবকিছু কত ছোটো হয়ে আসছে। পারুলী বোঝে শুধু তার সন্তান। হতাশায় জারিত তার অস্তিত্বের আধার। পারুলী দুনিয়া ভুলে তার সন্তানের চারপাশে উড়ে উড়ে চলে, যেন আবহমানকাল এভাবেই সে উড়বে।