বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় (পর্ব ১)
পর্ব ১
শীতের কলকাতা। ব্রিটিশরা বলতেন শীতের কলকাতা প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ শহর, উনিশ শতকের ঠিক প্রাক্কালে কলকাতা সেজে উঠত নতুন রঙ্গে। যদিও উনিশ শতকের কলকাতা তার পাততাড়ি গোটাচ্ছিল তখন, শেষ হয়ে যাচ্ছিল একটা গোটা পরিবর্তনের শতক। আধা গ্রাম চেহারা থেকে শহর হয়ে উঠেছে কলকাতা।
উনিশ শতকের কলকাতা। মানে আধা শহর–আধা মফঃস্বল। হুতোমের কলকাতা, বাবুয়ানা, বুলবুলি লড়াই, হাফ-আখড়াই-পাঁচালি গান-কবির লড়াই। সেদিনের কলকাতা মানে একদিকে নেটিভ বা ব্ল্যাক টাউন, অন্যদিকে হোয়াইট টাউন। এহেন কলকাতায় ক্রিকেট ক-জন দেখত? বুঝতোই বা ক-জন? দেশীয়দের আগ্রহ কতটা ছিল? আদৌ বুঝত?
কলকাতা ছিল একাধারে ব্রিটিশ নয়নের মণি আবার ব্রিটিশ হৃদয়ের আতঙ্ক। এই পরিস্থিতিকে বুঝতে চলুন যাওয়া যাক পুরোনো দিনের কলকাতায়। ঘড়ঘড় করে চলছে ট্রাম, ডবল ডেকার বাস, ঘোড়ার গাড়ি, রাস্তায় চলছে স্টুডিবেকার এর মতো বর্তমানে বিদায় নেওয়া গাড়ি।
আজকের মতো কালচে নীল নয়, ঝকঝকে নীল আকাশ আর অনেক সবুজ গাছ। সেসময় শেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটি বিভাজন ছিল। একদল যারা ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারী (CCC -এর সমর্থক), মার্চেন্টাইল কোম্পানির কর্মচারী (ডালহৌসি-এর সমর্থক) এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান (অন্যান্য স্থানীয় দলে খেলতেন)।
উনিশ শতকের শীতকাল। ক্রিসমাসের সময় ইডেনকে মনে হত কাউন্টি মাঠ যেন ম্যাজিক বলে কলকাতায় উঠে এসেছে। দেখলেই ওরসেস্টার কথা মনে পড়ে। মখমল সদৃশ্য সবুজ মাঠ, ঘন গাছপালায় ঢাকা, গঙ্গার দিক থেকে বাতাস ছুটে আসে। উর্স্টারের গ্রীষ্ম আর কলকাতার শীত প্রায় একইরকমের ছিল। হাইকোর্টটাও যেন ঠিক উর্স্টারের পিছনের ক্যাথিড্রালটার মতো লাগত।
বাঙালিরা মোটামুটিভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর ছয়-এর দশক থেকে। এবং সম্ভবত পূর্ববঙ্গের ঢাকা অঞ্চলেই বাঙালিরা প্রথম ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করে থাকে। ঢাকায় সবথেকে পুরনো ম্যাচ—১৮৫৮ সালের ২০শে জানুয়ারি ঢাকা স্টেশন ও হার ম্যাজেস্টি ৫৪ রেজিমেন্ট এর মধ্যে খেলা হয়। জনৈক অন্নদাচরণ সেন লিখেছেন, “…ঢাকার সাহেবরা বাঙালিদের নিয়ে খেলতেন, কলেজ অধ্যাপকরাও উৎসাহ দিতেন।” তিনি এও দাবি করেছেন যে পূর্ববঙ্গের ছেলেরাই ওই লেখা প্রকাশিত হওয়ার ১১ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৭৯ প্রেসিডেন্সি কলেজ-এ ক্লাব খোলে। সম্ভবত এই ক্লাবটিই প্রেসিডেন্সি ক্লাব যারা ১৮৮৪ সালের প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে বিদেশি দলের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলে। তবে শুধু মাত্র ক্রিকেট খেলার জন্যে ১৮৮৪ সালে তৈরি হয় ক্যালকাটা টাউন ক্লাব। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নাটোরের রাজা জগদীন্দ্রনাথ এবং অবশ্যই ‘মসুয়া’ অর্থাৎ মৈমনসিংহ জেলার রায় পরিবারের সারদারঞ্জন রায়। ১৮৮৯ সালের ১৫-ই আগস্ট প্রতিষ্ঠা হয় মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব-এর। যারা ১৮৯০ সাল থেকে নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব।
কিন্তু সেসব অনেক পরে। এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য হল শীতের উৎসবের সময়ের কলকাতার ক্রিকেট। যখন ব্রিটিশরা থাকতেন পার্ক স্ট্রিট এলাকায়, চাকরি করতেন ডালহৌসি এলাকায় আর ক্রিকেট খেলতে যেতেন গড়ের মাঠে অর্থাৎ আজকের ময়দানে।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত ২৫-শে ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি নিয়ম করে ম্যাচ হত ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের নিজেদের মধ্যে। মূলত সিভিলিয়ান বনাম আর্মি ম্যাচ। সেই সময় এটাই ছিল কলকাতার ক্রিকেট প্রেমীদের মুখ্য আকর্ষণ। কিন্তু বিষয়টা বদলাতে শুরু করেছিল ১৮৫৫ সালে বাংলায় রেল ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর। এখানে বলে রাখি, আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, ক্রিকেটের বিস্তারের সঙ্গে রেলের সম্পর্ক নিয়ে ভারতে কোনও গবেষণাই হয়নি, যদিও ইংল্যান্ডে ও অস্ট্রেলিয়ায় অজস্র গবেষণা ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে।
যাই হোক, রেল চালু হওয়ার পরে ম্যাচের সংখ্যা ও দূরবর্তী দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলার প্রবণতা বেড়ে গেল। এর ফল হল সুদূরপ্রসারী। ভারতের খেলার মান অনেক উন্নত হল।
১৮৮০- এর দশকে দেখা যাচ্ছে এই ধরনের ম্যাচ বাড়ছে। ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজের ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের একটি ওভারসিজ সংস্করণে দেখা যাচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর ১৮৮২ ও ১-লা জানুয়ারি ১৮৮৩ বেহার ক্রিকেট ক্লাব খেলছে ইডেনে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে। আবার ৩ জানুয়ারি ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্ট (২১৬) খেলছে HMS ELRYALUS (৫৫) এর বিরুদ্ধে এবং ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্ট জিতছে।
পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে বসছে এক্সিবিশন। যেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজ ক্রিকেট ক্লাব নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা বণিক দলটির বিরুদ্ধে খেলছে। এই প্রথম কোনো ভারতীয় দল খেলছে বিদেশি দলের বিরুদ্ধে। অনেকের মতে এই এক্সিবিশন জাতীয় কংগ্রেস সৃষ্টির অন্যতম বীজ।
১৮৮৪ সালের ৩০ জানুয়ারি যে খেলা ইডেনে হয়েছিল তাতে মুখোমুখি হয় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব ও নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স (বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত সুবা-এ-খাইবার-এ-পাখতুনকোয়া বা খাইবার পাখতুন প্রদেশ, তখন ভারতে বলা হত সুবা-এ-শরহদ-এ-হিন্দ)। কলকাতার হয়ে অ্যালয়স্লাস স্তানিস্লাস পেরেরা ১০৮ করেন, মনক্রিফ করেন ১১৮। কলকাতা ৩৫১ করে। জবাবে নর্থ ওয়েস্ট ১২৫ ও ১৮৭ করেছিল। মনক্রিফ দ্বিতীয় ইনিংসে ৭ উইকেট নেন।
এই ক্ষেত্রে অ্যালয়স্লাস স্তানিস্লাস পেরেরার কথা একটু বলতে হয়। কেমব্রিজের কলাবিদ্যার স্নাতক এবং পরবর্তীকালের মুজাফ্ফরপুরের চা-বাগানের মালিক আলয়সলাস স্তানিস্লাস পেরেরা (৩০ ডিসেম্বর ১৮৫৯) জীবনে একটি মাত্র প্রথম শ্রেণীর খেলা খেলেন, একটি অল ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে, ১৮৮০ সালে। সি আই থর্নটনের উইকেট সহ দুটি উইকেট ও ই এম গ্রেসের ক্যাচ নিয়েছিলেন তিনি। পরে বেহার ওয়ান্ডারার্স দলের হয়ে জি এফ ভের্ননের দলের বিরুদ্ধে আরও একটি ম্যাচ খেলেন ১৮৮৯-৯০ সালে। কলকাতায় জন্ম হয়েছিল তাঁর। মারা যান দেরাদুনে (১১ ই নভেম্বর ১৯৩৫ )। এ-কথা বলা মুশকিল, তিনি ব্রিটিশ না এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। আমার মনে হয় তিনি লুসো ইন্ডিয়ান।
এদিকে ওই একই সময়ে ঘটা একটি ঘটনা না উল্লেখ করে থাকা যায় না। ১৮৮৫ সালের ১ ও ২ জানুয়ারি জামালপুরে হাওড়া বনাম জামালপুরের ম্যাচে হাওড়া ৫৫১ করে, যা ভারতের প্রথমদিককার ৫০০-র বেশি রান। এর মধ্যে S S Doeg ২২৮ রান করেন, সম্ভবত ভারতের মাটিতে এটি চতুর্থ দ্বি-শতরান।
১৮৮৭ সালের ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব বড়োদিনের সময় (২৪-২৫ ডিসেম্বর) মুখোমুখি হয় সার্ভিসেসের। সি মিচেলের ১৪০ ও সি জে জি প্যাটারসন ১০৭ করায় ক্যালকাটা ৩৪০ রান তোলে। জবাবে সার্ভিসেস ১৭৫ ও ৪ উইকেটে ৮৩ করে কোনওমতে ড্র করে।
১৮৮৮ সালের ২ জানুয়ারি, ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব খেলতে নামে সিভিল সার্ভিসের বিরূদ্ধে এবং হেরে যায়। সি সি মিড ব্যাট হাতে ৬৫ করেন ও বল হাতে ৬ উইকেট নেন। ঘটনাচক্রে এই মাসে আরও একটি পরাজয় আসে ক্যালকাটার, বালিগঞ্জের বিরুদ্ধে তবে সেটা আলোচ্য বিষয় নয়।
পরের শীতে দার্জিলিং এর সেন্ট পলস স্কুল কলকাতা সফরে আসে। দলটি বেশ উন্নত ছিল তার বিবরণ যথাসময়ে দেওয়া হবে। ১৮৮৯ এর জানুয়ারি মাসে বেহার ক্রিকেট ক্লাব খেলতে এলেও তাঁদের সুযোগ হয়নি ওই সময়ে অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৫ই জানুয়ারির মধ্যে খেলার।
১৮৮৯ এর শীতকাল ছিল খুবই গুরত্বপূর্ণ একটি শীত। সেন্ট পলস এবারও এসেছিল। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্যালকাটা স্কুল-কে হারিয়ে দেয়। ক্যালকাটা স্কুল দলে শৈলেন বসু ও এম এম হুসেন খেলেন এবং বোস অপরাজিত ৩০ করেন। কিন্তু পরের ম্যাচেই তাঁদের বিরূদ্ধে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এয়ার্সে জন্মানো ও ইংল্যান্ডে কাউন্টি খেলা এডমুন্ড গ্রীনওয়ে ১১৮ করেন, ফলে সেন্ট পলস খুবই বাজেভাবে পরাজিত হয়। তবে এর থেকেও বড়ো ঘটনা হল জি এফ ভার্ননের দলের ভারত সফর। বছর দুয়েক বোম্বের পার্সি দল বিলেত সফর করার পরে এই প্রথম বিলেত থেকে দল এল খেলতে।
২৪ শে ডিসেম্বর ইংলিশম্যান ওভারসিজ জানাচ্ছে ভার্ননের দল ১৯ তারিখ সকালে কলকাতায় এসে পৌঁছেছে।
যাই হোক, ২৩-২৫ ডিসেম্বর ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব ইডেনে খেলতে নামে ভার্ননের দলের বিরদ্ধে। ২৪৯ করে ক্যালকাটা আউট হয়। গ্রীনওয়ে ১৩০ করেন। প্রথম কোনোও বিদেশি দলের বিরুদ্ধে ভারতের ক্রিকেটারের শতরান। ক্যালকাটার হিকলে ৮ উইকেট নিলেও গিবসনের ১০০, হোন-গোল্ডনের ৪৭, ট্যাপ্লিং এর ৪০ ও ওয়াকারের ৪৯ ভার্ননের দলকে ৩১১ অবধি টেনে নিয়ে যায়। লেথ্যাম আর হর্নসবি ক্যালকাটা-কে ৯০ রানে অল আউট করে দিলে জিততে আর মাত্র ২৯ রান ভার্ননের দল ১ উইকেট খুইয়ে তুলে নেয়।
ম্যাচটি তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় একটি স্ক্র্যাচ বা ফিল আপ প্রদর্শনী ম্যাচও খেলা হয়।
৩১ ডিসেম্বর, ১ ও ২ জানুয়ারি ছিল কলকাতা তথা বাংলার ক্রিকেটের ইতিহাসের ঐতিহাসিক দিন। প্রথম বাংলা নামে কোনও দল ক্রিকেট মাঠে নামে (যদিও ফার্স্ট ক্লাস নয়)। ম্যাচটি ভার্ননের দল ইনিংসে জেতে। তবে ম্যাচটি নিয়ে, বিশেষত দল গঠন, সংবাদপত্রে খুব সমালোচনা হয়েছিল। কারণ নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার-এর একজন খেলোয়াড়কে দলে নেওয়া হলে ইংলিশম্যান সরাসরি লিখে দেয় ওই ক্রিকেটার এই দলে খেলার যোগ্য নন।
একদা শেঠ বসাক বণিকদের সাথে জেলে, চাষি সহাবস্থানকারী গোবিন্দপুর গ্রাম–আজকের ময়দান (ইডেন সহ) অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। কালিঘাটের পথে যাওয়া তীর্থযাত্রী, ফাঁসুড়ে ঠগীর যুগ হয়ে ক্রিকেটের কেন্দ্র হয়ে ওঠা আসলে দিন বদলানোর, সময় বদলানোর কাহিনি। একদা ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য যে খেলা হত, পরিবহনের উন্নতির সুযোগে তার বিস্তার ঘটে। অন্য এলাকার দল খেলতে আসে। ক্রমে বিদেশি দলের আগমন ঘটে। এরই মধ্যে লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যতে টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করার বীজ। বড়োদিনের সাজে সেজে ওঠা ব্রিটিশ কলকাতা, বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তৈরি প্রাসাদ নগরীর পরবর্তী ইতিকথার আরও কাহিনি আছে। ক্রমশ প্রকাশ্য…