ধর্ষকের মা – মালবিকা মিত্র

ধর্ষকের মা – মালবিকা মিত্র

শেয়ার করুন

সুয্যি ওঠার আগেই দিন শুরু হয় রমেশের মা-র। সকালে উঠে উঠোন ঝাঁট দেয়, তারপর গোবরজলে নিকোয়। রাতের এঁটো বাসনপত্র মাজে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে। তারপর আকাশ একটু ফর্সা হলে, পাশের পুকুরে গিয়ে কাপড় কেচে নিয়ে আসে। ছোট্ট উঠোনটা ভরে যায় ভেজা কাপড় জামায়। ততক্ষণে রমেশের বাপ বিছানা থেকে উঠে পড়ে। তাকে চা করে দিতে হয়। শ্লেষ্মার রুগি। সারারাত ধরে হাঁপিয়ে ভোরের দিকে একটু চায়ের জন্যে বড়ো আঁকুপাকু করে মানুষটা। আগে আগে সংসারের নানান কাজে রমেশের মাকে সাহায্য করত। তারপর ক্ষেতের কাজ করতে যেত। না না, নিজেদের জমি নয়। অন্যের জমিতে জন খাটত রমেশের বাপ। মরশুমে আয় ভালোই হত। মানে গরিবের সংসারে একদিন পাতে মাছটা পড়ত, একদিন পায়েসও হত। নতুন ছাপা শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ। বছরে ওই একবারই। তবু হত তো! কিন্তু ইদানীং আর কিছুই পারে না মানুষটা। বয়সটা তো কম হল না রমেশের বাপের। 

মেয়েটা রুগ্ন ছেলেবেলা থেকেই। পড়াশোনা বেশিদূর চালাতে পারেনি। শরীরেই দেয় না। আর তাদের অত সামর্থ্য কোথায়, যে ঘরে মাস্টার রেখে রুগ্ন মেয়েকে পড়াশোনা করাবে, কিংবা শহরে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলবে। ঈশ্বরের ভরসায় ফেলে রাখা ছাড়া অন্য উপায়ও তো কিছু নেই। 

আর আছে রমেশ। পড়াশোনার মাথা যে খুব পরিষ্কার, তা কেউই বলবে না। তবু মাধ্যমিকটা তো পাস করেছে। রমেশের মা-বাপ দুজনেই বলেছিল, সাউদের খালের ধারের জমিতে জন খাটার লোক চাই। রমেশের বাপ তো সাউদের জমিতেই কাজ করত। কিন্তু মাধ্যমিক পাস করা ছেলের জন খাটতে মানে লাগে। মান! পেটে টান পড়লে ওসব মানসম্মান জানলা দিয়ে পালিয়ে যায়! কিন্তু সে কথা ছেলে বুঝলে তো? জেদাজেদি করে শহরে চলে গেল। শিলিগুড়ি। তা সেখানেও তো লেবারের কাজ বাদে অন্য কোনও কাজ জোটেনি। কে জানে, লেবারের কাজ জন খাটার চেয়ে কেমনতর আলাদা। তবে হ্যাঁ, শহর এলাকা বলে মজুরিটা গ্রামের চেয়ে বেশি। কিন্তু নিজের খরচ টেনে সংসারে আর কিছু দিতে পারে না ছেলেটা। 

কাল রাতে জ্বর ছিল রমেশের মা-র। এই শেষ অঘ্রানের মাসে, সারারাত জুড়ে হিম পড়ে টুপটাপ। নারকেলের পাতা ছাওয়া চালের সেই হিম আটকানোর ক্ষমতা কোথায়? কাল সারারাত জ্বরে এপাশ ওপাশ করেছে। সারা শরীরে যন্ত্রণা। কিন্তু অসুস্থ বলে মেয়েমানুষের বিছানায় শুয়ে থাকা তাদের মতো ঘরে আর হয় কই? তাই শত কষ্ট হলেও তাকে উঠতে হয়েছে। অন্যান্য দিন উঠোন ঝাঁট দিয়ে মিনিট খানেকের বেশি লাগে না। কিন্তু আজ অসুস্থ শরীরে ওই দেড় হাতের উঠোনটাকে মনে হচ্ছিল কত্ত বড়ো!

উঠোনটা নিকোনোর জন্যে জলের বালতি আনতে যাবে, এমন সময় বাঁশের বাতার তৈরি দরজা ঠেলে গ্রামেরই একটি ছেলে উঠোনে পা রাখল, “কাকি, রমেশ ঘরে আছে?”

ছেলেটি মাতব্বর গোছের। প্রধানের ডান হাত। ওকে সবাই একটু সমঝেই চলে। রমেশের মা-ও ছেলের এই বন্ধুটিকে যথেষ্ট ভয় করে। কে না জানে, এই সব রাজনীতি ঘেঁষা ছেলেপুলেরা কেউটে সাপের জাত। শত্রুতা করলে তো ছোবল দেবেই। ভালোবাসলেও ছোবলই দেবে।

—“না রে বাপ। ঘরে তো নাই। কাইল সাঁঝের বেলাতেই তো বারয় গেল।”
—“কই গ্যাছে গা?”
—“শিলিগুড়ি যাবে বলেই তো বার হল।”
—“আচ্ছা।”

মুখ নামিয়ে কিছু ভাবল ছেলেটি। সুবোধ, ওর নাম। রমেশের সঙ্গে একই প্রাইমারিতে পড়েছে। তারপর সাহুডাঙি হাই স্কুলে যখন পড়তে গেল রমেশ, তখনও সুবোধই ওর সঙ্গী হল। দুজনে হরিহর আত্মা। কিন্তু সুবোধের চালচলন আজকাল পালটে গিয়েছে। প্রধানের ডান হাত হওয়া কি যার-তার কথা? 

সুবোধ খানিকটা চিন্তিত মুখে বলল, “কাকি, কাইল রাতে রমেশ ঘরে ছিল না, ঠিক জানো?”

রমেশের মা-র বুকের ভিতরটা কেন জানি শীতকালের পুকুরের মতো নিস্পন্দ হয়ে গেল। রমেশ কাল রাতে বাড়িতে না থেকে কি মস্ত কোনও অন্যায় করে ফেলেছে? মুখ্যু মেয়েমানুষ, ভয়ে সারা হয়ে জিজ্ঞেস করল, “না রে বাপ। ছিল না। কিন্তু তুই এই কথা বারবার শুধাইতেছিস ক্যান?”

সুবোধ কোনও উত্তর না দিয়ে, যেমন আচমকা এসেছিল, তেমনই আচমকা বেরিয়ে গেল। 

সুবোধ বেরিয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু সাত সকালে সুবোধের বাড়িতে আসা এবং রমেশের খোঁজ করা, রমেশের মায়ের মনে একটা কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়ে গেল। রমেশ মাসখানেক আগে একটা মোবাইল নিয়েছে। ঘরের বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে, সেই নম্বরটা বের করে চলল সিধুদের বাড়িতে। যদিও যেতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। সাত সকালে ছেলেকে ফোন করার আবদার নিয়ে কারুর বাড়ি যেতে সঙ্কোচ হয় বই-কি। সময় অসময় বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু ছেলের প্রতি দুশ্চিন্তার কাছে সে সঙ্কোচ কিছুই নয়।
কিন্তু ফোন করেও কোনও লাভ হল না। রমেশের ফোন বন্ধ। অবশ্য এমনটা মাঝেমধ্যেই হয়। সস্তার স্মার্টফোন। যখন তখন দেহ রাখে। আবার নানান কায়দা কানুন করে তাকে চালু করতে হয়। আর বেলাও তো বেশি হয়নি। ঘুমই ভাঙেনি হয়তো রমেশের। ছেলেটার সঙ্গে কথা না বলে কেন জানি শান্তি পাচ্ছে না রমেশের মা। মনটা কু গাইছে যেন।

বেলার দিকে আবার ফোন করবে, ভাবল মনে মনে। ফোন নিয়ে পড়ে থাকলে তো তার চলবে না। ঘরের কাজ তো সারতে হবে। ছেলের জন্যে মনটা উতলা হচ্ছে বলে তো সংসার তাকে ছেড়ে দেবে না। তাই তড়িঘড়ি উনুন গোবরজল দিয়ে লেপল রমেশের মা। এরপর আঁচ দিতে দেরি হলে রান্না চাপাবে কখন?

বাঁশের বাতার দরজা সরানোর আওয়াজ হল। গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য এসেছেন তাদের ঘরে। অবাক বিস্মিত রমেশের মা গোবরজলের হাতেই মাথায় ঘোমটা তোলার চেষ্টা করল, 

—“কারে খোঁজেন ছ্যার?”
—“রমেশ কই? দেখতেছি না। কই গেল গা?”

সকলে আজ রমেশের খোঁজ করছে কেন? রমেশের মায়ের ভয়টা আরও জাঁকিয়ে বসছে।

—“রমেশ তো কাইল সন্ধ্যার আগেই শিলিগুড়ি গেল গা। ক্যান ছ্যার? কিসু হইছে?” যেটা জিজ্ঞেস করতে পারল না রমেশের মা, ‘ছেলেটার কোনও বিপদ-আপদ হয়নি তো?’

—“তোমরা কিসু জানো না?”

রমেশের মা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। 

ভিতর ঘর থেকে রমেশের বাপ চিৎকার করে, “আহ, চা-টাও কি দিবা না আইজ?”

সেই দিকে তাকিয়ে সদস্য বলেন, 

—“একখান খবর পাইসি। সত্যি-মিথ্যা কইতে পারি না, কিন্তু রমেশ শিলিগুড়িতে যে এলাকায় থাকে, সেখানে কিসু গোলমাল হইছে। সুবোধ কইল, কাইল নাকি রমেশ রে গেরামেই দ্যাখসে। তাই ভাবলাম যাই খোঁজ নিয়া আসি। কিন্তু আপনে তো কইতেসেন, রমেশ কাইল ফির‍্যা গ্যাসে।”

এই ভয়টাই পাচ্ছিল রমেশের মা। ছেলেটার নির্ঘাৎ বিপদ আপদ কিছু হয়েছে, 

—“কয়েন না ছ্যার। মোক ছেলেডা ঠিক আসে তো?”
—“তা কইতে পারি না রমেশের মা। তবে…’
—“তবে?”
—“ঘটনাটা ভালো না। একটা মাইয়ামানুষের লাশ পাওয়া গ্যাসে। মাইয়াটা রে রেপ করসে। রেপ বোঝেন তো? ধর্ষণ করসে। কইরে গলা টিপে মারসে।”

সদস্য চুপ করে যান।
কিন্তু রমেশের মা বুঝতে পারে না, এসবের সঙ্গে রমেশের কী সম্পর্ক? রমেশ তো আর খুন করেনি। তাহলে এরা বারবার রমেশের খোঁজ করছে কেন?

—“বস্তিতে খুব গোলমাল হইতেসে কি?”, রমেশের মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “একটা মাইয়ামানুষ মইরে গেল গা। বাপ-মার তো কষ্ট খুবই।”
—“বস্তিতে গোলমাল হইতেসে। পুলিশ কাইল রাতেই এলাকায় গ্যাসে। রমেশের মা…”, এরপরের কথাটা বলতে সদস্যও ইতস্তত করলেন। কথাটা সম্ভবত এমনই স্পর্শকাতর, “আমি ঠিক জানি না, কিন্তু শুনলাম, রমেশ রে পুলিশে ধরসে। কাইল রাতেই খবরটা পাইসি। তবে পুলিশ থিকা কেউ এখনো আসে নাই যখন…”

রমেশের মার সদস্যের কথাটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। সদস্য কি তার সঙ্গে মজা করছেন? এমন অদ্ভুত মজা, তাও এই সক্কালবেলায় করার কী মানে? 

—“কী কন ছ্যার? রমেশ রে পুলিশে ধরবে ক্যান?”

গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যটি আবার ইতস্তত করলেন। বস্তুত, তিনি বেশিদিন রাজনীতিতে আসেননি। খুব বলিয়ে কইয়েও নন। তাই কথা বলতেও খুব বেশি পোক্ত হয়ে ওঠেননি, “পুলিশ কইতেছিল যে… রমেশই রেপ করসে। তারপর খুনও করসে।”

মাথায় আচমকা আঘাত খেলে মানুষের কেমন বোধ হয় জানেন? চোখের সামনেটা হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রমেশের মা-রও তেমনই অনুভূতি হল। 

রমেশ ধর্ষণের আসামি! 
রমেশ খুনের আসামি! 

খবরটা নীলগঞ্জ গ্রামে চাউর হতে বেশিক্ষণ সময় নিল না। রমেশের মাঠকোঠার ছোট্ট উঠোনখানা ভেঙে পড়ল পড়শির ভিড়ে।

—“হাঁ গো!”, এক মহিলা গালে হাত দেন, “কী হইতেছে এসব?”
—“কী ঘেন্না, কী ঘেন্না!” অপরা বলেন, “চরিত্তির এক্কেবারে বাঁধায় রাখবার মতোন। হাঁ গো, রমেশ রে দেইখে তো এমনটা মনে হয় না।”

কোনো কথাই রমেশের মা’র কান বাঁচিয়ে হচ্ছে না। রমেশের হেঁপো রুগি বাপটা মাটির দাওয়ার এক কোণে ঝিমিয়ে আছে। আশেপাশের কথা কানে যাচ্ছে, না নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভাবছে, তা বোঝা দায়। রমেশের বোন ঘরে চাটাইয়ের উপর শুয়ে করুণ চোখে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। কিছু ভাবার মতো ক্ষমতা তার আছে বলে তো মনে হয় না। 

—“মোদের গেরাম থিকা এমন রাক্ষস হইল ক্যামনে?” একটা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল। গ্রামেরই কোনও মাতব্বর হবে হয়তো। 

রমেশের মা-ও তাই ভাবছিল। এমন নারীঘাতী রাক্ষস তার পেটেই জন্মাতে হল? লোকে যে খোলের দোষ দেবে। 

—“ফাঁসি, ফাঁসি। ফাঁসি হওন লাগে। বুঝলা কাকা? এই ইতরগুলানের ফাঁসি হওন লাগে।” রমেশের বয়সি কোনো ছেলেই হবে। গলা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। কে জানে, মনের অজান্তে সে-ও হয়তো কোনও দিন কোনও মেয়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছিল। হয়তো সে-ও মনে মনে অবাধ্য, অহংকারী মেয়েদের ধর্ষণই চায়। কিন্তু আজ, এক ধর্ষকের ভিটেয় দাঁড়িয়ে, সে সোচ্চারে রমেশের ফাঁসির ফরমান জারি করে।

রমেশের মা তখন ভাবছে, কোথায় তার গর্ভের দোষ রয়ে গেল। রমেশকে বড়ো করায় কোথায় খামতি রয়ে গেল। রমেশ কি বোনটার কথাও ভাবল না? সে-ও তো একটা মেয়ে। না না, এরা সকলে মিথ্যে বলছে। সর্বৈব মিথ্যে কথা বলছে। রমেশ অমনটা করতেই পারে না। এতখানি অমানুষ তার ছেলে হতেই পারে না। মনের মধ্যেই চেঁচিয়ে উঠতে চায় রমেশের মা। বলতে চায়, “ওগো আজ তোমরা যাকে শাপশাপান্ত করছ, সে আমার ছেলে, আমারই নাড়ি ছেঁড়া ধন। আমার সামনে তোমরা ওর মৃত্যু কামনা কোরো না। আমি যে সইতে পারছি না।”

রমেশের মা-র ভাবনাটাই অন্য এক পড়শির মুখে শোনা গেল, “আইচ্ছা, রমেশের তো একখান বোন আছে। তার কথাখানও ভাবল না। ধর্ষকের বোনে রে এর পরে কে বিয়া করবো? এমনিতেই মাইয়াটা দিনরাত শুইয়াই থাকে।”

—“এরা কারুর লগে ভাবে না, কাকি।” একটি অল্পবয়সি মেয়ের গলা, “এদের শুধু নিজেরটাই সব। শুনলাম মাইয়াটার লগে রমেশদার আলাপ ছিল। মাইয়াটা নাকি লোকের বাড়ি কাজ করে। কিন্তু ভাব-ভালোবাসা ছিল বলে মনে হয় না। আইচ্ছা খুন করল ক্যান কেউ কইতে পারো?”

—“আরে ফুলটি, তুইও যেমন। খুন না করলে প্রমাণ থাকবে তো, না কি? মাইয়াটা শুনলাম রমেশ রে পাত্তা দেয় নাই। বুঝলি?”, অন্য কোনও ছেলের গলা। আজ সবাই বিশেষজ্ঞ, সবাই গ্রামের হিতাকাঙ্ক্ষী। শুধু রমেশই অপরাধী। 

মনে মনে ভাবছে রমেশের মা। ওই যে খিড়কির কাছে ধুতি ফতুয়া পরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা তার ছেলেকে শাপশাপান্ত করছে, প্রতি সন্ধেয় তারি গিলে এসে বৌটাকে পেটায়। বৌটার পিঠে দাগড়া দাগড়া দাগ, সেদিনও দেখেছে রমেশের মা। এখন সে রমেশের নৈতিক চরিত্র কেমন করে উন্নত করা যেত, তার জ্ঞান দিচ্ছে। আর ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছে রমেশের এমন কাজের পিছনে আসলে রমেশের মা-বাবার অশিক্ষাই মূল কারণ। তার রমেশ… এই সেদিনও তো ইশকুল থেকে ফিরে সারাদিনের সব কথা মা-কে না বলে খেলতে অব্দি যেত না… সে কী করে, কবে এমনধারা পালটে গেল? 

—“মাইয়াটা রে শুনলাম কুপাইয়া খুন করসে। এত্ত রাগ শরীলে আইল কোথ থিকা? বাপটা তো অতি ভালো মানুষ, সাত চড়ে রা কারে না।” অন্য আর এক মহিলা বিস্ময় প্রকাশ করল।

—“ভালো মানষের পোলা ডাকাত হয় না? হইল কোথ থিকা? এমন কথা কও না হারুনের মা, যে মনে হয় এই বুঝি জন্মাইলা। আরে শহরে গ্যাসে, হাওয়া লাগসে শহরের। আর মাইয়া মানষেরও দোষ কম নাই। ছোট্ট ছোট্ট জামা কাপড় পইরা ঘুইরা বেড়ায়। ছেলেগুলানের উত্তেজনা তো হইবেই। কিন্তু এখন দোষ হবে গিয়া পোলাটার।” অপরা মত প্রকাশ করল। (অবশ্য সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েও কি ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পায়?)

রমেশের মা দেখতে পাচ্ছে… অপরিসীম গর্ভযন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া তার নিজের মুখচ্ছবি… রমেশ হল… জীবন্ত পুতুলের মতো ছোট্ট শরীর… ছোট্ট ছোট্ট আঙুলে মায়ের আঁচল পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করছে রমেশ… ফোকলা মুখের অনাবিল হাসি… হঠাৎ করে সেই মুখটা পরিবর্তিত হয়ে গেল… রমেশের মুখের স্বর্গীয় হাসি পরিণত হচ্ছে লোল হাসিতে… কী ঘৃণ্য সেই হাসি… সহ্য করতে পারছে না রমেশের মা… সহ্য করতে পারছে না…

সবার সব কথা শুনতে শুনতে রমেশের মা কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে। চোখে অর্থহীন দৃষ্টি। সে দৃষ্টিতে কী আছে তা বোধ করি সৃষ্টিকর্তাও জানেন না। তার ছেলে। তাই গ্রামের লোকের অধিকার আছে, তাকে কথা শোনানোর। তার ছেলে যে শহরে গিয়ে এমন অপদার্থ জানোয়ারে পরিণত হয়েছে, তা বুঝতে পারেনি সে। বস্তুত, ছেলের চরিত্রের আসল পরিচয়ই মা হয়ে পায়নি। এ তো তারই ব্যর্থতা। কিন্তু সে বলতে পারছে না, এমন শিক্ষা সে ছেলেকে দেয়নি। তাকে বলেনি কোনোদিন, মেয়ে মানুষ মানেই তাকে যেমন খুশি ভোগ করা যায়। তেমনই তাকে এটাও তো শেখায়নি, প্রত্যাখ্যান সহজ মনে গ্রহণ করতে হয়। কোথায় কখন যে রমেশের মনে পুরুষতান্ত্রিকতার বীজ রোপিত হল, জানে না রমেশের মা। ছেলে মানেই সে সব পাবে, সব কিছুতে তারই অধিকার—এ কথা কবে থেকে রমেশের মনে গেঁথে গেল, তাও জানে না। হয়তো, তার নিজের সংসারেই মেয়ের চেয়ে রমেশকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছে। হয়তো নিজের অজান্তেই সে বুঝিয়েছে, সংসারে ছেলের স্থান আগে। তাই সবটাই তার প্রাপ্য। তার ফলই কি পাচ্ছে আজ?

অবশ হয়ে আসছে রমেশের মা-র শরীর। জ্ঞান হারাচ্ছে ধীরে ধীরে। রমেশের ছেলেবেলার মুখটা মনে পড়ল। সবাই বলছে, জন্মের পর কেন নুন খাইয়ে মেরে ফেলেনি রমেশের মা। তাহলে সেদিনই পাপ চুকে যেত। সত্যি বলতে রমেশের মা-ও যে সে কথা ভাবেনি তা নয়। কিন্তু সেদিনের সেই নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক মুখে ধর্ষকের ছায়া তো দেখেনি কোনোদিন। তবে আজ এমন হল কেন? 

হঠাৎ খিড়কির কাছটাতে একটা সোরগোল উঠল, “পুলিশ এসেছে, পুলিশ।” চাপা একটা আতঙ্ক পাক দিয়ে উঠল জমা হওয়া ভিড়টার মধ্যে। দু একজন সরে পড়তে শুরু করল ধীরে ধীরে। কে না জানে, পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা?
রমেশের মা সচকিত হয়ে উঠল। 

এক জোড়া ভারি পায়ের শব্দ এসে থামল রমেশের মা-র সামনে, “রমেশ…”

পুলিশকে আর কথা এগোতে দিল না রমেশের মা। জলভরা চোখে যদিও সে সব ঝাপসা দেখছে, তবু আকাশের দিকে মুখ তুলে হাহাকার করে উঠল, “রমেশ ঘরে নাই সাহেব। উয়ারে খোঁজেন। যদি পান, কয়েন, ঘরে ফিরলে, মো উয়ারে বিষ খাওয়াইয়া মারিবি সাহেব, বিষ খাওয়াইয়া মারিবি…”

পুলিশ অফিসার গম্ভীর স্বরে বললেন, “ভুল করছেন আপনি। রমেশকে আমরা খুঁজতে আসিনি। একটা খবর দিতে এসেছি।” খানিকক্ষণ ইতস্তত করলেন বয়স্ক অফিসারটি, “বলছিলাম, কাল রাতে একটি মেয়েকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে রমেশ দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছে। রমেশের ডেডবডিটা পুলিশ মর্গে রাখা আছে। আপনারা গিয়ে ক্লেম করলে, আমরা এখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারি।”

সন্ধ্যার আকাশ তখন লাল হয়ে উঠেছে। একঝাঁক ছাতারে পাখি কিচকিচ শব্দ করে উড়ে গেল।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২