বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ৮) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম পর্ব
১৯২৮ সালে বোর্ড তৈরি হওয়ার পরেই স্থির করা হয় ১৯৩০-৩১ মরশুমে এম সি সি আসবে ভারতে। তখন ইংল্যাণ্ডের ক্রিকেটের নিয়ম স্থির করত এম সি সি। ট্যুর ম্যাচ এই নামেই খেলত তাঁরা। টেস্ট খেলত ইংল্যাণ্ডের নামে। কিন্তু ওই বছর ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়া খুব একটা ভালো ছিল না ইংরেজদের পক্ষে।
মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে তখন শুরু হয়েছে আইন অমান্য আন্দোলন। এর প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। এমনকি কমিউনাল ক্রিকেট অর্থাৎ কোয়াড্রঙ্গুলার ট্রফি বন্ধ হয়ে যায়। বোম্বের হিন্দু জিমখানা পুরোদস্তুর সমর্থন করে এই আন্দোলনকে।
স্বাভাবিকভাবে এম সি সি ভারতে আসতে রাজি হল না। তার বদলে সফর করার সিদ্ধান্ত নিলেন ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজকুমার ওরফে ভিজি। দেশ বিদেশের খেলোয়াড় নিয়ে ভারত ও সিলোন সফর করলেন।
ভিজি ১৯২৬ সাল থেকেই তাঁর ক্রিকেট দল তৈরি করে তাঁর প্রাসাদের কম্পাউন্ডে একটি মাঠ তৈরি করেছিলেন। তিনি জ্যাক হবস এবং হার্বার্ট সাটক্লিফকে দলে আনেন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কারণ হবস এর আগে এই ধরনের পাঁচটি সফরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কয়েক বছর পর ভিজি লিয়ারি কনস্টানটাইনকে ভারতে নিয়ে আসেন। তিনি মুশতাক আলীকে প্রশিক্ষণের জন্য বেনারসে নিয়ে আসেন যখন তিনি তখনও হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। এ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট-এ মিহির বোস লিখেছেন, “ভিজি যদি এমন একজন ক্রিকেট স্পনসর হয়েই সন্তুষ্ট হতেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর স্যার হোরাসিও মান বা বিংশ শতাব্দীতে স্যার জুলিয়েন কানের মতো, তাহলে তার নাম ভারতীয় ক্রিকেটে সবচেয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হত, কিন্তু তিনি একজন মহান ক্রিকেটার হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে সব ব্যর্থ করেন।”
১৯৩০-৩১ এর সফর ভিজিকে ভারতীয় ক্রিকেটে এমন একটি অবস্থান এনে দেয় যা পাতিয়ালার মহারাজার পরেই ছিল। এই সময়ে, পাতিয়ালা ভারতের ভাইসরয় লর্ড উইলিংডনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ভিজি ভাইসরয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
যাই হোক, ২১-২৪ নভেম্বর ১৯৩০, ইডেনে বাংলার গভর্নর দলের বিরুদ্ধে খেলতে নামে। গভর্নর দল টসে জিতে ব্যাট করতে নামলে কার্তিক বসু (৪১), আসাদ আলী (৫০) ও অধিনায়ক হোসি (৪৮) এর জন্য দুই উইকেটে ১৩০ তুলে ফেলে। কিন্তু মুস্তাক আলী (৩৬/৬) অসাধারণ বোলিং করে ১৭৩ রানে অল আউট করে দেন গভর্নর দলকে। কিন্তু গোর্লায় (৩/২১) ও সুইনি (৪/১৫) ভিজির দলের ৮ রানে ৩ উইকেট ফেলে দেয়। দিনের শেষে ২১ রানে ৩ উইকেটে ছিল। পরের দিন ৭৮ রানে অল আউট হয়ে যায় ভিজির দল। সাহাবুদ্দিন কেবল ২৩ করেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে মুস্তাক আবার বিধ্বংসী বোলিং করেন (৫/১৮)। গভর্নর দল মাত্র ৪৬ রানে শেষ। গুলাম মহম্মদ ৩ উইকেট নেন ১৬ রানে। ১৪২ রানের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে ভিজির দল দ্বিতীয় দিনের শেষে বিনা উইকেটে ২৫ তোলে।
তৃতীয় দিন সাটক্লিফ অপরাজিত ৬২ ও হবস ৩৬ করায় ৩ উইকেটে ১৪২ তুলে ভিজির দল ৭ উইকেটে জয়ী হয়।
বোলিংয়ের জন্য মুস্তাক সোনার ব্রাশ উপহার পান জ্যাক হবসের থেকে, আর গণেশ বসুর প্রথম শ্রেণির খেলায় অভিষেক হয়।
২৩ নভেম্বর ১৯৩০ সালে এক দিনের এক ইনিংসের খেলায় ভিজির দল ২ উইকেটে ২০৯ রান তোলেন। সাটক্লিফ করেন অপরাজিত ১১০। সি আর নাইডু করেন ৫৬। জবাবে স্পোর্টিং ইউনিয়ন ৭ উইকেটে ৯৯ করায় ম্যাচ ড্র হয়। কার্তিক বসু ৩০, গণেশ বসু ২১ ও জে দত্তরায় ২২ করেন। মুস্তাক আবার ৪ উইকেট পান।
এই ম্যাচে হবস খেলতেই নামেননি, কারণ দিনটা ছিল রবিবার আর হবস ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টান, যিনি রবিবার শুধু উপাসনা করতেন।
মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ম্যাচ বৃষ্টির কারণে বাতিল হয়।
যদিও কলকাতার ক্রিকেটের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ না থাকলেও ভারতের প্রথম টেস্ট সফরের সামান্য কথা আলোচনা করছি।
ভারতীয় ক্রিকেট দল ১৯৩২ মরশুমে “অল-ইন্ডিয়া” নামে ইংল্যাণ্ড সফর করে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন পোরবন্দরের মহারাজা। ১৯১১ সালের সফরের পর এটি ছিল জাতীয় দলের দ্বিতীয় ইংল্যাণ্ড সফর। তখন ভারতকে সবেমাত্র আইসিসি পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং ভারত ২৫ জুন লর্ডসে তাদের উদ্বোধনী টেস্ট ম্যাচ খেলে।
সফরকারী ভারতীয় দল গোটা সফরে ৩৭টি ম্যাচ খেলেছে, যার মধ্যে ২৬টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ রয়েছে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে, তাদের দুটি ছোটো ম্যাচ একটি বল ছাড়াই পরিত্যক্ত হয়েছিল। ভারত নয়টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ জেতে, নয়টিতে ড্র করে এবং আটটিতে হেরে। ২৯ এপ্রিলের প্রথম ম্যাচ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দলটি প্রচুর ম্যাচ খেলে।
উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালম্যানাক (উইসডেন) জানাচ্ছে যে সে সময়ের ভারতীয় ক্রিকেটাররা অভ্যস্ত ছিল না। ফলস্বরূপ, দলটি ইনজুরিতে খারাপভাবে ভুগছিল যার অর্থ তারা তাদের পরবর্তী ম্যাচে দল হিসাবে সাফল্য পাচ্ছিল না।
ভারতের অসামান্য ব্যটার ছিলেন ডানহাতি সি. কে. নাইডু, যিনি সমস্ত প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে খেলেছেন, ৪০.৪৫ গড়ে ১৬১৮ রান করেন, যার মধ্যে পাঁচটি শতক এবং সর্বোচ্চ ১৬২ রান করেন। উইজডেনের ১৯৩৩ সংস্করণে, নাইডু ১৯৩২ সালের বর্ষসেরা পাঁচজন ক্রিকেটারের একজন নির্বাচিত হন। ভারতের অমর সিং (২০.৩৭ গড়ে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে ১১১ উইকেট) এবং মোহাম্মদ নিসার (৭১ উইকেট, ১৮.০৯ গড়ে) দলের উদ্বোধনী বোলারদের সাংঘাতিক দুর্দান্ত জুটি হিসেবে গড়ে ওঠে। অমর সিং এক ম্যাচে তিনবার দশ উইকেট নিয়েছিলেন এবং ৮/৯০ ছিল তাঁর সেরা বোলিং পারফরম্যান্স।
এই দলের একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার নীরজারঞ্জন রায়, যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল পরীক্ষার জন্য যেতে পারেননি।
এরপরের ঘটনা ঐতিহাসিক। ১৯৩৩-৩৪ এ ভারতে এলো এম সি সি। টেস্ট খেলতে। ইডেনে প্রথম বসল টেস্টের আসর। তবে প্রথম টেস্টের আগে তিনটি ম্যাচ হয়েছিল।
২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৩ বাংলার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ম্যাচ ড্র হয়। এম সি সি ৫ উইকেটে ১৮৭ তোলে। বার্নেট একাই ৯৪ করেন। ইলিয়ট করেন ৪৩ করেন। গোর্লায় ৪৪ রানে ৩ উইকেট পান। জবাবে বাংলার ব্রিটিশরা ১২১/৮ তুললে ম্যাচ ড্র হয়। লংফিল্ড ৩৯ ও ক্যাম্পবেল ৩৪ করেন। ম্যারিয়ট ৫৫ রানে ৫ উইকেট পান।
পরের দিন ভারতীয় ও ইঙ্গ ভারতীয় যৌথ দলের বিরুদ্ধে একদিনের খেলায় এম সি সি জয়ী হয়। কার্তিক বসু ৪২ করায় ভারতীয় ও ইঙ্গ ভারতীয় যৌথ দলের রান হয় ১২৫। নিকোলাস ৩১ রানে ৪ উইকেট পান।
জবাবে এম সি সি ২ উইকেটে রান তুলে নিয়ে আরও ব্যাট করা শুরু করলে ভারতীয় ও ইঙ্গ ভারতীয় যৌথ দল ৬ উইকেট তুলে নেয়। বেকওয়েল ৫৪ ও নিকোলাস ৪১ করেন। শুঁটে ব্যানার্জী জার্ডিন-কে ১ রানের মাথায় বোল্ড করে দেন।
৩০-৩১ ডিসেম্বর ও ২ জানুয়ারি ইডেনে টেস্টের আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রায় বেসরকারি টেস্ট ম্যাচ হয় ভারতীয় একাদশের সঙ্গে। ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন আলেকজান্ডার হোসি।
এম সি সি প্রথমে ব্যাট করে ৩৩১ করে। সিরিল ওয়ালটার্স ৬৭ আর জার্ডিন ৪০ করলেও গোপালন (৪/৬৭) ও লংফিল্ড (৩/৮৪) এম সি সি কে ১৬২/৮ এ নামিয়ে দেয়। তখন ৯ নম্বর ব্যাটার টাউন্সেন্ড (৬৯) আর ১০ নম্বরে নামা ভেরিটি (৯১) করে নবম উইকেটে ১৪০ রান যোগ করে। আসলে টাউন্সেন্ড অলরাউন্ডার। প্রথম শ্রেণির খেলায় ডবল সেঞ্চুরি সহ ১৯,৫৫৫ রান ছিল। ১০৮৮ উইকেট ও ছিল। এই সফরের আগেই ১০,০০০ রান আর ৭০০ উইকেট ঝুলিতে ছিল। ভেরিটি টেল এন্ডার। ব্যাটে বলে করতে পারে মাত্র।
যাই হোক, নিকোলস (৪/৩৪), ম্যারিয়ট (৩/৫২) আর ভেরিটি (২/৪২) দাঁড়াতেই দেয়নি ভারতকে। ১৬৮ রানে খতম। কেবল কার্তিক বসু ৩৮ আর লাল সিং ৪৩ করেন।
এম সি সি দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ ওভারে ২৭৯/৫ তোলে। ভ্যালেন্টাইন ৭৪, নিকোলস ৭৯ করেন। মিনু প্যাটেল মাত্র ১১ ওভারে ৮৫ রান দেন, যদিও ৩ উইকেট নেন।
এরপর কেন্টের সি পি জনস্টন (অপরাজিত ৬৯) ও ইয়র্কশায়ারের হামফ্রে ওয়ার্ড (অপরাজিত ৭৭) দ্বিতীয় উইকেটে ১২৪ রান ও অবিচ্ছিন্ন হয়ে যোগ করলে ভারত ২৮ ওভারে ১৫২/১ তুলে ফেলে। ম্যাচ ড্র হয়।
এবার সরকারি টেস্ট। প্রথম টেস্টে লালা অমরনাথের সেঞ্চুরি সত্ত্বেও ভারত হেরেছে। এটি দ্বিতীয় টেস্ট।
৫ জানুয়ারি ১৯৩৪ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে প্রথম বারের জন্য সরকারি টেস্ট ম্যাচের আসর বসেছিল।
ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড বনাম সি কে নাইডুর ভারত। টসে জিতে জার্ডিন ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাট করতে নামে মিচেল আর ওয়াল্টারস।
প্রথমে ৪৫ রানের মাথায় আউট হলেন ওয়াল্টার্স ২৯ করে। গোপালন তাকে ধরল স্লিপে অমর সিং এর বলে। ল্যাংরিজ আর মিচেল টানলেন ১৩৫ অবধি। তখন ৪৭ করে মিচেল গেলেন। ল্যাংরিজ ৭০ করে আউট হলেন ১৮৫ রানের মাথায়। নিসার কাঁধের কাছে অদ্ভুত ক্যাচ লুফলেন। এরপর জার্ডিন আর ভ্যালেন্টাইন ২৫৬ রান অবধি টানলেন। ভ্যালেন্টাইন ৪০ করে আউট। নাইটওয়াচম্যান হিসেবে লেভেট নামলেন। দিনের শেষে ৫ উইকেট খুইয়ে ২৫৭ উঠল।
বহু কারণেই এই ম্যাচ গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলি আগামী দিনে জানানোর অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে শুধু এইটুকু জানাই যে সি এস নাইডু, গোপালন, দিলাওর হুসেন ও ইডেনের নয়নের মণি মুস্তাক আলীর টেস্ট অভিষেক হয় এই টেস্টে। সাথে ইংল্যাণ্ডের লেভেট-এর ও। গোপালন ও লেভেট অবশ্য এই একটাই টেস্ট খেলেন।
১৯৩৪ সালের ৬ জানুয়ারি। টেস্টের দ্বিতীয় দিন।
আগের দিনের ২৫৭/৫ থেকে ইংল্যাণ্ড শুরু করে। লেভেট ৫ করে আউট হলেন ২৮১ রানের মাথায়। ওই ২৮১ রানেই জার্ডিন গেলেন। দর্শকরা ভাবল ২৮১/৭ যখন ৩০০ এর বেশি হবে না। নিকোলস ১৩ রান করে আউট হল যখন তখন ৩০১/৮। সবাই ভাবল বড়জোর ৩৫০। দাঁড়িয়ে গেলেন ভেরিটি। মুস্তাক, নাউমুল আর সি এস পরপর ক্যাচ ফেলতে শুরু করলেন। শেষে ৩৭১ রানের মাথায় টাউনসেন্ড আউট। ভেরিটি এর আগে অ্যাসেজে নবম উইকেটে পেন্টারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। আবার ঠিক আগের ম্যাচেই ভারতের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলেন এই নবম উইকেটে, সেবারও টাউনসেন্ড এর সঙ্গে।
অবশেষে ৪০৩ রানে ইনিংস শেষ করে। ভেরিটি হাফ সেঞ্চুরি করলেন। অমর সিং ১০৬ রানে ৪ উইকেট পান, যদিও এত ক্যাচ তাঁর বলে পড়েছিল যে ইংল্যাণ্ড অত রান করতেই পারতো না। সি কে ৪০ রানে ২ উইকেট পান। মুস্তাক আলী একটা। তাও আবার জাৰ্ডিনের।
ভারতের ইনিংস শুরু হতে ফার্স্ট লেগ থিওরিতে বল শুরু করালেন জার্ডিন। প্রায় বডিলাইন। নবি ক্লার্ক আর নিকলস শর্টপিচ বল ফেলতে লাগলেন। ১১ রানের মাথায় দিলাওর হুসেনের মাথার পিছনে বল লাগল, নিকলসের বল। ‘মর গয়ে’ বলে তিনি শুয়ে পড়লেন। এরপরেই নাউমুল আউট জার্ডিনের হাতে ক্যাচ দিয়ে নিকলসের বলে (২)। দল ১২/১। ওয়াজির আলী লড়তে থাকলেও সি কে ৫ রানে আউট (১টা চার)। নামলেন আগের টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান অমরনাথ। তিনি ফিরলেন শূন্য করে। দল ২৭/৩। ওয়াজির আলীর সাথে রুখে দাঁড়ালেন মার্চেন্ট। কিন্তু দিনের একদম শেষে ৩৯ করে ওয়াজির আউট হলেন। দল তখন ৯০/৪। মার্চেন্ট ২৬ রানে ব্যাট করছেন।
আশা নিরাশার দোলায় ইডেনের প্যাগোডার পেছনে জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলের সূর্য অস্ত যাচ্ছে আগামীর প্রতীক্ষায়। দলে দলে মানুষ এগিয়ে চলেছে ধর্মতলার দিকে বাস, ট্রাম, ডবল ডেকার বাস, ঘোড়ার গাড়ি, বেবি ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরবে। কেউ বা হয়তো হাওড়া যাওয়ার ট্রামে উঠে বসল। দেখা যাক কাল কী হয়।
৭ জানুয়ারি ১৯৩৪ সাল। রবিবার। ৫ তারিখ প্রথম দিন বাংলা সরকার ছুটি ঘোষণা করেছিল। রবিবার এমনিতেই ছুটি। ব্যাপক পরিমাণে লোক ইডেনে ঢুকেছে।
দর্শকরা মাঠে ঢুকে অবাক। বিশাল শরীরের দিলাওর হুসেন মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে ব্যাট করতে নেমেছেন। পশ্চাৎভাগ ডেও পিঁপড়ের মতো উঁচু করে স্টান্স নিতেন। কিন্তু মার্চেন্ট আর দিলওর রুখে দিল জাৰ্ডিন এর দলকে। কিন্তু দিলাওর এদিনও চোট পান। ক্লার্কের বল তাঁর আঙুল চেঁচে দিয়েছিল।
দিলাওর এর ঘনঘন বল ব্লক করা দেখে ভেরিটিকে বল দিয়ে জার্ডিন ফিল্ডিং দিয়ে ঘিরে দিলেন। অমনি দিলাওর এগিয়ে সপাটে হাঁকড়ালেন। বল সোজা মাঠের বাইরে। সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমারের ভাষায় ‘সর, সরে দাঁড়া সব দড়ির দিকে। দিলওয়ার নতুন খেলতে আসেনি ক্রিকেটে।’
এর মধ্যে ১৬৬ মিনিট ব্যাট করে অমূল্য ৫৪ রান করে আউট হলেন মার্চেন্ট। পরপর দুই জুটিতে ১০৪ রান যোগ করলেন। তখন ভারত ১৩১/৫।
এলেন মুস্তাক আলী। বেশিক্ষণ টিকলেন না। ৯ রান করলেন, কিন্তু একটা চার। বোঝালেন তিনি মোটেই ফাস্ট বল ভয় পান না। নিকলস এর বলে আউট হওয়ার সময় দল ১৫৮/৬।
নামলেন সি কের ভাই সি এস। নেমেই মার শুরু। এদিকে ২১৬ মিনিট ব্যাট করে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাওর করলেন ৫৯। তিনি যখন আউট হলেন তখন দল ২১১/৭। চার দিনের ম্যাচ, ১৫০ কম করতে পারলে ফলো অন। তখনও ৪৩ রান বাকি।
নামলেন অমর সিং। তিনিও একটা চার মারলেন। কিন্তু ২২৩ রানের মাথায় ১০ করে ফিরে গেলেন । নামলেন গোপালন।
ততক্ষণে সি এস একটা ছয় মেরেছে। কিন্তু তিনিও ২৩৬ রানের মাথায় আউট। ১৮ রান বাকি।
শেষ ব্যাটসম্যান নিসার। গোপালন আর নিসার ৯ রান যোগ করে ফেললেন।
আর ৯ রান বাকি এমন সময় ভেরিটির বলে সপাটে হাঁকড়ালেন নিসার। বল লং অনে ওয়াল্টারস ফেলে দিলেন। ২ রান। আর বাকি মাত্র ৭। আবার তুলে হাঁকড়ালেন নিসার। এবার আর ভুল হল না। ওয়াল্টারসই ধরলেন। ভারত ২৪৭ রানে শেষ। গোপালন অপরাজিত ১১। ২৩ খানা চার মারে ভারত। ২টো ছয়। ভেরিটি চারটে, নবি ক্লার্ক ও নিকলস তিনটে করে উইকেট পান।
ফলো অন করে ভারত নামল আধ ঘণ্টার জন্য। নাউমুল আর মুস্তাক আলী। ভারত আর কোনো উইকেট না খুইয়ে দিনের শেষে ৩০/০।
কলকাতার দর্শক শান্তিতে বাড়ি গেল। ১০ খানা উইকেট-ই আছে। নাইডু, নাউমুল, অমরনাথ, ওয়াজির আলী, দিলাওররা তো আছেই, সঙ্গে সি এস আর অমর সিং ও আছে। মুস্তাক ও খেলে দেবে। আর যাই হোক। ইনিংসে হারতে হবে না। কিন্তু …. এটা ক্রিকেট। ‘বহত কঠিন হ্যায় ডগর পনঘট কি’।
তৃতীয় দিনের খেলা শেষ।
৮ জানুয়ারি, ১৯৩৪। টেস্টের চতুর্থ ও শেষদিন। সোমবার, কিন্তু ইডেন লোকে লোকারণ্য।
মুস্তাক ও নাউমুল দলকে ৫০ এর গণ্ডি পার করাল। এই প্রথম টেস্টে ভারতের হয়ে ওপেনিং এ ৫০ হল। কিন্তু মুস্তাক ৫৭ রানের মাথায় আউট। যাই হোক, এলেন নাইডু।
সেই কোন্ যুগে ছেলেবেলায় রঞ্জি তাঁর শরীর দেখে ডিফেন্সিভ খেলতে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন বুক চিতিয়ে সোজা ব্যাটে খেলতে। সেই উপদেশের ফলে জীবনের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে তিন নম্বর বল (ট্যারান্টের, যিনি এই ম্যাচে আম্পায়ার) মাঠের বাইরে পাঠান (১৯১৫/১৬, মাদ্রাজ, ইন্ডিয়ান বনাম ইউরোপিয়ান)। ভুলে যাওয়া ডিফেন্স ফিরিয়ে আনলেন পুরো স্বভাব বিরুদ্ধ ব্যাটিং শুরু করে। নাউমুল ৪৩ করে আউট হতে আয়ারাম গয়ারাম শুরু হল। অমরনাথ এবারও ব্যর্থ। করলেন ৯। যদিও কোনোদিন মানেননি তিনি আউট ছিলেন। তাঁর দাবি বল ব্যাটে লাগেনি। মার্চেন্ট ১৭ করে আউট হতে দর্শকদের চিন্তা তবে কি ইনিংসে হারবে? প্রথম ইনিংসে ১৩১/৫ ছিল! এবার ১২৯/৫!
এদিকে নাইডু ভেরিটির বল বুঝতে না পেরে ব্যাকফুটে ব্লক করছেন। ভেরিটি উত্তেজনায় এক একবার লাফিয়ে উঠছেন; এই গেল! খণ্ডমুহূর্তে নাইডুর ব্যাট নেমে আসছে। ১০০ মিনিটে যে নাইডু ১৫৩ করেছিলেন ১১ খানা ৬ মেরে তিনি সাড়ে তিন ঘণ্টায় করলেন ৩৬। সেই নাইডু যিনি এর ১৫ বছর পর ৫৩ বছর বয়সে ৮০ মিনিটে ১০৯ করবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
এদিকে দিলাওর নেমে গেছে। নেমেই চালাচ্ছে। সি এস ও নেমে চালাচ্ছে। দেখতে দেখতে ইংল্যান্ডের রান টপকে গেল। দিলাওর করলেন ৫৭, সি এস ১৫, অমর সিং ১৮। ভারত ২৩৭।
দরকার ৮১। সময় কুড়ি মিনিট। ইংল্যাণ্ড যাতে চালিয়ে খেলে না তুলে ফেলে নাইডু ৯ জনকে বাউন্ডারি তে দাঁড় করালেন। নিসারের প্রথম বল তুলে মারলেন বার্নেট, গোপালন ধরলেন, ইংল্যাণ্ড ০/১। এলেন ভ্যালেন্টাইন। এসেই আউট। ৫/২। শেষে যখন ৫ ওভারে ৭/২; ম্যাচের সময় শেষ। ম্যাচ ড্র। এই প্রথম ড্র করল ভারত। হুড়োহুড়ি পড়ল উইকেট স্মারক হিসেবে রাখবার জন্য। ট্যারান্ট আর দিলাওর একটা উইকেট নিয়ে টানাটানি করছিল। অপর আম্পায়ার ছিলেন বিল হিচ। তিনি প্রথম আম্পায়ার যিনি প্রাক্তন টেস্ট খেলোয়াড় হয়ে ইডেনে টেস্টে আম্পায়ারিং করেন। এর পরে এই কৃতিত্ব করেন ভেঙ্কট রাঘবন (১৯৯২/৯৩)।
এই ঐতিহাসিক ম্যাচের বর্ণনা ইংরেজিতে পাবেন ডকার, মিহির বোস, আরবি, প্রভৃতির বইতে। বাংলায় পাওয়া যাবে শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় আর মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর বইতে। তার বাইরে?
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘মৃগ নেই মৃগয়া’, শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘রমণীয় ক্রিকেট’, অশোক মিত্রের ‘আপিলা চাপিলা’, সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোট ছিলাম’ ও ‘ক্রিকেটার তারিণীখুড়ো’-য়।
এরপর বহু টেস্ট হয়েছে গত ৮৫-৮৬ বছরে। হবেও আরও। কিন্তু এতগুলি সাহিত্যে ঠাঁই কি আর কেউ পাবে?
বর্ষশেষের ইডেন সত্যি স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠত।
১৯৩৪ এ এম সি সি ,১৯৩৫ এ অস্ট্রেলিয়া, ১৯৩৬ এ টেনিসনের দল, ’৪০ এর শুরুতে সিংহল, ’৪৫ এ অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস, ’৪৮ এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর ১৯৪৯ এ খেলতে আসে প্রথম কমনওয়েলথ।
তারও ইতিহাস নিয়ে আগামী পর্বে আসছি।