কৃষ্ণচন্দ্র দে, সঙ্গীত মহীরুহ – সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় (২য় অংশ)
একইভাবে তিরিশের দশকে কীর্তন গানে তিনি ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন ও আপামর বাংলাকে ভাসিয়ে নিয়ে যান সে প্লাবনে। বিখ্যাত কীর্তনিয়া রাধারমণ বাবুর কাছে তিনি কীর্তন গানের তালিম নেন এবং খোলে সঙ্গত করতেন নবদ্বীপ ব্রজবাসী। তাঁর এই গানের ধারা এত জনপ্রিয় হয়েছিল, যে পরের দিকে আকাশবাণীতে মাসে একদিন করে একটানা ১১ মাস ধরে তিনি “নিমাই সন্ন্যাস” পদাবলী গাইতেন একটি নির্দিষ্ট সময়ে। কীর্তনের এই ভক্তিভাবে তিনি নিজেই এত বিভোর হয়ে যেতেন যে বাড়ি ফিরেও সে ঘোর কাটত না।
কৃষ্ণচন্দ্রের গাওয়া কীর্তনাঙ্গের একটি বিশেষ গানের কথা উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সেটি হল “ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধু”। এই গানটির শেষ লাইনে বলা আছে, ‘সিন্দুরের দাগ আছে সর্ব গায়, মোরা হলে মরি লাজে সখী মোরা হলে মরি লাজে’। তা এই কথা কয়টি বলার সময় তিনি গলায় এমন একটি রসসিক্ত অথচ অনুযোগের ভাব আনতেন যা মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে ছবির মত ফুটে উঠত। শ্রোতা যেন নিজেকে শ্রীমতীর স্থানে বসিয়ে ভাবত এমন হলে বুঝি তিনিও সেই একইভাবে কথা কয়টি বলতেন! এই গানটি কৃষ্ণচন্দ্রের একটি অক্ষয় কীর্তি। এই গানটির প্রসঙ্গে একটি গল্প আছে, সেটি বলছি। নিউ থিয়েটার্সে রাইকমল ছবিটি পরিচালনা করেন সুবোধ মিত্র, যিনি ‘কচি বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। তা কচি বাবু মনস্থ করলেন যে “ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধু” এই গানটি ব্যবহার করবেন রাইকমল ছবিতে নতুন সুরে এবং গাইবেন পঙ্কজ বাবু। প্রস্তাবটি পাড়তেই পঙ্কজ বাবু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ওই অনুরোধটি আমায় করবেন না। ওই গানে কেষ্টদা যে ছাপটা জনমানসে ফেলে গেছেন সেখানে আমি গিয়ে নিজের ক্ষতি করতে পারবো না’।কীর্তনগানকে ঘিরে আত্মভোলা নিরহংকারী কৃষ্ণচন্দ্র দে’র একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। তখন কীর্তনশিল্পী হিসাবে তাঁর বাংলা জোড়া নাম। একদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়েছেন, দূর থেকে শুনলেন কে একজন কীর্তন গাইছেন। ভারি অপূর্ব সে গান, আর দরদ। সন্ধান করে জানলেন তাঁর নাম বংশীধারী চট্টোপাধ্যায়। বাড়িতে তাঁকে ডেকে পাঠালেন। বংশীবাবু বাড়িতে এলে তিনি অতি বিনয়ের সাথে তাঁকে অনুরোধ করলেন যে ‘‘আহা কী অপূর্ব আপনার গলা! আপনি আমায় গান শেখাবেন?’’ কুণ্ঠিত বংশীবাবুর তখন হে ধরনী দ্বিধা হও অবস্থা! আপনি কৃষ্ণচন্দ্র দে, কীর্তনের সম্রাট, আপনাকে শেখাব আমি? এ কি বলছেন? দে মশাই কিন্তু ক্ষান্ত দেবার পাত্র নন, তাঁর কাছে গান শিখবেনই! তাঁর জোরাজুরিতে বংশীধারী শেষ পর্যন্ত গান শেখান কৃষ্ণচন্দ্রকে। সঙ্গীতের ছোটবড় কোনওদিন তাঁর কাছে বিচার্য হয়নি, এমনই উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। যে কীর্তনগান গেয়ে তিনি বছরে লক্ষ টাকার ওপর মুনাফা এনে দিয়েছেন, সেই রেকর্ড কোম্পানিই কিন্তু তাঁকে একটা সময় এত অপমান করেছে যা কহতব্য নয়! পাওনা টাকা তো দেয়ইনি, উল্টে বলেছিল, গাইতে হলে গানের মত গান গাইবেন, কেত্তন-টেত্তন এখানে আর চলবে না। আপনি কি পারবেন হিন্দি গানের বাংলা গাইতে? না পারলে আপনাকে আর রেকর্ড করতে হবে না! অপমানিত, ন্যুব্জ কৃষ্ণচন্দ্র দে আঘাতে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। যে মানুষের রেকর্ড বুকলেটে লেখা থাকত ‘সঙ্গীত জগতের রাজাধিরাজ’ তাঁরই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সেই রেকর্ড কোম্পানি। শেষ জীবনে এটাই ছিল তাঁর সব থেকে বড় মানসিক আঘাত। খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘জানো এমন একদিন গেছে যখন আমি বছরে ওদের এক কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছি, আর আজকে আমাকে কিনা তারা এই রকম কথা বলল?’আর কোনওদিন তিনি ফিরে যাননি হাতিবাগানের নলিন সরকার স্ট্রীটের সেই রেকর্ড কোম্পানিতে। কাজ করতেন হিন্দুস্থান রেকর্ডের সঙ্গে। সেখানে যেন এক আত্মসমীক্ষার প্রত্যয়ে বাউল গানের প্রথম রেকর্ড করেন, গান লিখেছিলেন রাখালবন্ধু নিয়োগী। গানের কথা ছিল, ‘বাংলা মায়ের অঙ্গনে আজ নামলো অন্ধকার, আয়রে ও ভাই তোদের পরেই ভবিষ্যতের ভার’।
যে কীর্তনগান গেয়ে তিনি বছরে লক্ষ টাকার ওপর মুনাফা এনে দিয়েছেন, সেই রেকর্ড কোম্পানিই কিন্তু তাঁকে একটা সময় এত অপমান করেছে যা কহতব্য নয়! পাওনা টাকা তো দেয়ইনি, উল্টে বলেছিল, গাইতে হলে গানের মত গান গাইবেন, কেত্তন-টেত্তন এখানে আর চলবে না।
আর সমস্ত গানের পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্র গানও গাইতেন। প্রয়াত সুবিনয় রায়ের কাছে বছর চারেক রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন এবং বেশ কিছু রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ডও করেন। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি সুর সংযোজনও করেছিলেন এবং ঘরোয়া পরিবেশে তা পরিবেশন করে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিলেন।যদিও কণ্ঠ সঙ্গীতের সমস্ত ধারা ছিল তাঁর আয়ত্বে, কিন্তু তিনি কোনওদিন নজরুল গান করেননি। এ প্রসঙ্গে আলোচনাক্রমে বিমান মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতি থেকে একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। সেইটি বলছি। ১৯৪৮ সাল নাগাদ প্রথম বেসকরকারিভাবে সভা, আলোচনা করে কলকাতায় নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী পালন করা শুরু করেন যে গুটিকয়েক যুবক, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিমান মুখোপাধ্যায়। নিজেরা কোনওমতে টাকা পয়সা চেয়ে চিন্তে জোগাড় করে এ কাজ শুরু করেছিলেন। কিছুদিন বাদে আকার আয়তন বৃদ্ধি হলে যতীন্দ্রমোহন এ্যভেনিউতে একটা বড় বাড়িতে এই সভা উঠে আসে। বাড়িটি ছিল শিল্পী সতীন্দ্রনাথ লাহার বাড়ি, এখন যেটি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক। হাতে লেখা কার্ডে সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হত। উপস্থিত হতেন মতি নন্দী, কবি শৈলেন রায়, সুরেশ চক্রবর্তীর মতো দিকপালেরা। এই সময়েই একবার কাকে সভাপতি করা যায় সেই নিয়ে কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। বিমানবাবুর বাবা সুবল মুখোপাধ্যায় ছিলেন ওনার বন্ধু মানুষ। তিনি ছেলেদের উৎসাহ দিয়ে বললেন যাও না, চেষ্টা করেই দেখো। সময় দেখে বিমান বাবু ও সুব্রত নন্দী দুজনে মিলে গেলেন তাঁর মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে। খালি গায়ে একতলার ঘরে বসে তানপুরা বাঁধছেন, তখন তাঁর বয়েস ৫৫-৫৬। ছেলেদের সাড়া পেয়ে বললেন, কে? কী চাই? সব শুনে বললেন ‘আমি নজরুলের অনুষ্ঠানের সভাপতি হবো কেন? আমি তো সাহিত্যিক নই, আর আমি কোনওদিন নজরুলের গানও করিনি, যদিও তিনি আমার বন্ধু ছিলেন’। একটু থেমে আবার বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি ভেবে দেখি, পরে বলব’খন’। সমস্ত শুনে বিমান বাবুর বাবা ছেলেকে নিয়ে আর একদিন গেলেন মদনঘোষ লেনে।ঘরে ঢুকে ডাক দিলেন, ও কেষ্ট দা!‘কে? কে গো?’আমি বামুন সুবল’। তখন গানবাজনার জগতে দুজন সুবল ছিলেন, কমল দাশগুপ্তের দাদা সুবল দাশগুপ্ত, আর বিমান বাবুর বাবা সুবল মুখোপাধ্যায়। তাই লোকে তাঁকে ডাকত ‘বামুন সুবল’ ব’লে। তা তাঁর কাছে আসার কারণ জেনে দে মশাই উত্তর দিলেন আমি তো না করে দিয়েছি। সুবল বাবুর জোরাজুরিতে অবশেষে রাজি হলেন আধঘণ্টার জন্য যেতে। ছ-টায় অনুষ্ঠান শুরু, ওনার শর্ত রইল এই যে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় গাড়ি নিয়ে বাড়িতে আসবে। ছটায় অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে ঘড়ি ধরে, সভাপতি হিসেবে উনি পাক্কা আধঘণ্টা থাকবেন, সাড়ে ছটায় বেরিয়ে যাবেন আর এক জায়গায়। এক মিনিটও বাড়তি দিতে পারবেন না, আর যেখানে যাবার আছে সেখানে গাড়ি করে পৌঁছে দিতে হবে। বিমানবাবু তো তাতেই রাজী হয়ে গেলেন। আগুপাছু ভাবার অবস্থা ছিল না যে গাড়ি কোথা থেকে আসবে, আর তার অর্থই বা কে যোগাবে। যা হবার তাই হলো। অনুষ্ঠানের দিন সামান্য ওই দূরত্ব কোনও ট্যাক্সিওলাই যেতে চায় না, শেষে বাড়তি একটাকা দেবার শর্তে একজনকে নিয়ে যখন মদনঘোষ লেনে পৌঁছালেন, ততক্ষণে পনের মিনিট দেরি হয়ে গেছে। পৌঁছেই তোপের মুখে পড়লেন, ‘কটায় আসবার কথা ছিল? আপনাদের কথার ঠিক নেই’। কোনোক্রমে বুঝিয়ে মাপ চেয়ে ওনাকে তো আনা গেল সভায়।
তাঁর সভাপতির নামে সভায় প্রচুর ভিড় – শৈলেন রায়, কমল দাশগুপ্ত, চিত্ত রায় প্রভৃতি সকলেই উপস্থিত। সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে সেদিন অতি মনোগ্রাহী বক্তৃতা দিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। অনেক কথার ফাঁকে বলেছিলেন যে ‘নজরুল বয়সে আমার থেকে ৪-৫ বছরের ছোট ছিলেন। ওনার চিত্রনাট্যে আমি অনেক অভিনয় করেছি। এমনিতে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল। নিউ থিয়েটার্সের ‘বিদ্যাপতি’, ‘সাপুড়ে’র অনেক গান লিখেছিলেন নজরুল। কিন্তু আমার মুখের গানগুলি লিখেছিলেন অজয় ভট্টাচার্য। রাইচাঁদ ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। তাঁকে আমি বলে দিয়েছিলাম নজরুল যদি নিজে ব্যক্তিগতভাবে, তাঁর গান গাইতে আমায় অনুরোধ করেন তাহলে আমি গাইব, কিন্তু তা না হলে, আপনি বললে আমি গাইব না। নজরুল তো আমায় কোনোদিন গাইতে বলেনি। কোনও কারণে আমাদের দুজনেরই হয়তো পরস্পরের প্রতি অভিমান ছিল’। এই অভিমান কথাটি তিনি এত দরদ মেশান আবেগ দিয়ে বলেছিলেন যে উপস্থিত সকলের মনে তার ঢেউ এসে লাগে। বক্তব্য শেষে সকলেই তাঁকে গান শোনাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অনড় – সভাপতি কখনও গান গায় না। বরং উপস্থিত শিল্পী চিত্ত রায়কে নিজে অনুরোধ করেন গান শোনাতে। বিমান বাবুকে বললেন তোমাদের উদ্যোগ, নিষ্ঠা আমার খুব ভালো লেগেছে, অনুষ্ঠান এই ভাবেই চালিয়ে যাও, কিন্তু এবার আমায় যেতে হবে। উদ্যোক্তাদের তরফে চা-মিষ্টির অনুরোধ তিনি মন্দ্রস্বরে ফিরিয়ে দিলেন, ‘না না আমি বাইরে কোথাও কিছু খাই না’। মজার কথা হলো এই যে যখন তিনি চ’লে যাবার কথা বলছেন তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছটা ছেড়ে সাতটা পেরিয়েছে। যাবার সময় সকলে প্রণাম করলে পর তিনি বললেন যে ‘আর আমায় ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিতে হবে না। তোমাদের টাকাপয়সার অভাবের কথা শুনেছি। বরং একটা রিক্সা জোগাড় করে আমায় হরিঘোষ স্ট্রীটের একটা বাড়িতে পৌঁছে দাও, তাহলেই হবে’। সে সময় সেণ্ট্রাল এ্যভেনিউ থেকে হরিঘোষ স্ট্রীটের রিক্সা ভাড়া ছিল চার আনা।
(ক্রমশ)
Sangeet maheeruho ….bhabi ni onar jeevan er choto baRo sab ajaanaa ghatona ato sundar kore jaante paarbo. Onek dhanyabaad Somnath Chattapadhyay
Porer episode er jonne wait korchi….khub bhalo laglo.