কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ৬)
ষষ্ঠ পর্ব
টিম অদ্রিজার ঝান্ডিধার অভিযান
সকাল সকাল রেস্ট হাউসের কর্মচারী এক বালতি গরম জল দিয়ে গেল। এটা শেষ হলে পরে আরেক বালতি দেবে বলল। বিদ্যুৎ নেই বলে এখানে রুমের বাথরুমে গিজারের ব্যবস্থা নেই। বাইরে কাঠের উনুনে গরম জল করে শুধু স্নানের জন্য বালতি করে রুমে রুমে সাপ্লাই দেয়। আমরাও কোনওমতে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম, এরপর তৈরি হয়ে পুরো টিম যাব জিরো পয়েন্টে।
জিরো পয়েন্ট এই পাহাড়ের উচ্চতম স্থান। আমাদের রেস্ট হাউস থেকে দু-কিমি পায়ে হাঁটা পথ। পথ বলতে ট্রেকিংয়ের পথ যেমন হয়, সরু ও কাঁচা! ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা আমার আছে। অনিমেষদাও একবার কেদারনাথ গিয়েছিল। আর বাকি সদস্যেরা আজ প্রথম ট্রেকিং করবে। সবাই উত্তেজিত। বড়োরা চুপচাপ হাঁটছি। কচিকাঁচাগুলো কিচিরমিচির করছে পাখিদের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে। এই দ্রুত পায়ে বড়োদের সাথে সাথে তাল মেলাচ্ছে তো এই হাঁপিয়ে বসে পড়ে। ওদেরকে সামলে রাখতে হচ্ছে। পাশেই তো গভীর খাদ। একটু অন্যমনস্ক হলেই বিপদ। শুরুতে অদ্রিজার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল, মাঝে মাঝে কোলে নিতে হচ্ছে। পাহাড়ি পথে ট্রেকিংয়ে হাতে ছড়ি থাকা চাই। আমরা কেউই তা আনিনি। পথের পাশে পড়ে থাকা ডাল দিয়েই ছড়ি বানিয়ে সবাইকে দিলাম। ছড়ির সাপোর্টে কীভাবে হাঁটতে হয় অদ্রিজাকে শিখিয়ে দিলাম। ছড়ির সাপোর্ট নিয়ে পথের ওঠা-পড়া সামলে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয় শ্রীজা, অদ্রিজা, প্রিয়াংশু-রা তা শিখে গেছে। এবার আর পথ চলতে ওদের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। একটু বেলা হয়ে যাওয়াতে কুয়াশার দৌরাত্ম্য আর নেই। বড়োরাও এই অজানা বন-জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে কিছু ভাবছে নিশ্চয়ই। তাদের ভালো লাগছে, তারা আশ্চর্য হচ্ছে, তারা মুগ্ধ হচ্ছে। পথশ্রমে ক্লান্ত হলেও কিন্তু ভীত হচ্ছে না। মাঝে মাঝে তাদের সেই ভালো লাগা, মুগ্ধতা, আশ্চর্য হবার ভাব ব্যক্ত করছে একে অন্যের কাছে। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে ছবি তুলছে। আমাদের টিমের সবচেয়ে ছোটো সদস্য সাড়ে চার বছরের অদ্রিজাও আমাকে দিয়ে ওর ভ্লগ করাচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে চলতে চলতে যাত্রাপথের বিবরণ দিচ্ছে। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে দর্শকদের জন্য ট্রেকিং কীভাবে করতে হয় তার জ্ঞান দিচ্ছে। পথ চলতে ছড়ির প্রয়োজনীয়তা কী তা-ও বুঝিয়ে দিচ্ছে তার দর্শকদের জন্য। ইউটিউব দেখে দেখে আজকালকার বাচ্চাদের এই একটা রোগ ধরেছে। একদিকে খারাপ নয়। অল্প বয়স থেকেই তারা জড়তা কাটিয়ে সবাইকে তার মনের কথাটি, তার ভাবনাটি ব্যক্ত করতে পারছে। আর বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য মৌসুমি মাসিমার হাঁটুর সমস্যা নিয়ে হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি। তবুও বাচ্চা ও তরুণদের সঙ্গ তাকে উজ্জীবিত করে রেখেছে। এই নৈসর্গিক পরিবেশ তার ব্যথায় কোথাও ওষুধের কাজ করছে নিশ্চয়ই। শুরুতে লক্ষ্যে পৌঁছনোর কোনও তাড়া না থাকলেও একটা সময় মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন মনে হয় আর কত দূর! আমাদের টিমেরও কয়েকজনের মনে হচ্ছিল জিরো পয়েন্ট আর কতক্ষণে আসবে।
—অউর কিতনা দূর হ্যাঁয় জিরো পয়েন্ট?, ফিরতি পথের অভিযাত্রীদের জিজ্ঞেস করতেই বলল
—বস্ পনরাহ্ মিনিট কা রাস্তা হ্যাঁয়।
ওদের পনেরো মিনিট মানে আমাদের প্রায় আধঘণ্টা তো লাগবেই। তবুও অবশেষে প্রায় দেড় ঘণ্টায় দু-কিমি চড়াই আমরা সম্পন্ন করলাম। সমুদ্রতল থেকে ২৪২০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত জিরো পয়েন্টের পর আর কিছু নেই। জিরো পয়েন্টে একটি ওয়াচ টাওয়ার বানানো আছে। এখান থেকে পুরো আলমোড়া শহরটা দেখা যায়। তাছাড়া হিমালয়ের কেদারনাথ, নন্দাদেবী, নন্দাঘুণ্টি, চৌখাম্বা, পঞ্চচুল্লী এইসব শৃঙ্গগুলি আরও ভালো স্পষ্ট দেখা যায়। তবে কেএমভিএন এর সেই স্বর্গীয় চাতাল থেকেও তা দেখা যায়। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকায় আমাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। মাথার উপরে মেঘ নিয়েই উঠেছিলাম, নামছিও মেঘ নিয়েই। তবে শুনেছিলাম যে এই জঙ্গল পাখিদের স্বর্গভূমি। প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি এখানে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা সেরকম কিছু দেখতে পেলাম না। হয়তো মেঘলা দিন বলে পাখিরা বাসা ছেড়ে বের হয়নি। সূর্যের আলো না দেখতে পেয়ে হয়তো ওরা ভাবছে যে সকাল হয়নি এখনও। যাই হোক, পাখি না দেখা যাক ওদের ডাক কিন্তু শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ফেরার পথে সকালের সেই বাঁকটায় এসে সবাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। সামনের ঢালটায় একটু উঁকিঝুঁকি মারলাম যদি আবার দেখা যায় সকালের দেখা সেই বার্কিং ডিয়ারটি। না আর সে দেখা দেয়নি। বাকিরা আমার কাছে হরিণটির গল্প শুনল, তার বর্ণনা শুনল, শুনল তার লাফিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবার দক্ষতা। গল্প শুনে মানসচক্ষেই তারা হরিণটিকে কল্পনা করতে করতে রেস্ট হাউসে ফিরে এল।
ফিরে এসে আদুর (অদ্রিজার ডাক নাম) সে কী উল্লাস— ‘ইয়েস্, হামনে কর দিখায়া, হামনে কর দিখায়া, হামনে কামাল কর দিয়া…’ ওইটুকুন একটি শিশুর এই উৎসাহ ও জয়োল্লাস দেখে আমার এডমন্ড হিলারির একটি উক্তি মনে পড়ছিল—‘It is not the mountain we conquer but ourselves’।
লোকদেবতা কলবিষ্ট
এইমাত্র আমরা ঝান্ডিধার জয় করে ফিরলাম। যে ঝান্ডিধার পাহাড় থেকে একসময় কুমায়ুন শাসন করতেন ব্রিটিশ কমিশনার হেনরি রামজে, তারও আগে চন্দ বংশের রাজাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল যে পাহাড়ে, সেই পাহাড় এখন আমাদের। এ তো গেল ইতিহাসের কথা। তবে স্থানীয় মিথ-গাথাও কিন্তু অনেক কিছু বলে লিখিত ইতিহাসের আড়ালে আবডালে। এমনই একটি গাথা শোনাল স্থানীয় মহেন্দ্র সিং বিষ্ট। কেএমভিএন-এর গেটের বাইরে পথের ধারেই গাছের নীচে একটি নীল প্লাস্টিকের ছাউনির নীচে একটি স্টোভের উপরে ম্যাগির সসপ্যান নিয়ে বসে আছেন যিনি তারই নাম মহেন্দ্র। ট্রেকিংয়ে আসা পর্যটকদের জন্য ম্যাগি বিক্রির সাথে সাথে কিছু বিস্কুট, কেক, সিগারেটের প্যাকেটও রাখা আছে। নীচের আয়ারপানি গ্রাম থেকে সে এই সিজন টাইমে রোজ আসে বাইকে করে। নীচের দিকের যে দু-চারটি প্রাইভেট রিসর্ট আছে সেখান থেকে তো পর্যটকরা তো আসেনই জিরো পয়েন্টে, তাছাড়া বাইরে থেকে শুধু দিনে দিনেই ঘুরে আবার ফিরে যান এমন অনেকে আসেন এই জঙ্গল সাফারিতে। আর এইসব পর্যটকদের সৌজন্যেই তার কিছু বিক্রিবাট্টা হয়। এই গাথার নায়ক তারই এক পূর্বজ কল্যাণ বিষ্ট উরফ কলবিষ্ট—এক সুঠাম চেহারার পশুপালক। বিনসারের এই বনভূমি ছিল তাঁর চারণভূমি। গোপালন করে ও নগরে-গ্রামে দুধ বিক্রি করেই সেই যুবকের রোজগার চলে। এই গোয়ালার বাকিটা সময় কাটে বাঁশিতে সুর তুলে, আর উদাসী গান গেয়ে। তাঁর বাঁশির সুরে কী জানি কী মায়া ছিল—সেই সুরের গুঞ্জনে বিনসারের পাহাড়, আকাশ, বাতাস মূর্ছনা যেত। তার সুরের মায়াবলে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, সব সব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। একদিন এই বংশীবাদক কলবিষ্টের প্রেমে পড়ে গেল কমলা সুন্দরী। এই কমলা আবার চন্দ রাজার দেওয়ান সকরাম পাণ্ডের কুলীন স্ত্রী। তাতে কী! প্রেম তো আর সমাজ দেখে না, সম্পর্ক দেখে না, জাতপাত দেখে না! কলাপ্রেমী কমলা সুন্দরী তখন কলবিষ্টের বাঁশির জাদুতে মজে আছে। কলবিষ্ট গোয়ালার বাঁশির সুর, উদাস করা গানের কথা তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিল্লোল তোলে। তার দুই নয়ন সদা গোয়ালাকে খোঁজে। সে তখন কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী রাধার মতো! যখনই সুযোগ পায় ছুটে যায় কলবিষ্টের কাছে অথবা কল্ল দুধ দিতে এলে জোর করে বসিয়ে রাখে নিজের বাটিতে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে সারাদিন তাঁর বাঁশির সুরে, গানে মজে থাকে। কলবিষ্টের বাঁশির সুর, গানের কথা তার হৃদয়ের মণিকোঠায় যতনে সাজিয়ে রাখে। তবে বেশিদিন আর গোপন রাখতে পারে না। পাড়াপড়শি জানে, সকরামও জেনে যায়।
ন-লক্ষ টাকার খাজনার মালিক সকরাম কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারে না। সে ভেবে পায় না তার বিত্ত-বৈভব ও সামাজিক সম্মানকে তুচ্ছ করে কী কারণে তার স্ত্রী এক সামান্য গোয়ালার প্রেমে পাগল হল! কিছু তো একটা বিহিত করতেই হয়। এমন কিছু করতে হবে যাতে না থাকে বাঁশ না বাজবে বাঁশি—সকরাম কলবিষ্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু নানা ফন্দিফিকিরের পরেও কলবিষ্ট যেন এক ফেরেশতার মতো প্রতিবারেই বেঁচে যায়। সকরামের কোথাও যেন আঁতে ঘা লাগে। অগাধ ক্ষমতা ও সম্পত্তির মালিক হয়ে সে নগণ্য কলবিষ্টের কাছে হেরে যাবে? কিছুতেই হতে পারে না। প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে তার হৃদয়ে। মল্লপ্রদেশের খস জনজাতির লোকজনকে সকরাম ভুলভাল বুঝিয়ে কলবিষ্টের বিরুদ্ধে উসকে দেয়। খস জনজাতি দ্বিধায় পড়ে যায়—একদিকে সাধারণ গরিব মানুষের রক্ত জল করে উপার্জন করা টাকা লুঠ করা অত্যাচারী সকরাম আর অন্যদিকে তাদের এই বন-জঙ্গলের রক্ষাকর্তা, গৃহপালিত পশুদের রক্ষাকর্তা শান্তশিষ্ট গল্ল দেবতা—তারা কার পক্ষ নেবে! এ যেন মানবসমাজের এক আবহমান দ্বন্দ্ব! শেষে টাকার লোভ দেখিয়েও কাজ না হলে সকরাম অন্য চাল চালে। স্ত্রীকে তালাবন্দি করে দিল অন্তঃপুরে! মানুষ মানুষের শরীরটাই তো বন্দি করতে পারে, মনকে তো নয়! কমলা সুন্দরী এই বন্ধ কুঠুরির অন্ধকারেও চোখ বন্ধ করে তাঁর মনের মানুষটির বাঁশির সুর শুনতে পায়। সে মনে মনে গুনগুন করে নিশ্চয়ই গেয়ে উঠেছিল এমনই কোনও গান—‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি/ মন বান্ধিবি কেমনে?/ আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি/ পরান বান্ধিবি কেমনে?’ মরিয়া সকরাম তখন কলবিষ্টকে মারতে তাঁর প্রাণ ভোমরার খোঁজ করতে থাকে। সে কলবিষ্টের বোন-জামাই লক্ষ্মণ সিং দেবড়ীকে সামন্ত করার লোভ দেখিয়ে কল্লকে হত্যার ফন্দি আঁটে। কলবিষ্টের প্রাণের রহস্য একমাত্র তাঁর বোন ভানা-ই জানত। লক্ষণ কৌশলে সেই রহস্য জানতে চায়। ভানাও সরল বিশ্বাসে স্বামীকে সব বলে দেয়। সেই লক্ষ্মণই ছল করে কলবিষ্টকে হত্যা করে! তরোয়ালের আঘাতে দ্বিখণ্ডিত কলবিষ্টের দেহের মুণ্ডু গিয়ে পড়ে কাপড়খানে আর ধরটি গিয়ে পড়ে গৈরাদ ডানাতে। এই দুটি স্থানেই তাঁর মন্দির গড়ে ওঠে। আজও ভক্তরা মনোকামনা পূরণের উদ্দেশ্যে কলবিষ্ট দেবতার মন্দিরে মনের কথা লেখা চিঠি বেঁধে রেখে যায়। স্থানীয়রা তাদের গৃহপালিত পশুদের রক্ষাকর্তা কলবিষ্টের ভরসাতেই বনে জঙ্গলে চরাতে ছেড়ে দেয়। শোষিত, নিপীড়িত ও অন্যায়ের শিকার মানুষেরা ন্যায় প্রার্থনায় তাদের প্রিয় কুলদেবতা কলবিষ্টের কাছে নতমস্তক হয়। কলবিষ্ট মরেও মরল না! সে তাঁর সৎকর্ম ও পরোপকারের দ্বারা জীবিত কালেই দেবতা হয়েছিল। আর অকাল মৃত্যুর পরেও ধর্ম-জাতি-বর্ণ-গরিব-ধনীর ঊর্ধ্বে এক লোক-দেবতা থেকে ক্রমশ কালের দেবতা হয়ে গেল! তবে মারা পড়ল এক নারীর এক পুরুষের প্রতি প্রেম, এক ভাইয়ের প্রতি তাঁর বোনের স্নেহ, এক স্বামীর প্রতি এক নারীর বিশ্বাস! এসবের সাথে এই পাহাড়ে পড়ে রইল আরও কিছু—অর্থ ও ক্ষমতার কুটিল খেলা। আর পড়ে রইল ভাইকে হারানো এক বোনের দীর্ঘ নিঃশ্বাস, প্রেমের প্রতি সমর্পিতা এক নারীর নিঃসঙ্গ হাহাকার। পুরুষতান্ত্রিক কৌশলে শৃঙ্খলিত এই একলা, নিঃসঙ্গ নারীর শূন্যতা যেন সব সমাজেই, ব্ল্যাকহোলের মতো আজও বর্তমান!
তথ্য ও ছবি ঋণ:
১. কুমায়ুন কা ইতিহাস- বদ্রী দত্ত পাণ্ডে
২. Kafaltree.com
৩. Google.com