ওমপ্রকাশ বাল্মীকির কবিতা – অনুবাদ: শিবু মণ্ডল
ওমপ্রকাশ বাল্মীকি: কবি পরিচিতি
হিন্দি ভাষার বিশিষ্ট কবি ওমপ্রকাশ বাল্মীকির জন্ম ৩০ জুন, ১৯৫০ সালে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগর জেলার বারলা গ্রামে।
প্রকাশিত কবিতার বই—‘সদিও কা সন্তাপ’, ‘বস্ বহুত হো চুকা’, ‘অব্ অউর নেহি’, ‘শব্দ্ ঝুট নেহি বোলতে’ ও ‘নির্বাচিত কবিতা-সংগ্রহ’। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ—‘সলাম’, ‘ঘুস্পেটিয়ে’, ‘আম্মা এন্ড আদার স্টোরিজ্’, ও ‘ছত্রি’। প্রবন্ধ সংকলন—‘দলিত সাহিত্য কা সৌন্দর্যশাস্ত্র’, ‘মুখ্যধারা অউর দলিত সাহিত্য’, ‘দলিত সাহিত্য: অনুভব, সংঘর্ষ অউর যথার্থ’, ‘সাফাই দেবতা’ ইত্যাদি।
তাঁর সাড়াজাগানো আত্মকথা ‘জুটন’ ভারতীয় নানা ভাষা সহ ইংরেজি, জার্মান ও সুইডিশ ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে।
যেসব পুরস্কার ও সম্মান তিনি পেয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—ডাঃ আম্বেদকর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার (১৯৯৩), পরিবেশ সম্মান (১৯৯৫), ন্যু ইন্ডিয়া বুক পুরস্কার (২০০৪), সাহিত্য ভূষণ সম্মান (২০০৬) ইত্যাদি।
২০১৩ সালের ১৭ই নভেম্বর কবি ওমপ্রকাশ বাল্মীকির দেহাবসান ঘটে।
জমিদারের কুয়া
চুলা মাটির
মাটি পুকুরের
পুকুর জমিদারের।
খিদে রুটির
রুটি বাজরার
বাজরা খেতের
খেত জমিদারের।
বলদ জমিদারের
লাঙল জমিদারের
লাঙলের মুঠিতে হাত আমাদের
ফসল জমিদারের।
কুয়া জমিদারের
জল জমিদারের
খেত থেকে বাগান জমিদারের
পাড়া থেকে গলি জমিদারের
তাহলে আমাদের কী?
গ্রাম?
শহর?
দেশ?
আমাদের হকের রুটি
আমি চেয়েছি
আমাদের হকের রুটি
সে উঠে দাঁড়িয়েছে
হাতে কয়লা নিয়ে
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে চির-অন্ধকার
কোনও দেবতা জন্মায়নি
হয়নি কোনও আকাশবাণী
ঈশ্বরও নেয়নি অবতার
ওহে, হাজারো বছর পুরানো দেবতারা
আমি অস্বীকার করি
তোমাদের অস্তিত্বকে
আমি লড়ব
আমার হাড়ের বজ্র দিয়ে
যার মুষ্টিতে লেগে আছে
নিষ্পাপ শিশুদের কান্না
লুণ্ঠিতা-নির্যাতিতা স্ত্রীদের প্রতিশোধ!
এক মুঠো ভাত
হে, আমার প্রতারিত পূর্বপুরুষ,
তোমার স্মৃতিগুলি
এই বন্ধ্যা পৃথিবীর বুকে
এখনও বেঁচে আছে
আপন সবুজ নিয়ে
তোমার পিঠের উপর
আঘাতের নীল গভীর ক্ষত
তোমার সাহস ও সহিষ্ণুতা
ভোলাতে পারেনি এখনও।
তোমার কঠিন হাতে লেগে থাকা আঁচড়
চুইয়ে পড়া রক্তের সাথে
উত্তরাধিকারে দিয়ে গেছে
তীব্র বেদনা
যা আমাকে ফলাতে হবে এই ধরাতে
লাল-নীল-সবুজ ফুলে।
বস্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া
ও আমার পূর্বপুরুষ,
তুমি চুপ ছিলে সেই রাতে
যখন তুমি ভালোবাসতে চাইছিলে
আলিঙ্গনে বদ্ধ করে,
নিজের স্ত্রীকে।
তুমি খোঁজ করছিলে
একমুঠো ভাত
স্বপ্নকে বন্ধক রেখে।
ও আমার অজানা, অনামা পূর্বপুরুষ
তোমার মূক শব্দ
পুড়ছে
তপ্ত ভস্মের মতো
ভস্ম—যা অনবরত কাঁপছে
তীব্র রোষানলে
আমি জানতে চাই
তোমার গন্ধ…
তোমার শব্দ…
তোমার ভয়…
যা তীব্র বাতাসের মধ্যেও
জ্বলছে
প্রদীপের মতো যুগ যুগ ধরে!
শ্রেষ্ঠ
ঘৃণাভরা প্রশ্নে তিনি জানতে চাইলেন
আমার নাম
আমার জাতি
আমি পাতালে তলিয়ে যাচ্ছি
হীনমন্যতা বোধে
একদিন আমিও
সাহস জুটিয়ে
তাকে জিজ্ঞেস করলাম
একই প্রশ্ন
সে আমার দিকে তাকাল
বলল, ‘ব্রহ্মার মুখ থেকে আমার জন্ম’
তাইতো আমি শ্রেষ্ঠ
আশ্চর্য!
মানুষের তো জন্ম হয়
শুধু মায়ের গর্ভে
তবে আপনি কী করে জন্ম নিলেন
ব্রহ্মার মুখ থেকে?
সেই দিন কবে আসবে
আমার মা জন্ম দিয়েছে সব অচ্ছুৎ আর অচ্ছুৎ
তোমার মা জন্ম দিয়েছে সব বামন আর বামন।
কী আশ্চর্য কথা
অথচ জনন-ক্রিয়া যেখানে সবার একইরকম।
সেই দিন কবে আসবে
বামনি জন্ম দেবে না বামন
চামারনী জন্ম দেবে না চামার
মেথরানিও জন্ম দেবে না মেথর।
সেইদিন পেতে হবে না
জাতপাতের দংশন।
মারা পড়বে না কোনও তপস্বী শম্বূক
কাটা পড়বে না কোনও একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুলি
কর্ণ হবে নায়ক
রাম ক্ষমতালোভী হত্যাকারী।
এমন দিন কি আসবে কখনও?
কখনও ভেবেছ কি
তুমি মহান
তোমার জিভ থেকে উৎপন্ন
প্রতিটা শব্দ পবিত্র—
মেনে নিয়েছিলাম আমি।
তোমার পড়া আছে
হাজারো বই
তুমি পটু শব্দের পুনরাবৃত্তিতে
তুমি পারো অর্থকে বদলে দিতে।
সহিষ্ণুতা তোমার পরিচয়।
বর্ণপ্রথাকে তুমি আদর্শ বলে মানো
তুমি খুশি হও
সাম্যবাদ হলে পরাজিত।
যখন রাশিয়া ভেঙে যায়
তোমার বুকের ছাতি উঠেছিল ফুলে
কেননা মার্কসবাদ
আঘাত হেনেছিল
তোমার বদ্ধ সংস্কৃতির মূলে।
হ্যাঁ, তুমি সত্যিই সহিষ্ণু
দাঙ্গায় যখন মারা যায়
আব্দুল আর কাশিম
কাল্লু আর বিরজু
তখন তুমি সত্যনারায়ণের ব্রতপাঠ শুনতে শুনতে
ভুলে যাও খবরের কাগজ পড়তে।
পুজো করো গান্ধীর হত্যাকারীকে
ভেঙে ফেলো ইবাদতখানা ভিড় হয়ে।
কখনও ভেবেছ কি
নর্দমার পাড়ে বসবাসকারী
বর্ণপ্রথায় জর্জরিত মানুষগুলি
এইভাবে কেন বেঁচে থাকে?
ওরা অপর কেন ভাবে তোমাকে
কখনও ভেবেছ কি?