কবির ভাষাদিবস – শ্রীঅনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র
…যখন ভাঙচুর চলে খুব…
বাহিরেই হোক, কি ভিতরে…
কবি যে, কোথায়, দেয় ডুব… …
…একটি সূচনা। একটি শেষ-না-হওয়া রচনার। কী বলছে, এ সূচনাটি? কিছু কি বলছে?
…একুশে ফেব্রুয়ারী, আর ক’দিন পরেই, আবার। একটি গদ্যরচনার দাবী, সেই উপলক্ষে। এমন দাবী, যা ফেরানো যায় না। যা ভালবাসার দাবী। যা আবদার। কিন্তু কী লিখবে, এই কবি? সে কি কোন মহামীনের, মহামকরের মতই ডুব দিয়েই থাকেনি, সত্তর দশকের সেই মহাভাঙচুরময় দিনগুলিতেও? এদিকে যখন একটি বিপ্লবপ্রচেষ্টা ম’রে যাচ্ছিল একটু-একটু ক’রে? আর ওদিকে, একটি দেশগঠন, রাষ্ট্রগঠনপ্রচেষ্টাও? আকাশে-বাতাসে যখন “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” সেই একুশে ফেব্রুয়ারীটি আবার একবার নতুন ক’রে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছিল সেদিন, “লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠে”?
…ভাঙচুরও, কবির কাছে আসলে, উৎসই একটি। তার কবিতারই শুধু। যেমন বিপ্লবও। রাষ্ট্রগঠনও। ভাষাদিবসও। এ সবই, খুব গভীরচারী, গূঢ়চারী কোন পরাবাস্তবের, একটি আলগা প্রচ্ছদই মাত্র। একটি ফ্লাই-লীফই শুধু। যে-প্রচ্ছদটি, যে-উড়ো-পাতাটি অতিক্রম ক’রে, সেই মহাগ্রন্থটির গভীরে, কবি প্রবেশলাভ করতে চায় চিরদিনই।
…ভাষা, একটি জনজাতির যা কথনমাধ্যম, বা লিখনমাধ্যমও, ঠিক কতটুকু তা প্রকাশ করে, সেই জনজাতিটিকে? কতখানি আধারিত করে, তার গহনতম অভীপ্সাগুলিকে? কেন, সেই ভাষাটি বিপন্ন হলে, বা তার উপর আঘাত, আক্রমণ নেমে এলে, মানুষ ক্ষেপে ওঠে এমন? মানুষ প্রাণ দেয় এমন? এমন একটা বিপর্যয় ঘ’টে যায়, মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে?
…কিছুই, প্রকাশ করতে পারি না আমরা, ঠিকই। কিছুই, ভাল ক’রে বুঝতেও পারি না ব’লেই, আমাদের গভীরের বেদনাগুলি। বার্তাগুলি। তবু, আমাদের প্রাত্যহিক ভুবনের তুচ্ছ প্রাত্যহিকতার অতীত একটি-দুটি আকাশছেঁড়া ইঙ্গিত, একটি-দুটি নাড়ীছেঁড়া সঙ্গীত, কি ভাষাই ধ’রে রাখে না শেষপর্যন্ত? যত অক্ষমভাবেই তা হোক না কেন? সেই ভাষা চ’লে গেলে, বা চ’লে-যাবার উপক্রম হলে, কি সেই কারণেই একেবারে আমাদের মর্মমূলেই একটি আঘাত এসে পড়ে না, কোন নিষ্ঠুর কাটারির? আমরা কি চীৎকার ক’রে উঠি না সেই আঘাতে?
…যদি তা’ই হয়, তাহলে আজও তেমন চীৎকার ক’রেই উঠছি না কেন আমরা আবার? আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাষাটি, আজও আবার তেমনই বিপন্ন, তেমনই আক্রান্ত হলেও? সে-আক্রমণ যত চোরাগোপ্তাই হোক না কেন? আমরা কেউই কিছু বলছি না কেন? চুপ ক’রেই আছি কেন সবাই?
…পাশের ফ্ল্যাটের ছোট্ট দেড়বছরের খুকিটিকে, তার আহ্লাদে দিদিমা, রোজই শেখান, শুনতে পাই : “স্ট্যাণ্ড আপ”, “সিট ডাউন”, “কাম হিয়ার”। রেগে, বা রাগের ভান ক’রে, বলেন, “আই উইল বীট ইউ”। আবার আদরও করেন, “আই উইল কিস ইউ”। নির্দেশ দেন, “রেড পেনসিলটা দাও। ওটা নয়। ওটা ব্লু। ওটা ব্ল্যাক! আই উইল বীট ইউ ব্লু অ্যাণ্ড ব্ল্যাক!”
…ওই খুকিটি, বড় হবে যখন, সে কি চুপ ক’রেই থাকবে না? সে কি প্রাণ দেবে, বা দেবার কথা স্বপ্নেও ভাববে কোনদিন, তার ‘ভাষা’র জন্য? কোন্ ‘ভাষা’? কী ‘ভাষা’য় কথা বলতে শিখছে সে? সে কি ভেবেও দেখবে তা, কোনদিন? বঙ্গীয় লিপিতে, অর্থাৎ সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে, কোনদিনই শিখবে কি, স্বচ্ছন্দে লিখতে কি পড়তেও? রোমান লিপিতে ঠাকুরমার ঝুলি বা টুনটুনির বই পড়তে-পড়তে? কিংবা ঐ রোমান লিপিতেই হোয়াটস-অ্যাপে অহরহ বাঙলা-নামক একটা খিচুড়ি-ভাষা লিখতে-লিখতেও?
…পরাধীন জাতির, দাসজাতির, কোন ভাষা ব’লে, কোন লিপি ব’লেও, কিছু থাকে না কখনও, নিজস্ব। প্রভুজাতির ভাষাকে বা লিপিকে মেনে নিতে, এমনকী মনে নিতেও, তাই কোন আপত্তিও থাকে না, কোন অসুবিধেও থাকে না তার কোনখানেই কিছু। যেমন আমাদের কারুরই ত নেই আজ আর তেমন কিছুই! আছে কি! আমরা যে হেরে গেছি! আমরা যে বীট্ন্ ব্লু অ্যাণ্ড ব্ল্যাক!
…দূর, কবি এসব ভেবে আর কী করবে! এসব কি তার ভাবার বিষয় নাকি কোনদিনই? যখন এই বাঙালী জাতিটা, ঠিক এতখানি দাসজাতিতে পরিণত হয়নি সবখানি—যখন সে প্রাণও দিয়েছিল, তার ভাষার জন্যে—কিংবা গানও বেঁধেছিল—তখনও কবি যেমন একপাশ থেকেই দেখেছে সেসব শুধু—আজও তেমনই, দেখে’ যাচ্ছে—দেখে’ যাবেও, এইভাবেই। একটি জনজাতি পড়বে। একটি জনজাতি উঠবে। একটি ভাষাগোষ্ঠী বিলুপ্ত হবে। একটি ভাষাগোষ্ঠী আবার স্থান নেবে তার। সবই ত প্রচ্ছদই মাত্র! গ্রন্থের গভীরে ডুব কে-বা আর দেবে, কবি ছাড়া! ভাষাকে কে আর ততখানি ভালবেসেছে কোনদিন, ভালবাসবে কোনদিন, যতখানি বাসলে, তাকে পেরিয়েও চ’লে যাওয়া যায়, শেষত! ভাষা দিয়েই, কে আর কবে লিখতে চেয়েছিল, ধরতে চেয়েছিল, সেই জগৎটিকে, কবি ছাড়া?… যে-জগৎটি, চিরভাষাতীত?… সকল ভাষাদিবস, ভাষামাস, ভাষাবর্ষপারের?…
…কথাটা আসলে সেইখানেই। ব্যথাটাও। বাঙলাভাষাটা কি শুধুই, কেবলই, একটা ভাষাই মাত্র?… একটি বিশেষ নৃগোষ্ঠীর?… তাহলে ত আফশোষের সত্যিই ঠিক ছিল না, তেমন কিছুই!… কত ভাষাই ত এইভাবেই হেরে গেছে, হারিয়ে গেছে কালের নিয়মে! বাঙলাও না-হয় তেমনই, যেত!… কিন্তু, বাঙলাভাষা, তুমি কি একটি বিশেষ বেদনাবোধও, নও? একটি টিপিকাল টেণ্ডারনেসও, নহ?… তোমাকে হারাইয়া, বা হারাইবার পথে ক্রমে অগ্রসর হইয়া, এই মানবজাতিটিই কি প্রকৃত প্রস্তাবে দরিদ্র হইতে দরিদ্রতরই হইতেছে না দিনে-দিনে?… আরও অমানবিকই, আরও গণ্ডারই, আরও শূয়ারই, আরও পোকামাকড়ই, হইতেছে না ক্রমে, এইভাবে?… একটি সূক্ষ্মতাই, একটি দুঃখতাই, ক্রমে হারাইয়া?… যে-দুঃখটি হারাইবার ন্যায় দুঃখ, আর নাই বলিয়া, এক বাঙালী কবিই, একদা জানাইয়াছিলেন আমাদিগকে?…
…তিনি কি ভুল বলিয়াছিলেন, হে ভাষাদিবস?… হে আমার মায়ের, আমার বোনেরও, অশ্রুমাখানো… একুশে ফেব্রুয়ারী?… …